ইলশেগুঁড়ি ২৯তম সংখ্যা (শারদীয়া)
ইলশেগুঁড়ি ২৯তম সংখ্যা (শারদীয়া)
‘‘....শঙ্খ শঙ্খ মঙ্গল গানে
জননী এসেছে দ্বারে..."
পুজো আসতে আর বেশী দেরী নেই। শরৎ প্রকৃতির নয়নাভিরাম রঙিন জ্যামিতি প্রতিনিয়তই ইঙ্গিত দিচ্ছে মা দশভূজার মর্ত্যে আসার আগমন। ঢাকের মাতাল করা মোলায়েম মল্লারে ভেসে আসছে আগমনীর সুর।
শতুর পাড়ার পুজো এবারে পঞ্চাশে পড়ল। পাড়ার সকলের ব্যস্ততা তাই বেশ তুঙ্গে। প্রতিদিনই চলছে শলা পরামর্শ। গোলটেবিল বৈঠক। পুজোকে সার্বিকভাবে সফল করে তুলতে সকলেই দল দলে কোমর বেঁধে নেমে পড়েছে। আট থেকে আশি সকলের চোখে মুখে খুশীর ঝলসানো সোনামুগ রোদ্দুরটা হামাগুড়ি দিচ্ছে।
এদিকে পঞ্চমীর সকাল থেকেই শুরু হয়েছে নিন্মচাপের দাপুটে ব্যাটিং। সকলের মনখারাপ, দুর্ভোগের শেষ নেই। অনেকের চিন্তা পঞ্চাশ বছরের পূর্তির আনন্দটাই না মাটি হয়ে যায়।
শতু সারাদিন ঘরের মধ্যেই ছিল গল্পের বইয়ে মুখ গুঁজে। বৃষ্টির চোখ রাঙানি বাড়তেই একটু বিছানায় গাটা এলিয়ে দিল। মা ঘরে ঢুকতেই বলে উঠলেন,‘‘কি রে, অবেলায় ঘুমোচ্ছিস?শরীর খারাপ?’’
‘‘আসলে কদিন ধরেই মনটা ভাল নেই।’’
‘‘কেন রে? বৃষ্টি থামলে একটু বাইরে ঘুরে আসবি, দেখবি মনটা ঠিক চাঙ্গা হয়ে গেছে।’’
‘‘মা, তুমি আবার জ্ঞান দিতে শুরু করলে। তুমি না...’’
মা আর কথা না বাড়িয়ে রান্না ঘরে চলে গেলেন।
পুজো আসলেই শতুর মনটা ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে। চারটে দিন নিজেকে গৃহবন্দি রাখে। কারণ ইচ্ছে হলেও ও উৎসবের গন্ধ গায়ে মাখতে চায়না। পুরানো অতীত ওকে নাড়িয়ে দেয়।
ষষ্ঠীর দিনটা সারাদিন বাড়িতে আলসেমি করেই কাটিয়ে দিল। যদিও বৃষ্টির বন্দিশ চলেছে পুরোদমে। মাঝে মাঝে একটু থেমে আবার সেই চেনা ছন্দ। সপ্তমীর দুপুরে বাচ্চাটার চিৎকারে হঠাৎই ঘুমটা ভাঙ্গল। নিম্নচাপ তখনও চলছে। তবে তার মেজাজ একটু হলেও কমেছে। একটা কুকুরের বাচ্ছা অতিবৃষ্টিতে হাইড্রেনের জলে পড়ে সাঁতার কাটছে। আর ড্রেন টপকে রাস্তায় ওঠার জন্যে আপ্রাণ চেষ্টা করছে। ওর বাঁচার জন্যে কুঁই কুঁই শব্দটা বৃষ্টির সাথে মিশে যাচ্ছে। ওর মা দুদিন আগেই মারা গেছে। লরী চাপা পড়ে।
শতু ছুটে গিয়ে বাচ্চাটাকে ঐ অবস্থা থেকে উদ্ধার করে ওকে ঘরে নিয়ে আসে। ওর শরীরের সমস্ত নোংরা ময়লা পরিষ্কার করে ওকে কিছু খেতে দেয়। খাবার পেয়ে বাচ্চাটার মেজাজ কিছুক্ষণেই ফুরফরে হয়ে ওঠে। শরীরে বল পেয়ে একটু তেজ ফিরতেই তিড়িং বিড়িং করে লাফাতে শুরু করে।
বুকের উষ্ণতায় দুবার গলা ছেডে ডেকেও ওঠে। ডাক শুনে মিতাদেবী পাশের ঘর থেকে এসেই মেয়েকে কড়া ধমক—‘‘তোর কি কোনো কাণ্ডজ্ঞান আছে, এমন শুভ দিনে এই কুকুরের বাচ্ছাটাকে কেউ ঘরে তোলে? ওর শরীরে কি রোগ আছে কে জানে?’’
