ইলশেগুঁড়ি ২৯তম সংখ্যা (শারদীয়া)
ইলশেগুঁড়ি ২৯তম সংখ্যা (শারদীয়া)
আজি তব রথ/চলিয়াছে রাত্রির আহ্বানে/নক্ষত্রের গানে প্রভাতের সিংহদ্বার পানে।য়তাই স্মৃতি ভারে আমি পড়ে আছি ভারমুক্ত সে এখানে নাই।"
গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রত্যক্ষ স্পর্শে যেসব স্থান ধন্য হয়েছে যেখানে তাঁর কাব্য কবিতার উৎস খুলে গেছে আমার কাছে সেগুলি তীর্থস্থান। আর তাই জোড়াসাঁকো, শান্তিনিকেতন, শিলাইদহ, মংপু ভ্রমণে অনুভব করি তীর্থ দর্শনের পূণ্য। সেখানকার পরিবেশে পেয়েছি কবির স্নেহস্পর্শ,অনুভব করেছি তাঁর সান্নিধ্য। ঘুরেছি অনেক পাহাড়-পর্বত, নদনদী, জঙ্গল বা সমুদ্র, বাদ নেই কিছুই। ভ্রমণ করেছি অনেক তীর্থস্থানও। তবে রবীন্দ্র স্মৃতি বিজড়িত স্থানে পেয়েছি মনে তৃপ্তি। বিশ্বপ্রেমিক, মানবপ্রেমিক, প্রকৃতি প্রেমিক ও দার্শনিক কবির আসন সর্বদা আমার মনের মন্দিরে।
আমি দাঁড়িয়ে আছি জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির সদর দরজায়। যে বাড়িটার দেওয়াল, দরজা, জানালা এবং প্রতিটি আঙিনা জুড়ে রয়েছে কবি গুরুর স্পর্শ।
এই বাড়িতেই জন্মেছিলেন তিনি, বাল্যকাল শৈশব কাটিয়ে বৃদ্ধ বয়সে দেহ রেখেছিলেন। বাড়ির কোণায় কোণায় ছড়িয়ে আছে নানান টুকরো টুকরো ইতিহাস। তাই ঠাকুরবাড়ি প্রবেশ করার আগে জেনে নেব এ বাড়ি ইতিহাস আর কবির বংশ পরিচয়।
প্রথমেই বলতে হয় কবির পূর্বপুরুষ নীল মনি ঠাকুরের কথা। তিনিই উত্তর কলকাতার চিৎপুর রোডের পূর্ব দিকে, এই বসতবাড়ি নির্মাণ করেন ১৭৮৪ সালে। অবশ্য তার নাতি প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের আমলেই বাড়ির গৌরবময় অধ্যায় শুরু হয়। জোড়াসাঁকর জমিতেই দ্বারকানাথ তৈরি করেন তাঁর ভদ্রাসন। এইখানেই ১৮৬১ সালে রবীন্দ্রনাথ জন্মগ্রহণ করেন। এই ভবনটি এখন মহর্ষি ভবন নামে পরিচিত। ১৮২৩ সালে পাশ্চাত্যের অতিথিদের জন্য দ্বারকানাথ বৈঠকখানা বাড়ি নামে আরেকটি ভবন তৈরি করেছিলেন। ১৮৯৭ সালে মহর্ষি ভবনের পশ্চিমে বিচিত্র ভবন তৈরি করিয়েছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। স্বাধীনতার পরে জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি অধিগ্রহণ করে। ১৯৬২ সালে স্থাপিত হয় বিশ্বভারতী মিউজিয়াম। মিউজিয়ামের দর্শকদের জন্য রয়েছে দ্বারকানাথ, দেবেন্দ্রনাথ, রবীন্দ্রনাথ, অবনীন্দ্রনাথ গগনেন্দ্রনাথ প্রমুখের ব্যবহৃত নানা জিনিস। শিল্পকলা নিয়েও আছে সংগ্রহশালা।
প্রিন্স দ্বারকানাথ একদিকে যেমন ইংরেজ বনিকদের সাথে ব্যবসা করে প্রচুর অর্থ লাভ করেন অন্যদিকে তেমনি তিনি প্রাচ্য ও প্রতিচ্য উভয় দেশের সভ্যতা ও সংস্কৃতির মিলনের পথ প্রশস্ত করেন। দ্বারকানাথের জ্যেষ্ঠ পুত্র মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ও প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের চিন্তা ধারায় এক নতুন পথের সন্ধান করেন। জাতির সমগ্র চেতনা ও কল্যাণকর্মের সঙ্গে তার অবিচ্ছেদ্য যোগ ছিল। ফলে তার সন্তান এবং ভ্রাতুষ্পুত্রদের মধ্যেও এক নবজাগ্রত ভারতের শিল্প সংস্কৃতির রূপরেখা অঙ্কিত হয়। দেবেন্দ্রনাথের জ্যেষ্ঠ পুত্র দীজেন্দ্রনাথ অসামান্য মনীষীর অধিকারী ছিলেন। কাব্যে দর্শনে সঙ্গীতে চিত্রকলায় এবং গণিতে তাঁর বুৎপত্তি ছিল। মধ্যমপুত্র সত্যেন্দ্রনাথ ছিলেন প্রথম ভারতীয় আই সি এস। দেবেন্দ্রনাথের পঞ্চম পুত্র জ্যোতিরিন্দ্র নাথ নাট্য রচনায় সঙ্গীতে চিত্রাঙ্কনে এবং স্বাদেশিকতায় প্রতিভায় পরিচয় দিয়েছিলেন। কিন্তু ঠাকুর পরিবারের নিহারিকার অসংখ্য জ্যোতিষ্কপুঞ্জের মধ্যে ভাস্বর জ্যোতিষ্ক ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। পিতামহের ঐশ্বর্য, পিতার রাজর্ষি তুল্য ব্যক্তিত্ব এবং অগ্রজদের শিক্ষা ও সংস্কৃতি এবং শিল্প প্রীতি সবকিছুই পুঞ্জিভূত হয়েছিল রবীন্দ্র প্রতিভার মধ্যে।
