ইলশেগুঁড়ি ২৯তম সংখ্যা (শারদীয়া)
ইলশেগুঁড়ি ২৯তম সংখ্যা (শারদীয়া)
বৈবস্বত মনুর পুত্র সৌদ্যুম্নের তিন পুত্র - উৎকল গয়া এবং বিনশ্ব। উৎকল নিজের নামে সৃষ্টি করেন উৎকল দেশ। মহাভারতে উল্লেখ আছে কলিঙ্গরাজ শ্রুতাযুধ কৌরব শিবিরে যোগদান করে অর্জুনের হাতে মতান্তরে ভীমের হাতে নিহত হয়েছিলেন।
“নীলাদ্রৌ শঙ্খমধ্যে শতদলকমলে রক্তসিংহাসনস্থং সর্বলঙ্কারযুক্তং নবঘনরুচিরং সংযুক্তং চাগ্রজেন। ভদ্রায়া বামভাগে রথচরনযুক্তং ব্রম্ভরুদ্রেন্দ্রবন্ধং দেবানাং সারমীশং স্বজনপরিবৃতং ব্রম্ভদারুং নমামি।।» অর্থাৎ যিনি শঙ্খ ক্ষেত্রের মধ্যে অবস্থিত নীল পর্বতের উপর শতদলযুক্ত পদ্মের উপরে বিরাজিত রক্ত সিংহাসনে আসীন। সমস্ত প্রকার রত্ন অলঙ্কারে সুশোভিত সেই ব্রহ্মের গাত্রবর্ণ নতুন মেঘের ন্যায় সঙ্গে জ্যেষ্ঠভ্রাতা বলরাম, সুভদ্রার বামভাগে উপবিষ্ট স্বজনদ্বারা পরিবেষ্টিত, তাঁর হস্তে সুদর্শন চক্র, যাঁকে ব্রম্ভা, রুদ্রদেব ও ইন্দ্র পূজার্চনা করেন, চতুর্বেদের সমস্ত সৌরভ নিয়ে যিনি পৃথিবীর অধীশ্বর, দারুরূপ সেই ব্রম্ভকে আমি শ্রদ্ধাবনত চিত্তে প্রণাম জানাই।
সমুদ্রের তটরেখা যেখানে শেষ হয়েছে সেখান থেকে সামান্য দূরে উঁচু পাহাড়ের মত একটি বালির ঢিবি, নীলসুন্দর পর্বত নামে খ্যাত। স্থানীয় লোকেরা বলেন নীলাচল। এই নীল পর্বতে পাথরের একটি ছোট মন্দিরে ভগবান নীলমাধবের পূজার্চনা হত। দিনের বেলায় এখান থেকে কাঁসরঘন্টার আওয়াজ শোনা যেত, রাত্রিবেলা সেখানে অজস্র প্রদীপের মাঝে নীল রঙের একটি দ্যুতি দেখা যেত। সমুদ্রতীরের এই অঞ্চলটির আকৃতি শঙ্খের ন্যায়, সেজন্য এই অঞ্চলকে শঙ্খক্ষেত্রও বলা হতো। অনেক নাম - যেমন শ্রীক্ষেত্র, নীলাচল, নীলাদ্রি, পুরুষোত্তম ক্ষেত্র - যেখানে হিন্দুদের চারধামের অন্যতম জগন্নাথ ধাম বিরাজিত। জগতের নাথ যিনি তিনি জগন্নাথ, তাঁর ধাম অর্থাৎ আবাস একত্রে জগন্নাথধাম বা জগন্নাথপুরী, কালক্রমে লোকমুখে পুরীনামে সবিশেষ প্রচলিত। «নীলাচল নিবাসায় নিত্যায় পরমাত্মনে, বলভদ্র সুভদ্রাভ্যাং জগন্নাথায় তে নমঃ। অর্থাৎ নীলাচলক্ষেত্রে বাস করেন যে পরমাত্মা সেই জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রাকে প্রণাম জানাই।
জগন্নাথধাম পুরী একত্রে বৈষ্ণব, শাক্ত, শক্তি, বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের পীঠস্থান। ভারতবর্ষের অতি প্রসিদ্ধ যে কয়েকটি তীর্থস্থান আছে তন্মধ্যে চারটি স্থানকে জগৎগুরু শঙ্করাচার্য চারধাম বলে চিহ্নিত করেছেন। সেগুলি হল উত্তরে নারায়নক্ষেত্র বদ্রীনাথ ধাম, দক্ষিনে রামেশ্বরধাম, পূর্বে ভগবান পুরুষোত্তমের জগন্নাথধাম এবং পশ্চিমে শ্রীকৃষ্ণ ভগবানের ক্ষেত্র দ্বারকাধাম। প্রবাদ আছে যে ভগবান নারায়ন রামেশ্বরে স্নান করে বদ্রীনাথে তপস্যা করেন এবং শ্রীক্ষেত্রে ভোজন করে দ্বারকাতে যেয়ে বিশ্রাম লাভ করেন। বৌদ্ধ ধর্মের মূলমন্ত্র বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি, ধর্মং শরণং গচ্ছামি, সঙ্ঘং শরণং গচ্ছামি। ডঃ হরেকৃষ্ণ মহতাবের লেখা ‘হিস্ট্রি অফ ওড়িশা’ গ্রন্থের দ্বিতীয় খন্ডে উল্লেখ আছে খ্রীষ্টপূর্ব চতুর্থ শতকে সম্রাট অশোকের সময় পুরীতে একটি বৌদ্ধস্তুপ নির্মাণ করা হয়েছিল এবং সেখানে বুদ্ধ ধর্ম ও সঙ্ঘ এই ত্রিরত্নের পুজো শুরু হয়। মনে করা হয় এই ত্রিরত্নের মধ্যে জগন্নাথ হলেন বুদ্ধদেব, বলরাম হলেন সংঘ এবং সুভদ্রা হলেন ধর্মের প্রতীক। ভগবান বিষ্ণুর দশ অবতারের অন্যতম বুদ্ধদেবকে জগন্নাথদেবের প্রতিরূপ বলে গণ্য করা হয়। বৌদ্ধধর্মের প্রেম, সহিষ্ণুতা, অন্যকে শারীরিক ও মানসিকভাবে আঘাত না করা- এইগুলি কালক্রমে বৈষ্ণব ধর্মাবলম্বীরা গ্রহণ করেছেন। কোন কোন ঐতিহাসিকের মতে জগন্নাথদেব জৈন ধর্মের আদি তীর্থঙ্কর ঋষভদেব। জৈনধর্মের তেইশ এবং চব্বিশতম তীর্থঙ্কর মহাবীর বা পার্শ্বনাথ বলেও মনে করা হয়। কালো পাথরের একটি টুকরোকে ‘কলিঙ্গ জিন’ বলা হতো এবং সেখান থেকে নীলমাধবের সূত্রপাত। জগন্নাথদেবের স্নানযাত্রা, রথযাত্রা এবং বিভিন্ন উৎসবের সঙ্গে জৈন ধর্মের উৎসবগুলির অনেকাংশে মিল আছে। আবার শৈব ধর্মাবলম্বীরা মনে করেন আদিতে জগন্নাথদেব ছিলেন শিব এবং সেই শিব বিষ্ণুতে রূপান্তরিত হন। সতীর একান্নপীঠের অন্যতম শ্রীক্ষেত্রে দেবীর নাভিস্থান পতিত হয়েছিল। জগন্নাথ মন্দিরের ভিতরের অংশের দক্ষিণ-পশ্চিমে