‘‘মা, তুমি এবার থামবে? অনেকক্ষণ ধরে যা নয় তাই বলে যাচ্ছ।’’
‘‘আমি কিছু বললেই দোষ, তাই না?’’
‘‘মা, প্লিজ! একটু চুপ কর।’’
‘‘আজ যদি তোর বাবা বেঁচে থাকত তাহলে কিছুতেই...’’
কথা শেষ হবার আগেই শতু মায়ের মুখের দিকে তাকায়—‘‘মা, তুমি আজ একথা বলছ? তোমার ডেসানকে মনে পড়ে না? সেই ছোট্ট আদুরে ডেসান?’’
ডেসানের কথা উঠতেই মিতাদেবী কোথায় যেন তলিয়ে যান। বুকের ভিতরটা চিন চিন করে ওঠে ব্যথায়। বাচ্চাটার দিকে একবার তাকিয়ে হঠাৎ ভেজা চোখটা নতুন শাড়ির আঁচলে মোছেন।
সন্ধ্যের পর থেকেই বৃষ্টির আশাবরী রাগ কমতে থাকে। আকাশ তবুও মেঘলা। মিতাদেবী রান্নাঘরে এসে দেখেন কুকুরের বাচ্চাটা গোটা রান্নাঘরটা নোংরা করে রেখেছে। মেজাজ গেছে সপ্তমে। তবে সেটা সাময়িক। একটু পরেই ফুটন্ত মেজাজ নিম্নচাপের হালকা বৃষ্টিতে ভিজে শীতল হতে শুরু করল।
সপ্তমী পেরিয়ে কখন যে ভোরের আলো ফুটেছে শতুর খেয়াল নেই। নতুন অতিথিকে পেয়ে গতকাল সন্ধ্যেটা ভালোই কেটেছে ওর।
আজ মহাষ্টমী। সকালে ঢাকের শব্দে ঘুম ভাঙে। দেখে কুকুরের বাচ্চাটা ঘরে, বারান্দাতে ছোট একটা বল নিয়ে খেলছে।আর এ ঘর থেকে ও ঘরে ছোটাছুটি করছে। নতুন জায়গাতে এসে আদর যত্ন পেয়ে ওর মুখে খুশী ঝলসে উঠছে।
অষ্টমীর অঞ্জলি শেষ হলে মিতাদেবী পুজোর পুষ্প শতু, কুকুরের বাচ্চাটার মাথায় একটু ঠেকিয়ে ওদের জন্যে মঙ্গল কামনা করেন। তারপর ওর পড়ার ঘরে ঢুকে দেওয়ালে ডেসানের ছবির দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন। ওর কপালেও পুজোর পুষ্প ছুঁইয়ে দেন। দু চোখের কোণে আবার নিম্নচাপের বারিধারা।
বাসি ফুলের মালাতে, ধুলোর চাদরে ডেসান ফটোফ্রেমে সদ্য ফোটা শিউলির মতন হাসছে। শতু ঘরে ঢুকে ধুলো ঝেড়ে ওর ছবিতে নতুন মালাটা চড়িয়ে দিল। আজ ডেসানের মৃত্যুবার্ষিকী। পুজোর আনন্দে সবাই ভুলে গেলেও শতু ঠিক মনে রেখেছে।
রান্নাঘর থেকে ডেসানের পছন্দের পদের গন্ধ ভেসে আসছে। আজ পুজোর দিন, মিতাদেবী ডেসানের কথা ভেবে হালকা কিছু বানিয়েছেন। শতুই মাকে সব বানাতে বলেছে। যদিও প্রতি বছর ওর মৃত্যুদিনে ওর পছন্দের স্পেশাল কিছু না কিছু বানানো হয়।
ঝুপ করে সন্ধ্যে নামতেই চন্দননগরের আলোতে গোটা পাড়া ভেসে গেল। একটু পরেই সন্ধিপুজো বসবে। পাড়ার কচি কাঁচারা মণ্ডপ দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। ওদের হাতে ক্যাপ ফাটানো পিস্তল। ক্যাপের ফট্ ফট্ শব্দে চারিদিক মুখরিত। ছোট, বড়, অল্প বয়সী সব ধরণের মহিলারা নতুন শাড়ির আদর মেখে সেলফি তুলতে ব্যস্ত। পাঞ্জাবীর খসখস শব্দে পুজোর রঙিন ছন্দটা একটু একটু করে যেন বৃষ্টির চোখ রাঙানি উপেক্ষা করে ফিরছে। মণ্ডপে পুরোহিতমশাই মন্ত্র উচ্চারণ করছেন। মাঝে মাঝে কাঁসর, ঢাকের মিষ্টি সুর ভেসে উঠছে।
‘‘বাজলো তোমার...আলোর বেণু...’’
