ইলশেগুঁড়ি ২৯তম সংখ্যা (শারদীয়া)
ইলশেগুঁড়ি ২৯তম সংখ্যা (শারদীয়া)
রাহুল একটা লম্বা হাই তুলে রক্তিমকে বলল—“আমার আবার সেই মেয়েকে খুব ভাল লাগে যার ব্যক্তিত্ব আছে, ভাল ঝগড়া করতে পারে, সবার থেকে আলাদা।’’
আকাশটা থমথমে। ক’দিন ধরেই হরিপদ বিরাট ঘূর্ণিঝড় আসার কথা শুনতে পাচ্ছে। বোধকরি আজ-কালের মধ্যেই ঝড় উঠতে পারে। বেলাবেলি চান করে হরিপদ শহর-বাজারের পানে যাবে বলে বেরিয়ে পড়ল। তাদের গাঁ ধুলোটচন্দ্রপুর থেকে আরামবাগ শহর তো বলতে গেলে ভাতঘর। এই তিন-চার কিমি হাঁটা হরিপদর কাছে কিচ্ছু নয়। দ্বারকেশ্বর নদের বাঁধ বরাবর হাঁটলে আরামবাগ হলো গিয়ে তোমার ঘরের কেঁদেলে।
দুশ্চিন্তাটা দিনকয়েক যাবৎ মনের ভিতর পাক খাচ্ছে। তার ব্যাটাটি বছর তিনেক হলো মুম্বাইয়ে সোনা-রুপোর কারিগরের কাজ পেয়েছে। চাকরি তো নামেই। আসলে টেরনিং চলেছে। এই ছ’মাস আগে অবধি পেটভাতার চুক্তিতে কাজ শিখত। তা কাজ-টাজ শিখে মোটে গেল মাসছয়েক যাবৎ বাঁধা মাইনে পাচ্ছে ছেলেটা। দাম খুব বেড়ে যাবার দরুন সোনার বাজারও এদানিং তেমন জুতসই নয়। তবে কাজ শিখতে পারলে এ লাইনে তোমাকে কেউ রুখতে পারবে নে। কেননা, বিয়ে শাদি তো ধরো বন্ধ হবার নয়। লোককে সোনা কিনতেই হয়। অল্প বয়সে একটুকুন কষ্ট করে পাকা কারিগর হতে পারলে দুবাই কি আফ্রিকাও যেতে পার তুমি। হ্যাঁ। তখন অঢেল পয়সা। দশ বারো বৎসর যারা বিদেশ বিভুঁয়ে মাটি কামড়ে পড়ে থাকে, তারা শেষে ঝমাঝম পয়সা বাজিয়ে গাঁয়ে ফিরে বউ-বাচ্চা নিয়ে সুখে শান্তিতে বাকি জীবনটা কাটায়। হরিপদর নিজের চোখে সব দেখা। তবে কিনা ঝুঁকিও আছে। লোভে পড়ে চুরি করে ফেললে বড্ড কঠিন শাস্তি। তোমার বডি কুচিকুচি করে কেটে কফিনে ভরে তখন বাড়িতে পাঠিয়ে দেবে। অবিশ্যি ছেলে তার ধম্মপুত্তুর যুধিষ্ঠির বললিই হয়। চুরির মতোন কাঁচা কাজ করার ছেলেই ও নয়। মেয়েছেলের দিকে মুখ তুলেও তাকায়নে মোটে। তবু বাবা হিসেবে সে ছেলেকে ভালো কথাই শেখায়। পইপই করে সে ব্যাটাকে বলেছে-“লোভে পাপ, পাপে মিত্যু। মন দিয়ে কাজ কল্লে জেবনে উন্নতি হবিই। শুদু মাটি কামড়িয়ে পড়ে থাক। তারপর দেখ না কী হয়।”
এখন একটাই চিন্তা! কী একটা ভাইরাস বেরিয়েছে, পটাপট মানুষ মরে যাচ্ছে। মানুষের জীবন যেমন খোলামকুচি হয়ে গেল গো! রোজ নাকি লোক মরচে। তাই মুম্বাই থেকে ছেলে ফোন করেছিল যে সে আর তার স্যাঙাৎরা সবাই মিলে এখনকার মতন ফিরে আসছে। মারপিট করে একটা ট্রেনে নাকি জায়গা পেয়ে বিহার তক আসতে পেরেছে। সেখান থেকে হাঁটছে। ওদের মালিক আর ওদের রাখতে চায় নি। কদ্দিন আর মালিক বসিয়ে খাওয়াবে! লকডাউন যে!
