ইলশেগুঁড়ি ২৯তম সংখ্যা (শারদীয়া)
ইলশেগুঁড়ি ২৯তম সংখ্যা (শারদীয়া)
কিছুদিন আগেও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ছিল দূর ভবিষ্যতের একটি কাল্পনিক বিষয়। কিন্তু অতি সম্প্রতি এই দূরবর্তী ভবিষ্যতের বিষয়টি আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অংশ হতে শুরু করেছে।
বিজ্ঞানের অভাবনীয় অগ্রগতিই কি শেষ পর্যন্ত মানব সভ্যতা বিনাশের কারণ হয়ে দাঁড়াবে? অষ্টাদশ শতক থেকে এই প্রশ্নে তোলপাড় কল্পবিজ্ঞানের জগত। সে বিতর্কে ভিন্ন মাত্রা যোগ করে লেখক সত্যজিৎ রায় পাল্টা প্রশ্ন করেন, যন্ত্রমানবের কি অনুভূতি-বিবেকবোধ-আনুগত্যের অস্তিত্ব থাকতে পারে? উল্লেখ্য, প্রফেসর শঙ্কু সিরিজের প্রথম গল্প 'ব্যোমযাত্রীর ডায়েরি'-তে রোবট বিধুশেখরের চরিত্রায়ণ থেকেই শুরু হয় তাঁর এই অন্বেষণ। পরবর্তী কালে 'প্রফেসর শঙ্কু ও রোবু' গল্পেও তা অব্যাহত। মনুষ্যরূপী যন্ত্রমানব বা অন্যান্ড্রয়েড 'অনুকূল'-ও ব্যতিক্রম নয়। পরিচালক সুজয় ঘোষ সত্যজিৎ রায়ের অসাধারণ এই ছোটগল্প শর্ট ফিল্মের আকারে ধরতে চেষ্টা করেছেন। কিছুদিন আগে 'অনুকূল' শর্ট ফিল্ম দেখলাম। তার আগে থেকেই আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স শব্দ-বন্ধটির সঙ্গে ভাসা ভাসা পরিচয় হয়েছে। শর্ট ফিল্মটি দেখার পর কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সম্পর্কে জানতে আগ্রহ আরও বেড়ে যায়।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা আর্টিফিসিয়াল ইন্টিলিজেন্স নিয়ে তোলপাড় গোটা পৃথিবী। মানুষের বুদ্ধিমত্তা ও চিন্তাশক্তিকে কৃত্রিম উপায়ে প্রযুক্তি নির্ভর করে যন্ত্রের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করাকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এ আই বলে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বলতে এক ধরনের যন্ত্রের উদ্ভাবনকে বোঝায় যার নিজস্ব চিন্তা-ভাবনা করার শক্তি আছে এবং মানুষের কোনও প্রকার হস্তক্ষেপ ছাড়াই নিজে নিজে সিদ্ধান্ত নিতে পারে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা হল একটি দ্রুত বিকশিত প্রযুক্তি যা আমাদের জীবনযাপন এবং কাজের পদ্ধতিতে আমূল পরিবর্তন নিয়ে আসছে। এই পদ্ধতি পুরোপুরি বাস্তবায়িত হলে মানুষের প্রয়োজন ছাড়াই কম্পিউটার সিস্টেমের দ্বারা কাজ হয়ে যাবে।
জন ম্যাক্যার্থি সর্বপ্রথম আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স নামক টার্মটি ব্যবহার করেন ১৯৫৫ সালে। পরের বছর নিউ হ্যামশায়ারের হ্যানোভার শহরস্থ ডার্টমাউথ কলেজে অনুষ্ঠিত এক একাডেমিক কনফারেন্সে তিনি তা প্রথম প্রকাশ করেন। এজন্য জন ম্যাক্যার্থিকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অন্যতম জনক বলা হয়। তাঁর অন্যান্য সহযোগীরা হলেন- মার্ভিন মিনস্কি, অ্যালেন নিউয়েল এবং হার্বাট এ সায়মন। সেই থেকে গুটি গুটি পায়ে হেঁটে চলা ধারণাটি আজকের দুনিয়ায় এক বিস্ময় জাগানিয়া পরিস্থিতি তৈরি করেছে।
কিছুদিন আগেও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ছিল দূর ভবিষ্যতের একটি কাল্পনিক বিষয়। কিন্তু অতি সম্প্রতি এই দূরবর্তী ভবিষ্যতের বিষয়টি আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অংশ হতে শুরু করেছে। তার প্রধান কারণ, পৃথিবীর মানুষ ডিজিটাল বিশ্বে এমনভাবে সম্পৃক্ত হয়েছে যে, হঠাৎ করে অচিন্তনীয় পরিমাণ ডেটা সৃষ্টি হয়েছে এবং সেই ডেটাকে প্রক্রিয়া করার মত ক্ষমতাশালী কম্পিউটার আমাদের হাতে চলে এসেছে। এই ডেটা বা তথ্যকে প্রক্রিয়া করার জন্য বিজ্ঞানী এবং প্রযুক্তিবিদরা এমন একটি পদ্ধতি বেছে নিয়েছে যেটি মানুষের মস্তিষ্কের মতো করে কাজ করে।