সন্ধিপুজোর ১০৮টা প্রদীপ জ্বলে উঠতেই শতাব্দী পুচকেটাকে কোলে করে মণ্ডপে আসল। ওকে দেখে সবাই স্তম্ভিত। আজ বহু বছর পরে ও মা অপর্ণার মুখ দেখল। এমনিতেই ও পুজোর দিনে নিজেকে আড়াল রাখে। তার কারণ একটাই...।
প্রদীপের আলোতে ঝলমল করছে পুচকে ‘‘ডেনে’’ এর মুখ। ‘‘ডেন’’ নামটা শতাব্দীর দেওয়া। ‘‘ডেসান’’ এর ক্ষুদ্র সংস্করণ। ‘‘ডেসান’’ এর নাম, শরীরের ভিতরেই ‘‘ডেন’’ এর গন্ধ লুকিয়ে আছে।
মিতাদেবী পুজো দেখতে দেখতে কোথায় যেন হারিয়ে গেলেন।
শতুর বাবা তখন বদলির চাকরি নিয়ে চলে গেলেন বোলপুরে। শতু হোস্টেলে পড়াশোনা করছে। একমাত্র ছেলে অনুষ্টুপও নাতি, নাতনি, বৌমাকে নিয়ে চাকরি সূত্রে ব্যাঙ্গালুরুতে আছে। প্রাইভেট কোম্পানী। ছুটিও কম। বছরে আসা যাওয়া কম হয়। মিতাদেবী একাই থাকেন। অত বড় বাড়িতে কেমন যেন ভয় ভয় করে।
শতাব্দী তখন বন্ধুর কাছে খোঁজ পেয়ে ছোট্ট ডেসানকে বাড়িতে আনল। মাকে একটু সঙ্গ দেবে বলে। এর তিন মাস পরেই স্বামী অনিকেতবাবু স্ট্রোকে মারা যান। শোকের ছায়া ঘিরে ধরল গোটা পরিবারকে।
স্বামী মারা গেলে স্বামীর সরকারী চাকরিটা মিতাদেবী পেলেন। এর কয়েক মাস পরেই ছেলে ব্যাঙ্গালুরু থেকে বদলি হয়ে কলকাতাতে ফিরে আসল। মিতাদেবী ভেবেছিলেন, একমাত্র ছেলে হয়ত তাঁর কাছে থাকবে নাতি, নাতনি, বৌমাকে নিয়ে। স্বার্থপরের মতন সেও ফ্ল্যাট নিয়ে চলে গেল। মিতাদেবীর একাকীত্বের জীবনে তখন থেকেই ডেসানের রোল প্লে শুরু।
টানা চার বছর বিপদে আপদে আগলে রেখেছে ওনাকে। ভরসার একমাত্র আশ্রয়স্থল হল এই চারপেয়ে, অবলা, প্রভুভক্ত ডেসান। মিতাদেবীর পর শতু দিদিমণিই ওকে বেশী আদর করত, ভালবাসত।
মিতাদেবী অফিস যাবার আগে ওর জন্যে খাবার গুছিয়ে রাখতেন। কাজের মেয়েটাও মাঝে মাঝে ওকে খাবার বেড়ে দিত। তারপর মেয়েটা চলে গেলে পুরো বাড়িটাতে ডেসানের একার রাজত্ব।
ডেসান সুবোধ বালকের মত বাড়িতে নিজের মত করে কাটাত। কখনোই কোন প্রয়োজন ছাড়া অযথা চিৎকার চেঁচামেচি করত না। বড়ই শান্ত স্বভাবের বলা চলে। পাড়ার সকলের তাই প্রিয় পাত্র ছিল। সবাই খুব ভালবাসত। খোঁজও নিত। মিতাদেবী কখনো কখনো ওকে অফিসেও নিয়ে যেতেন। যাতে ওনার কাজের জায়গাটা ডেসান বুঝতে পারে। চিনতে পারে।