পূর্বাভিমুখী মা বিমলার মন্দির। বিমলা দেবী শ্রীক্ষেত্রের ভৈরবী এবং জগন্নাথদেব হলেন শ্রীক্ষেত্রের ভৈরব। কথিত আছে জগন্নাথদেব যখন রত্নবেদীতে অবস্থান করেন তখন তিনি বিষ্ণু, শয়নকালে শক্তি, গমনে রুদ্র, স্নানবেদীতে বিনায়ক ও রথযাত্রা কালে সূর্য দেবতা। সেই হিসাবে শবরদের যিনি ‘চখানয়ন’ তিনিই বৈষ্ণবদের কৃষ্ণ, শৈবদের শিব। আবার তিনিই একাধারে ঋষভনাথ, গণপতি, কালী। জগন্নাথ পূজার রীতিনীতি ভালো করে লক্ষ্য করলেই এই সত্যতার প্রমাণ পাওয়া যায়। তাছাড়া ইতিহাস সেইরকমই সাক্ষ্য দিচ্ছে। অষ্টম শতকে উড়িষ্যা যে ধর্মীয় প্রভাব দ্বারা আচ্ছন্ন ছিল তা হল শৈববাদ, ব্রাম্ভন্যবাদ তথা বৌদ্ধতন্ত্র। ফলে স্বাভাবিকভাবেই প্রায় সর্বধর্মের কিছু কিছু রীতিনীতির প্রভাব সরাসরি এসে পড়েছিল প্রভু জগন্নাথের উপর। সেইজন্যই জগন্নাথের পূজোয় বৈষ্ণব আচরণবিধি ছাড়াও বৌদ্ধ, জৈন, শৈব প্রভাবসহ শাস্ত্র ক্রিয়া, তান্ত্রিক আচার সবই লক্ষ্য করা যায়।
প্রাচীনকাল থেকেই উড়িষ্যা বিভিন্ন ধর্ম সম্প্রদায়ের সাধন ভূমি। বৌদ্ধ, জৈন, শৈব, শাক্ত, বৈষ্ণব সম্প্রদায় যখন যে সম্প্রদায় প্রবল হয়ে উঠেছে মন্দিরের দেবতার উপরে তাদের প্রভাব পড়েছে। তাই তান্ত্রিক মতে জগন্নাথ ভৈরব। ‘ওড্রেষু বিমলাশক্তিঃ জগন্নাথস্তু ভৈরবঃ’, আবার বৌদ্ধদের বুদ্ধ। ধর্ম ও সঙ্ঘের প্রতীক। শৈবদের শিব, বৈষ্ণবদের বিষ্ণু। এছাড়াও যখন যে রাজশক্তি ক্ষমতায় এসেছে প্রজাদের সন্তুষ্টি বিধানের জন্য দেবতাকেও নিজের করে নিয়েছেন। রাজা তৃতীয় অনঙ্গভীমদেবের রাজত্বকালে পুরুষোত্তম জগন্নাথ হয়ে ওঠেন শ্রীকূর্মেশ্বর। মন্দিরের গায়ে ১২৩০ সালে উৎকীর্ণ শিলালিপিতে এর উল্লেখ পাওয়া গেছে। এখন প্রশ্ন হল বলরাম পুরুষোত্তম জগন্নাথদেবের পাশে কখন এলেন? এ বিষয়ে সঠিক কোন তথ্য পাওয়া যায় না তবে গবেষকদের মতামত থেকে একটা ধারণা করা যেতে পারে। গবেষকদের মতে বলরাম তোষালি উপজাতির নাগদেবতা। নাগদেবতার পূজা ভারতে আদিম অধিবাসীদের মধ্যে প্রচলিত ছিল। ব্রাহ্মণ্য যুগে এই নাগদেবতা বলরাম নামে পূজিত হন। বিশেষমতে ইনি অনন্ত বা শেষনাগ। জগন্নাথ যখন বিষ্ণুরূপে পূজিত হলেন, তোষালির নাগদেবতা বলরাম রূপে জগন্নাথের পাশে স্থান পেলেন, কারণ বিষ্ণুর সঙ্গে শেষ নাগের অঙ্গাঙ্গী সম্পর্ক। পৌরাণিক মতে ক্ষীরসমুদ্রে শেষ নাগের উপরে বিষ্ণু অনন্তশয্যায় শায়িত থাকেন। ভগবান বিষ্ণু যখন অবতার রূপে মর্ত্যধামে আসেন শেষ নাগও তাঁর সঙ্গে আসেন। রাম অবতারে তিনি লক্ষণ, কৃষ্ণ অবতারে তিনি বলরাম। হরিবংশ অনুযায়ী শেষ নাগের আরেক নাম সংকর্ষন। বিষ্ণুপুরাণে বলা হয়েছে বিষ্ণুর মুখ থেকে সংকর্ষন রুদ্রের আবির্ভাব। ব্রম্ভ পুরাণে বলা হয়েছে হলায়ুধ অর্থাৎ বলরাম - রুদ্রের অপর রূপ। এখানে জগন্নাথ ও বলরামকে এক ও অভিন্ন বলা হয়েছে। উড়িষ্যার লেখক অচ্যুতানন্দের চিত্তবোধে, যশোবন্ত দাসের প্রেমভক্তি গীতায়, মহাদেব দাসের মার্কন্ডেয় পুরাণে, মহাকবি সারলা দাসের মহাভারতে বলরামকে শিবরূপে বর্ণনা করা হয়েছে। মন্দিরে বলরামের পূজার পরে তাঁর ফুলমালা বিমলা মন্দিরে পাঠানো হয় অর্থাৎ শিব ও শক্তির সমন্বয়। প্রশ্ন থেকে যায় বলরাম যদি শিবের একরূপ হন তাহলে তাঁর পূজা বেলপাতা দিয়ে কেন হয় না? বলরামের পূজা হয় কিন্তু বাসুদেব মন্ত্রে। এছাড়াও ইতিহাসের ধারা লক্ষ্য করলে দেখা যায় শ্রী জগন্নাথ মন্দিরের অধিকার নিয়ে একসময় শৈব ও বৈষ্ণবদের মধ্যে যথেষ্ট বিরোধ ছিল। রাজা যজাতি কেশরী নিজে শৈব ছিলেন। বৈষ্ণব ও শৈব দুই ধারার ভক্তরাই দারু বিগ্রহের পূজা করত। যদিও শৈবদের প্রভাব মন্দিরে যথেষ্ট ছিল কিন্তু স্কন্দপুরাণের মতে বলরাম বিষ্ণুই। এখানে বলা হয়েছে “ তো বৈ কৃষ্ণঃ স বৈ রামঃ তো রামঃ কৃষ্ণ এব সঃ। যুবয়োরন্তরং নাস্তি প্রসীদ ত্বং জগন্ময়”।। আবার দশাবতার স্তোত্রে বলরাম অবতার। «কৃষ্ণস্তু ভগবান স্বয়ং”। পৌরাণিক কাহিনী অনুযায়ী বলরাম দেবকীর গর্ভ থেকে আকর্ষিত হয়ে যোগমায়ার দ্বারা রোহিণীর গর্ভে সংস্থাপিত হয়ে কৃষ্ণের অগ্রজ রূপে আবির্ভূত। পুরীর মন্দিরেও তিনি জগন্নাথের অগ্রজ। তাই তাঁর রথ আগে চলে। রত্নবেদীতে জগন্নাথ ও বলরামের মধ্যে অবস্থান করেন দেবী সুভদ্রা। বলা হয় জগন্নাথ ও বলরামের ভগিনী যশোদানন্দিনী। অপর মতে তিনি দশমহাবিদ্যার অন্তর্গত দেবী ভুবনেশ্বরী। শাক্তমতে পীঠ অধিষ্ঠাত্রী দেবী বিমলা এবং সুভদ্রা এক। তাঁর পূজা হয় ভুবনেশ্বরী মন্ত্রে। কৃষ্ণ বলরামের ভগিনী যোগমায়া বিষ্ণুর অংশে জন্ম তাই তাঁর অপর নাম একানংশা। তাঁর বর্ণনা প্রসঙ্গে বৃহৎসংহিতায় বলা হয়েছে দেবী দ্বিভূজা, চতুর্ভূজা অথবা অষ্টভূজা হতে পারেন। তাকে অবশ্যই কৃষ্ণ ও বলরামের মধ্যে স্থাপন করতে হবে। শ্রীমদ্ভাগবতে যোগমায়াকে দুর্গা, ভদ্রকালী, বিজয়া ও বৈষ্ণবী বলা হয়েছে। ইনিই পরবর্তীকালে সুভদ্রা বা একানংশা। গবেষকদের মতে ইনি আদিবাসী পূজিতা দেবী স্তম্ভেশ্বরী বা খাম্বেশ্বরী, সোনাপুর দাউদ অঞ্চলের ইষ্টদেবী। সম্ভবতঃ সুলকি উপজাতিরা দেবীর প্রতিষ্ঠা করেছিল। দারু মূর্তির জন্য নির্দিষ্ট সময়ে জগন্নাথ বলরামের সঙ্গে এঁরও নবকলেবর হয়। ঐতিহাসিকদের মতে এমনিভাবেই নাগ দেবতা বলরাম এবং স্তম্ভেশ্বরী সুভদ্রা হয়ে ওঠেন। শাক্ত, শৈব ও বৈষ্ণব ধর্মের প্রভাবে সুভদ্রা শক্তি দুর্গা এবং মহালক্ষ্মীর রূপ লাভ করেন। স্কন্দপুরাণের উৎকল খন্ডে তাঁকে মহালক্ষ্মী বলা হয়েছে। ‹ সুভদ্রা হি মহালক্ষ্মী’ আবার একই সঙ্গে পার্বতী,লক্ষ্মী ও সরস্বতী বলা হয়েছে। « বক্ষঃস্থল স্তিথাং বিষ্ণো শম্ভোরধাঙ্গবহারিণীম্, পদ্মযোনি মুখাব্জস্থাং প্রণমামি জগৎ প্রিয়াম্” অর্থাৎ আপনি লক্ষ্মীরূপে বিষ্ণুর বক্ষস্থলে অবস্থিতি করছেন, গৌরীরূপে শিবের অর্ধাঙ্গিনী হয়েছেন এবং সরস্বতীরূপে পদ্মযোনির মুখপদ্মে বিরাজ করছেন, অতএব জগৎপ্রিয়া আপনাকে প্রণাম করি। জগন্নাথ দেবের রত্নবেদীতে আরো একটি দারুমূর্তি রয়েছেন, তিনি হলেন সুদর্শন। রক্তবর্ণ বস্ত্রে আবৃত জগন্নাথের বাম দিকে অবস্থান করেন। আমরা জানি যে সুদর্শন বিষ্ণুর আয়ুধ। শঙ্খ চক্র গদা পদ্মধারী বিষ্ণুর ডান হাতে তিনি চক্ররূপে থাকেন কিন্তু এখানে তিনি দন্ডরূপী। পুরানে বলা হয়েছে শিবের আদেশে সমস্ত দেবতার তেজ সংহত করে সুদর্শনের সৃষ্টি। বিশ্বকর্মার প্রার্থনায় সূর্যের তেজকে অস্ত্রের রূপ দেওয়া হয়েছে। শিব এই সুদর্শন চক্র বিষ্ণুকে দেন। বিষ্ণু তাঁর দশটি অবতারে একমাত্র কৃষ্ণরূপ ছাড়া আর কখনো সুদর্শন ধারণ করেন নি। পৌরাণিক ব্যাখ্যা যাই হোক রত্নবেদীতে সুদর্শন কাপড়ে-ঢাকা দারুদন্ড। অনেক ক্ষেত্রে সুদর্শন জগন্নাথের প্রতিনিধির ভূমিকা নেন। নবকলেবরের সময় সুদর্শনের জন্য সর্বপ্রথম দারু চিহ্নিত করা হয়। ব্রহ্ম স্থাপন যখন হয় সেটিও প্রথমে এই দারুখণ্ডতেই করা হয়। রথযাত্রায় সর্বপ্রথম সুদর্শনকে সুভদ্রার রথে স্থাপন করা হয়। তাঁকে মনে করা হয় তিন বিগ্রহের যোগসূত্র। সুদর্শনের পূজা হয় নৃসিংহ মন্ত্রে। অর্থাৎ তিনি নৃসিংহদেব. শ্রীবিষ্ণুর অন্য এক রূপ। এই রূপে তিনি দৈত্যদের সংহার করেছিলেন। সুদর্শনের ধ্যানে বলা হয়েছে তিনি বিষ্ণুর ক্রিয়া শক্তি। তাঁর বন্দনায় বলা হয়েছে তাঁকে বিষ্ণুর জ্যোতি। পঞ্চরাত্র আগমে বলা হয়েছে সুদর্শন মহাবিষ্ণু। জগন্নাথ বলরাম ও সুভদ্রার মানবিক রূপ থাকলেও সুদর্শন অরূপের প্রতীক। বিশ্বচরাচরের আবর্তনের ইঙ্গিতবাহী। বিষ্ণুর নিরাকার রূপের প্রকাশ। সুতরাং সুদর্শন ও বিষ্ণু যে এক এবং অভেদ সে বিষয়ে কোন সংশয় থাকেনা। অতএব বিগ্রহ চারটি হলেও পূর্ণতায় এক। তাত্ত্বিকদের ব্যাখ্যায় চারটি অসম্পূর্ণ মূর্তি মিলে এক পূর্ণরূপের সন্ধান পাওয়া যায়। তাহলে আমরা দেখতে পাই এক একটি বিগ্রহ বিশেষ গুণ বা ভাবের প্রতীক। একে অপরের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত, কেউই স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়, একে অন্যের পরিপূরক। জগন্নাথ বলরাম সুভদ্রা তিনটি বিগ্রহ তিন বর্ণের। বলরামের শ্বেতবর্ণ, ইনি শুদ্ধ আত্মা। সুভদ্রার হরিদ্রাভ বর্ণ। ইনি প্রকৃতি বা শক্তি, এঁর থেকেই সমগ্র জগতের সৃষ্টি। আর জগন্নাথের কৃষ্ণবর্ণ তার অর্থ অনন্তের আভাস। তিনে মিলে সমগ্র জগৎ যাকে ধারন করে আছেন সেই পরমপুরুষ পুরুষোত্তম। চতুর্দেবতাকে ওম শব্দের সমাহার ভাবেন সাধক। অ+উ+ম= ওম। অ হলেন বলরাম, শুদ্ধ আত্মা, উ হলেন সুভদ্রা বা শক্তি এবং ম হলেন জগন্নাথ বা অনন্তের আভাস এবং অর্ধমাত্রা হলেন সুদর্শন যিনি তিন শক্তির সমন্বয়কারী যোগসূত্র। আবার বৈদান্তিক মতে এই চার দেবদেবী হলেন দেহ, সূক্ষ্মদেহ, জীবাত্মা ও পরমাত্মা। আর এক মতে চারজন চেতনার চারটি প্রকাশ - জাগ্রত, স্বপ্ন, সুষুপ্তি এবং তূরীয়। সংকর্ষন বলরাম জীবকে আকর্ষণ করেন, সুভদ্রা আনন্দ ও মঙ্গল দান করেন এবং কৃষ্ণবর্ণ জগন্নাথ অনন্তরূপী, সাধকের সাধনার ধন। জীবের হৃদয়ে তাঁকে জানার আগ্রহ সৃষ্টি করেন এবং শেষে অসীমস্বরূপ প্রদান করেন। একের মধ্যেই সব আছেন, জগন্নাথ মানেই চতুর্বিগ্রহ।
পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে ঋকবেদে জগন্নাথদেবের উল্লেখ আছে। সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মা নারায়ণের নাভিপদ্ম থেকে উত্থিত হয়ে পুরুষোত্তম ক্ষেত্রে এসে যজ্ঞ করেন এবং সেই যজ্ঞের থেকে নীলমাধবের উৎপত্তি। দ্বাপর যুগের শেষ প্রান্তে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ স্থির করলেন ইহজগতে তাঁর লীলা শেষ হয়েছে এরপরে তিনি বৈকুণ্ঠে ফিরে যাবেন। মহাভারতের যুদ্ধ শেষ হয়েছে, ধর্মের জয় হয়ে অধর্মের পরাজয় ঘটেছে, যদু বংশের বীরেরা নিজেদের মধ্যে হানাহানি করে সমূলে ধ্বংস হয়েছেন, অগ্রজ সঙ্কর্ষন প্রভাস তীর্থে যেয়ে যোগবলে প্রাণ ত্যাগ করেছেন - মরদেহ ত্যাগ করার আদর্শ সময় এটাই। মর্ত্যধাম ত্যাগ করার জন্য তিনিও প্রভাস তীর্থে যেয়ে নিমগাছে বসেছিলেন। দূরের থেকে তার রাঙা পা দুখানি দেখে পক্ষী ভেবে জরা ব্যাধ তীর নিক্ষেপ করার ফলে তিনি মৃত্যুমুখে পতিত হলেন। জরা ব্যাধ সামনে যেয়ে দেখলেন পাখির বদলে শ্রীকৃষ্ণের রাঙা পায়ে তীর বিদ্ধ করে তাঁকে হত্যা করেছে। জরা ব্যাধ অনুশোচনায় দগ্ধ হয়ে গেল। শ্রীকৃষ্ণ তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন «এ আমার পূর্বজন্মের অভিশাপ। তুমি সত্বর ইন্দ্রপ্রস্থে যেয়ে তৃতীয় পাণ্ডব অর্জুনকে সংবাদ দাও”। এ ক্ষেত্রে উল্লেখ করা যায় যে ত্রেতাযুগের বানররাজ বালি দ্বাপরে জরা ব্যাধ রূপে জন্মগ্রহণ করেছেন। অর্জুন আসার পরে তিনি পঞ্চভূত শরীর ত্যাগ করে বৈকুণ্ঠধামে চলে গেলেন। অর্জুন তখন জরা ব্যাধের সহায়তায় শ্রীকৃষ্ণের পার্থিব শরীরকে প্রভাসের ত্রিবেণী সঙ্গমে নিয়ে যেয়ে চিতায় অগ্নিসংযোগ করলেন, কিন্তু চিতার আগুনে শ্রীকৃষ্ণের দেহ ভস্মীভূত হলো না। ছয়দিন চিতার আগুন প্রজ্জ্বলিত ছিল। অবশেষে দৈববাণী হল ‘ভগবানের দেহ আগুনে পুড়বে না সমুদ্রে বিসর্জন দাও। এই শরীর নবরূপে কলিযুগে পূজিতে হবেন’। অর্জুন অর্ধদগ্ধ শরীরকে সমুদ্রের জলে বিসর্জন দিলেন। সমুদ্রের জলে শ্রীকৃষ্ণের অর্ধদগ্ধ দেহ ভাসতে-ভাসতে বাঁকিমুহান নামে সমুদ্র ও নদীর মোহনায় এক স্থানে শঙ্খ চক্র গদা পদ্ম চিহ্নিত এক দারুকাষ্ঠরূপে এসে উপস্থিত হল। কালক্রমে সমুদ্র সরে যেয়ে সেখানে এক চর বের হয়ে জঙ্গলে পরিণত হল। অরণ্যচারী শবরেরা সেখানে এসে বাস করতে লাগলো। দ্বাপর যুগের জরা ব্যাধ কলিযুগে শবর রাজা বিশ্বাবসু নামে জন্মগ্রহণ করলো। জঙ্গলে শিকার করতে গিয়ে বিশ্বাবসু একদিন সন্ধ্যার অন্ধকারে জঙ্গল থেকে এক নীল রঙের আলোর বিচ্ছুরণ দেখে সেই আলোকে অনুসরণ করে সেখানে যেয়ে ভগবান নীলমাধবের দর্শন পেলেন এবং পুজো করতে শুরু করলেন।
স্কন্দপুরাণ অনুযায়ী ব্রম্ভার পঞ্চম উত্তরপুরুষ রাজা ভরত ও সুনন্দার পুত্র ইন্দ্রদ্যুম্ন অবন্তী নগরের রাজা ছিলেন। একদিন তাঁর রাজসভায় এক বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ এসে তাঁকে পুরুষোত্তম ক্ষেত্রের শবরদের পূজিত নীলমাধবের কথা বললেন। সেখানে নীলগিরি পর্বতের ঘন অরন্যের মধ্যে রয়েছে কল্পবৃক্ষ ও রোহিনী কুন্ড। কুন্ডের পূর্বতটে নীলমাধবের মূর্তি বিরাজিত। রাজা উৎসুক হয়ে আরো কিছু সংবাদ জানার জন্য বৃদ্ধকে জিজ্ঞেস করতে দেখলেন বৃদ্ধ অদৃশ্য হয়ে গেছেন রাজসভা থেকে। ইন্দ্রদ্যুম্ন রাজসভায় আলোচনা করে স্থির করলেন রাজপুরোহিতের ভাই বিদ্যাপতিকে পাঠাবেন অনুসন্ধান করতে। বিদ্যাপতি শ্রীক্ষেত্রে যেয়ে শবররাজা বিশ্বাবসুর সাথে দেখা করে নীলমাধব দর্শনের ইচ্ছা প্রকাশ করলেন। বিদ্যাপতির সেবার জন্য বিশ্বাবসু তার কন্যাকে দায়িত্ব দিলেন। ললিতার সাথে থাকার ফলে উভয়ের মধ্যে প্রেমের উন্মেষ ঘটলো এবং নীলমাধবকে দর্শনের জন্য বিদ্যাপতি ললিতাকে বিশেষ অনুরোধ করলেন। তাঁদের প্রেমের বন্ধন চিরস্থায়ী করার জন্য বিশ্বাবসু বিদ্যাপতির সাথে ললিতার গন্ধর্বমতে বিবাহ দিলেন। ললিতার অনুরোধে বিশ্বাবসু রাজি হলেন বিদ্যাপতিকে নীলমাধব দর্শন করাতে কিন্তু সেই স্থানের সন্ধান যাতে বিদ্যাপতি না পান সেই জন্য তার চোখ বেঁধে তাকে নিয়ে যাওয়া