ইলশেগুঁড়ি ২৯তম সংখ্যা (শারদীয়া)
ইলশেগুঁড়ি ২৯তম সংখ্যা (শারদীয়া)
(পর্ব ১)
সাহিত্য পরিবারের কাজে এবং কিছুটা শখের তাগিদেও মাঝে মাঝেই যেতে হয় রূপসী বাংলার নানা প্রান্তে। চোখে পড়ে সোনার বাংলার নানা রূপ। সেই ছোট ছোট ভ্রমণেরই কিছু কথা এই লেখায়।
তিন সম্পাদক বন্ধু ও এক শিল্পীকে নিয়ে শিয়ালদহ থেকে লালগোলাতে উঠলাম সকাল ৮টায়, বহরমপুর স্টেশনে নেমেই দেখি প্রবীর হাসিমুখে, সঙ্গে অফিসের গাড়ি। প্রবীর আমার ভায়রাভাই, কর্মসূত্রে বহরমপুরে থাকে। ওর গাড়িতেই আমরা সোজা ঋত্বিক সদন, যেখানে আজ থেকে শুরু হল মুর্শিদাবাদ জেলা লিটল ম্যাগাজিন মেলা৷ ঠিক দুপুর বারোটায় কলিকাতা লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরি ও গবেষণাকেন্দ্রের কর্ণধার আমাদের প্রিয় শ্রী সন্দীপ দত্তের হাতে উদ্বোধন হল এই মেলার। যাই হোক, মেলা শুরুর পর আমাদের স্টলে বসলাম৷ ধীরে ধীরে পাঠকবন্ধুরও আসতে শুরু করলেন। পাশেই পেলাম ভাতৃপ্রতিম নির্মলেন্দুর পদক্ষেপ পত্রিকাকে। ফলে শুরু হল আড্ডা৷ টুকটাক পাঠক খোঁজখবর নিচ্ছেন৷ এরপর একে একে টেবিলে এসে বসলেন সন্দীপদা সহ অন্যান্য বন্ধুরা। প্রবীর তো সঙ্গে আছেই।
মূল মঞ্চ থেকে ভেসে আসছে আলোচনা, কবিতাপাঠ ও সঙ্গীতের মূর্চ্ছনা ৷ খুবই সুন্দর আয়োজন। নৈশ আহারেরও সুন্দর আয়োজন। তবে আমরা পাততাড়ি গুটিয়ে প্রবীরের আস্তানায়। প্রবীরের বন্ধুবৎসল বাড়িওয়ালা কানু মাইতি আর ওনার পরিবারের আতিথ্যে নৈশাহার সেরে সুন্দর শয্যায় তলিয়ে গেলাম ঘুমের দেশে।
পরদিন ঘুম ভাঙল ভোর পাঁচটায়। এঁরা ভোরে ওঠেন এবং প্রাতঃভ্রমনে যান। সকাল ছটাতেই ধূমায়িত চা পান এবং তারপরই বেরিয়ে পড়া।
সুন্দর সকালে হালকা শীতের আমেজ। টানা পিচের রাস্তা। মাঝে মাঝে মসজিদ এবং মন্দির। জায়গাটা উত্তরপাড়া। এলাম বাজারে। ছোট বাজার, হরেক রকমের টাটকা সব্জী। কানুদা দেশী ফুলকপি, টাটকা শীষ পালং, বেগুন সহ কিছু সবজী নিলেন। বিক্রেতা মাসীকে ধমক দিলেন এত দাম কেন? হেসে দুমুঠো শিম দিয়ে মুর্শিদাবাদী বাচনভঙ্গীতে মাসি বলল এটা মাগনা দিলাম যাও তো! কানুদা, ‘বড্ড জ্বালাস’ বলে সোজা মাছের বাজারে। এ বাজারও ছোট, কিন্তু মাছ খুব টাটকা। কাঁকড়া এবং গুগলিও আছে।
বাজার সেরে চায়ের দোকান। বেশ বড় দোকানে এল ই ডি বড় টিভি, ফ্রিজও বেশ বড়। হাসিমুখে কিশোর দোকানি এখানকার গরম লিকার চা সাথে খাস্তা দিলো। এই দোকানে প্রশস্ত বসার জায়গা, এলাকার প্রভাবশালী মানুষদের আড্ডার জায়গা। জানলাম কিশোর দোকানির হাসিমুখ আর মধুর ব্যবহার দোকানের মূলধন।
বাড়িতে এসে জলখাবারের পর স্নান সেরে আমি প্রবীর বেরিয়ে পড়লাম। আজ মেলা কমিটির ওখানেই খাবো আমরা, মাইতি দম্পতি না খাইয়ে ছাড়তে নারাজ, শেষে রাত্রে ওঁদের কাছে খাবো জানিয়ে শান্তি।
আবার বেড়াতে যাওয়া। এবার সোজা নদীর তীর। তীরে বিশাল বটগাছে এক মা হনুমান বাচ্ছাকে খাওয়াচ্ছে। পাশে বিশাল মাকালী মন্দির। ডানদিকে মসজিদ। আমরা নৌকাতে ওপারে যাব বহরমপুরে, এই ঘাটের নাম রাধারঘাট। টিকিট কাটা হল মাত্র ৫ টাকা। জেটিতে গিয়ে দেখি পুরোটাই বাঁশের। আড়াআড়ি পাতা বাঁশের উপর দিয়ে প্রচুর মানুষ নৌকার দিকে। নৌকার পাটাতনও বাঁশের, পুরো খোলা বিশাল নৌকা, গোটা টোটো গাড়ী উঠে গেল। আর কত মানুষ। কিন্তু স্থির দাঁড়িয়ে থেকে সবাই ওপারে পৌঁছে গেলাম।
নৌকা থেকে আবার বাঁশের জেটি দিয়ে নামলাম এপারে। লোকমুখে জানলাম নদীটি ভাগীরথী, কিন্তু ওপারে নদীটি গঙ্গা। শুভকাজে মানুষ ওপারের গঙ্গাজল সংগ্রহ করেন, এপারের জল তো ভাগীরথীর। দুই নদীর মিশ্রিত জলের এ কাহিনীর সত্যতা জানি না।
এবার কলেজ, ঋত্বিক সদন যা নাকি এখানকার নন্দন বলে পরিচিত, বিশাল বিশাল মাঠে নানা মেলা, সোজা রাস্তা লালবাগের দিকে, বেশ কয়েকটি বড় বাজার, স্কোয়ার ফিল্ড, টেক্সটাইল কলেজ ইত্যাদি দেখে এক মিঠাই দোকানে। এরা খুব নামী, আহারে বাংলার মেডেল পাওয়া। খেলাম এখানকার বিখ্যাত তুলসী রসগোল্লা, ছানবড়া, কদম। অপূর্ব স্বাদ। এরপর আবার মেলা প্রাঙ্গণ।
বেশ ভিড় আজ রোববার, মুর্শিদাবাদ জেলা লিটল ম্যাগাজিন মেলার অন্তিম দিন৷ প্রত্যাশামতোই দুপুর ১২টায় শুরু হল অনুষ্ঠান৷ প্রথম দিনই জেলার কয়েকজন স্বনামখ্যাত চিত্রশিল্পী এঁকেছিলেন কিছু ছবি৷ মানুষ যে শিল্প ভালোবাসেন তা বোঝা গেল যখন দেখলাম ছবিগুলোর বেশিরভাগেরই গায়ে স্টিকার সাঁটা ‘সোল্ড’। আমাদের স্টলে জেলার বহু মানুষ এসে আলাপ করলেন, সংগ্রহ করলেন ইলশেগুঁড়ি। ইলশেগুঁড়ি সন্দীপ দত্ত সংখ্যা আর অকালপ্রয়াত বন্ধু সৃজনের (গণেশ) ‘‘মেঘের মুলুক’’ চাহিদার শীর্ষে। শুধু একটাই খেদ, একা আসার দরুন অল্প বই এনেছিলাম, যা আমার পক্ষে বহনযোগ্য। শারদ সংখ্যার অপ্রতুলতা কাউকে কাউকে ফেরাতেও হল, তাঁদের পরে পাঠাব জানালাম।
মেলার মূল মঞ্চে আজ ছিল জমজমাট অনুষ্ঠান৷ গিটার, রবীন্দ্রসংগীত, শাস্ত্রীয় সংগীত। বিতর্ক, সেমিনার, গল্প কবিতাপাঠ। আমার সাম্প্রতিক কবিতা ‘চূড়ান্ত গন্তব্য-৩’ মঞ্চে পাঠ করবার পর বেশ কয়েকজন এসে জানালেন খুব ভাল লেগেছে। এটাই প্রাপ্তি।