চারপেয়ে এই সভ্য প্রাণীটি ধীরে ধীরে ওনার পরিবারেরই একজন হয়ে উঠল। মিতাদেবী তো মাঝে মাঝেই বলেই বসতেন, যে ডেসান তার তৃতীয় সন্তান। ছোট ছেলে। বহু বিপদ, অঘটন, বহুবার চুরির হাত থেকে মিতাদেবীকে বাঁচিয়েছে। ওনার শরীর খারাপ হলেই ছুটে গিয়ে চিৎকার করে পাশের বাড়ি থেকে কখনো সবিতা আন্টি, কখনো জয়া বৌদিকে ডেকে এনেছে।
ভাবতে ভাবতে স্মৃতির আটলান্টিকে তলিয়ে গিয়েছিলেন। ঢাকের জোর শব্দে, পাড়া পড়শির ছুটোছুটিতে সম্বিৎ ফিরল। ঠাকুরমশাই সন্ধিপুজোর অঞ্জলির জন্যে হাঁক দিচ্ছেন।
মিতাদেবীর এখনও বেশ মনে আছে। সেইদিনটাও ছিল অষ্টমীর সকাল। সবে পুজো বসেছে। উনি অঞ্জলির জন্যে তৈরী হচ্ছেন। বাড়িতে একা। সবাই বেরিয়েছে।ছেলেরাও নেই। হঠাৎ শাড়িতে পা বেঁধে পড়ে উনি চোট পান। পরিস্থিতি বুঝে ডেসান ছুটে গিয়ে সবিতা আন্টিকে ডাকতে যায়।
সেই শেষবারের মত বাড়ি থেকে ওর বেরোনো। আর ফেরেনি। ঘরে আসার পথে রাস্তা পেরোতে গিয়ে ফোর হুইলারের চাকায় পিষ্ট হয় ওর নিষ্পাপ শরীর। ড্রাইভারের কোন দোষ ছিল না। উনি আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলেন বাঁচাতে। আসলে নিয়তি। যখন যার সময় আসে...। শতাব্দী যখন ফিরে এসে সব শোনে তখন দেখে, ডেসানের রক্তমাখা, থেঁতলানো শরীরটা রাস্তার এক কোণে পড়ে রয়েছে। মৃত শরীরের উপর মাছি ভন ভন করছে। পথ চলতি মানুষ কেউ কেউ চোখ বড় বড় করে দেখে পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছেন। পাড়া প্রতিবেশীর অনেকের চোখেই জল। তার দু চার ফোঁটা ডেসানের নিথর দেহের উপরেও পড়ল।
ছেলেকে খবর দেওয়া হল অনেক পরে। ও তখন রাজস্থানে পুজোর ছুটি কাটাচ্ছে সপরিবারে। সেইদিনের পর থেকে টানা একমাস মিতাদেবীর ঘরে হাঁড়ি চড়েনি। মা মেয়ে শোকে দুঃখে এতটাই ভেঙে পড়েছিল যে গলা দিয়ে কোন খাবার নামত না। বমি হয়ে উগরে উঠত। পরিস্থিতি এতটাই বিষাদময় ছিল।
বহু বছর পার হয়েছে। ডেসান চলে গেছে না ফেরার দেশে। তবে পুজো আসলেই ওর টাটকা স্মৃতি ঝলসে ওঠে। আজ বহু দিন পরে ওর মৃত্যুবার্ষিকী আর অষ্টমী একই দিনে পড়েছে। কোইন্সিডেন্স!
সন্ধিপুজো অনেক আগেই শেষ হয়েছে। শতাব্দীর আলতো ছোঁয়ায় মিতাদেবীর আবারও সম্বিৎ ফিরল।
‘‘মা, আমি ডেনকে নিয়ে একটু উনিশ পল্লী আর বিদ্রোহী ক্লাবের ঠাকুরটা দেখে আসছি। সময় পেলে শক্তি নগর, পাঠক পাড়া, সীমান্ত পল্লীর ঠাকুরগুলো দেখে নেব। ফিরতে একটু দেরী হলেও হতে পারে। তুমি চিন্তা করো না।’’
‘‘সাবধানে যাস মা, দেখিস যেন কোন বিপদ না হয়। দুগ্গা! দুগ্গা! ....’’
