ইলশেগুঁড়ি ২৯তম সংখ্যা (শারদীয়া)
ইলশেগুঁড়ি ২৯তম সংখ্যা (শারদীয়া)
তখন দিনান্তের সূর্য অপূর্ব মোলায়েম। রাঙা আলোর রেণু ছড়িয়ে দিয়ে ধীরে ধীরে পশ্চিম আকাশটা যেখানে দিগন্ত রেখায় মাথা ঠেকিয়েছে—ঠিক সেখানেই ঢলে পড়ে।
এক
এই প্রথম সে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিল রোদ্দুরের গন্ধের সঙ্গে। শুধু রোদ্দুর নয়, তার সঙ্গে সকাল, শরৎ এর মায়ের শরীরের গন্ধ। সেই গন্ধেরও যেন দুটো সুন্দর ডানা আছে। নারকেল, সজনে গাছের মাথা হয়ে ডানা নাড়তে নাড়তে যখন আমার বারান্দায় এসে বসলো, এক কৌম সুরভিতে ভরে উঠলো চারপাশ। মনে হলো আমি যেন একটা ফুল হয়ে গেছি। ডানা নাড়ার সাথে সাথে সেই সুরভিরা কথা বলে ওঠে। রাংতা সৃষ্টির ইতিহাস আমার ঠিক জানা নেই। তবে ইতিহাস নিশ্চয় একটা আছে এটা যেমন সত্য, তেমনি এটাও ঠিক এর পরেও আর একটা বিষয় আছে। রাংতার ভাবনাটা রোদ্দুর মাখতে মাখতে একদিন ভাবনার কোষে কোষে সম্পৃক্ত হয়ে গিয়েছিল। কেননা রোদ্দুরেরও একটা পাতলা উজ্জ্বল রাংতা আছে। এবং সে সুন্দরের গন্ধ বহে বেড়ায়। চাঁদের যেমন জ্যোৎস্না, রোদ্দুরের তেমন রাংতা। রোদ্দুর এই রাংতার সৌরভে মাতৃকাব্য আবৃত্তি করে চলে শরৎ জুড়ে। আর তারই অনুরণন জলে স্থলে অন্তরীক্ষে। রাংতা সুন্দর সকালের শুভ্রতা। শুচিতা ও সরলতার কালি দিয়ে যখন কোন কাব্য লেখা হয় তখন জীবন সংস্কৃতির ফুল বাগানের কুঁড়িটি হিমের পরশ মেখে মেখে একটি একটি করে দল মেলে ধরে অপরের জন্য। সুন্দর হয়ে ওঠার সাথে সাথে অপরকে সুন্দর করে তোলার ব্রত পালন করে চলে অবলীলাক্রমে। ঠিক তখনই শরৎ এর আকাশ থেকে সে আমাকে হাতছানি দিয়ে ডাকে। আমি অবাক হয়ে যাই জীবন পাঠে। কাঁদতে কাঁদতে কিভাবে হাসতে হয়—সেই সুরেই যেন বাঁধা আকাশবীণা। শরতের বৃষ্টি যেন সেই সুরেরই কথা। আর সেই সুরের বীণাতে সুর তুলে যে গলা মেলায় তাকে একটি বারের জন্যও মনে হয় না অচেনা অপরিচিত। বরং বার বার এই কথা মনে হয় আমার কণ্ঠের স্বর তাকেই ডাকার জন্য। আমার চোখের দৃষ্টি তাকেই দেখার জন্য, আমার শ্রুতি তার গান শোনার জন্য, আমার মন তার কথা ভাবার জন্য, পৃথিবীতে সে শুধু অকাতরে দিয়েই যায়, সে তো আমার মা—সে ই তো আমার জীবন্ত ঈশ্বর।
দুই
