ইলশেগুঁড়ি ২৯তম সংখ্যা (শারদীয়া)
ইলশেগুঁড়ি ২৯তম সংখ্যা (শারদীয়া)
রাহুল একটা লম্বা হাই তুলে রক্তিমকে বলল—“আমার আবার সেই মেয়েকে খুব ভাল লাগে যার ব্যক্তিত্ব আছে, ভাল ঝগড়া করতে পারে, সবার থেকে আলাদা।’’
সায়ন্তনী ঘরের কোথাও বাবাকে খুঁজে না পেয়ে হন্তদন্ত হয়ে বাগানে এসে দেখল, প্রফেসর হরিপ্রসাদ মুখার্জি সকাল সকাল বাগানের মালির সাথে সদ্য আগত একটি লাল রঙের শিশু টিউলিপ নিয়ে অবিরাম তর্ক করে চলেছেন। ছোট্ট সবুজ চারাটিকে রোপণ করার মনের মতো স্থান নির্ধারণ করা যাচ্ছে না। এই চারাটি প্রাণের বন্ধু মৃগাঙ্ক সান্যাল নেদারল্যান্ড বেড়াতে গিয়ে নিয়ে এসেছেন। তাই ভীষণ কৌতুহলী তিনি। সারাদিনে কত বার যে ঘর থেকে বেরিয়ে বাগান পর্যবেক্ষণ করেন তা বলার অপেক্ষা রাখেনা। ফুলের গাছ ছাড়াও বাগান জুড়ে একপাশে সবজি ও একপাশে ফলের গাছ। শীতের মরশুমে দুই অভিজ্ঞ কর্মচারী ছাড়াও প্রফেসর মুখার্জির হাতের যত্নে এই বাগান মোহময়ী হয়ে ওঠে। প্রতিটি গাছকে সন্তানস্নেহে লালন করেন মুখার্জিবাবু। একমাত্র পঁচিশ বছরের যুবতী মা মরা মেয়ে সায়ন্তনী এসে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে বললো—‘‘বাবা আমি একটা দারুণ খবর এনেছি।’’
প্রকৃতির সবুজ খোলা উদ্ভিদের আলোড়ন থেকে সন্তানের ডাকে সাড়া দিয়ে গোল্ডেন ফ্রেমের চশমাটা কপালে তুলে প্রফেসর মুখার্জী বললেন—“বড়ই উদ্গ্রীব আমি শোনার জন্য।’’
—‘‘আমি দুর্গাপুরে চাকরিটা পেয়ে গেছি বাবা!’’
আধুনিক জাঁকজমকপূর্ণ শহর থেকে বেশ কিছুটা দূরে মফস্বলের গা ঘেঁষে হরিপ্রসাদ মুখার্জির বিশাল বাংলো। বাইরের গার্ডেন কম করে তিন কাঠা জমি নিয়ে। রিটায়ার্মেন্টের পর এই বাগান তাঁর কাছে সর্বস্ব। সবুজের সঙ্গে তাঁর দীর্ঘদিনের সখ্যতা। এতক্ষণ ধরে টিউলিপের চারা ও বিশাল পাইপে বাগানে জল দেওয়ায় ব্যস্ত ছিলেন কিন্তু মেয়ের কথা শুনে চেয়ারের ওপর মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লেন।
সায়ন্তনী জিজ্ঞাসা করল—‘‘কী হলো? তোমার মুখটা এত ফ্যাকাশে লাগছে কেন? শরীর খারাপ নয় তো! আমি একটা ভাল চাকরির খবর দিলাম তুমি আনন্দ পেলে না?”
