ইলশেগুঁড়ি ২৯তম সংখ্যা (শারদীয়া)
ইলশেগুঁড়ি ২৯তম সংখ্যা (শারদীয়া)
(নাট্যশাস্ত্র ও নৃত্যের শাস্ত্রীয় ঐতিহ্যের উপর ভিত্তি করে বাংলার প্রাচীন নৃত্য শৈলীর ধারণা)
বঙ্গের নিজস্ব সম্পদ যদি কিছু থেকে থাকে সেটি একমাত্র পদাবলী কীর্তন। বাংলার মানুষের হৃদয়ের সহিত ওতপ্রোতভাবে জড়িত পদাবলীও কীর্তন। শুধু বাংলায় নয় ভারতীয় অভিজাত বা ক্লাসিকাল সংগীত ধারায় এক অপরিচিত রূপে এই পদাবলী কীর্তনকে জানা যায়। এর সাহিত্য সুর গীতিরীতির পদ্ধতির মধ্যে রয়েছে ঐতিহাসিক অভিব্যক্তির এক অপূর্ব ধারা। প্রতিটি পদের সঙ্গে রয়েছে রস, ভাব, রাগ, তাল, ছন্দের সমাবেশ আর এই সমাবেশের মধ্যে পারস্পরিক সঙ্গতি ও লক্ষ্য করা যায়। আর এই পারস্পরিক সমাবেশের ছন্দের মধ্যে জন্ম নিয়েছে বাংলার প্রাচীন নৃত্যশৈলী ‘শ্রী পদাবলী নৃত্য’। পদাবলী কীর্তন সাহিত্যে যারা প্রবক্তা এবং পদকর্তা ছিলেন তাদের বহু সাহিত্যে ও পদে প্রাচীন বাংলার তথা গৌড় বঙ্গের এই শাস্ত্রীয় নৃত্যের কথা নানান ভাবে বর্ণিত হয়েছে।
প্রায় ৬০০ বছর আগে, চৈতন্য মহাপ্রভু ভক্ত রস ‘সমর্পণ’ এর উপর ভিত্তি করে তাঁর সমৃদ্ধ এবং নতুন দর্শন গান এবং নৃত্যের আকারে প্রকাশ করেছিলেন। তিনি সর্বদা গানের বিভিন্ন রূপের পাশাপাশি নৃত্যের মুদ্রার ধ্রুপদী রূপ ব্যবহার করে তার দর্শন প্রচার করতেন, যার মধ্যে কয়েকটি ভরতের নাট্যশাস্ত্রের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ। পরবর্তীতে এটি বেশিরভাগ নৃত্যের ফর্মগুলিতে কোনও না কোনও দিক থেকে বা অন্য কোনও খাঁটি শাস্ত্রীয় নৃত্যে এবং এমনকি বাংলার অনুসৃত লোকনৃত্য শিল্পের ফর্মগুলিতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। ভরতের নাট্যশাস্ত্রের ব্যাকরণ সহ চৈতন্য মহাপ্রভু ভিত্তিক নৃত্যের একটি নতুন রূপকে অনুসুচনা করার চেষ্টা করা হয়েছে।
(পদাবলি সাহিত্য ও পদকর্তা)
সপ্তম শতাব্দীর অলঙ্কারবিদ আচার্য দণ্ডী পদের অর্থে পদাবলী প্রয়োগ করেছিলেন। প্রাক-চৈতন্য যুগের পদাবলীর রচয়িতা ছিলেন তিনজন—চন্ডীদাস, জয়দেব বিদ্যাপতি।
পদাবলীর কবিগণের মধ্যে সর্বপ্রাচীন চণ্ডীদাস ও বিদ্যাপতি। চণ্ডীদাসের ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ (যার আদি নাম ‘শ্রীকৃষ্ণসন্দর্ভ’)। বৌদ্ধগানের ‘শূন্যতা’ বৈষ্ণব-পদাবলীতে ‘রাধা’ রাধা ভাব জন্মায় এর রাগ ও ভণিতা ও আছে। কাজেই বলা যেতে পারে, বৌদ্ধগানই (চর্যা ও বজ্রগীতি) যেমন একদিকে গজলের, তেমনি অন্যদিকে বৈষ্ণব-পদাবলীর মূল-উৎস।