ভোরের আঁধার তখনও কাটে নি, কি জানি পথের কুকুরগুলো ঘেউ ঘেউ করেই চলেছে। ঘুম ভাঙিয়ে দিলেও খারাপ লাগেনি। এক কথায় অপূর্ব সকাল। অস্পষ্টতার অবগুণ্ঠনে চারিদিক ঢাকা। রাত জাগা ভোরের পাখিটা তখনও ডেকে চলেছে। সূর্যেরও যে একটা আলোর জরী আছে, না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। তবে আমিও জানি না যে জরী সূর্যের কিনা। টগর গাছের মাথার ওপর ঝুলন্ত জরীর প্রান্তটা স্পষ্ট। কিন্তু উপরের দিকের প্রান্তটা ঠাহর হচ্ছে না। ইচ্ছেও হলো না তার রহস্য সন্ধানে। বরং এই তো ভালো। যা পেয়েছি তো হৃদয়ে আগলে রাখা। এও তো এক প্রকার কুড়িয়ে পাওয়া ষোলো আনা। সবচেয়ে মনোরম পাতলা ফিনফিনে হিমেল স্পর্শ টুকু। যেন কার কথা মনে করিয়ে দেয়। যে, কোন প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে চেতনার মধ্যে ঘুমিয়ে আছে। ক্লান্তি-ক্লীবতার আস্তরণে জর্জরিত হতে হতে একদিন ঘুমিয়ে পড়েছিল। রূপকথার সেই সোনার কাঠির জাদুস্পর্শে নতুন করে জেগে উঠেছে। শুধু জেগে উঠেছে না, জাগার সাথে সাথে জীবনবেদের মোহনায় সুকুমার, নীরবতার, মেখলার শীতলতায় আর বৃষ্টির উত্তেজনাময় আনন্দ। উন্মাদনার শালুক ফুলটি ধীরে ধীরে পাপড়িগুলো মেলে ধরে কোনো এক প্রজাপতি বা মৌমাছির উষ্ণ আগমনের জন্য। একটা কবিতা, তারপর কাব্য। কেউ কেউ আবার তা থেকে নির্যাস নিংড়ে নিয়ে একটা গল্প লিখবে—প্রথম প্রেমের গল্প। আর সেই গল্পটি উৎসর্গ করা হবে আরো একটা হৃদয়ে ঝড় তোলার জন্য...। আবার পরবর্তীকালে তা থেকেই জন্ম নেবে একটা ধ্রুপদী, পূর্ণাঙ্গ উপন্যাস। এ যেন ঠিক অর্থনীতির মাল্টিপ্লায়ার থিওরেমের মতো। তবে এটা শ্বাশ্বত তার উপস্থিতিতে এবং সম্পৃক্ততায় সুকুমার প্রবৃত্তি গুলো। গুণিতক হারে তৃপ্তিসাধন করে থাকে। সাথে সাথে গ্রহণ ও বর্জনের মাত্রাজ্ঞানকে সক্রিয় করে তোলে। আমার চারপাশে ইটে-দেওয়ালে, ঘরে-বারান্দায়, ছাদে প্যারাপিটে, ঠাকুর ঘরে, আকাশে বাতাসে, গাছে এমনকি আমার প্রতিটি অঙ্গ প্রত্যঙ্গে, ধর্মে, অহংএ, বিশ্বাসে এবং নিরন্তর শূন্যে বেতালের মত প্রলম্বিত শীতল ঘুম। একরাশ প্রশান্তি ও স্বপ্ন নিয়ে জেগে ওঠে আজ, ঠিক যেন একটা মহাকাব্য।
তিন