মতিউল, নির্মলেন্দুর পাশাপাশি বেশ কিছু বন্ধু টেবিলে এলেন। ওদের সঙ্গে জমিয়ে আড্ডা।
এর মধ্যেই প্রবীরের সঙ্গে খাবার টেবিলে। দারুন আয়োজন। গরম ভাত, ডাল, বাদাম আলুভাজা, পটল ফুলকপি সবজী, মাছের ঝাল, চাটনী আর শেষপাতে এখানকার অসাধারণ রসগোল্লা।
এদিকে মঞ্চে চলছে সানাই, গিটারে কিছু পরিচিত গান, সরোদ বাদন। একদম শেষে মার্গ সঙ্গীত মন ভরিয়ে দিল।
সবথেকে মনে দাগ কাটল মুর্শিদাবাদ জেলার গ্রামীণ বধূ ইলশেগুঁড়ি সংগ্রহ করলেন, দিয়ে গেলেন হাতে লেখা কবিতা। আর জেলার অচেনা বন্ধু স্টল খুঁজে এসে হাত বাড়িয়ে বললেনঁ— আপনি ইলশেগুঁড়ি পত্রিকার মলয়বাবু?
পাততাড়ি গুটাবার পালা। ফেস্টুন খুলল প্রবীর, সামান্যই পড়ে থাকা বই গুছোলাম, মেলা কমিটির কর্তারা জড়িয়ে ধরলেন, আসতে বললেন আবার। বিভিন্ন কবি বন্ধুদের বিদায় জানালাম। সন্দীপদার কাছেও বিদায় নিলাম। বিশাল ক্যানভাসে লিখলাম আমার কবিতার দুটো লাইন—
‘‘ফুল ছেঁড়া বড় নয়
গাছ পোঁতা বড় কাজ
বাড়িয়েছি আমি হাত
তুমি এসে ধর আজ।’’
মন্তব্য খাতায় ধন্যবাদ দিলাম সবাইকে।
আমার মতে মুর্শিদাবাদ জেলা লিটল ম্যাগাজিন মেলা সফল। যদি আসছে বছর আবার আসতে পারি খুশী হব।
আজ সোমবার বাড়ী ফিরছি মালদা ইন্টারসিটিতে। এক কিশোরী ভিখারিনী না না মানবী ঝাড়ু হাতে সাফাই করলেন সফরক্লান্ত আবর্জনা ভরা কামরাটিকে। আমরা তার কৌটোতে দু এক টাকা দিয়ে পা তুলে বসলাম।
সাঁতরাগাছি স্টেশন পৌছালাম ঠিক দেড়টায়। বই এবং জামাকাপড় একটা ব্যাগে নেওয়ায় ব্যাগটা কিঞ্চিত ভারি। ছেলের বাইকই অগতা ভরসা। রাজকুমারও দেখলাম ঠিক সময়েই এসে উপস্থিত। ট্রেনে নয় আমরা এবার যাবো বাসে। গন্তব্য বর্ধমান টাউন হল।
খুলেই বলি পরিপ্রেক্ষিতটা। আসলে প্রতিবছরের মধ্যে এ বছরও আমরা যাচ্ছি বর্ধমান লিটল ম্যাগাজিন মেলায়। প্রতিবছরের সঙ্গে এ বছরের তফাৎ একটাই, এই বছর রাত্রিবাস আজাপুরে শ্বশুরালয়ের বদলে মেলা কমিটির আয়োজিত গেস্ট হাউসে। দূরপাল্লার বাস পরিচিত পথ দুর্গাপুর এক্সপ্রেস ধরে এগিয়ে চলল মসৃণ গতিতে। সাড়ে চারটে নাগাদ আমরা পৌঁছে গেলাম টাউন হলে মেলা প্রাঙ্গণে।
মেলার সুসজ্জিত তোরণ পেরিয়ে ভিতরে ঢুকতেই মুক্ত মঞ্চ থেকে ভেসে এলো প্রারম্ভিক অনুষ্ঠানের আওয়াজ। মেলা কমিটির সম্পাদক বন্ধুবৎসল সুকান্তবাবু যথারীতি একমুখ হেসে এগিয়ে এসে আমাদের অভ্যর্থনা জানালেন। মেলার অফিসে লটারির কৌটা থেকে টিকিট তুললাম। মঞ্চের ডান দিকে ইলশেগুঁড়ি স্টল আর মঞ্চের বাঁদিকে পড়ল আমাদের পদক্ষেপ।