তো ব্যাটাটি হেঁটে সেই তেপান্তর থেকে ফিরছে। আর হরিপদ এইটুকুন হাঁটতে পারবে নি! বউ অতসী অবশ্য তাকে দুপুরবেলা খেয়ে বেরোতে বলেছিল। কিন্তু হরিপদ বললে, “বেটাটি আমার খালি পেটে হেঁটে আসছে। আর আমি গান্ডেপিন্ডে গিলব? বরং কাজ-কামের ধান্দায় একবার বেরোই। শালা, বাড়িতে বসে বসে যেমন গায়ে গতরে জং ধরে গেল।”
ধারালো কাস্তের মতো ভুরু দুটি তুলে অতসী তাকে জিজ্ঞাসা করে, “কুন চুলোয় যাবে শুনি? এই লকডাউনের সময় কে তমাখে কাজ দিবে? কী ধান্দায় যাচ্চ তুমিই জানো।”
ধক করে উঠেছিল হরিপদর বুক। পুরুষ মানুষ কী করে বেড়ায় বউগুলো বুঝি ঠিক টের পায়! সে তাড়াতাড়ি কথাটা চাপা দিতে বলেছিল, “বুজতে চাস নু ক্যানে? ব্যাটা এলিই কি অখে সঙ্গে সঙ্গেই খাটতে পাঠাব? কিন্তুন একটা পেট তো বাড়বে। সেই লেগেই আমি...”
বিরক্ত অতসী আর কথা বাড়ায়নি। হরিপদও চোরের মতো নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে হাঁটা দিয়েছিল। বাঁধে উঠল সে। এই রাক্ষুসে ভাইরাসটা আসার পর অবধি দিগ্বিদিক শুনশান, রোজগারপাতি একরকম শিকেয় উঠেছে। শুধু নাকে মুখে ঠুলি এঁটে ঘরে বসে থাক। কী দিনই দিল যে ভগবান। এখন ভরসা বলতে তার বউ অতসীর ঠিকে ঝিগিরির রোজগারটুকু। জমানো টাকায় আর কতদিনই বা চলে! অতসীকেও বাবুরা তাদের ঘর ঢুকতে দিচ্ছে নে।
হরিপদ যাচ্ছে গোলাপির কাছে। গোলাপি তার রাজমিস্ত্রির দলের জোগাড়ে। মেয়েরা তো আর রাজমিস্ত্রি হতে পারে না। ভারায় উঠে কাজ করবে কী করে? হরিপদ হচ্ছে হেডমিস্ত্রি। দলে তার আলাদা খাতির। তাকে কমিশন না দিলে কেউ কাজ পাবে না। গোলাপি এসেছিল কাজ খুঁজতে। ওর বর ভিন রাজ্যে কাজে গেছে। টাকা পাঠাতে পারেনি। তা গোলাপিকে কাজ দিয়েছিল হরিপদ। ওর দলমলে শরীরটা তার চোখ টেনেছিল। কাজ পাবার আনন্দে গোলাপিও তার ডাকে সাড়া দিয়েছিল, না দিয়ে ওর উপায়ও ছিল না।
ওঃ, বাঁধের বাতাসটা যেন গোলাপির মতোই ছনমনে। সেই আটাত্তর সালে বানের পর বাঁধটা খুব পোক্ত করে বাঁধা হয়েছিল। একটু টুটে-ফুটে গেলেও এখনও ওই বাঁধটাই শহরবাসীকে বান বন্যের কবল থেকে বাঁচাচ্ছে।