তখন দিনান্তের সূর্য অপূর্ব মোলায়েম। রাঙা আলোর রেণু ছড়িয়ে দিয়ে ধীরে ধীরে পশ্চিম আকাশটা যেখানে দিগন্ত রেখায় মাথা ঠেকিয়েছে—ঠিক সেখানেই ঢলে পড়ে। দিনান্তের সেই আলোয় সন্ধিক্ষণের কিশোরী হৃদয়ের মতো পুকুরের পদ্মগুলো একটু একটু করে মেলে ধরে একরাশ লাজুকতা নিয়ে। যদিও মুখে একটিও কথা নেই, তথাপি দুটি ঠোঁটে কালবৈশাখী। সমস্ত অঙ্গ প্রত্যঙ্গে কোনও এক খরস্রোতা নদীর পাহাড় থেকে উপত্যকায় নেমে আসা সুর ঝরনা। অন্ধকারের অস্পষ্টতায় কী ভয়ানক সুন্দরতায় স্পষ্ট হয়ে ফুটে ওঠে ফুলের মতো। কানের কাছে মুখ এনে ফিস ফিস করে কি যেন বলে। আর তাতেই এক মরমিয়া সুর সব কিছুকে আচ্ছন্ন করে ফেলে। হয়তো শুক সারি এই ভাষাতেই গান গাইতো। সেই পদ্মের নিঃশ্বাসে নিঃশ্বাসে আশ্বিনের গায়ের গন্ধ শিরা উপশিরায় তোলে ঢেউ। পদ্ম শালুক কখনও ইশারায়, কখনও ঘাড় কাত করে, কখনও বা লাজুক রাঙা ঠোঁট নেড়ে, কখনও আবার ভ্রমরকে দিয়ে চিঠি পাঠিয়ে, পৃথিবীর মানুষের হৃদয়ে যে বার্তাটি পৌঁছে দেয় তার সুরটি এক এবং অনন্য মিলনের। সেই তাগিদটাই নিবিড়ভাবে অনুভব করে। ভোরের ফুল—এই পদ্ম এবং শালুক এক অনুপম কৌম সরলতা ও আন্তরিকতার অঞ্জলী নিবেদন করে চলেছে। হৃদয় দিয়ে হৃদয় পাওয়া। মিলনের বীজ মন্ত্র তো তাই। এই জন্যই বোধ হয় শরৎ থেকে পদ্মকে কিছুতেই বিচ্ছিন্ন করা যায় না। ঘুম ভাঙ্গার সাথে সাথে সকালের পদ্ম শিশু সুলভ সরল দৃষ্টির সৌরভে অন্ধকারের সমস্ত মলিনতাকে দূর করে দেয়। তার পাপড়িতে, পাতায় বহুল আকাঙ্খিত - লালিত পালিত স্বপ্নগুলো মুক্তোর দ্যুতি নিয়ে অবস্থান করে। একটা ফড়িং-ভ্রমর সেই রেণু নিয়ে হৃদয়ে হৃদয়ে পরাগ সংঘটিত করে। আর দৃষ্টি হয় এক অনাবিল আনন্দ। আবার কোন এক নিদাঘ দুপুরে আশেপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা নীরবতা আর নিঃসঙ্গতাকে নিজের কাছে ডেকে এনে গল্প বলে। জলপরীর রূপকথা দীর্ঘ ঘুম থেকে জেগে ওঠার গল্প। দুপুরের রূপালী রোদের উষ্ণতাকে জলীয় বাষ্পের প্রদীপে সমস্ত একাকীত্ব ও নিঃসঙ্গতাকে প্রাণের তাপে ভরিয়ে দেয়। সেই প্রাণবন্ত নীরব নিঃসঙ্গ একাকীত্ব পদ্মের গল্পকে করে তোলে সবুজ সজীব। এই পদ্মরাই আবার দ্বিতীয়ার বাঁকা চাঁদের হাসি নিয়ে হৃদয়াকাশে ফুটিয়ে তোলে শত শত শিউলি তারা।
চার
শরতের অভিমুখ দ্বিমুখী। ঘর আর বাহির। একজনের কাছে ঘরের আকর্ষণ, তো অপর প্রান্তে বাহিরের আকর্ষণ। বিষয়টা আকর্ষণ-বিকর্ষণ বা আসক্তির নয়। বিষয়টি খুশির প্রবহমানতা। কোন এক জায়গায় দৈর্ঘ্য-প্রস্থহীন বিন্দুর মতো অবস্থান করা নয়। নদীর মতো চলতে চলতে সাগরের সঙ্গে মিশে যাওয়া। কিন্তু সে যাওয়া নীরবে নিভৃতে একা একা যাওয়া নয়। যত