প্রথমেই যথারীতি টেবিল সাজিয়ে আমরা বসে পড়লামনিজের টেবিলে। এরপর বিভিন্ন টেবিল থেকে পরিচিত মুখ বন্ধু সম্পাদকরা এগিয়ে এসে অভ্যর্থনা জানিয়ে আড্ডায় মেতে গেল।
প্রথম দিন ভিড় অনেকটাই কম। তবুও কয়েকজন এলেন এবং মূলত ইলশেগুঁড়ি ‘সাইকেল’ সংখ্যাটি সংগ্রহ করলেন। রাজকুমারের কাছ থেকেও আমাদের পদক্ষেপ পত্রিকার ‘মানভূম’ সংগ্রহ করলেন পাঠক। এরপর খানিকটা আড্ডার মেজাজেই আমরা মেলাটা ঘুরে দেখলাম। মঞ্চে তখন সুকান্তবাবু কিছু বলছেন। পাশাপাশি দেখতে পাচ্ছি প্রতাপবাবু, ইন্দ্রনীল বকশি সহ অন্যান্য আয়োজকদের।
টাউনহলের বিস্তীর্ণ প্রাঙ্গণ কংক্রিটে বাঁধানো ফলতঃ ধুলোর কোন জায়গা নেই। প্রাঙ্গণের চারদিকে স্টলগুলি সাজানো মধ্যিখানটা ফাঁকা। একদম মাঝখানে কিছুটা জায়গা নিয়ে চিত্র প্রদর্শনী এবং শিল্পীদের লাইভ পেইন্টিং এর আসর। এখানেই একটা সুন্দর প্রচেষ্টা স্কুল-কলেজের তরুণ ছাত্র-ছাত্রীদের লেখায় সাজানো দেওয়াল পত্রিকা যার নাম ক্যাম্পাস থেk।
মেলা মঞ্চের ঠিক উল্টোদিকে দুষ্প্রাপ্য পত্রপত্রিকার একটি মনোজ্ঞ প্রদর্শনীর আয়োজন করেছেন এরা। এখানে গিয়ে বহু পুরনো বাংলা পত্রপত্রিকাগুলি সংরক্ষিত আছে দেখে এলাম।
দেখতে দেখতে রাত্রি সাড়ে সাতটা পেরিয়ে গেল। মঞ্চে মাঝে মাঝে কবিতা পাঠের আসর। প্রিন্ট অন ডিমান্ড এসে বাংলা লিটল ম্যাগাজিন এর ক্ষতি করছে না লাভ করছে এই বিষয়ে একটি ছোট্ট সেমিনার হয়ে গেল। আমাদের প্রিয় ধ্যানবিন্দুর অভিক সেমিনারের উপসংহার টানলেন এভাবে—বিষয়টা প্রিন্ট অন ডিমান্ড নয়, বিষয়টা কেন বাংলা বই বা লিটল ম্যাগাজিনকে আজ পাঁচশোর বদলে পঞ্চাশ কপি ছাপতে হচ্ছে। কেনই বা তরুন প্রজন্মকে দেখতে পাচ্ছি না মেলা প্রাঙ্গণে।
এর মধ্যেই হঠাৎ মেলায় উপস্থিত শুভেন্দু মাইতি। অসুস্থ শরীরেও তাঁর জাদু মাখা কন্ঠে উপহার দিলেন একটি গান। এরপর স্থানীয় একটি মেয়ে খুব মিষ্টি কন্ঠে দু একটি বাংলা আধুনিক গান গেয়ে আজকের মত মেলার সমাপ্তি ঘোষণা করল।
এরপর আমাদের গন্তব্য গেস্ট হাউস। যথারীতি প্রায় ৮-১০ জন পত্রিকার সম্পাদক যার মধ্যে তরুণদের সংখ্যাই ভারী তারা সবাই জড়ো হলাম এক জায়গায়। এবং সবাই মিলে হাঁটতে হাটতেই মাঝরাতের বর্ধমান শহরের রাস্তা ধরে এগিয়ে চললাম কার্জন গেট পেরিয়ে খোসবাগানের দিকে। এখানে আমি আগেই এসেছি। রাজকুমারকে দেখাচ্ছিলাম এখানে দু’পাশে শুধুই ডাক্তারদের চেম্বার ডায়াগনস্টিক সেন্টার অথবা বিভিন্ন ধরনের চিকিৎসা কেন্দ্রের সমাহার। এখানে একটি নার্সিংহোমের পাশের গলিতে গেস্ট হাউসে আমাদের থাকার ব্যবস্থা।