রবীন্দ্রনাথ একাধারে ছিলেন কবি দার্শনিক, উপন্যাসিক ছোটগল্প লেখক নাট্যকার সুরকার, গীতিকার, প্রবন্ধকার, পত্র লেখক সাহিত্য, সমালোচক। প্রত্যেক বিভাগেই তার রচনা ছিল অসাধারণ শিল্পসমৃদ্ধ এবং অপরূপ সৌন্দর্যময়। উনবিংশ শতাব্দীর বাঙালির সমগ্র চেতনা প্রেরণা ধ্যান ধারণা, তার সমগ্র চিন্ময় সত্তা তাঁর মধ্যেই চূড়ান্ত বিকাশ ও প্রকাশ লাভ করেছিল।
জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে ছিল এই সময় এক আধুনিক বাংলার শিল্প সাহিত্য ও সাংস্কৃতির অন্যতম প্রধান কেন্দ্র। এক কথায় বঙ্গীয় নবজাগরণ বা বাংলা রেনেসাঁসের এক গুরুত্বপূর্ণ পিঠস্থান ছিল এই বাড়ি।
জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে প্রবেশ করেই অনুভব করি এ শুধু মাত্র একটা বাড়ি নয় এ তো বাঙালির তীর্থস্থান। বর্তমানে এবাড়ি একটি প্রদর্শনশালা বা মিউজিয়ামের রূপ নিয়েছে। এখানে রয়েছে রবীন্দ্রনাথ ও ঠাকুর পরিবারের বিভিন্ন পরিজনের ব্যবহৃত নানান সামগ্রী। বাড়ির দোতলা থেকেই এই মিউজিয়াম আরম্ভ হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ যে ঘরে প্রয়াত হন তা আজ রবীন্দ্র প্রয়াণ কক্ষ নামে খ্যাত। তার ব্যবহার করা বিছানা আজও রয়েছে সুন্দরভাবে কাঠের বেষ্টনীর মধ্যে। তাঁর প্রায় শেষ দিকের লেখা কবিতা—
তোমার সৃষ্টির পথ রেখেছো আকীর্ণ করি
বিচিত্র ছলনা-জালে, হে ছলনাময়ী।
মিথ্যা বিশ্বাসের ফাঁদ পেতেছ নিপুন হাতে সরল জীবনে।
এই প্রবঞ্চনা দিয়ে মহত্তেরে করেছ চিহ্নিত
তার তরে রাখোনি গোপন রাত্রি।
(৩০ জুলাই ১৯৪১)
এই বাড়িতেই কবির সঙ্গে থাকতেন কবি পত্নী মৃণালিনী দেবী। রয়েছে কবি পত্নীর ব্যবহৃত দুটি ঘর। সেখানে রাখা আছে তাঁর ব্যবহৃত নানা সামগ্রী। রয়েছে বেতের চেয়ার টেবিল যেগুলি ব্যবহার করতেন ঠাকুর পরিবারের সদস্যরা। পরের ঘরটিতে রাখা আছে কবির ব্যবহৃত পোশাক জোব্বা আর টুপি। এছাড়া রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মকক্ষ ঠাকুরবাড়ির পাকঘর সবই সুন্দর করে সাজানো রয়েছে। পাক ঘরের মেঝেতে উনুন এবং দেওয়ালে আটকানো আছে চিনা মাটি আর পাথরের বাসনপত্র। খাওয়ার ঘরে রয়েছে চেয়ার টেবিল যেখানে বসে ঠাকুরবাড়ির সদস্যরা খেতেন। রয়েছে ঠাকুরবাড়ির প্রশস্ত বারান্দা। কিশোর রবীন্দ্রনাথের অনেক স্মৃতি জড়িয়ে আছে বারান্দাটির সঙ্গে। এইখানেই পাঠশালা বসতো মাদুর পেতে। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন—‘‘বাড়িতে দিনরাত্রি সাহিত্যের আবহাওয়া বহিত, মনে পড়ে, যখন শিশু ছিলাম, বারান্দার রেলিং ধরিয়া দাঁড়াইয়া থাকিতাম, সন্ধ্যায় বৈঠকখানা বাড়িতে আলো জ্বলতেছে, লোক চলিতেছে, বড় বড় গাড়ি আসিয়া দাঁড়াইতেছে। কি হইতেছে ভালো করিয়া বুঝিতাম না। কেবল অন্ধকারে দাঁড়াইয়া সেই আলো মালার দিকে তাকাইয়া থাকিতাম।’’
বাড়ির পাশেই বিচিত্রা ভবন এখানে বসেই কবিগুরু বহু সাহিত্য সৃষ্টি করেছেন। এছাড়া ঠাকুরবাড়িতে আছে তিনটি আর্ট গ্যালারি। সে সব গ্যালারিতে রয়েছে কবি এবং পরিবারের লোকেদের নানান দুর্মূল্য তৈলচিত্র।