কেমন একটা দমকা বাতাস মাঝে মাঝে ঝাপটা মারছে। নদীর দিকে চাইল হরিপদ। এখন নদী কেমন ঘেয়ো কুকুরের মতন ধুঁকছে। তাতে ঘা থেকে রস কাটার পারা তিরতিরে জল। বর্ষা এলেই... এই রে, স্বপন আসছে উল্টোবাগ থেকে। ওর মুখের কোনো আগল নাই। কাছে আসতেই স্বপন বলল, কাকা, ম্যাচেস হবে? হরিপদ বাক্সটা ওর দিকে বাড়িয়ে দিতে তাকেও একটা বিড়ি দিল স্বপন—“কাকা, ই কী অভ্যেপাত বল দিকিনি? একে তো করুণা ভাইরাসের জ্বালায় কাজকম্ম ন্যাই, তার উপরে আবার বলচে বিরাট ঝড় এসবে।”
হাত আড়াল দিয়ে বেশ কয়েকবারের চেষ্টায় শেষ পর্যন্ত বিড়িটা ধরাতে পারল হরিপদ। ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে সে বলল, “শুন, করুণা ভাইরাস লয়, উটি হচ্চে করলা ভাইরাস। উসব ইদিকে এখনও অ্যাসে নে। শুনলুম সেবেরে যেমন সোরকার থিকে ডেঙ্গু তাড়াতে অ্যান্টি-ডেঙ্গু মশা ছেড়েছিল, এবেরেও শুনচি সের’মভাব কিছু হবে। তবে সাবধানের মার ন্যাই। মুখোশটি পরতেই হবে।”
বিড়ির খাতিরে দুজনের মুখোশই গলায় ঝোলানো। স্বপন এবার দাঁত গিজুড়ে জিজ্ঞাসা করল, “তা কাকা চল্লে কোথায়? তাড়াতাড়ি ফিরবে। ঝড়ে যেমন হারিই যেওনি। খুড়ি আবার চিন্তা করবে কিনা।” “একটুকুন তাড়া আছে রে আমার।” বলে দ্রুত পা চালায় হরিপদ। শালার যেমন শুকনির চোখ। কোন ভাগাড়ে মড়া পড়েছে ঠিক দেখতে পায়। হাঁটতে হাঁটতে কানে এলো স্বপনের চিৎকার—“কাকা আমার রসের নাগর।”
গোলাপি বাড়িতে ছিল না। ওর ছেলেটা নিজের মনে খেলা করছিল। হরিপদ জাঁকিয়ে বসে মুখোশটা খুলে জামার পকেটে রাখল। খানিকটা ছাগল মাংস এনেছে সে বাজার ঘুরে। বিড়িও নিয়েছে একতাড়া। এঃ হে, বড্ড ভুল হয়ে গেছে, গোলাপির ব্যাটার জন্যে দুটো মিষ্টি আনা উচিত ছিল। গোলাপি খুশি হতো।
ক্রিং ক্রিং করে তার মোবাইলটা বাজল। ও! ছেলে। হরিপদ কানে ধরল-“সে কী রে! জ্বর? …ও, ওষুদ সঙ্গে আছে? তাহালে খেয়ে লাও বাপ আমার।… উসব তর এখন চিন্তা কোরার দোরকার ন্যাই। এগু ঘরকে আয়। তারপর দেখা যাবে পাঁউরুটি বেচবি কী মাছ বেচবি। ঘরের ছেলে ঘরে ফিরো দিকিনি।...অ! বেটারি ফুরিই যাচ্চে! আচ্ছা, রাখো তাহালে। সাবোধানে, আর দেখ, একটুন জল...”