খ্রীষ্টীয় দ্বাদশ শতকের শেষভাবে বাঙলার মাটিতে ঠাকুর জয়দেবের অভ্যুদয় হয়েছিল। কবি জয়দেব-রচিত অষ্টপদী বা ‘গীতগোবিন্দ’-পদগান শ্রীরাধাকৃষ্ণের অপার্থিব লীলামাধুর্যসম্পক্ত। বাঙলার ঠাকুর শ্রীচৈতন্যদেব চণ্ডীদাস ও বিজ্ঞাপতির ‘কৃষ্ণকীর্তন’, রামানন্দ রায়ের ‘জগন্নাথবল্লভনাটক,’ লীলাশুক বা বিষমঙ্গলের ‘শ্রীকৃষ্ণকর্ণামৃত’-এর মতো জয়দেব-রচিত ‘গীতগোবিন্দ’ পদগানের পরমানুরাগী ছিলেন। ‘চৈতন্য- চরিতামৃত’ গ্রন্থে শ্রদ্ধেয় কৃষ্ণদাস কবিরাজ লিখেছেন—
চণ্ডীদাস বিজ্ঞাপতি রায়ের নাটকগীতি,
কর্ণামৃত শ্রীগীতগোবিন্দ।
স্বরূণ রামানন্দ সনে মহাপ্রভু রাত্রি দিনে
গান শুনে পরম-আনন্দে।
কবি জয়দেবকে ‘নবরসিক’-এর অন্যতম ও ‘আদিগুরু’। তবে গীতগোবিন্দের ছন্দ, ভাব নৃত্যর ও মাধুর্য যে পরবর্তী বৈষ্ণব-ভক্তিসাহিতাকে রস-ভাবসমৃদ্ধ করেছিল এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই।
বাঙলার কবি জয়দেবের আদি-রসাত্মক ‘গীতগোবিন্দ’ পদগানই বৈষ্ণব-পদাবলীকীর্তনের অন্যতম সৃষ্টিক্ষেত্র ও লীলাভূমি। পরবর্তী বৈষ্ণব-পদাবলী যে ৯ম-১১শ শতকের বৌদ্ধ-চর্যাপদ এবং ১২শ-১৩শ শতকের গীতগোবিন্দের ওপরই ভিত্তিভূমি রচনা করেছিল একথা নিঃসংশয়ে স্বীকার করা যেতে পারে।
(শ্রী পদাবলীয় নৃত্যর উৎপত্তি)
বাঙালি জাতির রসভাব সম্পৃক্ত হৃদয়ের যে আবেগ ও নিবিড় অন্তরের যে অনুভূতি তারই বহিঃপ্রকাশ হল এই পদাবলীও নৃত্য।
বাংলা এবং বাংলাদেশের এই নৃত্যের উৎপত্তি যোগ সূত্র মূলত বাংলার শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু নগর সংকীর্তন, প্রাচীন চর্যা ও নাথগীতি, পালা কীর্তন, বাংলার নানা পূজা পার্বণ এবং অনুষ্ঠান ভিত্তিক নৃত্য এবং বঙ্গীয় নৃত্য (লোক নৃত্য), ঐতিহ্যবাহী যাত্রা পালা।
এই নৃত্য কৌশল মূলত ‘পঞ্চমবেদ’ বা ‘নাট্যশাস্ত্র’ ঐতিহ্যের মূল প্রধান নীতি অনুসরণ করে নৃত্য (অভিনয় যুক্ত নৃত্য) নৃও (শুদ্ধ নৃত্য) নাট্য (অভিনয়ের) নৃত্যশাস্ত্র মূলধারা বহন করে। এই নৃত্য-নৃত্যনাট্যের মূল বর্ণনা পদ্ধতি অনুসরণ করে...শ্রী পদাবলী নৃত্য অন্যান্য ধ্রুপদী রীতি অনুসরণ করে ১০৮টি করণ বা ৩২টি অঙ্গহারা এই নৃত্যশৈলীতে বিভিন্ন ছন্দবদ্ধ আন্দোলন বা চলন এবং ভঙ্গি বা ভঙ্গিমা রচনা করে। এই নৃত্য কৌশলের মধ্যে রয়েছে বাংলার বিশেষ সৃষ্টি কিছু চারি এবং মহাচারিও। তিন ভঙ্গ এর প্রকাশ। ‘দেবতা হস্ত’-এর সাথে অসমযুক্ত এবং সংযুক্তা দশাবতারাম হস্ত মুদ্রা বিশেষভাবে এই নৃত্যশৈলীতে ব্যবহৃত হয়।
