ইলশেগুঁড়ি ২৯তম সংখ্যা (শারদীয়া)
ইলশেগুঁড়ি ২৯তম সংখ্যা (শারদীয়া)
নৃত্য, গীত ও বাদ্যের সমন্বয়ে গঠিত হয় সঙ্গীত। তেমনি লোকনৃত্য, লোকগীতি ও লোকবাদ্যের সমন্বয়ে গঠিত হয় লোকসঙ্গীত। এই সংগীত লোকের মানস থেকে নির্গত । পল্লীগীতির অন্যতম অংশ লোকগীতি। বাংলার সমস্ত লোকসংগীতের মধ্যে বাঙালির সংস্কৃতির আদি রূপ পাওয়া যায়।
‘Folklore’ শব্দটির বাংলা প্রতিশব্দ হল ‘লোকসংস্কৃতি’। ‘Folk’ কথার অর্থ ‘লোক’ ও ‘lore’ কথার অর্থ ‘সংস্কৃতি’। একটি বিশেষ জাতির আচার-আচরণ, রীতি-নীতি, পোশাক-আশাক, উৎসব, সঙ্গীত আরও অনেক বিষয় নিয়ে গড়ে ওঠে লোকসংস্কৃতি। লোকসঙ্গীত, লোকাচার লোকবিশ্বাস, লোকসংস্কার, লোকনাট্য, লোকনৃত্য, লোকক্রীড়া সবই লোকসংস্কৃতির অংশবিশেষ। বাংলার লোকসঙ্গীত বাঙালির প্রাণের সম্পদ। আজ আমরা আলোচনা করব বাংলার লোকসঙ্গীত নিয়ে।
নৃত্য, গীত ও বাদ্যের সমন্বয়ে গঠিত হয় সঙ্গীত। তেমনি লোকনৃত্য, লোকগীতি ও লোকবাদ্যের সমন্বয়ে গঠিত হয় লোকসঙ্গীত। এই সংগীত লোকের মানস থেকে নির্গত । পল্লীগীতির অন্যতম অংশ লোকগীতি। বাংলার সমস্ত লোকসংগীতের মধ্যে বাঙালির সংস্কৃতির আদি রূপ পাওয়া যায়। গ্ৰাম বাংলার মানুষের প্রানের গান লোকসঙ্গীতগুলি।
বাংলা লোকসঙ্গীতের বিশেষ কিছু বৈশিষ্ট্য আছে। বৈশিষ্ট্যগুলি হল :
১। জনমানস থেকে এর উদ্ভব ও মৌখিকভাবে লোকসমাজে প্রচারিত।
২। সম্মিলিত বা একক কণ্ঠে গীত হতে পারে।
৩। লোকসঙ্গীত নিয়মিত অনুশীলনের প্রয়োজন হয় না।
৪। সাধারণত নিরক্ষর মানুষ এর রচয়িতা বা সুরকার এবং অকৃত্রিম হৃদয়ের প্রকাশ ঘটে।
৫। সহজ ভাষা, আঞ্চলিক উচ্চারণ ও সুরের স্বতঃস্ফূর্ততা দেখা যায়।
৬। কথা ও সুরের সম্মিলনে হূদয়গ্রাহী আবেদন।
৭। সুরের আবেদন সর্বজনীন হলেও আঞ্চলিক ভাষার ব্যবহার স্বস্ব অঞ্চলকে চিহ্নিত করে।
৮। প্রকৃতি-নির্ভরতা নিসর্গ, প্রান্তর, নদী, নৌকা প্রভৃতি গ্রামীণ পরিবেশের বহুল ব্যবহার।
৯। দৈনন্দিন জীবনের সুখ-দুঃখ, ব্যথা-বেদনার নিরাভরণ প্রকাশ লক্ষ করা যায়।
১০। সহজ-স্বাভাবিক ছন্দের ব্যবহার করা হয়।
বাংলার নির্দিষ্ট অঞ্চলভেদে বাংলা লোকসংগীত প্রচলিত। বাংলার লোকসঙ্গীত বৈচিত্র্যময়। মোটা দাগে বাংলায় ২৪ ধরণের লোকজ সঙ্গীতের অস্তিত্ত্ব পাওয়া যায়- (১) ভাওয়াইয়া গান, (২) ভাটিয়ালী গান, (৩) মারফতী (মরমী) গান, (৪) বাউল গান, (৫) মুর্শিদি গান, (৬) কবিগান, (৭) টপ্পা গান, (৮) লেটো গান, (৯) আলকাপ গান, (১০) গম্ভীরা গান, (১১) সারি গান, (১২) ঘাটু