নিচে আয়তাকার উঠোনের একদিকে রয়েছে স্থায়ী মঞ্চ আর একদিকে পুজোর ঘর। দ্বারকানাথের সময়ে বহু জাঁকজমকে পুজোচর্না হোত। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ব্রাহ্ম ধর্ম গ্রহণ করার পর পৌত্তলিক পুজো অর্চনা বন্ধ হয় এবং পরবর্তীকালে এখানে নাট্য উৎসব, মাঘোৎসব, গান-বাজনা এবং নানারকম সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, সাহিত্য সভা ইত্যাদি লেগেই থাকতো।
ঠাকুরবাড়ি ঘুরতে ঘুরতে মনে হবে আমার প্রাণের ঠাকুর রবীন্দ্রনাথের সান্নিধ্য পাচ্ছি যেন প্রতিটি ঘরে কোনায় কোনায় তার আশীর্বাদের গান কবিতা ভেসে বেড়াচ্ছে আকাশে বাতাসে।
শান্তিনিকেতন হলো মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্থাপিত এবং তাঁর সুযোগ্য পুত্র কবি গুরু রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিবিজড়িত তীর্থভূমি।
১৮৬৩ খ্রিস্টাব্দে মার্চ মাস থেকে শান্তিনিকেতনের পত্তন হয়। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ রায়পুরের জমিদারের কাছ থেকে শান্তিনিকেতন দখলদারি পাট্টা গ্রহণ করেন। পরে এখানে আশ্রম স্থাপন ও মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন।
১৮৭৩ সালে পিতা দেবেন্দ্রনাথের সঙ্গে প্রথম শান্তিনিকেতনে আসেন। তখন তাঁর বয়স ১২ বছর। ১৮৭৮ এ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আর একবার শান্তিনিকেতনে এসেছিলেন তখন তার বয়স মাত্র ১৭ বছর। ১৯০১ সালের ২২শে ডিসেম্বর রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনে ব্রহ্ম বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। শান্তিনিকেতন ছিল একটি আশ্রমিক বিদ্যালয় এবং প্রাচীন ভারতীয় ঐতিহ্যের উপর ভিত্তি করে শিল্পের কেন্দ্র এবং ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক সীমানা অতিক্রম করে মানবতার এবং ঐক্যের এক মিলনস্থল। এ হলো রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টি ও দর্শনের এক মূর্ত প্রতীক যেখানে শিক্ষা প্রকৃতির উপলব্ধি সংগীত এবং শিল্পকলার সমন্বয় হয়েছে। বিশ্বের সমস্ত প্রান্তের মানুষ এক পরিবার হিসাবে একত্রিত হতে পারে এখানে। রবীন্দ্রনাথ তার নিজস্ব শিক্ষা চিন্তার ভিত্তিতে শান্তিনিকেতন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। প্রকৃতির আদর্শ পরিবেশে শিক্ষাদান প্রাচীন ভারতের আশ্রমিক শিক্ষা ভাবনা ছিল এর মূল মন্ত্র। শিক্ষা হবে মানবতার শিক্ষা, শিক্ষার মাধ্যম হবে মাতৃভাষা। শিক্ষার্থীদের সর্বাঙ্গীর বিকাশে গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন তিনি। দৈহিক, মানসিক, সামাজিক, আধ্যাত্মিক, বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রভৃতির বিকাশ হবে এই শিক্ষায়। শিক্ষার পাঠক্রম হবে কর্মকেন্দ্রিক, তাত্ত্বিক এবং ব্যবহারিক জ্ঞানলাভ করাই হবে এই শিক্ষার উদ্দেশ্য।
১৯১৮ সালে শান্তিনিকেতনের ব্রহ্মচর্য আশ্রম বিশ্বভারতীতে রূপান্তরিত হয়। পরে বিশ্বভারতী অর্জন করে এক কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদা।
আজ চলে এসেছি রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতনের মূল ফটকে। এ শুধু বাঙালি নয় বিশ্বের সাহিত্য প্রেমীদের কাছেই এক তীর্থ ক্ষেত্র, এক শান্তির আশ্রয়।