সাম্প্রতিককালে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের জগতে বড় ধরনের বিপ্লব ঘটে গেছে। বর্তমানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার ক্ষেত্র অনেক ব্যাপক। কৃষিক্ষেত্র, চিকিৎসা ক্ষেত্র শুরু করে পৃথিবীর প্রতিটি কেন্দ্রতে আজ এআই এর ব্যবহার উল্লেখযোগ্য। এটি মানুষের জীবনকে করে তুলেছে আরও সহজতর। এ আই এর মাধ্যমে গাছে বিভিন্ন রোগ নির্ণয় করা যায়। সারের পরিমাণ থেকে শুরু করে কখন সেচ প্রদান করতে হবে তাও আমাদের বলে সাহায্য করতে পারে। চিকিৎসা ক্ষেত্রেও রোগ নির্ণয় থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধরনের চিকিৎসা ও ছোটখাটো ঔষধ প্রদান এআই দ্বারা সম্ভব। এছাড়াও ব্যাংকিংয়ে, সেনাবাহিনীতে, নৌবাহিনীতে এআই-এর ব্যবহার বিপুলভাবে বেড়ে চলেছে। এর দ্বারা গাড়ি নির্মাণ, ওয়েবসাইট ব্রাউজ, রোবট নির্মাণ, মহাকাশ স্টেশন ইত্যাদিতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহৃত হচ্ছে। প্রযুক্তির এই অগ্রগতি মানুষের জন্য সুখবর।
জীবনকে সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যময় করে তোলার পাশাপাশি জন্ম দিয়েছে এক প্রশ্নের, এর ক্রমাগত প্রসার বিশ্ব সভ্যতার জন্য আশীর্বাদ বয়ে আনবে, নাকি হুমকির মুখে ঠেলে দেবে গোটা দুনিয়াকে? এআইয়ের প্রধান উদ্দেশ্য হল মানুষের ক্ষমতা অনুকরণ করা। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার এই ক্ষমতা দেখে অনেকেই আবার আশঙ্কিত। তারা মনে করছেন, গবেষণায় এখনই রাশ টেনে না ধরলে সমাজ ও মানবজাতি বড় ধরনের ঝুঁকির মুখে পড়বে। এই উদ্বেগ তৈরি হয়েছে মূলত চ্যাটজিপিটি নামের একটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বাজারে আসার পর। ভাষাভিত্তিক এই চ্যাটবট তার তথ্যভাণ্ডার বিশ্লেষণ করে প্রায় সব প্রশ্নেরই জবাব দিতে পারে। চ্যাটজিপিটির সঙ্গে রসিকতা করলে সে বুঝতে পারে। চ্যাটজিপিটি রচনা লিখতে পারে, চাকরির বা ছুটির আবেদন, যেকোনও রিপোর্ট তৈরি করতে পারে, এমনকি গান ও কবিতাও লিখতে পারে। মেশিনও এখন সৃষ্টিশীল হয়ে উঠেছে। আর এখানেই উদ্বেগর কালো মেঘ ঘনিয়ে আসছে বলে অনেকে মনে করছেন।
তাদের প্রশ্ন, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স যদি এমন কোনও সিদ্ধান্ত নেয় যা আমাদের বর্তমান সময়ের এথিকসের সাথে সংঘাতপূর্ণ, তখন কী হবে? সুতরাং একই সঙ্গে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা আশীর্বাদ ও অভিশাপ? কেন অভিশাপের এই ভীতি? বিজ্ঞানীদের একাংশে মত, এই ভয় অনেকটাই মানসিক। এটা হচ্ছে অজানাকে ভয় পাওয়ার মতো ভয়। কাজ হারানোর ভয়ের সঙ্গে সঙ্গে থাকছে প্রযুক্তির অপব্যবহারের আশঙ্কা। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের কারণে বহু মানুষের কর্মসংস্থান হুমকির মুখে পড়বে। গোল্ডম্যান স্যাকসের এক গবেষণায় দেখা গেছে যে সারা বিশ্বে ৩০ কোটি মানুষের চাকরি খোয়াবে। আরেকটি আন্তর্জাতিক সমীক্ষা বলছে, প্রায় এক তৃতীয়াংশ মানুষ আশঙ্কা করছে যে আগামী তিন বছরে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কারণে তারা চাকরি হারাবেন। ইতিমধ্যেই কন্টেন্ট রাইটাররা কর্মহীন হয়ে পড়ছেন। আরও যে বিষয়টি প্রকট হয়ে উঠতে পারে সেটা হচ্ছে বৈষম্য। একসময় বলতাম ডিজিটাল ডিভাইড। যার কাছে প্রযুক্তি আছে এবং যার কাছে প্রযুক্তি নেই তাদের মধ্যকার এই ব্যবধান নিয়ে কয়েক দশক ধরেই সোচ্চার ছিলেন অনেকেই। নতুন আশঙ্কা, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কারণে মানুষে মানুষে, সমাজে সমাজে এবং দেশে দেশে এই বিভাজন আরও বেড়ে যাবে।