গান, (১৩) গাজীর গান, (১৪) বিয়ের গীত, (১৫) জারি গান, (১৬) ভাদু গান, (১৭) কীর্তন, (১৮) আখড়াই গান, (১৯) চন্দ্ররাজার গীত, (২০) ধামাইল গান, (২১) পাঁচালি গান, (২২) বাদী গীত, (২৩) বাদ্যানীর গান, (২৪) মাইজভান্ডারী গান। এর মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য কয়েকটি লোকসঙ্গীত সম্পর্কে নিম্নে আলোচনা করা হল।
১) ভাটিয়ালি : বাংলার খুব জনপ্রিয় একটি লোকসঙ্গীত হল ভাটিয়ালি। পূর্ব ও পশ্চিম উভয় বঙ্গে এই গান প্রচলিত। মূলত নদীনির্ভর বাংলায় এই গান প্রচলিত। এটি মূলত মাঝি-মাল্লাদের গান। তবে ভাটিয়ালি একক সঙ্গীত। মাঝিদের সমবেত সঙ্গীত হল সারি গান। এটিও এক ধরনের লোকসঙ্গীত। নদী যাদের জীবিকার মূল সেই মানুষদের আচার-আচরণ, বিশ্বাস-সংস্কার , সুখ-দুঃখ সবই ধরা পড়ে এই গানে। পরিবার-পরিজনের কথা ভেবে নৌকা নিয়ে বেরিয়ে পড়তে হয় এদের মাঝসমুদ্রে। দিনের পর দিন মাসের পর মাস তারা সমুদ্রবক্ষে থাকে। দীগন্ত জুড়ে কালো মেঘ করে। উদাসী মন বাড়ি ফিরতে চায়। কখনো মন গেয়ে ওঠে --- " ভেবে দেখলাম ভবনদীর নাইরে পারাপার/আমি সেই দিকে চাই, সেই দিকেই দেখি অকূল পাথার।
বিষয় অনুসারে ভাটিয়ালি গানের লহর রয়েছে চারটি। লহর কথার অর্থ হল টান। এই লহরগুলি হল-- ক) বিচ্ছেদ লহর খ) সারি লহর গ) ঝাঁপ লহর ঘ) ফেরুসাই লহর। ভাটিয়ালি গানের বেশ কিছু বৈশিষ্ট্য আছে। বৈশিষ্ট্যগুলি হল ----
ক) ভাটিয়ালি গানে কোনো বাদ্যযন্ত্র থাকে না।
খ) মূলত চড়া পর্দার গান ও দীর্ঘ টান দেখা যায়।
গ) গভীর হৃদয়াবেগ ও তত্ত্বভাবনা এই গানে থাকে।
২) ভাওয়াইয়া : বিবাগী মনের গান হল ভাওয়াইয়া। যে কথা অব্যক্ত, যে ব্যথার কথা কাউকে বোঝানো যায় না, ভাওয়াইয়ার সুরে সেই গান ব্যক্ত হয়ে ওঠে। এই গান মূলত উত্তর বঙ্গের বিভিন্ন জায়গায় প্রচলিত। দার্জিলিং, কোচবিহার, দিনাজপুর, জলপাইগুড়ি, গোয়ালপাড়া, ধুবড়ি প্রভৃতি জায়গায় এই গান প্রচলিত। যারা এই গান পরিবেশন করেন তাদের বলে বাউদিয়া। এরা ঘরছাড়া বিবাগী মানুষ। পরকীয়া গানই এর মূলকথা। এই গানে রয়েছে কয়েকটি বিভাজন----
ক) গাড়োয়ালি
খ) মৈষালি
গ) চটকা ।
ক) গাড়োয়ালি : গরু মহিষের গাড়ির চালককে উদ্দেশ্য করে গাওয়া হয় গাড়োয়ালি। একটি বিখ্যাত গাড়োয়ালি গান হল--- "ওকি গাড়োয়াল ভাই/ কত রব আমি পন্থের দিকে চায়ারে।”
খ) মৈষালি : মহিষকুঁড়া নামাঙ্কিত স্থানে যাওয়া প্রেমিকদের উদ্দেশ্যে গাওয়া হয় মৈষাল বন্ধুর গান বা মৈষালি। এই গান মূলত বিরহমূলক।
