ইলশেগুঁড়ি ২৯তম সংখ্যা (শারদীয়া)
ইলশেগুঁড়ি ২৯তম সংখ্যা (শারদীয়া)
ভুলটা কার, দেওয়ালের ফটোর নাকি আমার? মনে হল, আরেকবার ফাইনাল টেস্ট করি। আজ আবার ফটো দুটোর ছবি তুলব। মোবাইল-ক্যামেরা অন করে আজও ফটো দুটোর ছবি তুললাম।
আমার বদলির চাকরি। প্রথম দিকে ডায়েরিতে নোট রাখতাম, বছরে কবার অফিস পরিবর্তন হয়। ডায়েরির তালিকা ডজন পেরিয়ে যাওয়ার পর এখন আর লিখি না। চাকরির কারণে বহু অজানা-অচেনা জায়গা-পরিবেশ-প্রতিবেশে আমাকে যেতে হয়েছে, কিন্তু কোথাও গিয়ে তেমন বৈচিত্র্যময় ঘটনার সম্মুখীন হইনি। তবে এবার যেখানে আমার বদলি হলো, সেখানে একটা বেশ অদ্ভুত ঘটনা ঘটলো।
জীবনচাঞ্চল্যে ভরপুর এক নদীতীরবর্তী অঞ্চলে একটা অত্যন্ত সুন্দর পাবলিক-বাংলোবাড়িতে আমি উঠলাম।
সন্ধ্যায় বারান্দায় বসে আছি, সামনে কুয়াশার চাদরে মোড়া আলো-আঁধারি জঙ্গল। কানে আসছে নদীর জলের আওয়াজ। সে জলজ-আওয়াজে একটা ভৌতিক মাদকতা জড়িয়ে রয়েছে। তবে আমার মনে ওসব ভয়ডর জায়গা পায় না। ইচ্ছে হল, নদীর কাছে বসে মনের কথা কই। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের মতো—‘ও নদী রে, একটি কথা শুধাই শুধু তোমারে…’ এমন গানের কলি আওড়াই।
ভাবতে-ভাবতেই উঠে পড়লাম। গুটি গুটি পায়ে নদীর দিকে এগোতে থাকলাম। নদীর দিকে যত এগোই ততই বাতাসের গতিবেগ বাড়তে থাকে। মৃদুমন্দ বাতাসের মাঝে মাঝে হলকা বাতাস মুখ-নাক-চোখ-কপাল হয়ে আমার বাবরি চুলে বিলি কাটতে কাটতে পেছনে প্রস্থান করে।
নদীর ঘাটে পৌঁছতেই সেকি মনোমুগ্ধকর বাতাস, সঙ্গে জলের কলরব। নদীর তীরে ঘাটমতো জায়গায় বসে পড়লাম। সেদিন কোন তিথি ছিল, সেটা বলতে পারবো না। তবে অমাবস্যার ঘুটঘুটে অন্ধকার ছিল না। আকাশে চাঁদ না থাকলেও চারিদিকে একটা আলোর আভা ছিল, যাতে করে নদীর জল, তীরবর্তী অঞ্চলে লম্বা ঘাস ও গাছপালা চোখে আসছিল। আশপাশ জনপ্রাণীহীন, নির্জন বাতাসি পরিবেশ।
এমন পরিবেশে নদীর গানই তো কেবল মনে জাগবে—
ও নদী রে একটা কথা শুধাই শুধু তোমারে
—জীবননদীর ঘুর্ণিপাকে
আর কতকাল বাইবি খেয়া বল…
ছোটবেলায় পড়া সেই ছড়া—
-নদী নদী নদী/
সোজা যেতিস যদি…
এমন নানান গানের কলি, কবিতার লাইন উঁকি মারছে মনের আনাচে-কানাচে, জেগে উঠছে কণ্ঠে।