এই নৃত্যে আঙ্গিক বাচিক আহার্য এবং সাত্ত্বিক ভাব প্রয়োগ করা হয়। এই নৃত্য কৌশলের দিকগুলিকে মাথায় রেখে যে পোশাকটি তৈরি করা হয় তার নাম—‘গারোদিয়া’। এটি লাল ঐতিহ্যবাহী শাড়ি দিয়ে তৈরি একটি নৃত্যর পোষাক বাংলার ঐতিহাসিক এবং ‘আরপৌড়ে’ শৈলী এই নাচের পোশাকে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এই নৃত্যের কিছু চরিত্রের জন্যে ‘স্বর্ণ চুরি’ শাড়ি পোশাক ব্যবহার করা হয় ‘নাট্য শাস্ত্রের’ রস এবং রঙের কথা মাথায় রেখে। এই নাচের পোশাকের মধ্যে রয়েছে কাঞ্চা, কুচি, উত্তরিয়া, অঙ্গবাস্ত্র ইত্যাদি।
মন্দিরের প্রাচীর এবং পটর ইত্যাদির জটিল নকশার সাথে মন্দিরের শৈলীতে গহনা তৈরি করা হয়েছে ‘তুলসী’ এবং ‘বেল’ কাঠের টুকরো দিয়ে তৈরি এই গহনাগুলি—হার, নাথ, চুল ঝুলানো কাটা, গৌরাঙ্ড়া চুরা,সূর্য চূড়া পাটি হার, কঙ্কন, ইত্যাদি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
এই নৃত্যের প্রদর্শিত নৃত্যগুলি নাট্যশাস্ত্রের বিভিন্ন পদের বর্ণনাকে মাথায় রেখে রচনা করা হয়েছে। নৃত্যের সূচনা হয়েছিল প্রণাম-ভূমিপ্রণামের মাধ্যমে। এরপর বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে নৃত্যচর্চা শুরু হয়। নৃত্যে একটি মূল্যবান প্রক্রিয়া আছে—‘রস গতি’ (অষ্ট রস, নবরস, পঞ্চম রস এবং ভক্তি রস অনুসরণ করে তৈরি এই গতি)। এই কৌশল নীতি পদাবলীয় নৃত্য ছাড়া অন্যান্য শাস্ত্রীয় নৃত্যের তেমন ভাবে দেখা যায় না।
প্রস্তুতি নৃত্যের মধ্যে প্রথমেই যোগ, মুদ্রা, চারি এবংবিভিন্ন ভঙ্গিমা শৈলীর অভ্যাস করা হয়। বাংলার বিশেষ রাগ এবং তালের অধ্যয়ন করা হয়। নৃত্যের সূচনা হয়েছিল মাটিতে প্রণাম-ভূমিপ্রণামের মাধ্যমে। নাট্যশাস্ত্রের মতে জর্জরের পূজো দণ্ড স্থাপন এবং মঙ্গলাচরণের মাধ্যমে নৃত্য শুরু় হয়।
তারপর শুরু হয় নৃত্যের নানান পালা, গৌরচন্দ্রিকা সহযোগে নানান লীলার কথা বর্ণনা করা হয় যেমন বাল্যলীলা, বংশী খন্ড, গৌরাঙ্গ বিষয়ক পদ, রাস, মহারাজ অষ্টনায়িকা, পুরুষ, গোষ্ঠ লীলা, কীর্তন, যাত্রা পালা, ভাগবতম সপ্তাহ ইত্যাদি নৃত্য।