হল। এই সময়ে ললিতা স্বামীর কাপড়ের এক কোণে এক মুষ্টি সরিষা দিয়ে বললেন “যে রাস্তা দিয়ে আপনি যাবেন সেই রাস্তাতে সরিষা গুলি ছড়িয়ে দিয়ে যাবেন”। বিদ্যাপতি নীলমাধবের দর্শন পেয়ে বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে গেল। ইন্দ্রদ্যুম্ন রাজাকে সংবাদ দেওয়ার জন্য বিদ্যাপতি পরের দিনে অবন্তীনগরের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন। বিদ্যাপতি ছলনা করে দর্শন করার পরে নীলমাধব বিদ্যাপতির ছলনা জানতে পেরে সেখান থেকে অদৃশ্য হয়ে গেলেন। বিদ্যাপতি অবন্তী নগরে ফিরে যেয়ে সমস্ত ঘটনা রাজা ইন্দ্রদ্যুম্নকে বলতে তিনি রাজপুরোহিত, বিদ্যাপতি ও সৈন্য-সামন্ত নিয়ে পুরুষোত্তম ক্ষেত্রে এলেন। বিদ্যাপতি যে সরিষা গুলি রাস্তায় ছড়িয়ে গিয়েছিলেন বর্ষার জল পেয়ে সেগুলি চারা গাছে রূপান্তরিত হয়েছে। সেই চারাগাছ লক্ষ্য করে রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন ও বিদ্যাপতি যখন নীলমাধবের দর্শন করতে গেলেন তখন সেখানে দেখলেন নীলমাধবের পরিবর্তে সোনালি বালিতে চারিদিক আবৃত। রাজা অন্তরে কষ্ট পেয়ে ব্রহ্মার শরণাপন্ন হলেন। দেবর্ষি নারদ মারফত ব্রহ্মা ইন্দ্রদ্যুম্নকে জানালেন এক হাজার অশ্বমেধ যজ্ঞ করার জন্য। এক হাজার অশ্বমেধ যজ্ঞ করার পরে দৈববাণী হল “এই পৃথিবীতে আমি মাধব রূপে তোমাকে দর্শন দিতে পারবো না। আমি চার আধারে বিভক্ত হব - জগন্নাথ, বলরাম, সুভদ্রা ও সুদর্শনরূপে। তুমি চক্রতীর্থে অপেক্ষা করো সেখানে একটি দারুকাষ্ঠের গুঁড়ি ভেসে আসবে। একটি সুরভিত লাল রংয়ের বৃহৎ আকারের কাঠের গুড়ির মধ্যে আমি নিজের রূপ পরিবর্তিত করে থাকবো। আর এই কাঠের গুঁড়ির মধ্যে শঙ্খ চক্র গদা ও পদ্ম চিহ্ন থাকবে। তুমি সেখানে গিয়ে আমাকে নিয়ে এসে চার মূর্তি নির্মাণ করে আমার পূজা করবে”। এরপরে পুরুষোত্তমদেব স্বয়ং দেবশিল্পী বিশ্বকর্মা রূপে সেখানে এসে হাজির হয়ে চারটি মূর্তি নির্মাণ করতে লাগলেন। নির্মাণ শুরুর পূর্বে রাজা ইন্দ্রদ্যুম্নকে তিনি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ করালেন যে মূর্তি তৈরি করতে একুশ দিন প্রয়োজন। এই সময়ে তিনি দরজা বন্ধ করে মূর্তি নির্মাণ করবেন। কোন কারনে রাজা প্রতিজ্ঞা লঙ্ঘন করলে তিনি সেই অবস্থায় অন্তর্হিত হবেন। চোদ্দ দিন পরে মন্দির থেকে কোনও আওয়াজ শুনতে না পেয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে ইন্দ্রদ্যুম্ন জোর করে মন্দিরের দরজা খুলে দেখলেন বিশ্বকর্মা মূর্তি নির্মাণ অসমাপ্ত রেখে অন্তর্হিত হয়েছেন। সেই দিন রাত্রে তিনি ভগবানের স্বপ্নাদেশ পেলেন যে কলিকালে তিনি এই মুর্তিতে পূজিত হবেন। শবররাজ বিশ্বাবসুর বংশধরেরা বংশানুক্রমিকভাবে মন্দিরের দৈতাপতি হয়ে তাঁর সেবা করবেন, ব্রাহ্মণ বিদ্যাপতির ব্রাহ্মণী স্ত্রীর গর্ভজাত সন্তানেরা মন্দিরের পূজারী হবেন এবং শবর কন্যা ললিতার গর্ভজাত সন্তানেরা বংশানুক্রমিকভাবে জগন্নাথ দেবের ভোগ করার দায়িত্বে থাকবেন যাদের নাম হবে ‘সূয়ার’। উল্লেখ করা যায় যে এক হাজার অশ্বমেধ যজ্ঞের সময়ে রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন বহু সহস্র গোদান করেছিলেন। সেই গরুগুলির পায়ের ক্ষুরের আঘাতে ভূমিতে গর্ত হয়ে সেখানে গোমূত্র এবং জল পড়ে এক বিরাট সরোবরের আকার ধারণ করে যে সরোবর বর্তমানে ইন্দ্রদ্যুম্ন সরোবর নামে পরিচিত।
বৈবস্বত মনুর পুত্র সৌদ্যুম্নের তিন পুত্র - উৎকল গয়া এবং বিনশ্ব। উৎকল নিজের নামে সৃষ্টি করেন উৎকল দেশ। মহাভারতে উল্লেখ আছে কলিঙ্গরাজ শ্রুতাযুধ কৌরব শিবিরে যোগদান করে অর্জুনের হাতে মতান্তরে ভীমের হাতে নিহত হয়েছিলেন। কলিঙ্গ রাজ্যের কথা বৌদ্ধযুগের চূল্লা কলিঙ্গ, জাতক এবং কলিঙ্গবোধি জাতকে উল্লেখ আছে। গুপ্তযুগে মহাপদ্ম নন্দ কলিঙ্গ রাজ্যকে তাঁর রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করেন। চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের সময়ে কলিঙ্গ রাজ্য মগধ থেকে আলাদা হয়ে যায়। দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত বা বিক্রমাদিত্যের মহাকবি কালিদাসের রঘুবংশ কাব্যে কলিঙ্গদেশের রাজার নাম উল্লেখ আছে হেমনগাদা নামে। সমুদ্রগুপ্তের রাজত্বকালে তিনি কলিঙ্গদেশ আক্রমণ করেন। গৌড়ের রাজা শশাঙ্ক উড়িষ্যার উত্তরাংশ আক্রমণ করে ৫৯০ থেকে ৬২৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেন। সপ্তম থেকে অষ্টম শতাব্দীতে দক্ষিণ কোশলদেশ থেকে সোমবংশীয় বা কেশরীবংশীয় রাজারা উড়িষ্যা আক্রমণ করে উড়িষ্যার রাজা হন। মন্দিরের উপরে প্রথম আক্রমণ করেন ৬৭০ খ্রিস্টাব্দে রাষ্ট্রকূট রাজা রক্তবাহু বা তৃতীয় গোবিন্দ।