ফোনটা কেটে গেল। একঘর দুশ্চিন্তা এসে ভিড় করল হরিপদর মাথায়। ভাইরাস, লকডাউন, তার উপরে ছেলেটা হেঁটে এতটা পথ ফিরছে। সে শুনেচে, যারা এখান থেকে ভিন রাজ্যে কাজে গিয়েছিল, তাদিকে নাকি ওরা তাড়িয়ে দিচ্চে! এরা নাকি ভাইরাস ছড়াবে! যাদের পয়সা আছে, তারা গাড়ি ভাড়া করে ফিরছে, তার ছেলের মতন গরিবদের হাঁটাই সম্বল। চিন্তায় তার শরীরটা আনচান লাগে। গোলাপিটা এলে হয়। দুটো কথা কয়েও তাহলে বাঁচে সে।
বিড়িটা শেষ করতে না করতেই গোলাপি হাজির। হরিপদও খানিক নিশ্চিন্ত বোধ করে বলল, “মাংসটা রাঁধ দিকিনি বেশ গরগরে করে। আজ দুফরে এখেনেই থাকব, খাব।” গোলাপি মুখ ঝামটা দিল, “আমার ভাতার এসচে, সে হাঁটচে। ফোং দিয়েছেল। তমার আর এখেনে এসা চলবেনি। আজ এসেচ, থাকো, খাও। কিন্তুন লীলেখেলা আর লয়। আমার ছেলের বাপ এলে আমি ত্যাখন শুদু তার।” গোলাপির ভাতারের উদ্দেশ্যে একটা ছোটো-বড়ো কথা মুখে এসে গেসল প্রায়, হরিপদ নিজেকে সামলে নিল। হাজার হলেও গোলাপিরই তো সোয়ামি। এখন তার ছেলে আর গোলাপির সোয়ামি এক বিন্দুতে দাঁড়িয়ে। দুজনাই ফিরতে পারে, দুজনাই নাও ফিরতে পারে, ওদের মধ্যে একজনাও ফিরতে পারে। গোলাপির সোয়ামিটা যদি...তাহলে গোলাপির উপর তার দখল বরাবরের মতো হয়ে যাবে। ভাবতেই ছ্যাঁৎ করে উঠল হরিপদর মন। সে না মনে মনে কিরে খেয়েছে কখনো কারও অনিষ্টচিন্তা করবে না! সে দেখেছে, যতবার সে অন্যের অমঙ্গল চেয়েছে ততবারই উল্টে তার নিজেরই কিছু না কিছু ক্ষতি হয়েছে। প্রকৃতির বিধান। হে ভগবান, সকলেই ভালোয় ভালোয় ঘরকে আসুক। তার অমনধারা ভাবাও তো পাপ।
তার সঙ্গে গোলাপির দোস্তি মেরেকেটে মাস তিনেকের। খালি জমি কী আর পড়ে থাকে রে ভাই? কেউ চালাঘর তুলে দোকান দেয় তো কেউ বসত বানায়। এ-ও সেইরকম। গোলাপিও দেখল সে একা মেয়েমানুষ, বজ্জাতি করার লোকের অভাব নাই, হরিপদ একটা খুঁটিও হলো, আবার যে টাকার জন্যে সে হন্যে হয়ে ঘুরছিল—তার ব্যবস্থাও পাকা। পাহারাদার বলো পাহারাদার, কাজ দিলো যে লোক, সে আবার টুকটাক পয়সাও দেয়, সেইসঙ্গে উপোসি শরীরে গতরসুখ—তাই গোলপি তাকে ফেরায় না কখনো। এই যে করোনার সময় কাজ না থাকলেও গোলাপি তো হরিপদর টাকাতেই খেতে পরতে পাচ্ছে। কিন্তু এখন পরিস্থিতি আলাদা! গোলাপির নাকি ভাতার ফিরছে। “শালা।” মনে মনে বলেই জিভ কাটে হরিপদ।
খেতে বসে গোলাপি বলে, “তুমি এখেনে খাচ্চ, তমার বউ কিছু বলবে নি?”
“-বউ জানলে ত। অখে বলেচি একটা কাজ-কামের ধান্দায় যাচ্চি। তর কাছকে দুদিন থাকনুম বা। খুব চিন্তেয় আছি বেটাটিকে লিয়ে। কুন দূরদেশ থিকেন হেঁটে ফিরচে। তর কাছে থাকলে মনটা একটু...” “-অত রস নাই গো আমার। পিরীত যে একবারে উথলে উঠেচে। আমি তমার বাঁধি মেয়েমানুষ নাকি? আমার সোয়ামি বোধকরি কালই এসবে। তুমি আর ইদিক মাড়াবেনে বলে রাখচি। যা রোখা লোক, হয়ত কাটারির কোপেই দুজনকে...”