“আনন্দ পেলাম ঠিক কিন্তু আমি আবার একা। সারাটা দিন পর আবার রাতে তোর সাথে খাবার টেবিলে দেখা হবে। এই বয়সে একা থাকা কত কষ্ট তুই কী আর বুঝবি! সবাই তো নিজের মত ব্যস্ত! কত আর হরিশংকরের সঙ্গে গল্প করব! ও তো রান্না ঘরে ব্যস্ত থাকে। কতবার বলি আমাকে নিয়ে বাজারে যেতে, কিন্তু সে মনিবের কোন কথাই কানে তোলে না। যাইহোক মেয়ে হয়ে যখন জন্মেছিস তখন তো বিয়ে দিতে হবে, সমাজের নিয়মে শ্বশুর বাড়িও চলে যাবি। তখন তো আমি একা। ঠিকই আছে অভ্যেস হয়ে যাবে। কিছুদিন আগেও তো তুই বাইরে পড়াশোনা করেছিস। এই তিনটে বছর শুধু বাড়িতে থেকে আমার অভ্যাস খারাপ করে দিলি।’’
—“তুমি একদম আমার বিয়ের কথা বলবেনা।’’
—“বেশ এখন বল চাকরিটা তো হল, কিন্তু যাতায়াত হবে কী করে? এখান থেকে দুর্গাপুর তো প্রায় তিন ঘণ্টার পথ। বাড়ির গাড়িটা করেই রোজ যাতায়াত করবি। আমি ড্রাইভারকে বলে দেব।’’
—“না বাবা আমি ঠিক করেছি ব্ল্যাক ডায়মন্ডে ডেইলি প্যাসেঞ্জারি করব।’’
—‘‘তাহলে তো শরীর বলে কিছু থাকবে না। ট্রেনে যদি যেতেই হয় তবে এসি কম্পার্টমেন্টের আরাম করে যাবি। ডেইলি প্যাসেঞ্জারের কথা বলছিস? তুই জানিস ওখানে কত ভিড় হয়!”
—“তুমি তো জান বাবা আমি চিরকালই ব্যতিক্রমী। তবে গাড়ির থেকে ট্রেন জার্নি আমার কাছে বেশি আরামদায়ক। বন্ধুদের কাছে ডেইলি প্যাসেঞ্জারদের অনেক গল্প শুনেছি। তাই ঠিক করেছি আমি ডেইলি প্যাসেঞ্জারি করব। এক, দু’দিন অন্তত যাই, তারপর যদি খারাপ লাগে তখন আর যাব না। তখন এসি কম্পার্টমেন্টে টিকিট কেটে নেব।’’
—“জানি ছোট থেকেই তুই খুব একরোখা তার ওপর আমি আবার তোকে লাই দিয়ে মাথায় তুলেছি, তোকে বলে কোন লাভ নেই। কবে থেকে জয়েনিং শুনি?’’
—‘‘আগামীকাল”।
মুখ ভার করে প্রফেসর মুখার্জি নিজের ঘরের দিকে এগিয়ে গেলেন।
ব্যান্ডেল থেকে ব্ল্যাক ডায়মন্ড সকাল সাতটা বেজে তিন মিনিটে। অনলাইনে টিকিট কাটা ছিল সায়ন্তনীর। স্টেশন চত্বরে এসে আ্যনাউন্সমেন্ট শুনতে পেল। মনে মনে ভাবল, বাহ্ বেশ রাইট টাইমে দিয়েছে তো! ট্রেনে উঠে দেখল একটা জায়গাও ফাঁকা নেই। বর্ধমানে নিশ্চয়ই সিট খালি হবে। বয়স্ক কিছু মহিলাকে চোখে পড়ল। ময়লা জামা কাপড় পরিহিত সারা কম্পার্টমেন্টে ছড়িয়ে ছিটিয়ে প্রায় দশ জন মানুষ বসে আছেন। সায়ন্তনী সবাইকে জিজ্ঞেস করল তাঁরা কোথায় যাবেন। বেশিরভাগই সব ধানবাদ। একজন অল্পবয়সী তরুণ, লম্বা, সুদর্শন এগিয়ে এসে বললো—‘‘আপনি কোথায় যাবেন? আসলে এটা ডেইলি প্যাসেঞ্জারি কামরা। এখানে কে কখন উঠবে, কোথায় বসবে আমরা ঠিক করি। মেয়েরা অবশ্য বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না। আপনি নতুন। যদি কোন উপকার করতে পারি!”