বাংলার সমস্ত লোকনৃত্য এই নৃত্যের মৌলিক রূপ তৈরি করতে সাহায্য করে, এছাড়াও আমরা নাট্যশাস্ত্রের বিভিন্ন ভঙ্গি খুঁজে পাই। যেমন ছৌ, রায়বেশে ব্রতচারী, ঢালী নৃত্য, কাঠি নৃত্য, ঝুমুর, গম্ভীরা, টুসু, ভাটিয়ালি বাউল ইত্যাদি।
পদাবলী নৃত্যে বাংলার প্রধান কিছু বাদ্যযন্ত্র ব্যবহৃত হয় যেমন—বাঁশি, করতাল বা মন্দিরা, তানপুরা, মৃদঙ্গ বা শ্রীখোল, ঢাক, ঢোল। বাংলার এই বাদ্যযন্ত্রের কথা ভরতের নাট্যশাস্ত্রে বর্ণিত আছে।
ততমতন্ত্রীগতম জ্ঞেয়মবদ্ধম তু পশুকরম্।
ঘনমতলস্ত বিজ্ঞেয়ম শুষির বংশ উচ্চতে। (নাট্যশাস্ত্র)
(ক) তত যন্ত্র—তানপুরা
(খ) সুষির যন্ত্র-অর্থাৎ বায়ুচালিত—বাঁশি ,শিঙা, শঙ্খ
(গ) অবনদ্ধ/আনদ্ধ যন্ত্র-অর্থাৎ চল—মৃদঙ্গ বা শ্রীখোল, ঢাক ঢোল
(ঘ) ঘন যন্ত্র—অর্থাৎ ধাতুনির্মিত কাঁসর, করতাল ইত্যাদি।
আন্দোলন কৌশল বিকশিত মৌলিক অবস্থান এই নৃত্য ফর্ম প্রধানত নৃত্য নাট্য ঐতিহ্য রচিত হয় উপস্থাপনের পদ্ধতির নীতি, যথা, মোড (ধর্মী), স্টেজ ওয়ে বা স্টাইলাইজড উপায় (নাট্য) এবং প্রাকৃতিক বা বিশ্বের পথ (লোকা)।
কিছু সময়, নৃত্যটি লাইন শব্দের সাথে ‘আঙ্গিক অভিনয়’ পরিবেশন করেছিল, আবার কখনও, নৃত্যশিল্পী ভারবলে বিশদভাবে বর্ণনা করেছিলেন, ‘বাচিক’। আমরা নম সংকীর্তন প্রসঙ্গে যে রেপারটোলার উল্লেখ করেছি। পালাগান নাম যজ্ঞ কীর্তন, যাত্রা পালা ভাগবতম সপ্তাহ ইত্যাদি নৃত্য।
বাংলার সমস্ত লোকনৃত্য এই নৃত্যের মৌলিক রূপ তৈরি করতে সাহায্য করে, এছাড়াও আমরা নাট্যশাস্ত্রের বিভিন্ন ভঙ্গি খুঁজে পাই। যেমন ছৌ, রাইবশে, ধলকাঠি ইত্যাদি লোকনৃত্যের মধ্যে বিশুদ্ধ নৃত্য বা নৃত্য পাওয়া যায় এবং ঝুমুর ক্রিলান, টুসু, বাউল, গাম্ভীরা, কুষাণ ইত্যাদি লোকনৃত্যের মধ্যে অবিনয় পাওয়া যায়।
প্রাচীন কোন শাস্ত্রীয় সংগীত এবং নৃত্য থেকে থাকে সেটি একমাত্র কীর্তন সংগীত বলে মনে হয়। সংগীত বলতে শুধু গীতকেই বোঝাই না, বোঝায় নৃত্য-গীত-বাদ্যকে, সংস্কৃত গ্রন্থে যাকে ‘ক্রৌর্যত্রিক’ বলে। বাংলার সে নগরী হোক বা পল্লীই হোক উভয় সমাজের মানব জীবন যাত্রার প্রতিটি গতি ছন্দের সঙ্গে এই নৃত্য-গীত-বাদ্য অর্থাৎ সংগীতের নিবিড় সম্পর্ক ছিল এখনও আছে এবং আশা করি সামনেও থাকবে।
পদাবলী সাহিত্যের নানান ভাগের মধ্যে এই নৃত্যকে দেখানো হয়েছে-
*বৈষ্ণব পদাবলী
*শাক্ত পদাবলী,
*হরগৌরীপদাবলী
পদাবলী সাহিত্যে বৈষ্ণব পদাবলীকে আবার চার ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে—
