ইলশেগুঁড়ি ২৯তম সংখ্যা (শারদীয়া)
ইলশেগুঁড়ি ২৯তম সংখ্যা (শারদীয়া)
বাঙালির রক্তের মধ্যে যদি কোনও সুর মিশে গিয়ে থাকে, সে সুর মহালয়ার। অন্য সময় রেডিওর সঙ্গে কোনওরকম সম্পর্ক না থাকলেও বছরের একটি বিশেষ দিনে ভোরবেলা আজও বাঙালি বাড়ি থেকে ভেসে আসে মহিষাসুর মর্দিনীর চেনা সুর।
১৯৩২ খ্রিস্টাব্দের চৈত্র মাসে বাসন্তী ও অন্নপূর্ণা পূজার সন্ধিক্ষণে প্রথম সম্প্রচারিত হয় বসন্তেশ্বরী শীর্ষক অনুষ্ঠান, যা মার্কণ্ডেয় চণ্ডীর উপর ভিত্তি করে বাণীকুমারের লেখা একটি বেতার লিপিলিখন। বসন্তেশ্বরী শীর্ষক অনুষ্ঠানের অনুকরণেই কিছু পরিমার্জনের মাধ্যমে সেই বছরই দুর্গাষষ্ঠীর দিন অনুষ্ঠানটি সম্প্রচারিত করা হয়। এই অনুষ্ঠানের সঙ্গীত পরিচালক ছিলেন রাইচাঁদ বড়াল, চণ্ডীপাঠ করেন বাণীকুমার স্বয়ং এবং নাট্যকথা সূত্র এবং গীতাংশ গ্রহণে ছিলেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র। পরবর্তীতে ১৯৩১-৩৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত প্রতিবছরই কিছু পরিমার্জন করে নতুন স্তবস্ততি, দেবীসূক্তি, নতুন গান এবং পুরাতন গানের সুরের পরিবর্তন ঘটিয়ে অনুষ্ঠানটির সম্প্রচার করা হয়। ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত এই অনুষ্ঠানটি মহিষাসুর বধ, শারদ বন্দনা [৩] নামে সম্প্রচারিত হয়, যার সঙ্গীত পরিচালনা করেন পঙ্কজ কুমার মল্লিক ও রাইচাঁদ বড়াল এবং শ্লোকপাঠ ও গ্রন্থনা করেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র। ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে এই অনুষ্ঠানের নাম পরিবর্তন করে মহিষাসুরমর্দ্দিনী রাখা হয়, যা এখনও একই নামে সম্প্রচারিত হয়ে চলেছে। এই প্রভাতী অনুষ্ঠানে বিভিন্ন বছর সঙ্গীতশিল্পীদের বিভিন্ন পরিবর্তন ঘটে। ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দের দিকে বোম্বাইতে গানের রেকর্ড করাতে যাওয়ায় হেমন্ত মুখোপাধ্যায় সঙ্ঘবদ্ধ ভাবে রিহার্সালে অংশ নিতে পারেননি এবং বাণীকুমারের নির্দেশে তিনি অনুষ্ঠান থেকে বাদ পড়েন। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের বদলে শচীন গুপ্তের নাম ঠিক করা হলেও শারীরিক অসুস্থতার কারণে তাঁর বদলে জাগো দুর্গা গানটি করেন দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়।১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত অনুষ্ঠানটি সরাসরি সম্প্রচারিত হত। অনুষ্ঠান শুরুর পূর্বে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র স্নান করে শুভ্র পোশাকে এসে শ্লোক পাঠ করতেন। বর্তমানে ১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দের রেকর্ডটিই মহালয়ার দিন ভোর চারটের সময় সম্প্রচারিত করা হয়।