সায়ন্তনী বললো—‘‘ধন্যবাদ আমি আমার ব্যবস্থা নিজেই করতে পারি। তার জন্য কারো সাহায্য আমার দরকার নেই।’’
—‘‘নেই বলছেন? বেশ তবে থাকুন।’’ কামরায় তাসের আড্ডা জাঁকিয়ে বসেছে। তুমুল শোরগোল চলছে ব্রিজ খেলা নিয়ে। আবার বেশ কতজন ট্রেনের মধ্যে আরামে স্নোক করছেন, আবার কেউ আবাল-বৃদ্ধ-বণিতার তোয়াক্কা না করে মধুরাতের রসের কথা রসিয়ে রসিয়ে বলছেন। বন্ধুরা মন দিয়ে শুনছে ও প্রাণভরে উপভোগ করছে। বর্ধমান আসতেই বড় বড় চটের বান্ডিল করা খালি (যা আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে বেশ ভারি) সিটের নিচের থেকে সেই বড় বড় বস্তাগুলো বার করে কয়েকজন মহিলা দরজার কাছে গিয়ে বসলো। সিট ফাঁকা হয়েছে দেখে সায়ন্তনী বসতে যাবে, তখনই সেই সুদর্শন যুবক এসে বললো—‘‘আমি রাহুল। আপনাকে আগে চান্স দিয়েছিলাম এখন আর হবে না। এখন সব জায়গা রাখা আছে। অনেক বন্ধুরা বর্ধমান থেকে উঠবে।’’
সায়ন্তনী উত্তেজিত হয়ে বললো—‘‘তার মানে এই মহিলারা এতক্ষণ বসেছিলেন, তাদের মাধ্যমে হাওড়া থেকে জায়গা রাখা হয়েছে। তাই তো? এঁদের গন্তব্যস্থল ধানবাদ নয়।’’
—‘‘এই মাসিরা রোজকার প্যাসেঞ্জার। দরকার মতো এঁরাই আমাদের সিট ছেড়ে দ্যায়। আমাদের আন্ডারস্ট্যান্ডিং আছে।’’
—‘‘এসব মানতে পারবো না।’’
—‘‘না মানতে পারলে অন্য কামরায় যান।’’
—“ট্রেনটা কী আপনার কেনা সম্পত্তি?”
—“ট্রেনটা নয়। শুধু এই কামরাটা। শুনুন আপনাকে বিস্তারিত বলি। আপনার কতটুকু ধারণা আছে এই গরিব মানুষগুলোর সম্পর্কে? এদের গন্তব্যস্থল কারো ধানবাদ বা কারো রানীগঞ্জ। এরা প্রতিদিন সকালে পেটের দায়ে হাওড়া থেকে ডেইলি প্যাসেঞ্জারি করে। ফেরার পথে এই যে বস্তাগুলো দেখছেন সেগুলোতে কয়লা বোঝাই করে নিয়ে আসে। যেহেতু এটা ডেইলি প্যাসেঞ্জারদের কম্পার্টমেন্ট সেইজন্য আর. পি. এফ এর সদস্যরা এদের ওপর অন্যায় জুলুম করে তোলা আদায় করতে পারে না। বেগতিক বুঝলে আমরা ওদের পাশে দাঁড়াই। এভাবেই ওই অভাবী মানুষগুলোর পেটে অন্ন জোটে।’’
নিমেষের মধ্যে জনা দশেক মানুষ যুবকটির পাশে দাঁড়িয়ে গেল। একজন বলে উঠলো—‘‘কি হয়েছে রাহুল?’’ কম্পার্টমেন্টে ঝালমুড়ি, চা বিক্রেতাও জমায়েত হল। তাদের মধ্যে একজন বলল—‘‘রাহুলদা’র উপর কোন কথা বলবেন না ম্যাডাম।’’
সায়ন্তনী বলল—“সবাই তো দেখছি অন্ধ ভক্ত। আপনাদের থেকে চা, কফি খায় বলে আপনারা ওকে প্রশ্রয় দিচ্ছেন।’’
একজন প্যাসেঞ্জার বললো—‘‘আপনি তো বড় আশ্চর্য! আপনাকে তো রাহুল আগেই বলেছিল আপনি তখন বসতে চাইলেন না।’’
—‘‘শুনুন একদম বাজে কথা বলবেন না। ট্রেনের মধ্যে অসভ্যতামি করেন, আবার এত কথা কিসের!”