১) রাধা কৃষ্ণ পদাবলী
২) গৌর পদাবলী
৩) ভজন পদাবলী
৪) রাগাত্মিক পদাবলী
(শ্রী পদাবলীয় নৃত্য এর নাম করণ এর সার্থকতা)
শ্রী নৃত্যে ‘পদাবলী’ এই শব্দটির পরিচয় বর্ণনা করলে পাওয়া যায়—পদ (গীতিকবিতা) + বালি (বলি) = নূপুর বা পায়েল। যেখানে নৃত্যটি মুখের বোলোবানি (তাল এর সাথে নাচের স্পন্দন)। এই পদ শব্দে মূলত গান এবং গীতিকবিতা বোঝানো হয়। এই পদাবলী শব্দের ব্যাখ্যা আমরা নানান শাস্ত্রে গ্রন্থে এবং সাহিত্যে পেয়ে থাকি। তাছাড়া বলা যেতে পারে পদের মুখ্য অর্থই হলো গান। রাগের বাঁধন রাগ, সুর, ছন্দ ছাড়া সৃষ্টি অসম্ভব। আর তাল, ছন্দ, সুর থাকলে সেখানে নৃত্য থাকবে। খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় শতকে ভারত মুনি রচিত নাট্যশাস্ত্রে পদ শব্দের অর্থ গান বা গীতিকেই লক্ষ্য করা হয়েছে।
অতালমণিবন্ধঞ্চ পদং তু জ্ঞেয়মের চর।।
-নাট্যশাস্ত্র (কানী সং) ৩২/২৬-২৮
অথবা
গান্ধর্বং যন্ময়া প্রাক্তং স্বরতালপদাত্মকম্।
পদং তস্য ভবেদ্বস্তুঃস্বরতালানুভাবকম্॥
-নাট্যশাস্ত্র (কাশী সং) ৩২/১৪
শ্লোকাংশ-দুটিতেও নীতির অবয়ব বা গীতি অর্থে গ্রন্থকার ‘পদ’ শব্দ ব্যবহার করেছেন। স্বর, তাল ও পদ এই তিন রকম আকারে ভরত গান্ধর্বগানের প্রকাশ ও অনুশীলন স্বীকার করেছেন ও তারি জন্য তিনি বলেছেন:
‘গান্ধর্বং ত্রিবিধং বিদ্যাৎ,’
যদিও পদের বিশ্লেষণ করতে গিয়ে তিনি পুনরায় বলেছেন-
• ছন্দো বৃত্তানি জাতাশ্চ নিত্যং পদগতাত্মকাঃ।
অনেকে ভরত মুনির উক্ত ‘স্বরতালপদাশ্রয়ম্’ শ্লোকাংশের ‘পদ’ শব্দকে ছন্দায়িত নৃতোর প্রতিফলন বলেন। আর যদিই বা ‘পদ’ অর্থে লাক্ষণিকভাবে ‘নৃত্য’-শব্দ বোঝায়, তাহলেও নৃত্য ক্রৌর্যত্রিক সঙ্গীতেরই অবিচ্ছেদ্য বা অপরিহার্য অংশ, সুতরাং ‘পদ’ শব্দ গীতের অনুবর্তী বা গীতির অবয়ব অথবা গানেরই দ্যোতক।
কবি কালিদাসের (খ্রীষ্টীয় ১ম-৪র্থ শতক) কাব্য ও নাটক গ্রন্থগুলির অনেক জায়গায় ‘পদ’ শব্দে গান, গীতি বা সঙ্গীত অর্থে ব্যবহৃত দেখা যায়। মেঘদূতে (উত্তরমেঘ ৯১ শ্লোক) বিয়োগবিধুরা যক্ষপত্নী যখন বীণার তন্ত্রীতে গোত্রাঙ্কিত মূর্ছনার প্রয়োগ করে আলাপ করতে উদ্যতা তখন সেই অভিচারিক প্রয়োগ নিষ্ফল হয়েছিল তাঁর চোখের জলে বীণার তন্ত্রী সিক্ত হয়ে। (কালিদাস বীণাশব্দের প্রসঙ্গেই ‘পদ’ শব্দ ব্যবহার করেছেন এবং তা গান, সুর বা সঙ্গীতের প্রকাশক রূপ।
