ইলশেগুঁড়ি ২৯তম সংখ্যা (শারদীয়া)
ইলশেগুঁড়ি ২৯তম সংখ্যা (শারদীয়া)
ভারতের আধুনিক যুগ প্রবর্তক রাজা রামমোহন রায় তাঁর অসাধারণ মনীষা ও কর্মশক্তির প্রভাবে মধ্যযুগীয় ভারতকে হঠাৎ আধুনিক যুগের দ্বারদেশে এনে উপস্থিত করলেন, বহু বছরের সঞ্চিত জড়ত্বের যবনিকা অপসারিত করে মুক্তিসূর্যের আলোকে চতুর্দিক প্রদীপ্ত করে তুললেন। রামমোহন ভারতবর্ষের সেই দূত যিনি সর্বপ্রথম বিশ্বক্ষেত্রে ভারতের বাণীকে নিয়ে দাঁড়াতে পেরেছিলেন। মানব সভ্যতাকে তিনি সমগ্র করে দেখেছিলেন—এ মত কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের। রবীন্দ্রনাথের উপলব্ধি ও শ্রদ্ধা-সঞ্জাত মূল্যায়নে, রাজা রামমোহন রায় ছিলেন ভারত পথিক যে পথিক ভারতবর্ষের প্রবহমান মহাপথে পরিভ্রমণ করেছেন। প্রথমত, তাঁর বিচারে রামমোহন ছিলেন সেই মনন ও মূল্যবোধের মূর্ত প্রতীক, যা একান্তভাবে ভারতীয় ভারতীয় সংস্কৃতি ও সভ্যতার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। দ্বিতীয়ত, রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টিতে, রামমোহন ভারতচেতনা ও সামাজিক অগ্রগতির নতুন অভ্যুদয় ঘটাতে চেয়েছিলেন।
আড়াইশো বছর অতিক্রম করেও রামমোহন আজও আমাদের কাছে ঈশ্বর। তিনি গোঁড়া নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ পরিবারের সন্তান হয়েও অক্লেশে অক্লেশে বেদ-উপনিষদ, কোরান, বাইবেল আয়ত্ত করেছিলেন মূল ভাষায় সেগুলি পাঠ করে। বহু ভাষাবিদ রামমোহন একই সঙ্গে গভীরভাবে অধ্যয়ন করেছিলেন হিন্দু, বৌদ্ধ, ইসলামিক ও খ্রিস্টীয় শাস্ত্রাদি। ধর্মের বিরোধিতা তিনি করেননি, তাঁর বিরোধিতা ছিল ধর্মীয় অনুশাসনের প্রতি এবং এই উদ্দেশ্যে তিনি মিলন ঘটাতে চেয়েছিলেন বেদের উপনিষদভাষ্য, ইসলামের যুক্তিবাদী উপাদান এবং খ্রিস্ট ধর্মের একেশ্বরবাদী ভাবনার, যার ভরকেন্দ্রে ছিল যুক্তি। বেদ উপনিষদ, তন্ত্রশাস্ত্রকে আয়ত্ত করে এবং একই সঙ্গে ইসলামিক, জৈন, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টীয় ধর্মের মূল শাস্ত্রাদি অধ্যয়ন করে তিনি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, সব ধর্মই আসলে একেশ্বরবাদী এবং সেই কারণে ধর্মে ধর্মে আঘাত নয়, প্রয়োজন সমন্বয়। ১৯৭২ সালে এশিয়াটিক সোসাইটিতে এক বক্তৃতায় ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদার বলেছিলেন, রামমোহনকে বিচার করতে হবে হিন্দুত্বের দর্পনে। হিন্দুধর্মের মূল মানবিক উপাদানগুলির সঙ্গে তাঁর কোন বিরোধ ছিল না। ধর্মের একেশ্বরবাদী ব্যাখ্যা প্রদান করে তিনি ধর্মীয় সংকীর্ণতার গণ্ডিকে অতিক্রম করে পৌঁছে গেলেন বিশ্বজনীনতার ভাবনায়, যা গড়ে দিল তাঁর আন্তর্জাতিকতাধর্মী চিন্তার ভিত্তিকে, যেখানে প্রাধান্য পেল ব্যক্তিস্বাধীনতা ও মুক্তচিন্তার ধারণা। আধুনিক ভারতে রামমোহনই ছিলেন একমাত্র চিন্তাবিদ যিনি বেদান্ত দর্শনকে পুনরুজ্জীবিত করে তাকে ভারতবর্ষের সর্বোত্তম দর্শনের মর্যাদা দিয়েছিলেন।
রবীন্দ্রনাথের কথায় শেষ করি—
“বর্তমান বঙ্গ সমাজের ভিত্তি স্থাপন করিয়াছেন রামমোহন। আমরা সমস্ত বঙ্গবাসী তাঁহার সম্পত্তির উত্তরাধিকারী, তাঁহার নির্মিত ভবনে বাস করিতেছি।”