রাত্রি প্রায় দশটা। দশটাতে গেস্ট হাউস বন্ধ হয়ে যাবে। তাই আগে আমরা আমাদের খাওয়ার জন্য নির্ধারিত হোটেলে রাধাকৃষ্ণতে চলে এলাম। আমরা সম্পাদকদের গোটা দলটা হোটেলের সবকটি টেবিল দখল করে নিলাম। হাতে গরম রুটি, সবজি আর ডিমের ওমলেট দিয়ে সারা হলো রাত্রের ডিনার। এবং গেস্ট হাউসে ঢোকার মুখে মিষ্টির দোকানটিতে বর্ধমানের গরম গরম রসগোল্লা।
আমরা যে গেস্টহাউসটিতে উঠলাম তার নাম খোসবাগান গেস্ট হাউস। প্রায় প্রত্যেকেই তিনজন পাঁচজন করে বিভিন্ন রুমগুলিতে চলে গেল। বাংলাদেশ থেকে এখনই এলেন এক ভদ্রলোক পত্রিকা নিয়ে, তাঁর জন্য একটি রুম বরাদ্দ হলো। কিন্তু শেষ পর্যন্ত দেখা গেল আমি আর রাজকুমার রইলাম রিসেপশনে, আমাদের রুমটা গায়েব। হোটেল কর্তৃপক্ষের টালবাহানাকে এক কথায় উড়িয়ে দিলেন মেলা সম্পাদক সুকান্তবাবু ও আমাদের আবাসনের ব্যবস্থার দায়িত্বে থাকা ইন্দ্রনীলবাবু। ওদের চটজলদি হস্তক্ষেপে আমরা একটি আলাদা রুম পেয়ে গেলাম অ্যাটাচ বাথরুম সহ। একেই বলে সব ভালো যার শেষ ভালো।
সুকান্তবাবু ইন্দ্রনীলবাবুর এতটুকুও বিশ্রাম হয়নি সারাদিন। ওরা আমাদের প্রত্যেককে থাকার ব্যবস্থা করে তবেই বিদায় নিলেন।
পরদিন সকাল সকাল ঘুম ভেঙে গেল। রাজকুমারকে ডেকে তুললাম। ততক্ষণে গেস্টহাউস সরগরম। আমরা নিচে গিয়ে সকালের মৃদু হাওয়া গায়ে মেখে সামান্য এগিয়ে দেখি, এক চায়ের দোকানে বেশ ভীড় আর আড্ডা। ওখানে বসেই গরম গরম চা আর বিস্কুট। অনান্য সম্পাদক বন্ধুরাও এসে গেছেন। বেশ কিছুক্ষণ আড্ডার পর আমরা উঠলাম।
গেস্ট হাউসে যেতেই দেখি সুকান্তবাবু, বললেন চলুন জলখাবার খেয়ে নেবেন। সবাই মিলে আবার নীচে একটি দোকানে গরম লুচি আর সবজী, একটা করে মিষ্টি। এরপর আমরা পাঁচ ছয় জন গেলাম জেলার বিখ্যাত শিল্পী-সুরকার সাংস্কৃতিক কর্মী মানবের বাড়ি। ওর বাড়ির সংগ্রহশালা দেখে আর বইয়ের সংগ্রহ দেখে আমরা যারপরনাই মুগ্ধ হয়ে গেলাম। মানবদের উদ্যোগে প্রতি লক্ষীপুজোর পরদিন ওরা আয়োজন করে কবি লেখক সাংস্কৃতিক কর্মীদের এক মিলন উৎসবের। আমাদের এখন থেকেই আমণ্ত্রণ জানিয়ে বললেন, এখানে কাউকে আলাদা করে আর নিমন্ত্রণ করা হয় না। ওই বাড়ির সবাই খুবই আন্তরিক। সারাদিনই মানুষের আনাগোনা লেগেই থাকে। আমাদের বাড়ি ছোটবেলার বন্ধু সমাগমের কথা মনে পড়ে গেল। এই অসাধারণ সাংস্কৃতিক পরিবেশ এবং উপাদেয় লুচি, সবজি বর্ধমানের সীতাভোগ দিয়ে জলযোগের পর আমরা বিদায় নিলাম।