খ্রীষ্টপূর্ব চারশো শতকের মহাকাব্য রামায়ণ, মহাভারত ও হরিবংশে এবং এমনকি খ্রীষ্টীয় শতকের প্রথম ভাগের পঞ্চরাত্র- সংহিতা ও পুরাণ-সাহিত্যগুলিতে গান বা গীতির দ্যোতক রূপে ‘পদ’ শব্দের ব্যবহার দেখা যায়। রামায়ণে (বালকাণ্ড, ৪র্থ সর্গ) ‘বিচিত্রার্থপদং সম্যগ গায়কে’, ‘সমচোদয়ৎ’ বা ‘অবগায়তাং মার্গবিধানসংপদা’ শ্লোকাংশে ‘পদ’ শব্দে গানকে বুঝিয়েছে।
চৈতন্যভাগবত ও চৈতন্যচরিতামৃত প্রভৃতিতে ‘তথাহি পদম্’ বলিয়া সাধারণত দুই ছত্র উদ্ধৃত হইয়াছে।
এই শব্দ-প্রসঙ্গেও ডঃ সুকুমার সেন বলেছেন: ‘পদাবলী’ শব্দটির প্রথম ব্যবহার পাই গীতগোবিন্দে—
মধুর কোমলকান্তপদাবলীং শৃণু জয়দেবসরস্বতীম্
সংস্কৃত সম্ভাব্য শব্দের অর্থ যথা—‘পদাবরন’ - ‘পোদাভরণ’ অর্থ নূপুর (বাংলা শব্দ পায়েল)। কবি জয়দেবের মতে পদাবলী শব্দের অর্থ পায়েল) কবি জয়দেবের এই আবেদন থেকে পদাবলি নামকরণের সার্থকতা।
(শ্রী পদাবলী নৃত্যের ইতিহাস বাংলার দেবদাসী এবং ভাস্কর্যের প্রমাণ)
সংগীতশাস্ত্রে নৃত্য এবং বাস্তকেও সংগীতকলার অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে - তা যে কোন শ্রেণীর সংগীতই হোক না কেন। খ্রীষ্টীয় ১০ম শতকের সংগীতশাস্ত্রী শার্জ দেব ‘সংগীত-রত্নাকর’ গ্রন্থে ‘সংগীত’ শব্দের ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ প্রসঙ্গে এ কথাই বলেছেন।
প্রাচীন ভারতে দেবদাসী প্রথার প্রচলন যখন থেকে হয়, মনে হয় তখন থেকেই ‘সংগীত’ শব্দ কলা-রূপে তৌর্যত্রিক তথা নৃত্য, গীত ও বাদ্যকলার সমন্বিত রূপকে নিয়ে সার্থক ছিল। বাঙলাদেশে পাল ও সেন রাজাদের রাজত্বের সময়ে শিব কিংবা কার্তিকের মন্দিরে দেবদাসিদের সংগীতের ব্যবস্থা ছিল এবং তাতে নৃত্য ও বাদ্য সহযোগে গীত পরিবেশনের ব্যবস্থা ছিল-একথা ‘রাজতরঙ্গিনী’ গ্রন্থে কহলন এবং ‘পবনদূত’ গ্রন্থে কবি ধোয়ী স্বীকার করেছেন। শ্রদ্ধেয় জি. এস ঘুরে (G. S. Ghurye) তাঁর Bharatanatya and Its Costume (Poona. 1958) গ্রন্থে বাঙলাদেশে শাস্ত্রীয় নৃত্যপ্রসঙ্গে লিখেছেন: ‘The Kashmiri royal patron and employer of Damodaragupta, Jayäpida, it would appear, was proficient in Bharata›s Nätyssästra even before he took Dämo daragupta in his service, Kalhana, while describing the inti- nerary of that King, tells us that he once entered the city of Pundravardhana in ‹Gauda-Desa›, Bengal. While