গাছের মাথায় সকালের সোনা রোদ যখন চিকচিক করছে তখন আমরা ছাতিমতলায়। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের স্মৃতি বিজড়িত এই ছাতিমতলা। এইখানেই তিনি তাঁর প্রাণের আরাম, মনের আনন্দ ও আত্মার শান্তি পেয়েছিলেন।
সামনে শান্তিনিকেতন ভবন আশ্রমের সবচেয়ে পুরনো বাড়ি, কৈশোরে বাবার সঙ্গে হিমালয় যাওয়ার পথে রবীন্দ্রনাথ এখানে কিছুদিন বাস করেন। বাড়ীটির সামনে রামকিঙ্কর বেইজ নির্মিত একটি বিমূর্ত ভাস্কর্য রয়েছে। চলেছি রঙিন কাঁচ দিয়ে ঘেরা উপাসনা গৃহ বা ব্রাহ্ম মন্দিরে। ১৮৯২ সালে এই মন্দিরের উদ্বোধন হয় সামনে উপবৃত্তে সাজানো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শেষ কুড়ি বছরের বাড়িগুলি। বাঁদিকে সুবিশাল উদয়ন, কোনার্ক, শ্যামলী, পুনশ্চ আর উদীচী। সূর্যকে বিভিন্ন ঋতুতে বিভিন্ন দিক থেকে সরাসরি দেখবার জন্য কবি কল্পনায় এই বাড়িগুলি তৈরি হয়। তার অসংখ্য কালজয়ী লেখা এইখানেই সৃষ্টি হয়েছে। উদয়ন ভবনে রয়েছে রবীন্দ্র জাদুঘর। কবির বহু পান্ডুলিপি, চিঠিপত্র, আলোকচিত্র এবং আঁকা ছবি আছে এখানে। তার ব্যবহৃত জিনিসপত্র, নোবেল পুরস্কারের রেপ্লিকা বিভিন্ন দেশ থেকে পাওয়া উপহার বাদ্যযন্ত্র, ব্যবহৃত কলম সহ অনেক কিছুই আছে সুন্দর ভাবে সাজানো। ছড়িয়ে রয়েছে বিভিন্ন ভাস্কর্য আর শিল্পকলা। প্রকৃতির খোলা মাঠে চলেছে আদর্শ শিক্ষাদান।
কবিগুরুর শান্তিনিকেতন যেন এক বিশ্ব তীর্থ। শহরের কোলাহল থেকে প্রকৃতির এই পরিবেশ আজও আকর্ষণ করে দেশ-বিদেশের পর্যটককে। রবীন্দ্রনাথের এই স্বপ্নময় শান্তিনিকেতন যেন আজও তাঁর উজ্জ্বল উপস্থিতি অনুভব করে।
এবার আসি শিলাইদহের কথায়। রবীন্দ্রনাথের স্মৃতি বিজড়িত শিলাইদহ এখন বিদেশ। বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা থেকে এর দূরত্ব ২০৩ কিলোমিটার। অবিভক্ত ভারতবর্ষে শিলাইদহ ছিল রবীন্দ্রকাব্য সৃষ্টির অন্যতম মঞ্চ। রবীন্দ্রনাথ জমিদারি দেখাশোনার দায়িত্ব নিয়ে প্রথম শিলাইদহ আসেন ১৮৮৯ সালের নভেম্বর মাসে। পরবর্তীকালেও মাঝে মাঝে আসতেন এবং এই কুঠি বাড়িতেই থাকতেন। পদ্মার ভাঙ্গনে পুরনো কুঠিবাড়ি বিলীন হওয়ার আশঙ্কায় নতুন কুঠিবাড়ি নির্মাণ করা হয়। ১৮৯১ থেকে ১৯০১ সালের মধ্যে ১ দশকেরও বেশি সময় রবীন্দ্রনাথ অনিয়মিত বিরতিতে এখানে বাস করেছেন।
শিলাইদহে রবীন্দ্রনাথের কাছে আসতেন বহু গুণীজন। কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘গুণীজন’, ‘শিলাইদহের স্মৃতি’ থেকে জানা যায় বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসু, কবি নাট্যকার দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, নাটোরের মহারাজা জগদিন্দ্রনাথ, কবি মোহিতলাল মজুমদার প্রমুখ ও গুণীজন এসেছিলেন নানা সময় এই শিলাইদহের কুঠিবাড়িতে। শিলাইদহের কুঠিবাড়ি সেকালের রবীন্দ্রভবন হিসেবে সারা ভারতের সংস্কৃতি সেবীদের মনোযোগ আকর্ষণ করেছে। শিলাইদহের মনোরম পরিবেশের মধ্যেই কবিগুরুর সাহিত্য সাধনার মূল উৎসের সন্ধান পাওয়া যাবে। পদ্মার তীরে এই বিচিত্র পল্লী পটভূমিকায় রবীন্দ্র মানসের বিশ্ব প্রকৃতির সঙ্গে প্রথম শুভদৃষ্টি বিনিময় হয়েছিল।