বাঙালির রক্তের মধ্যে যদি কোনও সুর মিশে গিয়ে থাকে, সে সুর মহালয়ার। অন্য সময় রেডিওর সঙ্গে কোনওরকম সম্পর্ক না থাকলেও বছরের একটি বিশেষ দিনে ভোরবেলা আজও বাঙালি বাড়ি থেকে ভেসে আসে মহিষাসুর মর্দিনীর চেনা সুর। এই সুরের শুরু ১৯৩১ সালে। তখন সবে পথ চলতে শুরু করেছে কলকাতা বেতার কেন্দ্র। অক্লান্ত পরিশ্রম করে চলেছেন সেখানকার তরুণ ব্রিগেড। নেতৃত্বে স্টেশন ডিরেক্টর নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ মজুমদার। চলছে নানা পরীক্ষা। তার মধ্যেই ‘‘বেতার জগৎ পত্রিকা’’র সম্পাদক প্রেমাঙ্কুর আতর্থী হঠাৎই বুদ্ধি দিলেন শ্রী শ্রী চণ্ডীর কাহিনি নিয়ে একটি গান এবং শ্লোক সংকলন রচনা করার। সে ভাবনাটা বেশ মনে ধরল স্টেশন ডিরেক্টর নৃপেনবাবুর। তখন বাণীকুমার রচনা করলেন শারদ বন্দনার একটি গীতি আলেখ্য। সঙ্গীত পরিচালনার দায়িত্ব নিলেন পঙ্কজ কুমার মল্লিক। ১৯৩২ সালের দেবী পক্ষের মহাষষ্ঠীতে সেটি প্রচারিত হয়। তখন সেই অনুষ্ঠানের নাম ছিল ‘‘মহিষাসুর বধ’’। ১৯৩৭ সাল থেকে এই অনুষ্ঠানের নাম হয় ‘‘মহিষাসুরমর্দিনী’’। কিন্তু কে এই পঙ্কজকুমার? স্কটিশ চার্চ কলেজে পড়াকালীন গানের নেশা ক্রমশ জাঁকিয়ে বসল পঙ্কজকুমার মল্লিকের। কলেজে পড়াকালীনই আলাপ হয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভ্রাতুষ্পুত্র দ্বিপেন্দ্রনাথ ঠাকুরের পুত্র দীনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে। আকৃষ্ট হন রবীন্দ্রসংগীতের প্রতি। ১৯২৬ সালে মাত্র ১৮ বছর বয়সে ভিয়েলোফোন কোম্পানি থেকে রেকর্ড করেন ‘নেমেছে আজ প্রথম বাদল’ গানটি।তিনি শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের চর্চা করেছিলেন দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের গানের ইস্কুলে। আর সেখানেই প্রথম সুর দেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা কবিতায়। তাও আবার কবির অজান্তেই। পরে অবশ্য কবি তা জানতে পারেন। তবে তাঁর সুরক্ষেপন এবং গায়কিতে এত মুগ্ধ হয়েছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যে কবিগুরুর ইচ্ছা অনুযায়ী তাঁর বেশ কয়েকটি কবিতায় সুরারোপ করেছিলেন পঙ্কজ মল্লিক। রবীন্দ্রনাথ তাঁকে বলেছিলেন, জীবদ্দশায় যে সব গানে তিনি সুর করে যেতে পারবেন না, সেগুলিতে সুর করার দায়িত্ব যেন পঙ্কজকুমার মল্লিক নেন। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত কবিগুরুর এই আশীর্বাদকে তিনি সব পুরস্কার ও সম্মানের ঊর্ধ্বে মনে করেছেন। এমন কি ভারতের জাতীয় সঙ্গীত ‘জন গণ মন’ তিনিই প্রথম গেয়ে রেকর্ড করেছিলেন। কিন্তু এই পঙ্কজকুমার মল্লিকের সঙ্গে ভারতীয় বাঙলা সিনেমার যোগ সূত্র কি! তখন নিউ থিয়েটার্স স্টুডিয়ো-য় ‘ভাগ্যচক্র’ ছবির কাজ চলছে। পরিচালক নীতিন বসু। নীতিন বাবু থাকতেন