গ) চটকা : চটকা দ্রুত তালের গান। এই গানের মধ্যে প্রেম-প্রণয় যেমন থাকে, তেমনি সমাজের দোষ - ত্রুটিও থাকে। এই গান লঘু সুরের গান।
ভাওয়াইয়া গান টানা সুরের গান। মূলত বিরহ, প্রেম-অপ্রেমের ছন্দ না পাওয়ার বেদনা প্রকাশিত হয় এই গানে।
৩) সারি গান : সারিবদ্ধ নৌকা থেকে একাধিক মাঝি-মাল্লাদের সুরবদ্ধ গানকে সারি গান বলে। নদী প্রধান রাজশাহী, দিনাজপুর, যশোর জেলায় এই গান প্রচলিত। পদ্মা - মেঘনা - যমুনায় নৌকা ভাসানো জেলে - মাঝিরা মনের আনন্দে এই গান করেন। তবে এখন বিভিন্ন মঞ্চে সারি গান গাওয়া হয়। এই গানের বিষয় রাধা-কৃষ্ণ, শিবপাবতী , লৌকিক প্রেম-প্রণয়। এই গান শুধু মাঝিরা নয় বর্তমানে চাষি - তাঁতি - কামার - কুমোর প্রত্যেকেই করে থাকেন।
৪) জারি গান : মহরমের বিষাদ স্মৃতি বুকে নিয়ে জারি গান ও জারি নাচ করা হয়। হাসান - হোসেন সহ তাদের পরিবারের প্রত্যেক সদস্য কিভাবে প্রাণ হারিয়েছিলেন, সেই বিষয়কে নিয়ে নাকি জারি গান করা হয়। এই গান বন্দনা, মূল আখ্যান ও বিদায়ী নামে তিনটি পর্বে পরিবেশিত হয়। এই গানে একজন মূল গায়েন থাকেন, যিনি কাহিনী বলে চলেন, অন্যরা দোহারের কাজ করেন। অঞ্চল বা মানুষের মন বুঝে আঞ্চলিক হিন্দুধর্ম উঠে আসে জারি গানের মধ্যে।
৫) ঝুমুর : আঞ্চলিক সঙ্গীত গুলির মধ্যে ঝুমুর গান সব থেকে বেশি জায়গায় প্রচলিত। উত্তরে সাঁওতাল পরগণা থেকে আরম্ভ করে দক্ষিণে সমগ্ৰ ছোটো নাগপুর ও পশ্চিমে মধ্যপ্রদেশের পূর্বভাগ পর্যন্ত আদিবাসী সমাজে এই গানের চল আছে।
লৌকিক বিষয় নিয়ে ঝুমুর গান লেখা হয়।এর অধিকাংশ বিষয় হল প্রেম। সাঁওতালি ঝুমুর গানে বাংলায় প্রচলিত রাধাকৃষ্ণের কাহিনী দেখা যায়। বাংলার প্রতিবেশী এই আদিম জাতিসমূহের বংশী-প্রীতি লক্ষণীয়। কর্মের ঝুমুর উপলক্ষ্যে রাধা-কৃষ্ণ প্রসঙ্গ এসেছে ---- “ঘরেত শাশুড়ি বাদী/বাহিরেত ননদিনী বাদী/অন্তরে বা দেখা হয়/আমার পুরুষও বাদী।"
রাধাকৃষ্ণের প্রেম-প্রীতি, মিলন-বিরহ ছাড়াও বিভিন্ন লৌকিক বিষয়, রাজনীতি - ধর্ম - সমাজ - সংস্কৃতির নানা উপাদান ঝুমুর গানের অঙ্গ। পশ্চিম বঙ্গের পুরুলিয়া, পূর্ব মেদিনীপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর, বাঁকুড়া, পশ্চিম সীমান্ত বঙ্গের বিভিন্ন জায়গায় এই ঝুমুর গানের প্রভাব রয়েছে। নাচের বিষয় অনুসারে ঝুমুর গান গুলিকে কয়েকটি শ্রেনীতে ভাগ করা যায়। যথা ----- ক) পাতা নাচের ঝুমুর, খ) রাসলীলা ঝুমুর,গ) করমের ঝুমুর ও ঘ) ঠাট ঝুমুর ইত্যাদি।