হরিপদ অবাক মানে। মেয়েরা এরকমই। যেই সোয়ামির গন্ধ পেয়েছে অমনি একেবারে সতী! এই কটা মাস ও বেমালুম ভুলে গেল! তবু মেটে চিবুতে চিবুতে শেষ চেষ্টা করে হরিপদ। গোলাপির দলমলে শরীরের দিকে চোখ ভারি করে চেয়ে হাত বাড়ায়। গোলাপি সরে গিয়ে ঝামরে ওঠে—“বলি, কত শখ যায় গো চিতে/ মলের আগে চুটকি দিতে। অ্যামনে নাই, উমনে আছে। বলি বাড়িতে বিয়ে করা ইস্ত্রী আছে তমার, একেবারে বেবাক ভুলে গেলে?” হরিপদ বলল, “সে মাগির জিভে সবসময় শান দিয়া, অনবরত যেমন কথার ছুরি চালাচ্চে। যত দজ্জালপনা বাড়চে, তত চেহারাটাও শুকিয়ে আমসি হচ্চে। আরে অখে দেখলিই মনে হবে-বর্ষাকালে হাতে হাজা/ গরমকালে ঘামাচি/ শীতকালে পা যদি ফাটা/ কখন তবে রুপসী? শালা জেবনটা আমার কেরাসিন হয়ে গেল। আমি তখেই চাই গোলাপি। হ্যাঁ, লিয্যস। একফোঁটা জল মেশাইনি কথাটায়।” ঝট করে লাল হয়ে উঠল গোলাপির মুখ। নিজেকে সামলে নিয়ে সে বলল, “দেখ, পষ্ট কথায় কষ্ট নাই। তাহালে তুমি শুদু আমার হও। ভালোই যেদি বাসবে তবে এত লুকোছাপা ক্যানে? আমিও আমার সোয়ামির সৈতন ছাড়কাটের করে লিচ্চি।” তারপর একটু মুখ টিপে হেসে গোলাপি বলল, “তাহালে যাব একদিন তমার বাড়ি।” হরিপদর বুকটা ধড়াস করে উঠল। তার পক্ষে অতসীকে ছাড়া সম্ভব নয়। অতসী তার ছেলের মা। আসলে সে ভেবেছিল দুকূল বজায় রাখবে। নাঃ, তা আর হল না। মনটা আনচান। একে গোলাপি খেদিয়ে দিল, তায় ছেলেটি তার পথ হেঁটে ফিরছে। খেয়ে উঠে মনমরা হরিপদ ঘরের ফিরতি রাস্তা ধরে। অতসী তো বলেইছিল একবার, “কোথাকে যাবে তুমি? গুয়োলের গরু সারাদিনমান যেখেনেই ঘুরুক, সন্ধেবেলা ঠিক গুয়োলেই ফিরে। উ লিয়ে আমার চিন্তা নাই।” দেখা যাচ্ছে, সত্যিই তাই। খেটেনটে আড়াইয়ের, সজনে বারোমাস। যতই হোক, গোলাপি কতদিন স্বামীর ঘর করছে। সে তো দুদিনের নাগর।
বাঁ হাতে জমজমাট মোড় ছাড়িয়ে বাজার, ইস্কুলবাড়ি ফেলে হরিপদ এগোয়। বাঁ ধারে মহাশ্মশান। এখানে নদী আরও চওড়া। জনমনিষ্যি নাই বলে হাওয়ার গোমরানো শব্দ আরও কানে বাজে। হরিপদর আবারও মনে পড়ে কোন দূরদেশ থেকে হেঁটে আসছে তার ছেলে। মরুক গোলাপির বর। বেঁচে থাক তার ছেলে। ফাঁকা বাঁধে ভেসে আসে দূরের আওয়াজ—“প্রশাসনের পক্ষ হইতে জানানো হইতেছে যে আজ রাতে অথবা কাল ভোরে সাইক্লোন আসবে। আপনারা কেহ সন্ধ্যা ছয় ঘটিকার পর বাড়ি থেকে বাহির হইবেন না। সকলে নিরাপদ স্থানে আশ্রয় লইবেন। প্রশাসনের পক্ষ থেকে আরও জানানো যাইতেছে যাহাদের বাড়ি মাটির তারা স্থানীয় ফ্লাড শেল্টারে...” ক্রমে আওয়াজটা মিলিয়ে গেল। হয়ত এসডিও অফিসের লোকেরা টোটোয় চেপে চোঙা ফুঁকতে বেরিয়েছে।