জেফ্রি হিন্টন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার জগতে অন্যতম ‘গডফাদার’, সম্প্রতি গুগল থেকে ইস্তফা দিয়ে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন, আর কিছুকাল পরই চ্যাটবটরা মানুষের চেয়েও বুদ্ধিমান হয়ে যেতে পারে। তিনি কৃত্রিম বৃদ্ধিমত্তার ক্ষেত্রে যেসব উন্নতি হচ্ছে তার বিপদ সম্পর্কে সবাইকে সতর্ক করে দিয়েছেন। শুধু তাই নয়, এআইয়ের ক্ষেত্রে তিনি যেসব কাজ করেছেন তার জন্য তিনি অনুতাপও প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেন এআই চ্যাটবট থেকে এমন কিছু বিপদ হতে পারে যা রীতিমত ভয়ংকর। তাহলে মানুষের সঙ্গে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের এই প্রতিযোগিতা কি কখনও নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে? আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স কি একসময় মানুষের মতো সৃষ্টিশীল হয়ে উঠবে? মিলিয়ন ডলার প্রশ্ন।
অন্যপক্ষের মত, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের যতোই অগ্রগতি হোক না কেন মানুষের প্রয়োজন কখনোই ফুরাবে না। কম্পিউটার যখন বাজারজাত হয় তখনও মনে হয়েছিল প্রচুর মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়বে। বাস্তবে অন্য কথা বলে। হ্যাঁ, সাময়িক একটা ধাক্কা আসবে। হয়তো আগামী ত্রিশ বছর বিশ্বজুড়ে কর্মসংস্থানের একটা ভাটা আসবে। কিন্তু পুনরায় মানুষ সেই অস্থিরতা কাটিয়ে উঠবেই। মানবসভ্যতার ইতিহাস তার সাক্ষী। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কখনও নিয়ন্ত্রণের বাইরে যাবে না। হিউম্যান মাইন্ড, ব্রেইন না, সেটা অনেক বেশি ক্ষমতাবান। এই মাইন্ডের যে কল্পনা ও চিন্তা শক্তি, মেশিন এখনও সেটা পারে না। যন্ত্রের এই ক্ষমতা তৈরি হতে হতেই মানুষ এর সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নেবে। মানুষ যেহেতু এই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে বানাচ্ছে, মেশিন যদি কিছু কিছু জায়গায় মানুষকে ছাড়িয়েও যায়, মানুষ এটাকে তার গণ্ডির মধ্যেই রেখে দিবে। মানুষই নতুন নতুন প্রযুক্তি তৈরি করবে যা কৃত্রিম বৃদ্ধিমত্তাকে সামাল দেওয়ার রাস্তা বের করে ফেলবে।
সারা বিশ্বেই এআই প্রযুক্তি এখন স্পর্শকাতর বিষয়। প্রযুক্তিবিদরা বলছেন বর্তমানে আমরা যেভাবে জীবন-যাপন করি, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কারণে তা নাটকীয়ভাবে বদলে যেতে পারে। ভালো বা মন্দ উভয় অর্থেই। কিন্তু আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স জগত ও পৃথিবীর নেতৃত্ব যাদের হাতে তারা এর জন্য কতোটা প্রস্তুত? কিন্তু পৃথিবীতে ক্ষমতা যাদের হাতে, তারা ভবিষ্যতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার যে বিরাট উন্নতি হতে যাচ্ছে সেটির জন্য কতটা প্রস্তুত, তা নিয়ে সন্দেহ আছে বিশেষজ্ঞদের। মদ্দা কথা, এ ধরনের প্রযুক্তির নিয়ন্ত্রণ এবং অপব্যবহার বন্ধে কর্তৃপক্ষকে আইনগত সুরক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রসার আগামী দিনগুলোয় বিশ্ববাসীর জন্য স্বস্তি বয়ে আনবে, না দুর্ভোগ বাড়াবে– তা নিয়ে বোদ্ধা মহলে রয়েছে বিতর্ক। বিজ্ঞানের দ্রুত উন্নতি মানব জীবনে যে প্রশান্তির পরশ বইয়ে দিয়েছে, তা আরও বেগবান হবে, নাকি মানব সভ্যতাকেই কোনও এক অজানা বিপর্যয়ের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাবে—উত্তর ভবিষ্যতের গর্ভে।