৬) বাউল গান : বাউল একটি স্বতন্ত্র ধর্মসম্প্রদায়, যারা কোনো বিগ্ৰহের উপাসনা করে না, কোনো দেব-দেবীও তাদের উপাস্য নয়। তাদের উপাস্য এক মনের মানুষ ; তাকে নিজেদের দেহে, মর্মে উপলব্ধি করার চেষ্টা করে। বাউল সম্প্রদায়ে হিন্দু ও মুসলমান দুই সম্প্রদায়ের লোক রয়েছে। বাউল ধর্মে কোনো জাত থাকে না। তাঁরা মানুষ জাতি বলেই নিজেদের একজাতি বলে ভাবে। বাউলরা সংসার ত্যাগ করে ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে তারা আখরা ও আশ্রম গড়ে তোলে। তবে সবাই যে বৈরাগী বাউল তা কিন্তু নয়, অনেক গৃহস্থ বাউলও আছে তারা স্বামী - স্ত্রী - সন্তানাদি নিয়ে সংসার জীবনে যুক্ত।
বাউল গান গাওয়ার ভঙ্গি ‘ফকির চাঁদি' নামে পরিচিত। বাউল গান গাওয়ার সময় দেহের অঙ্গ বিভিন্ন তালে ও ভঙ্গিতে দোলে। গানের সঙ্গে নৃত্য ওতোপ্রতোভাবে যুক্ত। রাঢ়ি বাউলরা নাচে এবং গান গায়, কিন্তু নবদ্বীপের বাউলরা গান গাইবার সময় নাচে না, কিন্তু তারা একতারা নামে একটি বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে গান করে।
বাউল গানে লালন শাহ দরবেশ (লালন ফকির) - এর নাম সবথেকে পরিচিত। তিনি হিন্দুর ঘরে জন্মগ্ৰহণ করেছিলেন কিন্তু পরে সিরাজ শাহ ফকিরের কাছে দীক্ষা গ্ৰহণ করেছিলেন। তাই লালন গান বেঁধে বলেছিলেন --- " সব লোকে কয় লালন কি জাত সংসারে/লালন ভাবে জাতের কিরূপ দেখলাম না এ নজরে।” বাউল ধর্ম প্রচারক হিসাবে লালন ফকিরের নাম সবার আগে নিতে হয়। হাজার হাজার তার শিষ্য। তার গান বড়ই সাংকেতিক। গানের অর্থ বোঝেন একমাত্র বাউলরাই। লালনের সবচেয়ে জনপ্রিয় গান --- "খাঁচার ভিতর অচিন পাখি কেমনে আসে যায়/ ধরতে পারলে মনোবেড়ি দিতেম পাখির পায়।” তার কাছে নতুন নতুন গান তৈরি করাই হল তার প্রকৃতি। লালনের গান এক অপূর্ব ভাবে পূর্ণ, যা চিরকালীন। তার ভাবও গভীর। তার এক গভীর ভাবের গান হল --- “ আমি একদিনও না দেখিলাম তারে/আমার বাড়ির কাছে আরশীনগর/ও এক পড়শী বসত করে।” লালন ফকির ছাড়াও বর্তমানে বাংলায় অনেক বিখ্যাত বাউল শিল্পী আছেন। কার্তিক দাস বাউল, পূর্ণদাস বাউল, পার্বতী বাউল প্রভৃতি।
৭) টপ্পা গান : টপ্পা গান কলকাতা অঞ্চলের একটি লৌকিক গান। এটি পাঞ্জাব অঞ্চলের মূল গানের সাথে মিল থাকলেও বাংলায় এটি রাগাশ্রয়ী গান হিসেবে পরিচিত। রামনিধি গুপ্ত (নিধু বাবু) এর উদ্ভাবক বলে পরিচিত। অষ্টাদশ শতকের শেষভাগে পাঞ্জাব অঞ্চলের লোকগীতি টপ্পা গানের প্রচলন শুরু হয়। প্রধানত উটের গাড়ি চালকের মুখেই টপ্পা গান বেশি শোনা যেত। শোরী মিয়া (১৭৪২-১৭৯২) নামে একজন সঙ্গীতজ্ঞ টপ্পা গানগুলোকে সাঙ্গিতিক আদর্শে সাজিয়ে সম্পূর্ণ আলাদা একটি গায়ন পদ্ধতি উদ্ভাবন করেন। এ পদ্ধতি অনুসরণ করে রামনিধি গুপ্ত বা নিধু বাবু (১৭৪১-১৮৩৯) বাংলা টপ্পা রচনা করেন।