ইতিহাসের পাতায় চোখ রাখলে আমরা দেখতে পাই জগন্নাথ দেবের মন্দিরের উপরে বহুবার আক্রমণ হয়েছে। ওড়িশায় জগন্নাথ দেবের মাদলাপাঁজি রাজভোগের ইতিহাস অনুসারে জানতে পারি রাজা যযাতি কেশরীর রাজত্বের প্রায় ১৪৬ বৎসর আগে রক্তবাহু নামে এক পরাক্রমশালী রাষ্ট্রকূট সম্রাট সমুদ্রপথে এসে উড়িষ্যার বহু অঞ্চল ধ্বংস করে পুরীতে এসে জগন্নাথ দেবের মন্দির ধ্বংস করেছিলেন। রক্তবাহু পুরীতে আসার পূর্বে মন্দিরের পূজারীরা তিন দারুমূর্তিকে মন্দির থেকে লুকিয়ে নিয়ে যেয়ে চিল্কা হ্রদের তীরে শোনপুর নামক এক অঞ্চলের গোপালী গ্রামে মাটির তলায় লুকিয়ে রেখে মাটির উপরের অংশে একটি বট গাছের চারা রোপণ করেছিলেন - উদ্দেশ্য ভবিষ্যতে যাতে এই চিহ্ন দেখে দারুমূর্তিগুলি উদ্ধার করে পুনরায় পূজার্চনা করা যায়। এরপরে প্রায় ১৪৬ বৎসর জগন্নাথ দেবের পূজার্চনা বন্ধ হয়ে যায়। কারণ দীর্ঘ সময়ের ব্যবধানে মন্দিরের পূজারীদের বিস্মৃতির ফলে সেই দারু মূর্তিগুলিকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। আনুমানিক ৮১৬ খ্রিস্টাব্দে জগদগুরু আদি শঙ্করাচার্য ভারতবর্ষের লুপ্তপ্রায় হিন্দু তীর্থ গুলি উদ্ধারের জন্য সমগ্র ভারতবর্ষ যখন পরিভ্রমণ করেছিলেন সেই সময়ে তিনি অন্ধ্রপ্রদেশের তীর্থস্থানগুলি উদ্ধার করে কলিঙ্গদেশে বৈতরণী নদী তীরে জাজনগরে (বর্তমানের জাজপুর) কলিঙ্গরাজ মহাভাবগুপ্ত যযাতি কেশরীর আতিথ্য গ্রহণ করেন। বৈতরণী নদীতে স্নান করে তিনি নারায়ণের যজ্ঞবরাহ মূর্তির দর্শন পেয়েছিলেন। জগন্নাথদেবের সবিশেষ তথ্য তিনি রাজার কাছে জানতে চাইলেন কিন্তু রাজা বা তার রাজসভার কেহই এই ব্যাপারে কোনো সদুত্তর দিতে পারলেন না। অগত্যা আচার্য শঙ্কর ধ্যানে বসে জানতে পারলেন পুরী থেকে কিছু দূরে চিল্কা হ্রদের তীরে শোনপুর নামক অঞ্চলে জগন্নাথ দেবের মূর্তি মাটির তলায় রাখা আছে। রাজা যযাতি কেশরী এই সংবাদ জানতে পেরে লোকলস্কর নিয়ে সেখানে যেয়ে বটবৃক্ষের তলায় খনন করে দেখলেন জগন্নাথ দেবের দারুমূর্তিগুলি নষ্ট হয়ে গেছে কিন্তু মূর্তির ব্রম্ভ অটুট আছে। আচার্য শংকরের উপদেশ মত ব্রহ্মগুলিকে পুরীর মন্দিরের রত্নবেদীর উপরে স্থাপন করা হলো। এরপরে দারুকাষ্ঠ থেকে নব কলেবরে মূর্তি নির্মাণ করে সেই মূর্তিগুলির ভিতরে ব্রহ্ম স্থাপন করে রত্নবেদীর উপরে প্রতিষ্ঠা করা হলো। আচার্য এর পরে তাঁর এক সন্ন্যাসীকে রাজা যযাতি কেশরী প্রেরিত দূতের সাথে নেপালরাজের কাছে পাঠিয়ে নেপালের রাজাকে অনুরোধ করলেন গণ্ডকী নদী থেকে শালগ্রাম শিলা দেওয়ার জন্য। আচার্যের অনুরোধে নেপালের রাজা সন্ন্যাসীর হাতে শালগ্রাম শিলা দিয়েছিলেন। শালগ্রাম শিলাগুলি আনার পরে আচার্য শঙ্কর তিন দেবতার নাভিদেশে মন্ত্রপূতঃ শালগ্রাম শিলা স্থাপন করে গ্রহগুলির প্রাণ প্রতিষ্ঠা করলেন এবং অবশিষ্ট শালগ্রাম শিলাগুলি রত্নবেদীর নীচে মন্ত্র সহকারে স্থাপন করলেন। নেপালের রাজা ব্রম্ভ দান করেছিলেন বলে জগন্নাথদেবের মন্দিরে পূজার্চনা ও সমস্ত ব্যাপারে পুরীর রাজার সমপরিমাণ অধিকার নেপালের রাজার। রাজা যযাতি কেশরী পুরীর মন্দিরে জগন্নাথদেবের প্রথম নবকলেবর অনুষ্ঠান করেছিলেন বলে তাঁকে ‘দ্বিতীয় ইন্দ্রদ্যুম্ন’ বলা হয়। এরপরে দীর্ঘ পাঁচশ বৎসরের অধিক সময় পুরীর জগন্নাথ দেবের মন্দিরের উপরে যদিও বিদেশী শক্তির আক্রমণ হয়েছিল কিন্তু প্রতিবারই তারা পরাজিত হয়। রাজা অনঙ্গভীমদেব-তৃতীয়ের পিতা রাজরাজাদেব তৃতীয়ের আমলে মুসলমান আক্রমণে ভারতবর্ষের এক বিশাল এলাকাজুড়ে হিন্দুধর্ম সংকটের মুখে পড়ে। সেই সময়ে ইখতিয়ার উদ্দিন বখতিয়ার খিলজী যদিও উড়িষ্যার উত্তরাংশে আক্রমণ করেছিল তথাপি রাজরাজাদেব তৃতীয়ের কাছে পরাজিত হয়ে বঙ্গের রাজধানী গৌড় অধিকার করে এবং তারপরে মগধ আক্রমণ করে। রাজরাজাদেব তৃতীয়ের আমলে বারংবার মুসলমান আক্রমণ প্রতিহত হয়ে আক্রমণের তীব্রতা স্তিমিত হয়ে যায়। এই সময়ে উড়িষ্যার জনসাধারণের মনে বিশ্বাস হয় প্রভু জগন্নাথদেবের কৃপায় বিধর্মীদের আক্রমণ থেকে উড়িষ্যা রক্ষা পেয়েছে।