উত্তর কলকাতার আমহার্স্ট স্ট্রিটে আর পাশের পাড়া চালতাবাগানে থাকতেন পঙ্কজকুমার। প্রতিদিন স্টুডিয়ো যাবার পথে পঙ্কজকুমারকে বাড়ি থেকে গাড়িতে তুলে নিয়ে যেতেন তাঁর নীতিন বসু। এমনই এক দিন, নীতিনবাবু গাড়ি নিয়ে এসে নীচ থেকে পঙ্কজকুমারকে ডেকেই চলেছেন। কিন্তু পঙ্কজকুমার আর নামেনই না। তিনি যে তখন পাশের বাড়ি থেকে ভেসে আসা ‘পেগান লভ সং’-এ গলা মেলাচ্ছেন। রামোন নাভারোর বিখ্যাত গান— ‘হোয়্যার দ্য গোল্ডেন সানবিমস/ অ্যান্ড দ্য লেজি ল্যান্ড ড্রিমস...’। ‘দ্য পেগান’ ছায়াছবির। বহুক্ষণ বাদে যখন পঙ্কজ মল্লিকের বাবা এসে ডাকলেন তাঁকে, টনক নড়ল। হুড়মুড়িয়ে নীচে নেমে গাড়িতে বসলেন। তখন নীতিন বসু গম্ভীর। কোনও কথা নেই মুখে। নির্ঘাৎ দেরি করার জন্য রাগ করেছেন। চৌরঙ্গীতে মেট্রো সিনেমার কাছে ট্র্যাফিক সিগনালে গাড়ি থামতেই আচমকা নেমে গেলেন নীতিন বাবু। চালককে শুধু বলে গেলেন, মিউজিয়ামের সামনে যেন গাড়িটা ‘পার্ক’ করা হয়। তারপর ফিরলেন বেশ কয়েকটা ইংরেজি বই আর একটা রেকর্ড নিয়ে। স্টুডিয়োয় ঢুকেও কোনও কথা না বলে হন হন করে হাঁটা দিলেন। নীতিন বসুর পিছু নিলেন পঙ্কজ মল্লিক। ঘরে ঢুকেই সামনে রাখা গ্রামাফোনে সদ্য কিনে আনা রেকর্ডটা বসিয়ে দিলেন নীতিন বাবু। ‘পেগান লভ সং’! গান শুরু হতেই প্রচণ্ড উত্তেজিত হয়ে বললেন, ‘‘পঙ্কজ, শিগগির। গলা মেলা। ঠিক যেমন বাড়িতে মেলাচ্ছিলি। ক্যুইক, ক্যুইক।’’ কিছু না বুঝে যন্ত্রের মতো আদেশ পালন করতে লাগলেন পঙ্কজ মল্লিক। আর গান গাইতে গাইতে অবাক হয়ে দেখলেন, নীতিন বসু এ দিক ও দিক থেকে তাঁকে দেখে চলেছেন। গানের শেষে যা ঘটল তাতে পঙ্কজ ভাবলেন, নীতিন বাবু নির্ঘাৎ পাগল হয়ে গিয়েছেন। হঠাৎ পঙ্কজকে জড়িয়ে ধরে নাচতে শুরু করে দিলেন। ‘‘পেয়েছি রে পেয়েছি পঙ্কজ। পেয়েছি।’’
"কী পেয়েছেন পুতুলদা?" নীতিন বসুরই ডাক নাম পুতুলদা।
‘‘কী শুভক্ষণেই না তুই তোর বাড়িতে রেকর্ডের গানের সঙ্গে গলা মেলাচ্ছিলি।’’
আসলে নীতিন বসু তখন পঙ্কজকুমারের মাধ্যমেই ‘প্লেব্যাক’-এর পদ্ধতিটা আবিষ্কার করে বসে আছেন! আর সেই প্রথম ‘প্লেব্যাক’ হল ভারতীয় সিনেমায়। ‘মুক্তি’-তে জোর করে পঙ্কজ মল্লিককে দিয়ে জেদ করে অভিনয়ও করালেন বরুয়া সাহেব। এর পর আরও আরও অনেক ছবিতে অভিনয় করলেন তিনি। হিন্দি, বাংলা দুই-ই। পুরোপুরি অভিনয় ছেড়ে দেওয়ার পরও ‘অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি’ করার জন্য উঠে পড়ে লেগেছিলেন এক প্রযোজক। আর রাজি করানো যায়নি। তখন আর অভিনয় নয়, শুধু সুর করার নেশা তখন পঙ্কজ মল্লিককে আরওই যেন পাগল করে দিয়েছে। সেই নেশার জালে একে একে জরিয়ে চলেছেন কাননদেবী, গীতা দত্ত, শচীন দেব বর্মন, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় … কে নন!