৮) মুর্শিদি গান : মুর্শিদি গান এক প্রকার আধ্যাত্মিক লোকসঙ্গীত। সুফিদের দ্বারা এর উদ্ভব ও বিকাশ ঘটেছে। ‘মুর্শিদ’ শব্দটি আরবি; এর শব্দমূল ‘এরশাদ’, অর্থ আদেশ-উপদেশ দেওয়া। যিনি মুরিদ বা ভক্তকে আদেশ-উপদেশ দেন এবং জিকিরাদি দ্বারা অধ্যাত্মপথে পরিচালিত করেন, তিনিই মুর্শিদ। এক কথায়, মুর্শিদ হচ্ছেন আধ্যাত্মিক উপদেষ্টা বা পথপ্রদর্শক। হিন্দুর আধ্যাত্মিক যোগসাধনায় গুরুর এবং মারফতি ভাবসাধনায় মুর্শিদের স্থান একই।
৯) কবিগান : কবিগান এক ধরনের প্রতিযোগিতামূলক গান। দুটি দলে এ প্রতিযোগিতা হয়। দলের দলপতিকে বলে কবিয়াল বা সরকার। কবিয়ালের সঙ্গীদের নাম দোহার। যন্ত্রসঙ্গীতকারীদের মধ্যে ঢুলি মুখ্য ভূমিকা পালন করে। দল দুটি পর্যায়ক্রমে আসরে এসে গান পরিবেশন করে।
উনিশ শতকের কলকাতায় যে কয়জন কবিয়াল বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেন, তাঁদের মধ্যে হরু ঠাকুর (১৭৪৯-১৮২৪), নিতাই বৈরাগী (১৭৫১-১৮২১), রাম বসু (১৭৮৬-১৮২৮), ভোলা ময়রা, এন্টনি ফিরিঙ্গি প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য। বিশ শতকে সর্বাধিক জনপ্রিয় কয়েকজন কবিয়াল হরিচরণ আচার্য (১৮৬১-১৯৪১), রমেশ শীল (১৮৭৭-১৯৬৭), রাজেন্দ্রনাথ সরকার (১৮৯২-১৯৭৪), মানিকগঞ্জের রাধাবল্লভ সরকার, উপেন্দ্র সরকার, ভাসান সরকার, কুমুদ সরকার, অভয়চরণ সরকার, বিজয়কৃষ্ণ অধিকারী (১৯০৩-১৯৮৫), গুমানী দেওয়ান প্রমুখ।
১০) ভাদু গান : ভাদু গান পশ্চিমবঙ্গের একটি প্রচীন লোকগান। এই গান পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, বীরভূম, পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা ও বর্ধমান জেলার আসানসোল মহকুমা এবং ঝাড়খণ্ড রাজ্যের রাঁচি ও হাজারিবাগ জেলার লৌকিক উৎসব ভাদু উৎসবে এই গান গাওয়া হয়ে থাকে। ভাদু গানগুলিতে প্রেম এবং রাজনীতি সর্বতোভাবে বর্জিত। সাধারণত গৃহনারীদের জীবনের কাহিনী এই গানগুলির মূল উপজীব্য। পৌরাণিক ও সামাজিক ভাদু গানগুলি বিভিন্ন পাঁচালির সুরে গীত হয়। সাধারণত রামায়ণ, মহাভারত ও কৃষ্ণ-রাধার প্রেম পৌরাণিক গানগুলির এবং বারোমাস্যার কাহিনী সামাজিক