হঠাৎ মনে হল, শুকনো পাতার ওপর পা ফেলে খচমচ-খচমচ শব্দ করতে করতে কেউ আমার দিকে এগিয়ে আসছে। ক্ষণিকের জন্য মনে ভয় জাতীয় কিছু একটা খোঁচা মেরে উঠলেও পরক্ষণে সাহস সঞ্চয় করে বসে রইলাম। যেদিক থেকে শব্দটা আসছে, একদৃষ্টে সেদিকে তাকিয়ে রইলাম। আবছা অন্ধকার ভেদ করে একটা মনুষ্যমূর্তি চোখে ধরা দিতে লাগলো। ধীরে ধীরে মূর্তিটি আমার সামনাসামনি এসে দাঁড়ালো। তবে আবছা অন্ধকারে মূর্তিটা স্বাভাবিক মনে হলো না—মানুষ না জন্তু! অদ্ভুত রকমের মনে হল। আমি তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে তার মুখোমুখি তাকালাম। তাকাতেই সে শুধু বলল, “ফটো, ফটো, ফটো...” বলতে বলতে আবার আবছা আঁধারেই মিলিয়ে গেল।
দুই
কী ফটো, কিসের ফটো, কোথায় ফটো…? এসব কী বলে গেল, বিদঘুটে লোকটা! অন্ধকার ভেদ করে বেরোনো অদ্ভুত দর্শনের লোকটার মুখ থেকে এমন কথা শুনে সবকিছু কেমন গুলিয়ে যেতে লাগলো! নদীর পাশে বসে একটু সময় কাটিয়ে আনন্দ উপভোগ করার মনটাই মরে গেল! থ হয়ে কিছুক্ষণ বসে থেকে উঠে দাঁড়ালাম। ইতিমধ্যে সন্ধ্যা গড়িয়ে চারদিক ঘুটঘুটে অন্ধকারে ঢেকে গেল। অন্ধকার ঠেলে ঠেলে ধীরপায়ে বাংলোর দিকে এগোচ্ছি। মাথাটা ভীষণ ভার হয়ে আছে। ‘ফটো, ফটো, ফটো…’ এই তিন শব্দ-রহস্য মাথায় ভর করে আছে। বাংলোতে ঢুকে খাটে বসার পর আমি নদীর পাড় থেকে কিভাবে যে এলাম, সেটাই মনে করতে পারছি না! বিদঘুটে একটা মায়াবী রহস্য মনটাকে আবিষ্ট করে নিয়েছে!
তিন
বাংলোতে ঢোকার মিনিট দশেকের মধ্যে একজন হাট্টাগোট্টা, মাঝবয়সী লোক এসে আমাকে বলল, “স্যর, এখানকার কেয়ারটেকার ছুটিতে আছে। দু-চারদিনের মধ্যে এসে পড়বে খন। এই কটা-দিন কষ্টেসৃষ্টে চালিয়ে নিন। একা থাকতে কোনো অসুবিধে হবে না। এখানে ভূত-প্রেতের ভয় নেই। ঘরদোর নিজের মতো করে গুছিয়ে নিন। এখানে অল্প পয়সায় কাজের লোকও মিলে যাবে, যদি আপনার প্রয়োজন হয়।” বলতে বলতে সেই লোক চলে গেল।
এখানে ‘ভূত-প্রেতের ভয় নেই’ কথাটা শুনেই মাথার মধ্যে যেন ঝিলিক মেরে উঠলো! সবকিছু ‘ফটো, ফটো, ফটো’তেই তালগোল পাকিয়ে যেতে লাগলো!
উঠে দাঁড়িয়ে বেডরুমে ঢুকে লাইটগুলো জ্বালালাম। এবারে ড্রয়িংরুমের লাইটগুলো জ্বালিয়ে সোফাটায় এসে বসলাম। মাথা তুলে তাকাতেই দেখলাম, সামনাসামনি দেওয়ালে পাশাপাশি দুটো ঢাউশ ফটোফ্রেম সাঁটা। বাঁ-দিকে রবীন্দ্রনাথ, ডানদিকে হেমন্ত। দেখে মনপ্রাণ জুড়িয়ে গেল। মনে জেগে উঠল সেই গান, ‘ও নদী রে…’। গুনগুন করতে করতে ব্যাগ থেকে ম্যাগাজিন বের করে চোখ বোলাতে লাগলাম…
দেখতে দেখতে রাত নটা। কিছুই ভালো লাগছে না। কিছু খেতে ইচ্ছে করছে না! আবার রাতে না খেয়ে থাকা, স্বাস্থ্যের পক্ষে ভীষণ ক্ষতিকর। সে বিষয়ে আমি খুব সচেতন। স্বাস্থ্যের ক্ষতি হয় সজ্ঞানে সেসব কর্ম থেকে আমি বিরত থাকি। বলতে হয়, সর্বদা বিরত থাকার চেষ্টা করি।