রাহুল এগিয়ে এসে বললো—‘‘কী দেখেছেন অসভ্যতামির? ট্রেনে মানুষ আনন্দ করবে না? প্রাণ খুলে হাসবে না? খেলবে না? খাবে না? জড়সড় হয়ে বসে থাকবে?”
—“আপনার মত খারাপ মানুষ আমি আজ অব্দি দেখিনি।’’
—“জীবনে সবাই সব কিছু দেখে আসে না, আপনিও হয়তো দেখেননি আজ দেখে নিন, জেনে নিন।’’
মাঝের সিটে বসেছিলেন এক বয়স্ক ভদ্রমহিলা। গোলমাল শুনে উঠে এসে সায়ন্তনীর কাঁধে হাত রেখে বললেন—‘‘শোনো মেয়ে, আমি সামনে রিটায়ার করব। এতদিন এঁদের সাথে যাতায়াত করেছি। ওয়ারিয়াতে আমার অফিস। এঁরা সবাই আমার নিজের ছেলে মেয়ের থেকে কম কিছু না। আমার নিজের সন্তান আমাকে এত সাহায্য করে না যতটা এঁরা করে। আপদে বিপদে সবসময় পাশে থাকে। মাথা ঠাণ্ডা করো। ওঁরা খুব ভাল।’’
সায়ন্তনী চুপ করল। মাতৃসমা এক ভদ্রমহিলার মুখের ওপর কথা বলার শিক্ষা সে কোনদিন পায়নি।
যাবার সময় রাহুল পিছন ফিরে বললো—‘‘শুনুন দরজার দিকে একটাই সিট ফাঁকা আছে। পা টনটন করলে ওখানে গিয়ে টান টান করুন। ডিজগাস্টিং!’’
সায়ন্তনী আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না। মুখ ঘুরিয়ে দরজার পাশে সিটে বসে পড়ল। মনে মনে ভাবলো, এই লোকটার মাতব্বরি কাল বার করে দেব। আজ প্রথম দিন বলে কিছু বললাম না। এই জন্য বাবা বারবার বারণ করেছিল এই কামরায় উঠতে। হঠাৎ একটা বড় কাগজ রাহুল সায়ন্তনীর কোলে ফেলে দিল—“এটা পড়ে দেখুন আর পারলে কিছু ডোনেট করুন।’’
সায়ন্তনী বললো—‘‘কি এটা?”
—“দেখে তো অশিক্ষিত মনে হচ্ছে না তবে কী চোখের প্রবলেম?”
—“অভদ্র একটা!” রাগে গজগজ করতে করতে সায়ন্তনী কাগজটা নিয়ে পড়তে লাগলো।
রাহুল বলল—‘‘আসলে আমার একটা বন্ধু প্রাইভেট ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে প্রফেসর পদে সদ্য জয়েন করেছিল। কিন্তু ও হঠাৎ লিউকোমিয়ায় আক্রান্ত হয়। ওর রোজগার বন্ধ হলে পরিবার পথে বসবে অথচ এত টাকা দিয়ে চিকিৎসা করার ক্ষমতা নেই তাই আমরা এই কালেকশন করছি। ছেলেটি আমাদের সঙ্গে যাতায়াত করে।’’ সায়ন্তনী ব্যাগ থেকে পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে বললো—‘‘আমার কাছে আপাতত এই আছে।’’
রাহুল অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল সায়ন্তনীর চোখে। সায়ন্তনী বললো—‘‘কী দেখছেন?”