ওঃ, কী দিনই এলো। এই তো ক’বছর আগে নোটবন্দির সময় এক হাহাকার গেছে। চারিদিকে শুধু কাজ নাই, কাজ নাই রব। কাজ নাই তো টাকা নাই। টাকা নাই তো খাবার নাই। আবার এসেছে এই মহামারি। কিন্তু ভাইরাসের থেকে লকডাউন আরও ভয়ংকর। ভাইরাসে মরার আগে মানুষ তো না খেয়ে, হেঁটে হেঁটে মরবে। আচ্ছা, তার ব্যাটা যেখানে চাকরি করে সেখানকার লোকই বা কেমন! ভাইরাসের ভয়ে বা চাট্টি খেতে দিতে হবে বলে মানুষগুলোকে তাড়িয়ে দেয়। এবার ছেলেটি তার ঘরে এলে সে তাকে আর বিদেশে কাজে পাঠাবেনি। ঘরে থেকে দিনশেষে শাক-ভাত খাওয়াও ভালো।
বিকেলে হরিপদ বাড়ি পৌঁছায়। বাতাসের ছমক-ঠমক যেন একটু কমেছে। ঝড় নাকি সকাল নাগাদ আসবে। হরিপদ হাত পা ধুয়ে বাড়ি ঢুকতেই অতসী খরখরে গলায় বলে উঠল, “মরণ দশা, মুখোশটা খুলো দিকিনি। আমি কি পরলোকের বউ নাকি?” হরিপদর হাত পা হিম। সে কি ধরা পড়ে গেল নাকি? উঁহু, হরিপদ তাদের ধুলোটচন্দ্রপুর গাঁয়ে যাত্রার তুখোড় অভিনেতা। বিবেকের পার্ট তাকে ছাড়া চলেই না। তার মুখচোখে যাতে অতসীর সামনে কোনো বেচাল না ধরা পড়ে তাই এ ক’মাস সে খুব হুঁশিয়ার থেকেছে। বোধ হয়, অতসী এখনও কিছু জানেনা। আজ বাঁধে স্বপনের কথার যা ছিরি সে দেখল তাতে মনে হয়, গোলাপির কাছে তার যাতায়াত নিয়ে চাদ্দিকে কিছু রটেছে। দেখা যাক। গোলাপির আজ যে ভাব সে দেখল, তাতে বোঝা যাচ্ছে এবার আমে দুধে মিশে যাবে, আঁটি গড়াগড়ি যাবে।
রাতে অতসী ভাতের সঙ্গে রাঁধল আলু দিয়ে শুকনো কাঁঠাল বীজের ঝোল আর কুঁদরির তরকারি। খেতে খেতে অতসী বলল, “ছেলেটার জন্যে মনটা হু হু কচ্চে গা। এত রোদে তাতে বেটাটি আমার হাঁটচে। ইসব কি অর কুনুদিন অব্যেস ছিল?” হরিপদ তখন নেশায় ঝিমঝিম। বাড়িতে খানিকটা ধেনো ছিল, একটু আগে সেটি চড়িয়েছে। তার কেবল মনে পড়ে সে এঁটো হাত বাড়িয়েছিল গোলাপির দিকে, সে হাত ফিরিয়ে দিয়েছিল গোলাপি। এবার সে হাত বাড়াল অতসীর দিকে।
মাঝরাতে হরিপদর ঘুম ভাঙল অতসীর কথায়-“হ্যাঁ গা, ঝড় এসবে সোবাই বলচে, তাহালে কী হবে?” হরিপদ আশ্বস্ত করে তাকে, “দেখ বউ, আমার ছাদ পাকা, দিয়ালের গাঁথুনিও পাকা, ভয়ের কিছু ন্যাই। ঘুমো দিকিনি। ছেলেটি এসচে, উ যেমন ভালোয় ভালোয় ফিরে, ঠাকুরকে ডাক।” অতসী ফুঁপিয়ে কাঁদে। হরিপদ তাকে জড়িয়ে ধরে শান্তভাবে বলে, “ঝড় তো ইদিকে। উ আছে বিহারে। ভয় নাই। তর চিন্তা কিসের বল দিনি? তুই এবেরে ঘুমো না।” অতসী কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়ে। তার একটা হাত এসে পড়ে হরিপদর বুকে। হরিপদ একটু পরে ওর হাত সরিয়ে ঘরের হুড়কো খুলে বাইরে বেরোয়। ছেলের মঙ্গল কামনায় ভগবানের উদ্দেশে মুখ তুলে সে দেখে মেঘে চাপা পড়া কালো আকাশ। একঝলক দমকা বাতাস গুমরে গুমরে চলে যায় হরিপদকে ছুঁয়ে। মাঝরাত? ঝড় কি আসছে?