there, he once chanced to see a dance being performed to the accom- paniment of vocal and instrumental music, and being ‹versed in the historic arts of the dance, song and the like in accor- dance with Bharata, sat himself down for a while. Jayapida›s reign, according to R.S, Pandit, extended from A.D, 751 to 782»। তিনি আরো লিখেছেন: «Another Käshmiri King, Jayapida (A.D, 751-782) while he was in the town of Paundra- vardhana in Gauda, Bengal, once saw in the temple of Kärti- keya a dance ‹lāsya› being performed. The dancer ‹nartaki›, was one Kamala by name, Kamalä, on her part, (এখানে লাস্য নিত্য ছন্দ নৃত্যছন্দ স্ত্রীলোকদের ও দেবদাসী-দের নৃত্যকেই লক্ষ্য করা হয়েছে এবং পুরুষ-নৃত্য ছিল ‘তান্ডব’। নাট্যশাস্ত্রে ভরত এবং নাট্যদর্পণে রামচন্দ্র তাণ্ডব ও লাস্যনৃত্যের উল্লেখ করেছেন।
তাছাড়া বাঙলার ইতিহাস থেকে একথা প্রমাণ হয় যে, গুপ্ত, পাল ও সেন রাজাদের আমলে শাস্ত্রনির্দিষ্ট গান ও নৃত্যের পাশাপাশি দেশীগান এবং আঞ্চলিক নৃত্যেরও প্রচলন ছিল এবং গুপ্ত, পাল ও সেন রাজারা সে-সকল গান ও নৃত্যের বিশেষ পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। কথিত আছে, রাজা লক্ষ্মণসেনের রাজত্বকালে ‘সেকশুভোদয়া’- গ্রন্থ রচিত হয়।
গুপ্ত, পাল ও সেন-রাজাদের আমলে বাঙলায় (বৃহত্তর বাঙলায়) নৃতা-গীতের যে সচ্ছ্বল অনুশীলন ছিল সেকথা পূর্বেই আলোচনা করেছি। লোকগীতি ও লোকনৃত্যের পাশাপাশি শাস্ত্রীয় করণ, অঙ্গহার ও চারি-সম্বলিত নৃত্যকলার অনুশীলন তখন অব্যাহত ছিল রাজ-অন্তঃপুরে, রাজদরবারে রাজপ্রসাদসংলগ্ন নাটাগৃহে বা রঙ্গমঞ্চে, দেবায়তনে ও বিভিন্ন পার্বণ-উৎসবাদিতে। অভিজাত নৃত্যকর্মের আঙ্গিক ও বিকাশ নাট্যশাস্ত্রকার ভরতের নির্দেশানুযায়ী ছিল এবং নৃত্য, নাট্য বাদ্য সহচারী ছিল অভিজাত ও দেশী গান। ‘সেকশুভোদয়ায় বর্ণিত গঙ্গোনউবধূ’, ‘বিদ্যুৎ প্রভা’, বুঢ়ন মিশ্র, জয়দেবসতী পদ্মাবতী ও কবি জয়দেবের নৃত্যগীত- সম্পৃক্ত কাহিনীর কিছুটা পরিচয় দেব গীতগোবিন্দ নাট্যরূপের পরিচয় দেবার আগে।
‘সেকশুভোদয়া’-র ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদে নৃত্যসম্পক্ত গীতিকাহিনীটি হোল:
(ক) বিদ্যুৎপ্রভানায়ী নর্তকীবিশেষ তামানয়।
সা নর্তয়তু, লোকাঃ ...