কৃষক, যত নাবিক, যত মাঝি, যত ইটভাটার মালিক, তাদের তৃষিত হৃদয়ের খানা খন্দ ভরিয়ে ও তাদের হৃদয়ের উষ্ণতা নিয়ে দ্রিমিকি দ্রিমিকি ভঙ্গিমায় চলে যাওয়া, আর যেতে যেতে খুশির রেণুতে সকলকে রাঙিয়ে দিয়ে যাওয়া। সব বন্ধন ছিন্ন করে এ যে হারিয়ে যাওয়া নিজের সর্বক্ষণের কাছ থেকে, খাঁচা থেকে। তাই বোধ হয় যে প্রবাসী সেও এই সন্ধিক্ষণে জোয়ারে গা ভাসিয়ে চলাকে রাখে অব্যাহত। হয়ত সেটাও বাড়ির অভিমুখে। আবার এ প্রান্তে যারা বাড়ির গণ্ডিতে হাঁপিয়ে উঠেছে—তারাও সেই স্রোতে গা ভাসিয়ে দিতে চায় চলাকে অব্যাহত রাখতেই এবং নিশ্চিতভাবে সেটা বেড়ানোর পরিপ্রেক্ষিতে। নিঃসীম আকাশে মেঘের মতো। কালো মেঘ, সাদা মেঘ। কালো মেঘ চলে আসে পৃথিবীতে। আবার সাদা মেঘ পরীর মতো ভাসতে ভাসতে চলে যায় দূর দুরান্তরে। ঠিক যেন কু - ঝিক ঝিক রেলগাড়ি। শুধুই আপ অ্যান্ড ডাউন। মাঝে মধ্যে দু’ এক দণ্ড জিরিয়ে নেয় স্টেশনে স্টেশনে। চলাতেই ট্রেনের জীবন। অভিমুখ শেষ কথা নয়। কিন্তু শেষ কথার মাঝেও আরও একটা জরুরী কথা আছে। সেটা স্টেশন। এখান থেকেই হৃদয়ের উষ্ণতায় স্বপ্নের বীজের অঙ্কুরোদগম ঘটে। গভীর অন্ধকারের ঘুম থেকে জেগে ওঠে। প্রথম সূর্যের আলোর প্রথম স্নেহশীল ভালোবাসার চুম্বন পৃথিবীকে করে তার পরম আত্মীয়। এবং ধূলোমাটির আবেগে সিক্ত এই সবুজ পৃথিবী সেই জংশন স্টেশন যেখান থেকে ইচ্ছেমত স্বপ্নের রূপকথার দেশে চলে যাওয়া যায় বন্ধনকে ছিন্ন করে। আর যাওয়ার সাথে সাথে রেখে যায় একটা পথ ভাবি সময়ের জন্য এবং স্বপ্নের জন্য।
পাঁচ
তুমি নও নও একা ওগো/ মানব ভুবনে / আকাশ বলে বাতাস বলে/ বলে তরুলতা / এই ভুবনের সংগোপনে জীবন যথা তথা। জীবনের বৃত্তায়নে আনন্দ উল্লাস উদ্দীপনার মধ্য থেকেও সংযম কী সুন্দর ভাবে ভারসাম্য বজায় রেখে চলেছে যার উপস্থিতিতে, তাকে অস্বীকার কোনোভাবেই করা যায় না। একেই বুঝি বলে আনন্দ। আশ্বিনের ধানক্ষেতে সেই সংযম স্বর্গকে নামিয়ে নিয়ে আসে। ইন্দ্রপ্রস্থের রাজসভা কখন উন্মুক্ত হয়ে যায় সেখানে। অপ্সরা, রম্ভা প্রভৃতি কিন্নর কিন্নরীর ললিত নৃত্যকলায় উপছে পড়ে শারদীয়া উৎফুল্লতা। উৎকণ্ঠাহীন এক অনাবিল কৌম কোমল মোলায়েম খুশিতে ডগমগ। নিস্তরঙ্গ সবুজ সমুদ্রে মৃদুমন্দ তরঙ্গ ধীর পদক্ষেপে এগিয়ে যায় খেলার মাঠে মেক্সিকান ওয়েভের মতো সংযম আর একতার ছন্দে ছন্দে, তালে