শেষ রাতে ঘুমিয়ে পড়েছিল হরিপদ। উঠতে বেলা গড়াল। নাঃ, ঝড় মনে হয় হবে নি। ঝড়টা বোধ করি অন্যদিকে চলে গেছে। রোদের তেজ দেখ, যেন গায়ে বিঁধছে। অতসী হয়ত ঘাট বসতে গেছে। উ এলেই গুড় দিয়ে এককাপ চা খাবে সে। ভেলিগুড় আছে বাড়িতে। মাঝে মধ্যে দোকানে ছাড়া চিনির চা খাওয়া পোষায় না, যা দাম চিনির।
বিড়িটা দু আঙুলে হালকাভাবে টিপে ধরে কানের কাছে দুবার নাড়ায় হরিপদ। ঠোঁটে বিড়ি বসিয়ে আগুন দেয় সে। দু-একবার টান দিয়ে জ্বলন্ত দিকটা মুখে ঢুকিয়ে বিড়ির পিছন দিয়ে ধোঁয়া বার করে। ব্যস, এবার গোটা বিড়িটা শুকনো ঝনঝনে হয়ে উঠল। এখন জুত করে টানা যাবে।
ওঃ, ওই তো অতসী আসছে। এবার চা খাবে সে। আজ একটু ঘুসো মাছ আনবে। ছেলেটা ঘুসো মাছ খুব ভালোবাসে। আজই হয়ত ছেলে দুপুর নাগাদ এসে যাবে। নাঃ, এবার থেকে সে ভালো ভাবে থাকবে, আর মেয়েছেলে নিয়ে ফস্টিনস্টি নয়। আর সে দেখেও তো নিল এ ধরণের সম্পর্ক টেকে না। এটা তার বরাবরের দেখা। যতগুলো কেস সে দেখেছে সব এক ব্যাপার।
শব্দ করে চা খায় হরিপদ। কিছুটা নিশ্চিন্দিও লাগছে তার। ছেলে ফিরছে। কোন বিদেশে পড়ে ছিল। গোলাপিও ঘাড় থেকে নামল। হ্যাঁ, মনটা তো একটু খারাপ লাগবেই। কিন্তু সব তো আর একসঙ্গে ভালো হয় না। তাছাড়া অতসীকে সে ভয়ও করে। অতসী তাকে যেন মায়ের শাসন আর বউয়ের সোহাগ-দুইই ঢেলে দেয়।
ফোন বাজছে। গোলাপি? না তার ছেলে? ঘরের কাছকে চলে এল? দুই চিন্তাই তার মনে পাশাপাশি সুখ আর ভয় জানান দেয়। দুটি ভাবনার ওই ভালোলাগা আর ভীতি বাজতে থাকে ফোনের রিংটোনে।
ফোনটা আবার বাজছে। নম্বরটা অচেনা। ঘোর কাটিয়ে হরিপদ ধরল—“কাকা, আমি দখিনপাড়ার অনিল বলচি। হ্যাঁ হ্যাঁ, আমাদের ধুলোটচন্দ্রফুরের গো। হাঁটতে হাঁটতে তমার বেটাটি রাস্তায় পড়ে গেল। না না, থামার আমাদের কুনু উপায় ন্যাই। কত লোক অমন রাস্তায় মরে পড়ে থাকচে। কত জেয়গায় নুকিই নুকিই হাঁটতে হচ্চে...জল ন্যাই, খাবার ন্যাই... না না উ চলিই গেল ধরো। কাল থেকে জ্বর গায়ে চলছিল তো। ভোরের দিকটায় দু-একবার রক্তবমি হলো। বডি এখেনে রেখেই আমরা...” হরিপদ ধীরে বসে। পাশে ফোনটি রাখে। কেমন ঘোলাটে হয়ে যায় তার চাউনি। অতসী তার পোষা মাদি ছাগলটার ছানাগুলোকে ঘাস খাওয়াচ্ছিল, হরিপদর রকম দেখে ছুটে আসে—“কী হলো গা? অ্যাঁ? কথা কও নি ক্যানে? ফোং কে দিয়েছেল? খোকার খবর কী? চুপ করে থেক নি গো।”
তবু হরিপদর কথা ফোটে না। ধূসর চোখে দূরের দিকে চেয়ে থাকে।