‘‘আমার যৌবন প্রৌঢ় বয়সের সাহিত্য সাধনার তীর্থস্থান ছিল পদ্মা প্রবাহচুম্বিত শিলাইদহ পল্লীতে’’—রবীন্দ্রনাথের নিজের এই সুস্পষ্ট স্বীকৃতি রবীন্দ্র জীবনে শিলাইদহের স্থান ও নির্দিষ্ট করে দিয়েছে। তাঁর কর্ম ও সাহিত্যরস সাধনার আদি তীর্থ শিলাইদহ জীবন। সাহিত্যিক জীবনের পরম লগ্ন উপস্থিত হয়েছিল তাঁর শিলাইদহ শাহজাদপুর কালী গ্রামের দীর্ঘ ৩০ বছর বাসের ফলে। শিলাইদহ অঞ্চলের পল্লী বাংলার ঐশ্বর্য শস্যক্ষেত্র, মাঠ ঘাট, বন, কৃষকের কুটির মুগ্ধ করেছে কবিকে। পদ্মা তীরের শান্ত পল্লীপ্রকৃতি, তীরস্থ গ্রাম্য জীবন লীলা স্থান করে নিয়েছে তাঁর লেখনীতে। ১৮৯১ থেকে ১৯০১ সাল পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথ এ অঞ্চলে কাটিয়েছেন। সমগ্র রবীন্দ্র সাহিত্য সৃষ্টিকালে এই দশক সবদিক দিয়ে সফলতম এবং শ্রেষ্ঠ। প্রমথনাথ বিশীর কথায় ‘‘রবীন্দ্র জীবনের কিঞ্চিদধিক আশি বছর কালকে আটটি দশকে ভাগ করে বিচার করলে দেখা যায় যে চতুর্থ দশকটি তাঁর কর্মজীবনের সফলতম কাল।’’
চতুর্থ দশকে যে সোনার ফসল তার তুলনা হয় না। সোনার তরী, চিত্রা, চৈতালী, কণিকা, ক্ষণিকা, কল্পনা, কথা, নৈবেদ্য, চিত্রাঙ্গদা, মালিনী, গান্ধারীর আবেদন, বিদায় অভিশাপ, কর্ণ কুন্তী সংবাদ, নরক বাস, সতী, লক্ষ্মীর পরীক্ষা, এসব ছাড়া আছে ছোটগল্প অনেকগুলি এবং ছিন্নপত্রাবলীর পত্রগুচ্ছ। ‘‘তাঁর হাত দিয়ে যেসব ছোট গল্প বেরিয়েছিল তা আজও সাহিত্যের আকাশে নক্ষত্রের মতো জ্বলজ্বল করছে।’’
কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথ পিতৃস্মৃতি তর্পণ করে বলেছেন—‘‘বাবার গদ্য ও পদ্য দু’রকম লেখারই উৎস যেন খুলে গিয়েছিল শিলাইদহে এমন আর কোথাও হয়নি।’’ রবীন্দ্রনাথের অসাধারণ রচনা ছিন্নপত্র এই শিলাইদহ থেকেই লেখা। তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্রী ইন্দিরা দেবীকে ৫৬টি চিঠির মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলেছেন বাংলাদেশের আকাশ, নদী, মাঠ, দুপুরের সন্ধ্যে রোদ, আলো হাওয়া বর্ষা, রাত ও অন্ধকার। প্রাণ খুলে বর্ণনা করেছেন প্রকৃতির বৃহৎ উদার বাক্যহীন স্পর্শ। প্রকৃতির মাঝেই কবি পেয়েছেন মানসিক শান্তি। ছিন্নপত্রে আছে বাংলাদেশের প্রকৃতি, তুচ্ছাতিতুচ্ছ বিষয়বস্তু, প্রাণী উদ্ভিদের নিখুঁত বর্ণনা, কলকাতার কোলাহল থেকে শিলাইদহের নির্জন পরিবেশ কিছুই বাদ নেই এতে। প্রকৃতির বৃহৎ উদার বাক্যহীন স্পর্শ তাঁর বর্ণনায় স্থান পেয়েছে।
রবীন্দ্রনাথ যখন ছিন্নপত্রের চিঠি গুলো লেখেন তখন তিনি ছিলেন টগবগে তরুণ। প্রমত্ত পদ্মার অপরূপ সৌন্দর্য গ্রাম বাংলার প্রকৃতির সুন্দর রূপ ধরা দেয় তাঁর লেখনীতে। এখানের প্রতিটি বার্তায় আছে বাংলার মাটির গন্ধ। এইখানেই জীবন ও প্রকৃতির সৌন্দর্য দর্শন ঘটে। তাঁর কাছে তখন সত্যই সুন্দর, সুন্দরই সত্য হয়ে ধরা দেয়, প্রকৃতির গভীরে অন্তর্দৃষ্টি ফেলে পাঠকের মনজগতে তাঁর ভাব সম্পদ পাঠাতে সমর্থ হন। কবির ভাষায়—‘‘পৃথিবী যে বাস্তবিক কি আশ্চর্য সুন্দরী তা কলকাতায় থাকলে ভুলে যেতে হয়। এই যে ছোট নদী তীরে শান্তিময় গাছপালার মধ্যে সূর্য প্রতিদিন অস্ত যাচ্ছে এবং এই অনন্ত ধূসর নির্জন নিঃশব্দ অভ্যুদয় হচ্ছে জগত সংসারে একটা মহৎ ঘটনা তা এখানে থাকলে তবে বোঝা যায়।’’ (ছিন্নপত্র ১০)। আবার প্রকৃতি বর্ণনায় তাঁর লেখায় পাই—‘‘পৃথিবী যে কি আশ্চর্য সুন্দর এবং কি প্রশস্ত প্রাণ এবং গভীরভাবে পরিপূর্ণ তা এইখানে না এলে মনে পড়ে না। যখন সন্ধ্যেবেলা বোটের উপর চুপ করে বসে থাকি, জল স্তব্ধ থাকে, তীর আবছা হয়ে যায় এবং আকাশের প্রান্তে সূর্যাস্তের দীপ্তি ক্রমে ক্রমে ম্লান হয়ে যায় তখন আমার সর্বাঙ্গে এবং সমস্ত মনের ওপর নিস্তব্ধ নতনেত্র প্রকৃতির কি একটা বৃহৎ উদার বাক্যহীন স্পর্শ অনুভব করি। (ছিন্নপত্র ৩১)