এরপরে আমরা আলোচনা করব পুরীর জগন্নাথদেবের মন্দিরের উন্নতিকল্পে বিভিন্ন রাজবংশের রাজাদের অবদান এবং বিভিন্ন ঘটনাবলী। ১১১২ খ্রিস্টাব্দে সোমবংশীয় বা কেশরীবংশীয় রাজা কর্ণদেব বা কর্ণকেশরীর রাজত্বের সময়ে পূর্ব চালুক্য বংশের রাজা প্রথম রাজরাজার উত্তরপুরুষ অনন্তবর্মন চোড়গঙ্গদেব কলিঙ্গ রাজ্য আক্রমণ করে কর্ণকেশরীকে পরাজিত করেন এবং সমগ্র কলিঙ্গ রাজ্য অধিকার করার পরে পূর্বে গঙ্গাতীর থেকে দক্ষিনে গোদাবরীর তীর পর্যন্ত এক বিশাল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। এর অন্যতম কারণ পুরুষোত্তম ক্ষেত্রকে তার সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করা। প্রথম রাজরাজা পুরুষোত্তমদেবের একনিষ্ঠ ভক্ত ছিলেন। সোমবংশীয় রাজা যযাতি কেশরী যদিও শৈবধর্মে বিশ্বাসী ছিলেন তথাপি তিনি পুরুষোত্তম ক্ষেত্রে ভগবান পুরুষোত্তমদেবের একটি পাথরের মন্দির নির্মাণ করেছিলেন কিন্তু পুরুষোত্তম ক্ষেত্রে ভগবান পুরুষোত্তম দেবের পূজার ব্যাপারে সোমবংশীয় রাজাদের খুব একটা উৎসাহ ছিল না। পুরুষোত্তম ক্ষেত্রকে প্রথম রাজরাজা তাঁর সম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করতে চেয়েছিলেন কিন্তু তাঁর ইচ্ছা পূরণ হয়নি। প্রথম রাজরাজার অপূর্ণ ইচ্ছাকে পূর্ণতা দান করেছিলেন অনন্তবর্মন চোড়গঙ্গদেব। তিনি পুরুষোত্তম ক্ষেত্র অধিকার করার পরে ১১৩৫ খ্রিস্টাব্দে শ্রী জগন্নাথদেবের একটি সুউচ্চ মন্দির নির্মাণ কাজ শুরু করেছিলেন। দীর্ঘ বার বৎসরে সেই নির্মাণকার্য শেষ হয়নি। ১১৪৭ খ্রিস্টাব্দে তিনি মারা যাবার পরে সেই মন্দিরের নির্মাণকার্য সম্পূর্ণ হয় সপ্তম পুরুষ রাজা অনঙ্গভীমদেব তৃতীয়ের আমলে অর্থাৎ ১২৩৫ খ্রিস্টাব্দে। এক শত বৎসরে পুরীর মন্দির নির্মাণ কার্য শেষ হয়েছিল। মন্দিরের বিমান বা গর্ভগৃহের বেশিরভাগ অংশ অনন্ত বর্মন শেষ করেন। বিমানের অবশিষ্ট অংশ অর্থাৎ জগমোহন, নাটমন্দির যথাক্রমে অনঙ্গভীমদেব দ্বিতীয় ও তৃতীয়ের আমলে শেষ হয়। অনঙ্গভীমদেব তৃতীয়ের তাম্রলিপি থেকে জানা যায় ১২৩৫ খ্রিস্টাব্দের ১লা মার্চ বৃহস্পতিবার দুপুরে, একাদশী তিথি শুরু হওয়ার মুহূর্তে নতুন মন্দিরে শ্রী জগন্নাথদেব, বলভদ্রদেব ও সুভদ্রা দেবীর নতুন বিগ্রহ যথোচিত মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত হয়। মাদলাপাঁজিতেও বলা হয়েছে অনঙ্গভীমদেব তৃতীয় জগন্নাথ মন্দিরের নির্মাণকার্য শেষ করে নতুন বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এঁর রাজত্বকাল ছিল ১২১১ থেকে ১২৩৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত।
মন্দিরে জগন্নাথদেবের দারুমূর্তি কোন সময় থেকে পূজিত হচ্ছেন সে ব্যাপারে ঐতিহাসিকদের মধ্যে বিভিন্ন মত আছে। ডঃ হরেকৃষ্ণ মহতাবের মতে নীলমাধবের পূজা-অর্চনার দায়িত্ব ছিল শবরদের উপরে। তারা পাথরের মূর্তির পরিবর্তে কাঠের মূর্তি তৈরি করে পূজা-অর্চনা শুরু করেন। অষ্টম শতাব্দীতে শবরদের কাছ থেকে ভৌমকর রাজবংশ যখন মন্দিরের দায়িত্ব নেন তখন থেকে তিন মূর্তির দারু বিগ্রহের পূজা শুরু করেন। আবার ঐতিহাসিক ডঃ এস এন রাজগুরুর মতে অনঙ্গভীমদেব তৃতীয়ের পরে নরসিংহদেব প্রথমের আমলে (১২৩৮-১২৬৮) জগন্নাথ বলরাম ও সুভদ্রার দারুমূর্তি প্রথম পূজিত হন। গোঁড়া ব্রাহ্মণেরা দারুমূর্তিতে ভগবান শ্রী জগন্নাথদেবের পূজা মেনে নেন কারণ তাঁরা বিশ্বাস করতেন জগন্নাথদেবের আত্মা বা ব্রম্ভ শালগ্রাম শিলা রূপে মূর্তির ভিতরে রাখা আছে। দারুমূর্তি যেহেতু ভঙ্গুর সেজন্য কিছু দিন অন্তর এই দারুমূর্তি পরিবর্তিত করে নবকলেবর নামে একটি বিশেষ অনুষ্ঠান হয়। অবশ্য কখন মূর্তি পরিবর্তিত হবে এবং কোথায় ও কখন মূর্তির কাঠ পাওয়া যাবে সে ব্যাপারে জগন্নাথদেবের স্বপ্নাদেশ হয়। জগন্নাথদেবের যে দারু বিগ্রহ হয় সেটি একমাত্র নিমকাঠে হয়। এক্ষেত্রে পৌরাণিক বিশ্লেষণ এই যে দ্বাপর যুগে প্রভাস তীর্থে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের নিম গাছে বসে থাকা অবস্থায় দেহ নিষ্ক্রমণ হয়েছিল বলে নিম কাঠের মূর্তি নির্মিত হয়। বিভিন্ন সময়ে বিধর্মীদের হাতে উড়িষ্যা আক্রান্ত হয়েছিল কেবলমাত্র পুরীর জগন্নাথদেবের মন্দিরকে কেন্দ্র করে। বিভিন্ন ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়েও শ্রীভগবানের পূজা-অর্চনা চালু ছিল।