তালে। কোনো একজন পরী একবুক সিক্ততার মাধুরী নিয়ে ধীরে ধীরে উঠে আসে। আর সেই ক্ষেতকে মঞ্চ করে নিজেকে মেলে ধরে জল-কাব্যে। দেখতে দেখতে ঝিনুকের পাপড়ি উন্মুক্ত হয়ে যায়। এবং মুক্তোর অপূর্ব সুষমায় সব কিছু ভরে ওঠে। নেই এতটুকু উগ্রতার লেশ। ঠিক একইভাবে নেই এতটুকু খামতি রূপে-লাবণ্যে-অনুরাগে। হেথা নয়, হেথা নয়, অন্য কোথা, অন্য কোন খানে। আশ্বিনের এই ধানক্ষেত, যেন সেই রূপকথার স্বপ্নপুরী। ঘুমের ভিতরে যে সব স্বপ্নরা এতদিন ঘুমে সমাধিস্থ হয়ে যেত, সেই সব স্বপ্নরা আজ প্রজাপতি হয়ে সংবাদ পরিবেশন করে চলেছে ফুলেদের দ্বারে দ্বারে। রূপকথার সেই সব চরিত্রগুলো, যারা এতদিন থেকেও ছিল না, তারাই আজ বই এর পাতা থেকে উঠে এসেছে স্বমহিমায়। হাতছানি দিয়ে ডাকে। এতটুকু অতিরঞ্জিত বলেও মনে হয় না। প্রতিটি চরিত্র যেন এক একটি কবিতা। ভিন্ন ভিন্ন মাধুরীতে প্রাণবন্ত। প্রতিটি ধানের শীষে শীষে অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যত এর সংবেদনশীল উপস্থাপনা।
ছয়
শরতের সঙ্গে শাঁখের আর ঢাকের বড্ড বেশী মিল। শাঁখের ফুঁ উ উ উ... ভাসিয়ে নিয়ে যায় কোন সুদুর আকাশে। পেঁজা তুলোর খন্ড খন্ড পাহাড়ে। যেখানে সোনালী রোদ্দুর দিয়ে অজন্তা-ইলোরা-খাজুরাহো-কোনারকের মতো সুন্দর সুন্দর ভাস্কর্য করে চলেছে কোনো এক পরম শিল্পী। পাখির ডানায় খোদাই এর ডাস্ট ও কেমন শিল্প হয়ে গেছে। আকাশেও যেন আর একটা পৃথিবী। সেখানে রাশি রাশি কাশ। শঙ্খের শুভ্রতা-শুচিতা-পবিত্রতা-সুর আকাশে ছড়ানো। আজ ভীষণ ভাবে বুঝতে পারি—সাদা রঙ কেন সব রঙের উৎস। সাদা রঙ মিলিয়েই সব রঙ তৈরী করা যায়। সমস্ত আকাশ থেকে গুঁড়ো গুঁড়ো সাদা আলো ঝরে পড়ছে। সেই আলোর সঙ্গে মিশে গেছে গুঁড়ো গুঁড়ো শাঁখের আওয়াজ। ভাসতে ভাসতে সেই আওয়াজ সমস্ত শূন্যতাকে ভরিয়ে দেয়। শব্দেরও একটা রঙ হয়। এবং নিশ্চিতভাবে সে রঙ সাদা। কেননা ঘুম ভাঙানির রঙ সাদা ছাড়া কিছু হতে পারে না। সাদা মেঘের পাহাড়ের সানুদেশে কাশেরা সেই শঙ্খধ্বনি তে আপন মনে মাথা নাড়তে থাকে। আবার সন্ধ্যার পূর্বের থালার মতো চাঁদটা যখন সেই সাদা গুঁড়ো ছড়ানো চাদরের ভেতর থেকে ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসে একটা রহস্যের অবগুণ্ঠন নিয়ে। সেই সময় কোথায় যেন বেজে ওঠে ঢাক। ড্যাং কুর কুর, ড্যাং কুর কুর। পাহাড়ের