আর সেই পঙ্কজ-সুরের মোহ এমনই যে অদ্ভুত অদ্ভুত সব কাণ্ড ঘটতে লাগল সিনেমা হলেও। ‘যাত্রিক’-এ যেমন। তীর্থস্থান কেন্দ্রিক ছবি। আর সব ছবিতে থাকতো ভক্তিরসের গান। দর্শক লোকমুখে গল্প শুনে এতই ভাবরসে ডুবে থাকত যে জুতো খুলে হলে ঢুকতেন তাঁরা। এক দিকে এই ভাববিহ্বলতা। অন্য দিকে অদ্ভুত অদ্ভুত সব এফেক্টসের ছোঁওয়া! ‘ডাক্তার’ ছবিতে গীতিকার অজয় ভট্টাচার্যের লেখা গান ‘ওরে চঞ্চল’। তারই হিন্দি রূপান্তর ‘চলে পবন কী চাল’। শুট্যিং হচ্ছিল ডায়মন্ডহারবারে। রাস্তায়। ঘোড়ায় গাড়ি চালিয়ে। এ দিকে সিনেমায় ঘোড়ার ক্ষুরের শব্দ আনার মতো আধুনিক যন্ত্র তখন কই! পঙ্কজ মল্লিক নারকোলের খোল বাজিয়ে হুবহু সেই আওয়াজ আনলেন সাউন্ডট্র্যাকে।পঙ্কজ মল্লিকের নাম তখন সারা ভারতে ছড়িয়ে গেছে।বারবার ডাক আসতে লাগল বম্বে থেকে। তিনি কিছুতেই যাবেন না। এক বার তো রাজ কাপূর নিজে এসে বললেন, ‘‘চাচা, আপনার টেবিলে আমি ব্ল্যাঙ্কচেক রেখে যাচ্ছি, যা মনে আসবে ভরে নেবেন। আমার ছবিতে কিন্তু আপনাকে চাই।’’ শুধু তাই না। জার্মান পরিচালক পল জিলস্ ডাকলেন। রবীন্দ্রনাথের ‘চার অধ্যায়’ নিয়ে হিন্দিতে ‘জলজলা’ বানাবেন। বম্বেতে। দেব আনন্দ, গীতা বালি অভিনয় করছেন। গান গাইবেন গীতা দত্ত। সঙ্গীত পরিচালনা করে দিতে হবে। সবেতেই এক কথা, ‘‘না।’’শেষে জিলস্ হার মানলেন না। গীতাকে নিয়ে সোজা কলকাতায় চলে এলেন। সেবক বৈদ্য স্ট্রিটের নিজের বাড়িতে গীতা দত্তকে নিয়ে মহলা দিয়ে পঙ্কজ মল্লিক গান রেকর্ড করালেন নিউ থিয়েটার্সে। তবু বম্বে গেলেন না। আসলে তখন খ্যাতি আর অর্থের টানে দলে দলে শিল্পীরা বাংলা ছাড়ছেন। তাই নিউ থিয়েটার্স-এর সরকার সাহেব একদি পঙ্কজ মল্লিককে বললেন, ‘‘সবাই তো চলে যাচ্ছে। আপনিও যান। এত টাকা দেবার ক্ষমতা যে আমার নেই! সুযোগ হারাবেন কেন?’’ কিন্তু পঙ্কজকুমার বললেন, ‘‘আপনি আমার অসময়ে পাশে থেকেছেন, আজ এই দুঃসময়ে আপনাকে ছেড়ে চলে যাব!’’ সরকার সাহেবের এর পর আর কী করার থাকে, চোখের জলে ভেসে যাওয়াটুকু ছাড়া। তখন নিউ থিয়েটার্সের প্রযোজনায় ‘মাই সিস্টার’ ছবির কাজ চলছে। ‘অ্যা-এ কাতিবে তাখদির মুঝে ইতনা বাতা দে’ গানটির রেকর্ড করতে গিয়ে কিছুতেই সুর লাগাতে পারছেন না সায়গল। কথাও ভুলে যাচ্ছেন। সঙ্গীত পরিচালক পঙ্কজ মল্লিক সমেত ঘরসুদ্ধ সকলেই তত ক্ষণে বুঝে গেছেন চূড়ান্ত মদ্যপানের জেরেই সায়গলের এই বিপত্তি। ওঁর তখন বদ্ধমূল ধারণা, মদ না খেলে বুঝি গান গাইতে পারবেন না! সে দিনও তাই নেশায় চুড়। পঙ্কজকুমার বহু ভাবে চেষ্টা করছিলেন। টুকরো টুকরো করে ভেঙে ভেঙেও রেকর্ড করতে চাইছিলেন। তাতেও সামাল দিতে না পেরে এক সময় মেজাজ হারালেন। সায়গলকে সজোরে চড় মেরে দিলেন। আর তাতেই সম্বিৎ ফিরল সায়গলের! অল্পক্ষণ থমকে ছিলেন। তার পরই বন্ধু পঙ্কজকে বুকে জড়িয়ে ধরে হাউ হাউ করে কান্না। এর পরই ‘টেক’। এবং এক বারেই নির্ভুল রেকর্ডিং। সে-গান যে কতটা দরদ-ঢালা, গানপাগল কারওই আজ অজানা নয়। এরপর একদিন কালের ফেরে সত্যিই বন্ধ হয়ে গেলো নিউ থিয়েটার্স। আবারও ফিরে আসি রেডিওর কথা। যতই তিনি সিনেমার সাথে যুক্ত হন না কেনো পঙ্কজকুমার মল্লিকের প্রান