প্রকৃতির মধ্যেই যেন কবি পেয়েছেন এক অপরূপ বিশ্বরূপের দর্শন। এই শিলাইদহেই রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে পরিচয় হয় সেখানকার বাউলদের। বাউলদের দর্শন, কথা, সুর রবীন্দ্রনাথকে শুধু মুগ্ধ করেনি প্রভাবিতও করেছিল। তাঁর গানে বেজে উঠেছিল সেই সুর—
‘‘ভেঙে মোর ঘরের চাবি নিয়ে যাবি কে আমারে
ও বন্ধু আমার
ভেঙে মোর ঘরের চাবি নিয়ে যাবি কে আমারে
ও বন্ধু আমার
না পেয়ে তোমার দেখা একা একা
দিন যে আমার কাটে নারে’’
১৮৯০ সালের শেষভাগ, রবীন্দ্রনাথ এলেন শিলাইদহে। পরিচিত হতে থাকলেন বাউল ফকিরদের সঙ্গে। ওই শিলাইদহ পোস্ট অফিসের পিয়ন গগন হরকরার বাউল গানে আকৃষ্ট হন কবি। তাঁর রচিত ও গাওয়া গান কোথায় পাব তারে/আমার মনের মানুষ যেরে কবিকে মুগ্ধ করে। আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি, এই বাণীর সঙ্গে গগনের গানের সুর যোজনা করেন। লালন ও রবীন্দ্রনাথের মুখোমুখি সাক্ষাৎ হয়েছিল কিনা তা নিয়ে দ্বিমত আছে তবে সবাই একমত যে রবীন্দ্র রচনায় লালনের গানের প্রভাব ব্যাপকভাবে পড়েছিল । লালনের অনুসারী অনেক বাউলের সঙ্গে দেখা হয়েছিল কবির। বাউল গানের সুর তাঁকে মুগ্ধ করেছিল। তাঁর নিজের ভাষায়—‘‘আমার অনেক গান বাউলের ছাঁচে, কিন্তু জাল করতে চেষ্টা করিনি, সেগুলো স্পষ্টত রবীন্দ্র বাউলের রচনা।’’ লালনের দর্শন প্রচার করে যিনি বিশ্ব মানসে প্রতিষ্ঠা করেছেন তিনি অবশ্যই রবীন্দ্রনাথ। আর সে দর্শন স্থান পেয়েছে রবীন্দ্রনাথের লেখনীতে। তাইতো তিনি হয়ে উঠেছেন রবি বাউল।
এখন আমার সামনে রবীন্দ্র কুঠি শিলাইদহ। আম, কাঁঠাল ও অন্যান্য চিরসবুজ গাছ আর ফুলের বাগান আর দুটো পুকুর সহ ১১ একর জুড়ে এই কুঠিবাড়ি প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরে ওঠে মনটা। একটা বেষ্টনী প্রাচীর দিয়ে ঘেরা এই কুঠিবাড়ির আকর্ষণীয় প্রবেশ তোরণ পেরিয়ে প্রবেশ করলাম কুঠিবাড়িতে। মনে হল প্রকৃতির মাঝে দাঁড়িয়ে কবি অভ্যর্থনা করছেন আমাদের। এগিয়ে চলেছি কুঠিবাড়ির প্রবেশদ্বারের দিকে।
তিন তালা এই কুঠিবাড়ির কামরার সংখ্যা ১৮টি। নিচ তলায় নটি দোতলায় সাতটি এবং তিন তলায় দুটি কামরা রয়েছে। কুঠিবাড়ির দোতালা পূর্ব দিকে বড় কামরায় রবীন্দ্রনাথ নিজে শয়ন করতেন। স্ত্রী বিয়োগের পর তেতালার একখানা প্রকোষ্ঠ ও স্নানের ঘর তৈরি হয়। রবীন্দ্রনাথ ওই ঘরেতেই পরবর্তীকালে সাহিত্য সাধনা করতেন এবং এইখানেই ইংরেজি গীতাঞ্জলির জন্ম হয়। কবি মুগ্ধ হতেন ছাদের ওপর বসে সূর্যোদয়, সূর্যাস্ত এবং জোৎস্না প্লাবিত প্রাকৃতিক শোভায়।
পদ্মা এখন একটু দূরে। তখন ঘরে বসেই কবি শুনতে পেতেন পদ্মার ডাক। প্রাচীন ঐতিহ্য ও জমিদারি নিদর্শনের অবয়বে গড়ে উঠেছে এই কুঠিবাড়ি। এই কুঠিবাড়ির পশ্চিম দিকে অবস্থিত পুকুরপাড়ের সান বাঁধানো বকুলতলার ঘাট যেখানে ফুলের সুগন্ধ আর পাখিদের কলরবে কবি লিখতেন গান ও কবিতা। কুঠিবাড়িতে কবির ব্যবহার্য জিনিসপত্র ও অন্যান্য সামগ্রী সংরক্ষিত রয়েছে। আশিটির অধিক বিভিন্ন দুর্লভ ছবি। কবির নানা বয়সের ছবি রয়েছে বিভিন্ন ভঙ্গিমায়। বাল্যকাল থেকে মৃত্যু শয্যার ছবি সংরক্ষিত রয়েছে এখানে। রয়েছে নানান শিল্পকর্ম এবং তাঁর ব্যবহৃত খাট, ইজি চেয়ার, লেখার টেবিল, ঘাস কাটার মেশিন, গদি চেয়ার নৌকা ও অন্যান্য ব্যবহার্য জিনিসপত্র সুন্দরভাবে সাজানো। কবিগুরুর স্মৃতিধন্য শিলাইদহ কুঠিবাড়ি দেখে মনে মনে আর একবার তাঁরই সুরে তাঁরই কবিতায় শ্রদ্ধাঞ্জলি দিয়ে বেরিয়ে এলাম বাইরে।