—“কিছু নয়, ভাবছি নারী চরিত্র বোঝা বড়ই কঠিন।’’
—“আপনাকে কেউ বুঝতে বলেছে?” স্টেশন এসে গেছে আমি তবে আসি। জার্নিটা মনে থাকবে।’’
দুর্গাপুরে ট্রেন অধিকাংশ ফাঁকা হয়ে গেল। ওভারব্রীজ দিয়ে নামতে নামতে সায়ন্তনী হাঁপিয়ে উঠলো। নিঃশ্বাস বেশ ঘনঘন পড়ছে। নিজের মনে ভাবল, এভাবে কতদিন হাঁটা হয়নি। বাবার সঙ্গে বেরোলে শুধু গাড়ি আর গাড়ি। আরেকটু এগিয়ে মনে হয় এস্কেলেটর ছিল। সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে দেখল, রাহুল একটা ছোট স্কুলের বাচ্চাকে নিজের টিফিন বার করে খাইয়ে দিচ্ছে। হাতে একটা বই। এখন রাহুলের কোনদিকে কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। এই তো কিছুক্ষণ আগে মুখরা বদমাশ ছেলেটা কত ঝগড়া করছিল। এখন একদম নির্বিকার ও শান্ত। যাই হোক, আজ অফিসে প্রথম দিন। সায়ন্তনী দুর্গাপুর স্টেশন থেকে বেরিয়ে ট্যাক্সি ধরে অফিসে পৌঁছল। ঢুকেই দেখতে পেল রিসেপশনিস্ট মেয়েটি সবেমাত্র অফিসে পৌঁছেছেন। সায়ন্তনী ভাবল, এই মেয়েটিকে তো ট্রেনে দেখলাম। হয়তো অফিসের গাড়ি করে আগে চলে এসেছে। স্টেশনের ট্যাক্সি খুঁজতে একটু দেরি হয়ে গেল। সায়ন্তনী বলল—‘‘আপনি ব্লাক ডায়মন্ডে এসেছেন না?”
—‘‘হ্যাঁ ম্যাডাম আমি হাওড়া থেকে ডেইলি প্যাসেঞ্জারি করি। আপনি তো আজ ট্রেনে ছিলেন। আপনি অফিসে আজ নতুন। তাই আপনাকে চিনতে পারিনি। আমি দেখেছি রাহুলদা’র সঙ্গে আপনার ঝগড়া হয়েছিল। ওকে প্রথম দেখায় সবার মনে হবে ও খুব খিটখিটে, রুক্ষ মেজাজের ছেলে কিন্তু ওঁর মনটা খুব ভালো। একটু ঝাঁঝালো ভেতরটা কাঁচা। যে যখন বিপদে পড়ে কিছু না ভেবেই সাহায্যের জন্য এগিয়ে যায়। ও আমার নাম হলো মিলি।’’
সায়ন্তনী বলল—‘‘মিলি আমার জন্য একটা জায়গা রাখতে পারবেন?”
—“হ্যাঁ পারব ম্যাডাম। তবে রাহুলদাকে একবার বলে নেব।’’
—“কেন তোমার নিজস্বতা বলতে কিছু নেই? উনি কি নেতা?”
নিজের অজান্তেই অভদ্র ছেলেটার কথা শুনে রাগে আপনি থেকে তুমিতে নেমে এলো সায়ন্তনী।
রিসেপশনিস্ট মিলি বলল—‘‘না উনি আমার দাদা। আমার মা মারা যাবার পর আমি খুব অসুস্থ ছিলাম, দীর্ঘদিন অফিসে আসতে পারিনি তখন রাহুলদা নিজের থেকে অনেক সাহায্য করেছে। আমাকে কোন কিছুই বলতে হয়নি।’’
সায়ন্তনী আর কথা না বাড়িয়ে বসের কেবিনে গেল। ইতিমধ্যে বাবার প্রায় বারো বার ফোন এসেছে। নতুন অফিসের প্রতিটি সদস্যই খুব ফ্রেন্ডলি। অফিসের প্রথম দিনটা নতুন কলিগদের সঙ্গে খুব ভালো কাটলো সায়ন্তনীর। অফিস থেকে বেরিয়ে রিসেপশনিস্ট মিলির সঙ্গে ছুটির সময় স্টেশন থেকে কচুরি খেয়ে টেনে উঠতে আবার অভদ্র রাহুলের সঙ্গে দেখা। রাহুল বলল—‘‘আপনি আবার? দুর্গাপুরে এসেছিলেন এখন ফিরছেন বুঝি?”