বাংলার দেবদাসীদের মধ্যে বিদ্যুৎ প্রভা শশী কলা পদ্মাবতী এবং কমলা নামের উল্লেখ পাওয়া যায়। বাংলার এই প্রাচীন নৃত্যের সাক্ষ্য শুধুমাত্র সাহিত্যে নয় পাওয়া যায় ভাস্কর্য চিত্রকলাতেও।
বাঙলার ইতিহাসের পথযাত্রীমাত্রেরই জানা আছে যে, পরমভাগবত গুপ্তরাজাদের সময়ে বাঙলায় শিব, গণপতি ও কার্তিকেয়ের মন্দির এবং স্থানে স্থানে শক্তিপীঠ প্রতিষ্ঠিত থাকলেও সাধারণ সমাজে বিষ্ণু-উপাসনার অনুষ্ঠান ও নিষ্ঠাই বৈষ্ণবধর্মের ভাবপ্রবাহকে অব্যাহত রেখেছিল। (রাজতরঙ্গিণীকার কলণের ঐতিহাসিক বিবরণে পাওয়া যায়, শিব ও কার্তিকেয়ের বিভিন্ন মন্দিরে নৃত্য-গীত-অনুষ্ঠানের জন্ম দেবদাসীরা নিযুক্ত থাকত এবং তাদের নৃত্যছন্দ-ছিল সম্পূর্ণভাবে ভরতের নাট্যশাস্ত্র-অনুমোদিত।)
গুপ্ত ও পালোত্তর সেন-রাজাদের মধ্যে শিব ও বিষ্ণু এই উভয় দেবতারই উপাসনা প্রচলিত ছিল। তবে রাজা লক্ষ্মণসেন নিজে ছিলেন পরমবৈষ্ণব ও বিষ্ণুর উপাসক। তাঁর রাজত্বকালে বাঙলার সমাজে যে রাধাকৃষ্ণলীলাসেবিত ভক্তিবাদের প্রচলন ছিল তা বাঙলার ইতিহাসই বিশেষভাবে প্রমাণ করে। খ্রিস্টীয় সপ্তম শতকে পাহাড়পুরে আবিষ্কৃত কৃষ্ণলীলাবিষয়ক মূর্তির নিদর্শন সেকথা আরো বিশেষভাবে প্রমাণ করে। অবশ্য পাহাড়পুরে আবিষ্কৃত ধ্বংসস্তুপে রাধাকৃষ্ণের মূর্তি ছাড়াও বিষ্ণু, বলরাম, ত্রিশূলধারী শিব, গণেশ, ইন্দ্র, যমুনা ও রামায়ণকাহিনীর মূর্তি পাওয়া গেছে। (রায় বাহাদুর কে. এন. দীক্ষিত ১৯২০-২১, ১৯২৬-২৭, এবং ১৯২৭-২৮ খ্রীষ্টাব্দের বার্ষিক প্রত্নতাত্ত্বিকী বিবরণীতে (Annual Report of the Archaeological Survey of India for 1920-21, 1926-27, 1927-28) পাহাড়পুর-স্তূপের ও স্তূপ থেকে আবিষ্কৃত বিচিত্র উপাদান-সামগ্রী ও মূর্তির পরিচয় তিনি দিয়েছেন) ।
এই পদাবলী ও নৃত্য এমন একটি গবেষণামূলক নৃত্য যে নৃত্যের উপর স্নায়বিক জ্ঞানের উপর বেশ কয়েকটি কাজ করা হয়েছে। এটি নিউরো কগনিটিভ ডান্স থেরাপির একটি অংশ। বিজ্ঞানকে সাথে নিয়ে এই নৃত্যটি গবেষণা করা হয়েছে।উদ্দেশ্য হলো মানুষকে মানুষিক এবং শারীরিক সুস্থ রাখা।
বিষ্ণুপুর ও অনেক প্রাচীন মন্দিরের স্থাপত্য দেখে বুঝা যায় যে আমাদের বাংলার একটা খুব উচ্চমার্গের সংগীত (নৃত্য গীতার বাদ্য) ধরা ছিল, পদাবলীকীর্তনের ইতিহাস-এ প্রাচীন সংস্কৃত ধারা আজ অনেকটাই অবক্ষয়ের পথে। এই অবক্ষয় থেকে আমরা প্রত্যেকে বাঁচাতে পারি এই শিল্প ও সংস্কৃতিকে।
বাংলা হারিয়ে যাওয়ার সংস্কৃতি নিয়ে আমাদের আরো বেশি সচেতন হতে হবে যাতে আমাদের সামনের প্রজন্ম অনেক বেশি সুস্থ মস্তিষ্কে সুস্থ পরিবেশে তারা কর্ম করতে পারে তার সাথে -পদাবলী কীর্তনের ইতিহাসের পাতায় সে সকল সাক্ষ্যই বাঙলার সরস ও প্রেমনিবিড় মরমী অন্তরের পরিচয় দান করবে তাই আশা রাখব।
লেখিকা ডঃ অনুরাধা রায়, অতিথি অনুষদ, সংস্কৃত বিভাগ, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়