এরপর দেখলাম দুটি মন্দির। প্রথমটি সর্বমঙ্গলা মন্দির এবং দ্বিতীয়টি বর্ধমানেশ্বর মন্দির যেখানে একটি বিশাল শিবলিঙ্গ মন্দিরের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত। এখানে প্রচুর মন্দির কিন্তু আমাদের মেলার সময় হয়ে গেছে। তাড়াতাড়ি টোটো ধরে আবার মেলায়।
এদিন মেলায় আরোও মানুষ। বিকিকিনিও হল বেশ। এত বইপ্রেমিক মানুষের সমাগম মনটা ভাল করে দিল। মেলায় সহযোগী হিসেবে এসেছিলেন গাছ গ্রুপ। গাছ নিয়ে সচেতন করার উদ্দেশ্য এরা ছোটদের কুইজ করছেন স্টলে। এছাড়াও আমাদের আগত সমস্ত অতিথিদের এবং আমাদের অর্থাৎ লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদকদের গাছ উপহার দিচ্ছেন। আমাদের স্টলে বর্ধমানের বন্ধু ও আত্মীয় সমাগমের পাশাপাশি এলেন বহু কবি লেখক ও পাঠক।
তৃতীয় তথা শেষ দিনেও ঘুম ভাঙল বেশ সকালে। আজ চা জলখাবার খেয়েই আমরা বেরিয়ে পড়লাম শহর পরিক্রমায়। একটি টোটোর সঙ্গে চুক্তি করে নিলাম আমরা।
আমরা দেখলাম রাজমহিষী বিষ্ণুকুমারীর স্বপ্নের শৈবতীর্থ বর্ধমান একশত আট শিব মন্দির। বেশ সুন্দর সাজানো বিশাল উদ্যানের চারিপাশে মন্দিরগুলি। প্রতিটি মন্দির একই রকম, প্রতিটির কাঠের দরজা পেরোলেই শিবলিঙ্গ। এক পুরোহিতকে দেখলাম ঘুরে ঘুরে পুজো করছেন। আমরা বেশ কিছু ছবি তুললাম। তোরনের পাশেই অফিস যেখান থেকে আমরা একটি বই কিনলাম যাতে লেখা আছে এই ঐতিহাসিক মন্দিরের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস।
এরপর আবার টোটো করে আমরা এগিয়ে চললাম। এবার শহর ছেড়ে বেশ গ্রামের দিকে। একটি ছোট মাঠের মধ্যে দেবী কঙ্কালেশ্বরী মন্দির। প্রতিমা বেশ অন্যরকম। অনেক গল্প জড়িয়ে আছে এই মন্দিরের সঙ্গে। কিছুক্ষণ দেখার পর আমরা ফেরার পথ ধরলাম।
ফেরার পথে বেশ কয়েকটি তোরণ আমাদের যাতায়াতের পথে পড়ল। এর মধ্যে রয়েছে সুপরিচিত কার্জন গেট এবং রথতলা গেট।
গেস্টহাউসে ফিরে দ্বিপ্রাহরিক আহার সেরে একটু পরেই আমরা আবার পৌঁছে গেলাম মেলায়।
আজ এখানকার বন্ধুরা জমায়েত হলে আমাদের ইলশেগুঁড়ি স্টলে। সবার মনই অল্পবিস্তর খারাপ মেলা শেষ হয়ে যাবে। এর মধ্যেই মঞ্চ থেকে ডাক এল কবিতাপাঠের।
কখন যে বিকেল হয়ে গেল বুঝতেই পারলাম না। সন্ধ্যে হয়ে এল। সুকান্ত সহ মেলা কমিটির সবাই হাত মিলিয়ে, জড়িয়ে ধরে আসতে বললেন আবার। প্রিয় বর্ধমান শহর তার সুবিদিত আতিথ্য নিয়ে আমাদের মনে জায়গা করে নিল।