সায়ন্তনী মুখ বেঁকিয়ে বলল—‘‘তাতে আপনার কি? আপনাকে আমি এত কৈফিয়ত দিতে যাব কেন?”
মিলি বলল—‘‘দাদা উনি আমার অফিসে চাকরি করেন। এখন থেকে আমাদের সঙ্গে যাতায়াত করবেন।’’
রাহুলের পাশে দাঁড়িয়ে রক্তিম বলল—‘‘এটা তো খুব ভালো খবর। আমাদের সবাইকে যখন এতটা পথ একসাথে চলতে হবে তবে আমরা বন্ধু হতে পারি।’’
সায়ন্তনী বলল—‘‘নিশ্চয়ই হতে পারি, তবে একটা শর্ত আছে। এই যে আপনাদের মধ্যে একজন কারণে অকারণে অভদ্র ব্যবহার করেন, সবাইকে মেজাজ দেখান এসব সহ্য করব না। এখানে কেউ কিন্তু লিডারশিপ দেখাতে পারবে না।’’
হঠাৎ রাহুল ট্রেন থেকে লাফিয়ে প্লাটফর্মে নেমে পড়ল। সবাই মিলে চিৎকার করল—“রাহুল ট্রেন ছেড়ে দেবে।’’ রাহুল কর্ণপাত করল না। সবার দৃষ্টি রাহুলের দিকে। হকার্স কর্নারে চায়ের দোকানে ব্যাগ থেকে বার করে শিবুদার হাতে ওষুধ লাগিয়ে দিল রাহুল। এরপর ব্যান্ডেজ বেঁধে দিল সযত্নে। সায়ন্তনী অবাক হয়ে বলল—‘‘কী হয়েছে?”
রক্তিম বলল—“আজ সকালে চা বানাতে গিয়ে শিবুদার হাতে গরম চা পড়ে গিয়ে হাতের অনেকটা অংশ পুড়ে গিয়েছিল। অফিস থেকে ফেরার সময় রাহুল মনে করে ব্যান্ডেজ আর ওষুধ নিয়ে এসেছে। আমরা দশ জন ছিলাম, সবাই ভুলে গেছি ও ভোলেনি। ওই দেখুন শিবুদাকে ওষুধ বুঝিয়ে দিচ্ছে! রোজ দেখবেন দুর্গাপুর স্টেশনে নেমে একটি ছোট বাচ্চাকে টিফিন খাইয়ে দ্যায়। ছেলেটির জন্য ও বাড়ি থেকে আলাদা করে রোজ খাবার নিয়ে আসে। ছেলেটি কিন্তু ওর কেউ হয় না। ছেলেটির মায়ের সাথে যখন ওর প্রথম দেখা হয় তখন সে জানায়, বাড়িতে খুব অভাব। তাও লোকের বাড়িতে কাজ করে ছেলেটিকে স্কুল পাঠানোর ব্যবস্থা করেছে সে। সেদিন থেকে রাহুল ওকে জামাকাপড় দ্যায়, টিফিন খাওয়ায়, বই পড়ায়। কখনো আবার প্রয়োজনে ওর মায়ের হাতে টাকা তুলে দ্যায়। এসব ওকে কেউ বলে না, নিজের থেকেই করে। এই ট্রেনে পরিচালনা করার মত দৃঢ় ব্যক্তিত্বসম্পন্ন একজনকে দরকার। আপনি তো জানেন না এখানে প্রচুর ভিড় হয় নয়তো এখানে কেউ বসতে পারবে না, প্রতিদিন একটা অরাজকতার সৃষ্টি হবে। তাই আমরা পারস্পরিক সহযোগিতা করে যাত্রা সুন্দর করি। রাহুল কখনোই লিডারশিপ দেখায় না কিন্তু আমরাই ওকে নিজেদের লিডার মনে করি। কারণ ও তার যোগ্য।’’