দেওয়ালে দেওয়ালে প্রতিফলিত সেই শব্দ ঝরনার মতো শিখর দেশ থেকে নিচে নেমে আসে। সেও দুধের মতো সাদা। সেই ঝরনায় শূন্যতা স্নান করে। অন্ধকার তার বুকে ধরে রাখে তার শীতলতা আর পৃথিবীর কৌম উদাসীনতা একটা বাঁধন ছাড়া শিথিলতা। বাতাসে বাতাসে ঢাকের আওয়াজের সঙ্গে কার যেন একটা নান্দনিক উপস্থিতি ললিত কলার মতো থেকে যায়। ঢাক যেন আর ঢাক নয়। একটা দীর্ঘ অপেক্ষার পর ভোরের নরম সূর্য। ধীরে ধীরে আলোর স্পষ্টতর আল্পনার মাঝে পঞ্চ পল্লব শোভিত মঙ্গলঘট উপছে ছড়িয়ে পড়া একরাশ দুধ সাদা প্রসন্নতার ঢাকের আওয়াজের সঙ্গে আরতি আর ঘরে বসে থাকতে দেয় না। কার এক শুড়শুড়িতে পায়ে ছন্দ নেমে আসে। কোমর দুলে দুলে ওঠে।
সাত
আশ্বিনের বর্ষা, কাজল ঘন মেঘ, শিউলি-কাশ-শুভ্র মেঘমল্লার। আপাতভাবে শ্রাবণের বর্ষার মতো মনে হলেও কোথাও যেন একটা অন্যরকম। একরকম বেশী ভালো লাগা বা অন্যকিছু। গ্রীষ্মের দিনে তিস্তার সোনালী রোদ কিম্বা মুসৌরীর ইলশেগুঁড়ি তুষার। বিষয়টা সময় এবং অসময়। সময়ের বিষয়ে যখন কোন অসময়ের বিষয় এসে পড়ে, যতই অস্বীকার করি না কেন তার জ্যোৎস্নার মতো সৌরভটুকুকে কিছুতেই অস্বীকার করতে পারি না। বৈষয়িক মন নিয়ে চাহিদা-যোগানের যুক্তি জল ছড়ালেও জ্যোৎস্নাটুকু মলিন হয় না। মূল বিষয়টি কিন্তু একটা সত্ত্বা, আর সব সত্ত্বাই অতিথি। সব সত্ত্বাই ভগবান। আর অতিথির আসা যাওয়ার নির্দিষ্ট কোন তিথি বা সময় নেই। শারদ-বর্ষা উপযুক্ত বিহঙ্গ। কোন ছাতার আচ্ছাদনের নিরাপদ ভাবনার মধ্যে পথ হাঁটে না। বরং ভিজতে ভিজতে চোখে চোখে, শরীরে শরীরে কথা বলতে বলতে পথ হাঁটে। এখানকার রাস্তা বড় আতঙ্কিত, বড় ব্যস্ত। তবু পথেরও একটা মোহন বাঁশি আছে। আছে একটা অভিসার, একটা বিপ্রলম্ভ, তাজমহলের পূর্ণিমা। সেই পথকেই ফিরে পেতে হলে এমনই বর্ষাকে আসতে হয়। পথের নির্জনতায়, একাকীত্বে কে যেন রচনা করে গেছে অসম্ভব সুন্দর সব কবিতা। আর পথ এই সন্ধিক্ষণে উপভোগ করে চলেছে কাব্যের সেই সব চরিত্রকে। যারা কখনো হেঁটে গেছে, যেতে যেতে ছড়িয়ে দিয়ে গেছে হৃদয় কুসুমের সৌরভ। কখনো পথ প্রান্তে কোন এক নির্দিষ্ট নিশানায় একটি হৃদয়কে অপূর্ব সুন্দর উৎকণ্ঠা নিয়ে ছটপটানি করতে দেখেছে। আবার কখনো কোন এক জোছনা ভরা পথে হাঁটতে হাঁটতে দুটি হৃদয় আপন সুরে গেয়ে উঠেছে। সেই পথকে একটু একটু করে আলোর সুতো দিয়ে বুনে চলেছে শ্বাশ্বত শিল্পী। পথ যেন এক মায়ের গন্ধমাখা শাড়ী। তার দুটো পাড় স্মৃতির জরীতে বোনা দুটো স্মরণিকা। সমস্ত পথের মেঝেটা অভিজ্ঞতার মনি মুক্তার বুটিক। ঠিক যেন রাতের আকাশের নক্ষত্র। আর আঁচলখানি সংসারের চাবি কাঠির রিমিঝিমি মোহনা। ঠিক যেন নদীর সাগরে মেলা।