তিন হাজার সাতশো উনষাট ফুট উঁচুতে মংপু দার্জিলিং জেলার এক ছোট পাহাড়ী শহর। কবির সময় তা ছিল গন্ডগ্রাম। সিনকোনা চাষের জন্য এর প্রথম খ্যাতি ছড়ায়। কালিম্পং থেকে এর দূরত্ব আটত্রিশ কিলোমিটার। এর তেরো কিলোমিটার নীচে শাল, সেগুন, অর্জুন সহ নানা গাছের সমারোহ। মংপু যাওয়ার পথে রাস্তার ধারে দিনের বেলাতেই যেন বনের ধার থেকে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক কানে ভেসে আসে। এই শহরের শোভায় মুগ্ধ হয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তাই তিনি প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের ডাকে বারবার ছুটে এসেছিলেন মংপুতে। ‘মংপু পাহাড়ে’ কবিতায় কবি এখানে বসে লিখেছেন—
ওই ঢালু গিরিমালা রুক্ষ ও বন্ধ্যা
দিন গেলে ওরই পরে জপ করে সন্ধ্যা।
নিচে রেখা দেখা যায় ওই নদী তিস্তার,
কঠোরের স্বপ্নে ও মধুরের বিস্তার।
কবি বারবার মংপুতে এসেছিলেন তাঁর একান্ত অনুগামী মৈত্রৈয়ী দেবীর আমন্ত্রণে। মৈত্রেয়ী দেবীর বিয়ে হয়েছিল সিনকোনা প্লান্টেশনের চিপ কেমিস্ট মনোমোহন সেনের সঙ্গে। কাজের সুবাদে মৈত্রেয়ী দেবী থাকতেন স্বামীর কোয়ার্টারে। এইখানেই কবিকে বারবার আমন্ত্রণ জানিয়ে নিয়ে আসেন মৈত্রেয়ী দেবী। কবি এখানকার শান্ত সুন্দর পাহাড় দেখে মুগ্ধ হয়ে একমাস দেড় মাস করে থেকে যেতেন। এই কোয়ার্টারটি আজ রবীন্দ্র ভবন।
মৈত্রেয়ী দেবী লিখেছেন এই ছোট জনবিরল ও বহির্জগত থেকে একান্ত দূরের গ্রামটিতে বিশ্ববরেণ্য কবি রবীন্দ্রনাথের আগমনের স্মৃতিকে স্মরণীয় করবার জন্য যে গৃহে তিনি আতিথ্য গ্রহণ করেছিলেন সেই গৃহে শ্রীযুক্ত মনমোহন সেন কর্তৃক গত ২৮শে মে রবিবার একটি তাম্র ফলক প্রতিষ্ঠা করা হয়।
যে বারান্দায় কবি প্রত্যহ প্রভাতে সমাহিত চিত্তে ধ্যানে বসতেন ঠিক সেই স্থানের দেয়ালে ওই লিপিটি গ্রথিত করা হয়েছে। তিন ফুট লম্বা এবং আড়াই ফুট চওড়া একটি তাম্র ফলকে লেখা আছে—‘‘যার অলৌকিক প্রতিভাদীপ্ত আবির্ভাবে এই পৃথিবী কৃতার্থ সেই পরম পূজনীয় মহামানব ও আমাদের প্রিয়তম কবি দিব্যমূর্তি রবীন্দ্রনাথ ১৯৩৮ সালে প্রথম পদার্পণ করেন...’’।
১৯৩৮ সালের ২১শে মে কবি প্রথমবার কালিম্পং থেকে মংপুর সুরেল বাংলোতে আসেন। সেখানে ৫ই জুন পর্যন্ত কাটিয়ে তিনি এই ভবনে এসে ৯ই জুন পর্যন্ত থাকেন। তারপর আবার চলে যান কালিম্পং। দ্বিতীয় বার কবি ১৯৩৯ সালের ১৪ই মে পুরী থেকে সোজা মংপু আসেন গ্রীষ্ম কাটাতে। সেবার ১৭ই জুন পর্যন্ত সময় পার করে কবি কলকাতায় ফিরে যান। তারপর এই বছর সেপ্টেম্বর মাসের ১২ তারিখে তিনি আবার মংপু আসেন। দুই মাসের কিছু বেশি সময় পার করে নভেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহেই কলকাতা ফিরে যান। ১৯৪০ সালের এপ্রিল মাসে মংপু আসেন রবীন্দ্রনাথ। সেবারে ২৫ শে বৈশাখে তার জন্মদিন এখানেই পালিত হয়। জন্মদিন নামক তিনটি কবিতা সেদিন তিনি লিখেছিলেন। তার একটিতে আছে—
জীবনের আশি বর্ষে প্রবেশিনু যবে
এ বিষ্ময় মনে আজ জাগে.../লক্ষকোটি নক্ষত্রের
অগ্নি নির্ঝরের যেথা নিঃশব্দ জ্যোতির বন্যাধারা
ফুটেছে অচিন্ত্য বেগে নিরুদ্দেশ শূন্যতা প্লাবিয়া দিকে দিকে,
(জন্মদিনে, বৈশাখ ১৩৪৭)
কবি ‘স্মৃতির ভূমিকা’ কবিতায় লিখেছেন...