সায়ন্তনীর মনে পরে ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময় সহপাঠী রাজীব পাল এর কথা। দু’বছর ছেলেটির জন্য মনের নরম মাটিতে সবুজের চাষ করেছিল সে। একদিন জানতে পারে রাজীব ছেলেটি ধুরন্ধর, লোভী, স্বার্থপর। অথচ সবার সামনে এমন অভিনয় করত যেন সে কত ভাল মনের মানুষ। এরপর থেকে নিজের বাবা ছাড়া কোন পুরুষ মানুষকে বিশ্বাস করতে পারেনা সায়ন্তনী। তবে রাজীব যা করত তা নিজের ঢাক নিজে পেটাতো। কখনো আবার কোন বন্ধুকে টাকা খাইয়ে তার চরিত্রের ভালো গুণগুলো সায়ন্তনীর সামনে তুলে ধরত কিন্তু রাহুল ছেলেটি একদম অন্যরকম। সামনে রুক্ষ ,কর্কশ, বদমেজাজী, কিন্তু মনটা খাঁটি। ওর প্রশংসায় দশদিক পঞ্চমুখর। মন ও মাথা দুই বলছে, কাউকে ইমপ্রেস করার জন্য এই আচরণ নয়।
সিগনাল হয়ে গেছে। ট্রেনের চাকা ঘুরতে শুরু করেছে। সায়ন্তনীর ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠল। অল্প সময়ের ব্যবধানে মানুষ চেনা যায় না। রাহুলকেও চিনতে পারেনি সে। দরজার কাছে ছুটে গেল সায়ন্তনী। রাহুল দৌড়তে দৌড়তে কোনক্রমে ট্রেনের দরজার সামনে এলে সায়ন্তনী হাত ধরে টেনে তুলল। প্রায় দশ সেকেন্ড দু’জন দুজনের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে খনিজ গহবর থেকে তুলে আনল এক চিলতে উষ্ণতা।
ট্রেন তার নিজের গতি বাড়িয়েছে। সবাই সিট পেয়েছে। জার্নির শুরুতে সকালবেলা সবাই যতটা আনন্দে উচ্ছ্বাসিত থাকে, দিনের শেষে ক্লান্তি যেন ভর করে শরীর জুড়ে। চোখের পাতা বুজে আসে। তবে রাহুলের যেন কোন কিছুতেই এনার্জি কমে না।
জানলার ধারে মুখোমুখি বসেছে সায়ন্তনী ও রাহুল। সায়ন্তনী ব্যাগ থেকে একটি বই বার করে পড়তে লাগলো। রাহুলকে অনেক কথা বলতে ইচ্ছে করছে কিন্তু কিভাবে শুরু করবে বুঝতে পারছে না। শুরুটা রাহুল করলো—“বলছিলাম ধন্যবাদ আমাকে সাহায্য করার জন্য। আপনার হাত না ধরলে আমি ট্রেনে উঠতে পারতাম না।’’
সায়ন্তনী একবার চোখ তুলে তাকিয়ে আবার বইয়ের দিকে মনোনিবেশ করলো। লাভ স্টোরি বরাবরই প্রিয় তবে এই মুহূর্তে একটা ওয়ার্ডও মাথায় ঢুকছে না।
রক্তিম কামরার দরজা খুলে স্মোক করছিল। রাহুলের কাছে এসে বলল—‘‘তোর সম্বন্ধটা কি ঠিক হয়ে গেছে? ওই যে কাল বলছিলি মেয়েটি নাকি দারুণ দেখতে, তোর বাবার খুব পছন্দ হয়েছে।’’
“শুধু বাবার নয় বাড়ি শুদ্ধ সবার পছন্দ, তাই তো ভাবছি আমি কি উত্তর দিই! বাড়িতে ঢুকলেই আমাকে সব চেপে ধরবে। আজকাল ছোট ভাইপোটা’ও রেহাই দিতে চায় না।’’
“ভালো মেয়ে হলে তুই রাজি হয়ে যা।’’
সায়ন্তনীর কানে কথাগুলো প্রবল বেগে ঢুকছিল। বই বন্ধ করে রক্তিম এর দিকে তাকিয়ে বললো, আপনি ওনাকে ফোর্স করছেন কেন?”