কথা শেষ হবার আগেই ডেন কেমন যেন নড়ে বসল। আর পরম আনন্দে দুবার ডেকে উঠল। ওর শরীরি ভাষা কিছু একটা ইঙ্গিত করছে বলে মনে হল। তাহলে কি ডেন এ বাড়িতে ডেসানের অস্তিত্বটা টের পেয়েছে। হতেও পারে। মিতাদেবী দেখেন শতাব্দীর কোলে পুচকে ডেন যেন ডেসানেরই হারিয়ে যাওয়া অতীত। মা যেন জেনে বুঝেই ওকে এখানে পাঠিয়েছেন।
নিম্নচাপ কেটে গিয়ে তারায় ঝলমল করছে অষ্টমীর সন্ধ্যে। ভাঙা কোজাগরী চাঁদটা রূপোর অহংকার ছড়াচ্ছে। একটু একটু করে। ডেনকে পেয়ে শতাব্দীর মনের উঠোনে আজ বোধনের রোদ্দুর। মিতাদেবীর চোখ থেকে নামছে পবিত্র শরৎ শিশিরের ফোঁটা ফোঁটা নোনা চন্দন। ঠিক নিম্নচাপের মতই। তার ছিঁটে ফোঁটা মনে হল যেন ডেনের নরম, স্নিগ্ধ পশমেও পড়ল।
মিতাদেবী সকলের মঙ্গল কামনায় মা উমার কাছে প্রার্থনা করলেন। মায়ের মুখে কোজাগরী চাঁদের হাসি উথলে উঠছে। ধূপ ধুনো ফুল বেলপাতার সোহাগে ডুবে মা দরাজ হস্তে সবাইকে আশীর্বাদ করছেন। মণ্ডপে মণ্ডপে চলছে প্রসাদ বিতরণ। জাতি ধর্ম নির্বিশেষে হরি আল্লার লুটোপুটি! এ যেন আমার আপনার সকলের চেনা ভারতবর্ষ।
চারিদিকে চন্দননগরের বাহারি আলোর বন্যায় মেখে আধুনিক গান,আর মাঝে মাঝে বাজির ফটাস্ ফটাস্ শব্দ ভেসে আসছে। মণ্ডপে মণ্ডপে জনস্রোত। বৃষ্টি থেমে গিয়ে একটু গরমও ধরেছে।
মিতাদেবী বেশ কিছুক্ষণ ধরে ওদের চলার পথের দিকে তাকিয়ে থেকে, গুটি গুটি পায়ে চৌরাস্তার দিকে এগিয়ে যেতেই হঠাৎ একটা বহুদিনের চেনা কণ্ঠস্বরে পায়ের গতি শ্লথ করলেন।
‘‘মিতু, অ্যাই মিতু! চিনতে পারছিস?’’
‘‘কে? ও মা! নন্দা! কবে এসেছিস? কতদিন পরে...’’
‘‘হ্যাঁ, বহুদিন পরে আজ তোর সাথে দেখা হল। তুই সেই আগের মতনই আছিস। চল, ওধারটাতে একটু ফাঁকা আছে গিয়ে বসি।’’
‘‘দাঁড়া, একটু আসছি।’’
‘‘আবার কোথায়...?’’
‘‘নে ধর, আইসক্রিম। যা গরম!’’
‘‘তোর মনে আছে, আমরা পুজোতে কত আইসক্রিম খেতাম।’’
‘‘হমমম...!’’
দুই বন্ধুর হাসি, আড্ডায় বোধনের রোদ্দুরে যখন জোয়ারের ভরা কোটাল, তখন শতাব্দী ডেনকে নিয়ে একটার পর একটা মণ্ডপ পেরিয়ে শক্তিনগরের দিকে পা বাড়াল। ডেন ওকে জাপটে ধরে আঁকড়ে আছে। মাঝে মাঝে দুষ্টুমিসুলভ ভঙ্গিতে ওর ছোট্ট নাকটা শতাব্দীর নরম শালোয়ারের মেঝেতে ঘষছে আর চোখ পিটপিট করছে।
‘‘দুর্গে দুর্গে দুর্গতিনাশিনী
মহিষাসুরমর্দিনী জয় মা দুর্গে’’