সর্বোপরি, যখন থেকে—Eat your food as your medicines, otherwise you have to eat medicines as your food... স্বাস্থ্য বিষয়ক এমন গুরুত্বপূর্ণ ইংরেজি বাক্যবন্ধ আমি পড়েছি তখন থেকেই আমি খাবার ব্যাপারে ভীষণ খুঁতখুঁতে এবং স্বাস্থ্যসচেতন হয়ে পড়েছি।
তাই অনিচ্ছা সত্ত্বেও উঠে আলুসেদ্ধ-ভাত চাপিয়ে দিলাম। সারাদিন অনেকটা ধকল গেছে। এবারের বদলিটা এত দূরে হবে এবং বেসরকারি বনবাংলোতে ভাড়া থেকে চাকরি করতে হবে কোনোদিন ভাবিনি।
যাইহোক, আলুসেদ্ধ-ভাত নামিয়ে কাঁচালঙ্কা-পেঁয়াজ দিয়ে সঙ্গে কয়েক ফোঁটা সর্ষের তেল নিয়ে খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়লাম।
সকাল-সকাল ঘুম ভাঙল। দু-বার হাই তুলে ড্রয়িংরুমের সোফায় গিয়ে বসলাম। চোখ পড়ল, রবীন্দ্র-হেমন্তের ফটো-ফ্রেমের ওপর। ফটোর ওপর ঢুলু ঢুলু দৃষ্টি যেন ফেবিকুইকের মতো আটকে গেল। হেমন্ত বাঁ-দিকে, রবীন্দ্রনাথ ডানদিকে!! এমন ভাবতে ভাবতে আমাকে একটা ধাঁধায় পেয়ে বসলো। ফটো দুটোর আজকের অবস্থান থেকে একটা রহস্যের গন্ধ আসতে লাগলো! ফটো দুটো গতকাল কি এই অবস্থায় ছিল, নাকি একটু অন্যরকম অবস্থায় ছিল! রবীন্দ্রনাথ বাঁ-দিকে হেমন্ত ডানদিকে ছিল, আমার পরিষ্কার মনে আছে। বেশ ধন্দে পড়ে গেলাম! তবুও মাথা ঝাড়া দিয়ে সঠিকটা মনে করার চেষ্টা করলাম…
আবছা হলেও মনে জাগছে, গতকাল তো রবীন্দ্রনাথ বাঁ-দিকে আর হেমন্ত ডা-ডি ডানদিকে… নাহ, সব কেমন গুলিয়ে যাচ্ছে। মোবাইলে ছবি তুললাম। হ্যাঁ, হেমন্ত বাঁ-দিকে, রবীন্দ্রনাথ ডানদিকে। ভাবলাম, বেশি চিন্তা না করে কাল সকাল অবধি দেখি।
চার
সারাদিন আমার মন পড়ে রইলো, দেওয়ালের ফটো দুটোতে। দুপুরে-বিকেলে-সন্ধ্যায় দেখলাম, যেমন তেমনই। হেমন্ত বাঁ-দিকেই। তাহলে আমারই দৃষ্টিভ্রম হয়েছিল হয়তো। যাকগে, কাল সকালে তো আর ভুলটা হবে না। মোবাইলে ছবি তো থাকলো…
ফটোচিন্তায় সারারাত বলতে গেলে ঘুমই হয়নি। ভোররাতের দিকে একটু ঘুম ধরেছিল, তবে নির্দিষ্ট সময়ের আগেই ঘুমটা ভেঙে গেল, ফটোদুটো দেখার আকর্ষণেই হয়তো!
চোখেমুখে জল দিয়ে সোফায় বসে সিধা ফটোর দিকে তাকালাম—কী সব্বোনাশ! আজ আবার রবীন্দ্রনাথ বাঁ-দিকে। মোবাইলের ছবি মিলিয়ে দেখলাম, গতকাল রবীন্দ্রনাথ ডানদিকে ছিল। ফটো দুটো ধরে নাড়াচাড়া করার চেষ্টা করলাম। নাহ, নড়ছে না। দেওয়ালের সঙ্গে দুটো ফটোবক্স ফিট করা। তাহলে ফটো কী করে ডাইনে-বাঁয়ে করছে? মাথায় ঢুকছে না!