আট
দীর্ঘ রাত্রির পর ভোরের শিউলি ঝরা সকাল। গতকাল দিনের শেষের যে ভালোলাগার আলোটুকু আগে চলে গিয়েছিল, আজকে তার খামতিটুকু মিটিয়ে দিয়ে একটু সকালেই চলে এসেছে। হয়তো এটাকেই ভারসাম্য বলে, এটাকেই ছন্দ বলে। সেই নরম আলো রশ্মির অঙ্গ জুড়ে আর একজনের মধুর উপস্থিতি। কোন ধ্রুপদী চিঠিতে অক্ষরের রশ্মিতে যেমন কোন কোন জনের উপস্থিতি থাকে। শূন্যকে ভেদ করে ওপর থেকে নিপতিত সকালের আলোক-রশ্মিতে সেই চিঠির অক্ষরগুলো এক অনাবিল প্রশান্তিতে দুলে দুলে ওঠে। চিঠির মাধুর্যের মধ্য দিয়ে আগমনীর জ্যোৎস্নায় আর্দ্র আশপাশ সব কিছু। মাকড়সার দু’এক গাছি সূক্ষ্ম প্লাটিনাম তারে সেই চিঠির সুর মূর্চ্ছনা ফুলঝুরির ফুলকি মতো চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। কালো ল্যাজ ঝোলা পাখিটার ল্যাজ সেই ফুলকিতে দুলে ওঠে। আশেপাশের গাছগুলো যখন নিথর নির্বাক অদূরের লম্বা নারকেল গাছের পাতাগুলো কার সঙ্গে যেন ইশারায় গল্প মশগুল। শুধু চোখে চোখে, ঠোঁটে ঠোঁটে সে কথা। কত কথা ভেসে যায়, ফুল কথা, আলো কথা, মুক্ত বিহঙ্গের ডানার কথা, প্রেমিক-প্রেমিকার দেওয়া প্রথম কথা আবার মেয়ের আসার কথা, উত্তর আকাশের চাঁদের কথা। একেবারে কিউবিক ফর্মের আধাআধি চাঁদ। যদিও সে কথার মধ্যে চাঁদের মনোহারী বলয়ের কথা নেই। তেমন ফুটফুটে জ্যোৎস্নার কথা নেই। তবু আছে মেঘময় চাঁদের কথা। উল্টে পাল্টে। মেঘের চাঁদের কথা। কিম্বা চাঁদের মেঘের কথা। আর সেই কথায় ভেজে হৃদয়। পাতা ঝরার শব্দের মধ্যে আরতির কাঁসর ঘণ্টার অনুরণন। গাছে গাছে কে যেন ঝুলিয়ে দিয়েছে কাঁসর ঘণ্টা। একসঙ্গে সকলে বেজে ওঠে। বাতাসের মুখে শাঁখের উতরোল। অলক্ষ্যে থেকে কে যেন আবৃত্তি করে চলেছে মহালয়ার স্তোত্র। আর ঢ্যাং কুর কুর ঢাকের আওয়াজ মনের আনাচে কানাচে কখন যে ঢুকে পড়েছে টেরই পাইনি। সে আসলে বুঝি এমনই হয়। যেগুলো এতদিন নিজের কাছ থেকে হারিয়ে গিয়েছিল সেইগুলিই আবার নতুন আবেগে, নতুন ভাবনায়, নতুন উদ্দীপনায় নতুন মননে-চিন্তনে, নব রাগে সেজে ওঠে সুরের রামধনুতে।