ছিল আকাশবাণী। তার সঙ্গে সম্পর্ক যে সেই ১৯২৭ সাল থেকে। আকাশবাণী তখন টেম্পল চেম্বার্স-এর বাড়িতে ছিলো। গান, নাটক, কথিকা, গল্পদাদুর আসর আরো কত কি। অনেক প্রান ঢাল আন্তরিকতায় চালু হয়েছিল দুটি অনুষ্ঠান। রবিবার সকালের ‘সঙ্গীতশিক্ষার আসর’ এবং মহালয়ার ভোরের বিখ্যাত অনুষ্ঠান ‘মহিষাসুরমর্দিনী’। টানা প্রায় ৪৭ বছর একা তিনি সঙ্গীতশিক্ষার আসরের সঞ্চালনা ও পরিচালনা করেছেন। তখনও বাড়ির মেয়েদের বাইরে গিয়ে গান শেখার চল তেমন হয়নি, কিন্তু তাঁর অনুষ্ঠানের সূত্রে অজস্র নারী-পুরুষ উপকৃত হয়েছেন, তাঁদের কেউ কেউ আজ প্রথিতযশা শিল্পীও! পঙ্কজ মল্লিকই প্রথম ব্যক্তি যিনি রবীন্দ্রনাথের গানকে সমাজের সব স্তরে জনপ্রিয় করে তুলেছিলেন এবং সঙ্গীতশিক্ষার আসর ছিল তার অন্যতম মাধ্যম। ১৯৩১ থেকে ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ প্রচারিত হতে আরম্ভ করে, আজও তার জনপ্রিয়তায় বিন্দুমাত্র ভাটা পড়েনি। বাণীকুমারের সৃষ্ট এবং রচিত এই বীথিটি বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের স্তোত্রপাঠে সজ্জিত ও পঙ্কজ মল্লিকের সুরে অলঙ্কৃত। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের সম্পূর্ণ গ্রন্থনাটি তাঁর সুরে বাঁধা এমনকী, গোড়ার দিকের অনেক বছর সব ক’টি গানও তিনিই গাইতেন! কিন্তু সেই ভালবাসার গর্ভগৃহেই যে এক দিন চরম আঘাত পেতে হবে, কোনও কালে ভাবেননি। দীর্ঘ কাল ধরে চলে আসা তাঁর স্বপ্নের ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ হঠাৎ এক বার বন্ধ করে নতুন আকার দিয়ে সম্প্রচার করা হল। চিরপরিচিত পঙ্কজকুমার মল্লিক, বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র ও বাণীকুমারের মহালয়া নয়। ১৯৭৬ সালে অল ইন্ডিয়া রেডিও থেকে নতুন মহালয়ার অনুষ্ঠান সম্প্রচারিত হয়েছিল প্রথম ও শেষবারের মতো। আর এই নতুন সংস্করণটির সুররচনা ও সঙ্গীত পরিচালনা করেছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। ভাষ্যরচনা করেছিলেন গোবিন্দগোপাল মুখোপাধ্যায় ও পাঠ করেছিলেন উত্তমকুমার। অথচ এমনটা যে হবে, ঘুণাক্ষরে আগে থেকে জানতেন না তিনি। শ্রোতারা একেবারেই গ্রহণ করেননি মহালয়ার এই নতুন রূপ। যদিও শ্রোতার প্রবল দাবিতে পরের বছর থেকেই আকাশবাণী ফিরে যায় চিরাচরিত ‘মহিষাসুরমর্দিনী’তে। কিন্তু সেই আঘাতের ক্ষত তো রয়ে গেল বুকের পাঁজরে। আর একটা আঘাত পান ‘সঙ্গীত শিক্ষার আসর’থেকেও। বহু দশক ধরে শ্রোতাদের রেডিয়োর যে অনুষ্ঠানে প্রাণ ভ’রে গান শেখাতেন তিনি। সেই আসরে শেষ রবীন্দ্রসঙ্গীত শিখিয়েছিলেন ‘তোমার শেষ গানেরই রেশ নিয়ে যাও চলে’। তারপর মীরাবাঈ ভজন শেখাতে আরম্ভ করেছিলেন। এই সময় এক দিন পঙ্কজকুমারের বাসভবনের ঠিকানায় এল এক চিঠি, পত্রলেখক কলকাতা বেতার কেন্দ্রের তদানীন্তন স্টেশন ডিরেক্টর। এই জনপ্রিয় অনুষ্ঠানটির প্রচার বন্ধ করে দেওয়া হল। জীবনের প্রান্তবেলায় সন্তান হারানোর মতো এই আঘাতগুলো ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছিল গানসাধক প্রবীণ মানুষটিকে। তারপর ১৯৭৮ সালের ১৯ শে ফেব্রুয়ারি কলকাতায় এই কিংবদন্তি শিল্পীর মৃত্যু হয়।