এবারে আমি নিজেই চিন্তায় পড়ে গেলাম। ভুলটা কার, দেওয়ালের ফটোর নাকি আমার? মনে হল, আরেকবার ফাইনাল টেস্ট করি। আজ আবার ফটো দুটোর ছবি তুলব।
মোবাইল-ক্যামেরা অন করে আজও ফটো দুটোর ছবি তুললাম। তারপর ভালো করে দেখে নিলাম, হেমন্ত বামদিকেই আছে। আগামীকাল সকাল পর্যন্ত আবারও অপেক্ষা।
সেদিনের রাতটা বলতে গেলে না-ঘুমিয়েই কাটিয়ে দিলাম! সকাল ছয়টা বাজতেই বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লাম। সোজা ওয়াশিংরুমে গিয়ে ভালো করে চোখেমুখে জল দিয়ে গামছা দিয়ে চোখমুখ ভালো করে মুছে ফটোর সামনে সোফায় বসলাম। এবার ধীরে ধীরে চোখ তুলে শান্ত ভাবে ফটোর দিকে তাকালাম। নাহ, হেমন্ত ডানদিকে, রবীন্দ্রনাথ বামদিকেই! এমতাবস্থায় কি মাথার ঠিক রাখা সম্ভব? নিজেকে অসুস্থ বোধ হতে লাগলো। মোবাইল খুললাম। শেষবারের মতো মোবাইলের ছবির সঙ্গে দেওয়ালের ফটো মিলিয়ে দেখলাম। সব এলোমেলো-উল্টোপাল্টা!
পাঁচ
চতুর্থ দিনের-দিন বাংলো-মালিক এলেন। আমি ওঁকে সোফায় বসতে বলে আড়াল থেকে ফলো করলাম। উনি বার-বার ফটোদুটোর দিকে দৃষ্টি ফেলতে লাগলেন। আমি সামনে আসতেই এ কথা-সে কথার মাঝে জিগ্যেস করলেন, “ফটো দুটো কেমন বলুন?”
“বিন্দাস।”
“একা একা ভয়টয় লাগছে নাতো?”
“না।”
“ভাববেন না, কেয়ারটেকার শীঘ্রই এসে পড়বে খন।” বলে উঠে পড়লেন।
ছয়
বাংলো-মালিক চলে যাবার পর আমি বাইরে বেরিয়ে দেখলাম, ফটো-দেওয়ালের পেছনের দিকটায়ও ঘর। দরজায় তালা। কী করা যায়, ভেবে পাচ্ছি না…!
শেষমেষ ভেবেচিন্তে আমার এক পুলিশবন্ধুকে ফোন করলাম। কাছেই পোস্টিং। বিস্তারিত শুনে বলল, “আমি শুনেছি, এখানে একটা ভূতুড়ে-বাংলো আছে। সে বাংলোয় বিশ/ত্রিশ দিনের বেশি কেউ থাকতে পারে না। ছয়মাসের ভাড়া অ্যাডভান্স দিয়েও ভূতের ভয়ে ছেড়ে চলে যায়। মালিক এডভান্সের টাকা ফেরত দেয় না। সে আবার নতুন ভাড়াটিয়া বসায়। মনে হচ্ছে এটাই সেই বাংলো। তুই এক কাজ কর, যে করেই হোক ফটো-দেওয়ালের পেছনে যে ঘরটা, ওই ঘরে ঢুকে দেখার চেষ্টা কর, দেওয়ালের পেছনটায় কী আছে। কিভাবে কী করবি, সেটা তোর ব্যাপার। বুদ্ধি কাজে লাগা সব সামনে এসে পড়বে।”
বন্ধুর পরামর্শে একই মডেলের আরেকটা তালা কিনে আনলাম। তারপর ঘরটির তালা ভেঙে ঢুকে দেখি, আমার ড্রয়িংরুমের উল্টো দিকের দেওয়ালের পেছনে দেওয়াল-আলমারিতে থরে থরে বই। একটা-একটা করে বই সরাতেই রবীন্দ্র-হেমন্তের ফটোর ব্যাকসাইড। তার মানে প্রতিদিন রাতে কেউ এসে তালাবন্ধ এই ঘরের তালা খুলে ফটোফ্রেমের ভেতর থেকে ফটো অদল-বদল করে রাখে, বাংলোটাকে ভৌতিক প্রতিপন্ন করার জন্য। যাতে ভাড়াটিয়া ভয় পেয়ে টাকার মায়া না করে প্রাণ বাঁচিয়ে বাড়ি ছেড়ে পালায়। মালিক আবার নতুন ভাড়াটিয়া বসায়।
সাত
বাবা! এখন বুঝতে পারছি, সন্তান যতই বাবার প্রতি খারাপ ব্যবহার করুক না কেন, বাবা সে সব কিছুই মনে রাখে না। সব ভুলে যায়। বাবা সব সময়ই চায় তার সন্তানেরা ভালো থাক। দুধে-ভাতে থাক।