‘‘আজি এই মেঘমুক্ত সকালের স্নিগ্ধ নিরালায়
অচেনা গাছের যত ছিন্ন ছিন্ন ছায়ার ডালায়
রৌদ্র পুঞ্জ আছে ভরি।
সারা বেলা ধরি
কোন পাখি আপনারি সুরে কুতূহলী
আলস্যের পেয়ালায় ঢেলে দেয় অস্ফুট কাকলি।’’
কবি এই বাড়িতে বসেই তাঁর জন্মদিন কবিতা যেমন লিখেছেন তেমনি শেষ কথা, বাংলা ভাষার পরিচয়, ছেলেবেলার কথা, লিখেছেন। তাছাড়া নবজাতক, সানাই, আকাশ প্রদীপ, ক্যামেলিয়া কবিতাগুলিও এইখানে বসেই তার সৃষ্টি। তিনি এখানে বসে পাহাড়ের ছবি বাদে বেশ কিছু ছবিও নিজের হাতে এঁকে ছিলেন। মৈত্রেয়ীদেবীকে লেখা চিঠি এখনে শোভা পাচ্ছে। সেসব এখন এই সংগ্রহশালা ভবনে সুন্দর করে সাজানো।
এবার চলেছি রবীন্দ্রভবনের দিকে। ভবনের সামনেই সুন্দর একটা বাগান। সেখানে কবিগুরুর একটা আবক্ষ মূর্তি রয়েছে। একতলা ভবন। ঘরের মেঝে তৈরি কাঠের পাটাতন দিয়ে । দেয়াল পাকা হলেও বাড়ির টিনের ছাউনির নিচে কাঠ দিয়ে সিলিং তৈরি করা। রয়েছে কবির ছবি আঁকার ও লেখার ঘর। সামনে লম্বা বারান্দা। আছে কবির শয়নকক্ষ। এখানে কবির ব্যবহৃত একটা সিঙ্গল খাট, আর খাটের ওপর তোষক বিছানা দিয়ে সাজানো। শয়নকক্ষের পাশেই বাথরুম। কবিপুত্র অনন্য ডিজাইনার রথীন্দ্রনাথ কবির উপযোগী বিশিষ্ট আসবাবপত্র এবং স্নানঘর নির্মাণ করেছিলেন। তখন রান্নাঘরটি ছিল ভবনের বাইরে, এখন নেই। এখানে ছিল কবিগুরুর উপাসনা গৃহ। উপাসনা গৃহের পিছনে ছিল বিরাট এক পাহাড়ি গাছ। কবিগুরু গাছটির নাম দিয়েছিলেন সপ্তপর্ণী। আজও আছে গাছটা। দিগন্তের সূর্য আলোর আতিথ্য নিয়ে পৃথিবীর কবিকে যেন অভিবাদন জানাত প্রতিদিন। রবীন্দ্র স্মৃতিময় মঙপুর এই গৃহ রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টিশীল আত্মজীবনের অচ্ছেদ্য অংশ।
তীর্থ ভ্রমণে পুণ্য লাভ করে ঈশ্বরের আশীর্বাদ পেতে ব্যাকুল মানুষ। আমার ঈশ্বর তথা মনের মানুষ রবি ঠাকুরের কাছে আমার প্রার্থনা সকল প্রেম, ভালবাসা, দ্রোহ, বিরহ, সমস্যা, দুঃখ-কষ্ট সব সময় থাকুন আমার পাশে। তাঁর আদর্শবানীই হোক আমার চলার পথে পাথেয়।
গ্ৰন্থ সাহায্য
১) জীবন স্মৃতি--রবীন্দ্রনাথ
২) রবীন্দ্র জীবনী-- প্রভাত মুখোপাধ্যায়
৩) রবীন্দ্রনাথের শান্তি নিকেতন----তপন সোম
৪) রবীন্দ্র স্মৃতি---বিশ্বনাথ দে (সংকলন)
৫) শিলাইদহে রবীন্দ্রনাথ--প্রমথ বিশী
৬) মংপু তে রবীন্দ্রনাথ--মৈত্রেয়ী দেবী
বন্ধুবর সুগত মিত্র উপদেশ এবং নানা তথ্য যুগিয়ে সমৃদ্ধ করেছে আমার লেখা।