১৫৫৯ খ্রিষ্টাব্দে উড়িষ্যার রাজা হলেন চালুক্যবংশীয় মুকুন্দ হরিচন্দন। তাঁর সময়ে মন্দিরের শিখরে নীলচক্র স্থাপন করেন। এই নীলচক্র অষ্টধাতুতে তৈরী ভগবান বিষ্ণুর সুদর্শন চক্রের প্রতিরূপ। উচ্চতা ১২ ফুট ৮ ইঞ্চি এবং ব্যাস ৭ ফুট ৭ ইঞ্চি।নীলচক্রে দুটি চাকা ছিল। মোট আটটি চক্রনাভি নীল চক্রের ভিতর ও বাইরের চাকা দুটির সাথে সংযুক্ত ছিল। ব্রহ্মপুরাণে এই চক্রের কথা উল্লেখ আছে। প্রবাদ নীলচক্রের উপরে পবিত্র পতাকা না থাকলে জগন্নাথদেবের ভোগ হবে না। এছাড়াও রাজা মুকুন্দ হরিচন্দন জগমোহনের কিছু উন্নতি করেছিলেন। ১৫৯২ খ্রীষ্টাব্দে সম্রাট আকবরের প্রতিনিধি হিসেবে রাজা মানসিংহ উড়িষ্যাতে এসে জগন্নাথ মন্দিরের পূজা অর্চনার ব্যাপারে যথেষ্ট যত্নবান ছিলেন। সেই সময়ে খুরদার রাজা রামচন্দ্রদেব মন্দিরে অন্নভোগ নতুন করে শুরু করেছিলেন। রাজা মানসিংহের সময় জগন্নাথদেবের মন্দিরের মুক্তিমন্ডপের দুরবস্থা দেখে তার স্ত্রী গৌর রানী মুক্তি মন্ডপ নতুন করে নির্মাণ করিয়ে দেন। ষোলটি স্তম্ভের উপরে এই মুক্তিমণ্ডপ নির্মিত। প্রবাদ রাজা ইন্দ্রদ্যুম্নের সময়ে যখন শ্রী জগন্নাথদেবের মন্দির নির্মাণের কাজ হচ্ছিল বিশ্বকর্মার তত্ত্বাবধানে সেই সময়ে স্বয়ং ব্রম্ভা মুক্তিমন্ডপে বসে শিল্পীদের নির্দেশ দান করতেন। মুক্তিমণ্ডপে যে সকল ব্রাহ্মণেরা বসেন তারাই ওড়িয়া পঞ্জিকা তৈরি করেন। শ্রী জগন্নাথদেবের মন্দিরের প্রশাসনিক কাজ কর্মের ক্ষেত্রে আজও মুক্তিমন্ডপের গুরুত্ব অপরিসীম। এছাড়াও জগন্নাথদেবের মন্দিরে যারা পুজো করেন তাদের সম্পূর্ণ প্রশিক্ষিত করার দায়িত্ব মুক্তিমন্ডপের ব্রাহ্মণ পণ্ডিতদের। বীর কিশোর দেবের রাজত্বকালে(১৭৩৭-১৭৯৩) মন্দিরের পূর্বমুখী জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রার স্নান মণ্ডপ তৈরী হয়। জৈষ্ঠ্য মাসের পূর্ণিমার দিনে বৎসরে একবার এই মণ্ডপে তিন প্রভুর স্নানপর্ব সমারোহ সহকারে করা হয়। এই স্নান মণ্ডপে ৭৫ বর্গফুট পাথরের একটি স্নানবেদীতে বিগ্রহদের স্নান করানো হয়। তাঁর আমলে মন্দিরে বিগ্রহের রত্নবেদী বা রত্নসিংহাসন নতুন করে তৈরী করা হয়। বর্তমানের স্নানবেদীটি তাঁর সময়ের। এছাড়াও মন্দিরে তিনি প্রচুর স্বর্ণালঙ্কার দান করেন। সপ্তদশ শতাব্দীর প্রথমভাগে রাজা নরসিংহদেবের এক মন্ত্রী ছিলেন নীল পট্টনায়ক। মন্দিরের ভিতর প্রাচীরের মধ্যে ভগবান নীলমাধবের মন্ডপ তিনি নির্মাণ করে দেন। খুরদার রাজা দিব্যসিংহদেব স্নান মন্ডপের দক্ষিনে ‘চাহনি মন্ডপ’ নির্মাণ করে দেন। প্রশ্ন উঠতে পারে ‘চাহনি মন্ডপ’ কি এবং কেন হয়েছিল? প্রতি বৎসর উল্টোরথের দিনে গুন্ডিচা মন্দির থেকে যখন জগন্নাথদেব বলরাম ও সুভদ্রাকে নিয়ে ফিরে আসেন সেই সময়ে জগন্নাথ দেবের স্ত্রী মহালক্ষ্মী দেবী সখী পরিবৃতা হয়ে চাহনি মণ্ডপে এসে উপস্থিত হয়ে স্বামীর দিকে রোষকষায়িত চোখে তাকিয়ে থাকেন কারণ স্বামী জগন্নাথদেব রথযাত্রায় তাঁকে না নিয়ে গিয়ে ভগিনী সুভদ্রাকে নিয়ে গিয়েছিলেন বলে।
মারাঠাদের রাজত্বকালে মন্দিরের উন্নতি হয় কারণ মারাঠারা হিন্দু ছিলেন। তাদের সময়ে মন্দিরের পূজা অর্চনা, ভোগ নিবেদনের ব্যাপারে সতর্ক দৃষ্টি থাকতো। বিভিন্ন উৎসব যাতে ভালোভাবে সম্পন্ন হয় এবং বাৎসরিক খরচ মেটানোর জন্য সাতাশ হাজার টাকা রাজকোষ থেকে দেওয়া হতো। শ্রী জগন্নাথদেবের নামে একটি ‘এস্টেট’ তৈরি করেন। এছাড়াও পুরীর বিভিন্ন মঠকে জমি দান করেন। কোনারকের ভগ্নপ্রায় মন্দির থেকে পাথর খন্ড নিয়ে এসে ভোগমন্ডপের শ্রীবৃদ্ধি করা হয়। এছাড়াও কোনারক থেকে আনা পাথরে সিংহদ্বারের দক্ষিনে ৩৪ফুট উচ্চ অরুণস্তম্ভটি স্থাপন করা হয়। এখানে একটি অদ্ভুত সামঞ্জস্যের কথা জানাই। অরুণস্তম্ভের শিখর, নাটমন্দিরে গরুড়স্তম্ভের শিখর এবং রত্নবেদীর উপরের অংশের উচ্চতা একই মাপের। মারাঠাদের আমলে পুরীতে যে সকল তীর্থযাত্রী দক্ষিণ দিক থেকে আসতেন তাদের কাছে লোকনাথ ঘাটে তীর্থকর আদায় করা হতো, অনুরূপভাবে উত্তর দিক থেকে যারা আসতেন তাদের কাছে আঠারোনালা ঘাটে তীর্থকর আদায় করা হতো। তীর্থকর বাবদ প্রচুর টাকা রাজকোষে জমা পড়তো কিন্তু সে টাকার বেশিরভাগ তারা নিয়ে চলে যেতেন। উড়িষ্যার জনগণ বিশ্বাস করতেন রাজ্যকে সবসময় রক্ষা করছেন প্রভু জগন্নাথদেব।