রাহুল মুচকি হেসে বলল—‘‘আমি ডিসিশন নিয়ে নিয়েছি।’’
সায়ন্তনী বড় বড় চোখে তাকিয়ে রইল রাহুলের দিকে।
রাহুল একটা লম্বা হাই তুলে রক্তিমকে বলল—“আমার আবার সেই মেয়েকে খুব ভাল লাগে যার ব্যক্তিত্ব আছে, ভাল ঝগড়া করতে পারে, সবার থেকে আলাদা।’’
রক্তিম বলল—‘‘যা দেখে বুঝছি আবহাওয়া ভীষণ ভাল। শুভেচ্ছা জানাই। তবে বেশি দেরি করিস না।’’
“দাঁড়াও পথিকবর! সফর অভি তো শুরু হুয়া, মঞ্জিল বহুত দূর হ্যায়’’—রাহুল হাসতে হাসতে বলল।
রক্তিম সায়ন্তনীর দিকে তাকিয়ে বলল—‘‘নেমন্তন্নটা আমরা যেন দু’পক্ষ থেকেই পাই।’’
সায়ন্তনী সবার সামনে গম্ভীর থাকলেও মনে মনে হাসলো। এক অজানা শিহরণে মন আন্দোলিত। এক অদ্ভুত অনুভূতি শিরা উপশিরায় ছড়িয়ে পড়ছে ক্রমশ। অন্দরমহলে নিজের ইগোর লড়াইয়ে পরাজয়ের আনন্দ সে আগে কখনো অনুভব করেনি। গ্রীষ্মের এই হাঁসফাঁস গরমে ট্রেনের জানলার বাইরে পড়ন্ত সূর্যের দিকে তাকিয়ে আগামীর আলো গায়ে মেখে নিল।
রাত আটটা কুড়ি। ট্রেন ব্যান্ডেল স্টেশনে পৌঁছলো। দেখতে দেখতে দীর্ঘ সময় কি করে পেরিয়ে গেল টের পায়নি সায়ন্তনী। রাতে ডিনার করার সময় বাবাকে জানালো আগামীকাল থেকে মান্থলি কেটে নেবে। রাতে ফোনে রাহুলের মেসেজ ঢুকলো। “ঘুমিয়ে পড়ুন।’’
সায়ন্তনী ভাবল, ছেলেটা কি ম্যাজিক জানে? রাতে যে ঘুম আসছে না বুঝলো কি করে? তার পরই মনে হল তাহলে অপর প্রান্তে রাত জাগা ব্যক্তিটির চোখেও ঘুম নেই। দুজনেরই একই অবস্থা। কেবল ভোর হওয়ার অপেক্ষায়! পরদিন সকালে হন্তদন্ত হয়ে প্রায় এক ঘন্টা আগে ব্যান্ডেল স্টেশনে পৌঁছল সায়ন্তনী। ট্রেন থামতেই রাহুলকে দেখা গেল দরজার সামনে। দুজনের মুখেই প্রশস্তির হাসি। পরম সুখের এই বৈচিত্র্যময় দিনগুলি সাক্ষী থেকে দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলল ব্ল্যাক ডায়মন্ড এক্সপ্রেস।