আজ সে সব দিনের কথা খুব মনে পড়ছে—অফিস থেকে বাড়ি ফিরলেই বাবার বিরুদ্ধে বউয়ের সারা রাজ্যের অভিযোগ—‘‘তোমার বাবা এটা করেছে-সেটা করেছে। তোমার বাবার অত্যাচারে আমি অতিষ্ট। আমি আর সহ্য করতে পারছি না। তুমি এর একটা বিহিত করো। সারাদিনে এত ফাইফরমাশ, আমি আর পারি না। আমি তো তোমার বউ না, যেন বাড়ির কাজের লোক। তোমার বাবার দেখাশোনার ব্যবস্থা করো, না হলে আমি এ বাড়ি ছেড়ে চলে যাব বলে দিচ্ছি। যাব মানে যাবই।”
“তুমি এভাবে বলছ কেন? তোমার নিজের বাবা-মা হলেও তো করতে হতো নাকি?” সে কথা বলতেই বউ রীতিমতো মুখঝামটা দিয়ে তিরিক্ষি মেজাজে বলে উঠতো, “ওসব আদিখ্যেতার কথা ছাড়ো। দুদিনের মধ্যে ওই বুড়োটাকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসবা। ওখানে কিছু টাকাপয়সা দিলে ভালো চিকিৎসা হবে। আরামে থাকতে পারবে। এই শেষবারের মতো আমি বলে দিলাম, ঘাটের মরাকে বিদেয় করবই।”
বাবার প্রতি বউয়ের এমন জঘন্য, কুরুচিকর, অপমানসূচক ভাষার প্রয়োগে আমার রাগ চরমে ওঠে। ভেতরের পৌরুষ, সঙ্গে চণ্ডাল পশুটাকে জাগিয়ে তুলে মারমুখী হয়েও পরক্ষণে নিজেকে কোনো জাদুমন্ত্রে সামলে নি। কিভাবে নিজেকে সামলে নি, কেন সামলে নি, সেটা হয়তো বলতে পারবো না…
সংসারে একটু শান্তির জন্য বউয়ের পরামর্শমতো অসুস্থ বাবাকে পাষণ্ড-অমানুষের মতো বৃদ্ধাশ্রমে রেখে এসেছিলাম। সেই বাবা আমাকে বিপদের হাত থেকে বাঁচাতে মৃত্যুর পরেও নদীর পাড়ে ফটোর ইঙ্গিত দিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল!
আজ নিজেকে বড্ড অপরাধী মনে হচ্ছে! বউয়ের পরামর্শে অসুস্থ বাবাকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে এসে সেদিন আমি যে ভুল করেছি, তার প্রায়শ্চিত্ত কিছুতেই হয় না। যে বাবা মাথার ছাতা হয়ে বুকে আগলে সন্তানকে মানুষ করে তোলে, সেই বাবাকে নিজের সামান্য সুখের জন্য বিবেক-মানবতা-মনুষ্যত্ব সব বিসর্জন দিয়ে প্রতিষ্ঠিত ছেলেরা সামান্য কারণে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসছে। আমিও রেখে এসেছিলাম। আমি যে কী চরম ভুল করেছি, সে ভুলের জন্য আমি মরেও শান্তি পাব না! বাবা, “তুমি যেখানেই থাকো, এই অবুঝ সন্তানকে ক্ষমা করে দিও। সন্তান যতই বড় হোক, সে তার বাবা-মা’র কাছে অবুঝ শিশু, সেই ভেবে ক্ষমা করে দিও বাবা…” বাবার বিদেহী আত্মার উদ্দেশ্যে এটুকু বলে নিজেকে সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করলাম।
আট
পুলিশবন্ধুর পরামর্শমতো এগিয়ে ফটোরহস্য সামনে চলে আসার পর তাকে ফোন করলাম। ফোনেই ফটোরহস্যের সমাধানের কথা বললাম। পুলিশবন্ধু বলল, “অপেক্ষা কর। আমি এখনই ফোর্স নিয়ে যাচ্ছি। অল্প সময়ের মধ্যে বাংলোর সামনে পুলিশের গাড়ি এসে দাঁড়ালো। আমার পুলিশবন্ধুসহ ৫-৬ জনের পুলিশের টিম গাড়ি থেকে নেমে সোজা বাংলোতে ঢুকে পড়ল। বাংলো-মালিকও কিছু না বুঝেই আমার ফোন পেয়ে হাজির।
পুলিশবন্ধু বাংলোর মালিককে হাতকড়া পরিয়ে নিয়ে যেতে যেতে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “তুই বিজ্ঞানের ছাত্র হয়েও গোয়েন্দাগিরিতে কম যাস না।”