বিশ্ববরেণ্য বিজ্ঞানী অ্যালবার্ট আইনস্টাইন যিনি বিজ্ঞানজগতে আলোড়নকারী তত্ত্বের আবিষ্কর্তা—‘থিয়োরি অব রিলেটিভিটি’ (আপেক্ষিতাবাদ)। এটি হল পরমানু শক্তি উৎপাদনের ভিত্তি। গুরু-তত্ত্বের আবিষ্কর্তা হলেও এই বিখ্যাত মানুষটি মোটেই ভীষণ গম্ভীর বা রসবোধহীন ছিলেন না। আইনস্টাইন আবিষ্কৃত ফর্মুলাকে প্রয়োগ করে এটম বোমা তৈরির সম্ভাবনা কতটুকু—এই প্রশ্ন করা হয়েছিল খোদ আইনস্টাইনকে। রসিক মানুষ ছিলেন তিনি। তিনি বলেছিলেন—কাজটা এতই কঠিন যে, যে জঙ্গলে পাখি নেই, সেখানে রাতের অন্ধকারে পাখি শিকারের মতো। অবশ্য পরবর্তীকালে এহেন কঠিন কাজ সমাধান সমাধান করে ফেলেছিলেন বিজ্ঞানীরা। তাঁর জীবনের বেশকিছু ঘটনা থেকে মানুষ আইনস্টাইনের পরিচয় পাওয়া যায়। বারো বছর বয়স পর্যন্ত আইনস্টাইন খুব মসৃনভাবে কথা বলতে পারতেন না। স্কুলের ক্লাসে অন্য সতীর্থদের বিরক্ত করা আর দুষ্টু স্বভাবের জন্য তাঁকে সবাই ডাকত ‘রটারডাম রটার’ বলে। তাঁর ক্লেপটোম্যানিয়া নামে একটি অসুখ ছিল। যে কারণে ছেলেবেলায় আইনস্টাইন অজ্ঞানতাবশত প্রায়ই অন্যদের জিনিস চুরি করে ফেলতেন। অবশ্য পরবর্তীকালে এই রোগ থেকে মুক্তি পেয়েছিলেন।
যাই হোক, আইনস্টাইন একদিন আমেরিকার প্রিন্সটন থেকে ট্রেনে উঠেছেন। সে সময় বিজ্ঞানী হিসাবে তিনি খ্যাতির শীর্ষে। টিকিট পরীক্ষক যথারীতি আইনস্টাইনের কাছে এসে টিকিট চাইলেন। আইনস্টাইন তাঁর কোর্টের পকেটে হাত দিয়ে টিকিট বের করতে গিয়ে দেখলেন টিকিটটা সেই। তিনি তাঁর প্যান্টের পকেট, জামার পকেট, এমনকী ব্রিফকেস তন্ন তন্ন করে খুঁজলেন কিন্তু কোথাও টিকিটটি পেলেন না। আইনস্টাইনের অবস্থা দেখে সেই টিকিট-পরীক্ষক তাঁকে বললেন, ‘স্যার, আমি জানি আপনি কে! শুধু তাই নয়, ট্রেনে উপস্থিত অন্যান্যরাও আপনাকে চেনেন। আপনি টিকিট না কেটে উঠবেন, এটা হতেই পারে না।’ এই বলে টিকিট পরীক্ষক অন্য যাত্রীদের টিকিট পরীক্ষায় ব্যস্ত হয়ে পড়লেন।
এর কিছুক্ষণ পর সেই টিকিট পরীক্ষক খেয়াল করলেন যে, আইনস্টাইন এখনও টিকিট খুঁজে চলেছেন, ট্রেনের মধ্যে হাঁটু মুড়ে সিটের তলা পর্যন্ত হাতড়াচ্ছেন। টিকিট পরীক্ষক দেখে তখন আইনস্টাইনকে বললেন, ‘স্যার, আমি তো আপনাকে বললাম, আপনার টিকিট দেখানোর কোনও প্রয়োজন নেই, আপনি কেন শুধু শুধু খুঁজছেন।’ উত্তরে আইনস্টাইন বলেন, ‘আসলে আমি কোথায় যার সেটাই ভুলে গিয়েছি। তাই টিকিটটা না পেলে সেটা কিছুতেই মনে করা সম্ভব নয়।
আইনস্টাইনকে জীবনে বহু বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে তাঁর আবিষ্কার সম্পর্কে বক্তৃতা দিতে হয়েছে। এই সব দিনগুলিতে তাঁর সঙ্গী হিসাবে থাকতেন তাঁর এক গাড়ির চালক, হ্যারি। হ্যারি আইনস্টাইনের বক্তৃতার সময় পিছনের সারিতে বসে থাকতেন আর সবটা শুনতেন। একদিন হ্যারি আইনস্টাইনকে বলেন, প্রফেসর, আপনি আপনার ঐ আপেক্ষিকতাবাদ তত্ত্বের ওপর বক্তৃতাটা এতবার দিয়েছেন যে, আমার তো দাঁড়ি, কমা সুদ্ধ মুখস্থ হয়ে গিয়েছে।’ শুনে আইনস্টাইন বলেন, খুব ভালো কথা, আমার পরের সপ্তাহে ডর্টমাউথ যাওয়ার কথা। ওখানে আমাকে আগে কেউ দেখেনি, তুমি সেখানে আইনস্টাইন হয়ে বক্তৃতা দাও আর আমি তোমার জায়গায় ড্রাইভার হয়ে বসে থাকব। যেমন কথা তেমন কাজ। হ্যারি তো ডর্টমাউথে বক্তৃতা দিল। সবাই তো হ্যারিকেই আইনস্টাইন ভাবল। বক্তৃতার শেষে শ্রোতারা কঠিন কঠিন প্রশ্ন করতে লাগল। বিপদ থেকে উদ্ধারের জন্য হ্যারি বুদ্ধি খাটিয়ে ড্রাইভাররূপী আইনস্টাইনকে দেখিয়ে বললেন, ‘আপনাদের প্রশ্নগুলি এতটাই সোজা যে, এর উত্তর আমার ড্রাইভারই দিতে পারবে।’ বিজ্ঞানীর মতো তাঁর ড্রাইভারটিও বুদ্ধিমান ছিলেন।