গানগুলির বিষয় হয়ে থাকে। এছাড়া চার লাইনের ছড়া বা চুটকি জাতীয় ভাদু গানগুলিতে সমাজ জীবনের বিভিন্ন অসঙ্গতির চিত্র সরস ভঙ্গীতে ফুটিয়ে তোলা হয়। কয়েকটি ভাদু গান হল --- " ও আমার ভাদুরে/ তোমায় ছাড়া আমি বাঁচি কি করে?", “ ভাদর মাসে ভাদু পূজা " । বতর্মান সময়ের একজন বিখ্যাত ভাদুশিল্পী হলেন রতন কাহার। তিনি তার ভাদু গানের জন্য পদ্মশ্রী পুরস্কার পেয়েছেন।
১১) টুসু গান : টুসু উৎসবের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ টুসু সঙ্গীত। এই সঙ্গীতের মূল বিষয়বস্তু লৌকিক ও দেহগত প্রেম। এই গান গায়িকার কল্পনা, দুঃখ, আনন্দ ও সামাজিক অভিজ্ঞতাকে ব্যক্ত করে। কুমারী মেয়ে ও বিবাহিত নারীরা তাদের সাংসারিক সুখ দুঃখকে এই সঙ্গীতের মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলেন। গানের মাধ্যমে মেয়েলি কলহ, ঈর্ষা, অভীপ্সা, দ্বেষ, ঘৃণা স্পষ্ট ভাষায় ব্যক্ত করা হয়। এছাড়া সমকালীন রাজনীতির কথা ব্যাপক ভাবে এই গানে প্রভাব বিস্তার করে থাকে। এই সমস্ত গানে পণপ্রথা, সাক্ষরতা সম্বন্ধে সচেতনতা, বধূ নির্যাতনের বিরুদ্ধতা প্রভৃতি সামাজিক দায়িত্বের কথাও বলা হয়।
টুসু গীতকে ভনিতাযুক্ত ও ভনিতাবিহীন এই দুই শ্রেণিতে ভাগ করা যায়। ভণিতাবিহীন টুসু গীতকে মূল টুসু পদ এবং টুসু পদের রঙ এই দুইটি অংশে ভাগ করা যায়। টুসু পদের রঙ অংশটি কখনো মূল পদের সঙ্গে সাযুজ্য রেখে রচনা করা হয়, কখনো বা স্বতন্ত্র ভাবে রচিত হয়। ভণিতাবিহীন টুসু পদ মূলতঃ চার চরণে বাঁধা থাকে, যার মধ্যে রঙের জন্য মাত্র দুইটি চরণ নির্দিষ্ট থাকে।
১২) গম্ভীরা গান : উত্তরবঙ্গ, বিশেষ করে মালদা জেলার অন্যতম জনপ্রিয় লোক সংগীত হল গম্ভীরা ৷ অবশ্য গানের পাশাপাশি এতে নাচের পরিবেশনও হয় ৷ মূলত চৈত্র মাসে চড়ক উৎসবের সময় শিবের মহিমা কীর্তন নাচ ও গানের মাধ্যমে প্রচার করা হয় ৷ প্রাচীন গৌড়িয় জনপদ তৈরির অনেক আগেই গম্ভীরার সৃষ্টি ৷ পণ্ডিতদের মতে গম্ভীরা দু'ধরনের হয় ৷ প্রাথমিক ও Narrative গম্ভীরা ৷ প্রাথমিক গম্ভীরায় দেবদেবীর মহিমা ও মানবজীবনে তার প্রভাব বর্ণিত থাকে ৷ আর মানুষের সামাজিক সমস্যা তুলে ধরা হয় Narrative গম্ভীরায় ৷ একজন বা দুজন শিল্পী গম্ভীরা পরিবেশন করেন ৷ কখনও মুখোশ পরে বিভিন্ন দেবদেবীর সাজে শিল্পীরা গান করে অভিনয় করেন ৷ আবার কখনও দাদু নাতির দুটি কাল্পনিক চরিত্র তৈরি করে সামাজিক সমস্যা বর্ণনা করে নাচ ও গান পরিবেশন করা হয় ৷ গম্ভীরাতে ঢাকের ব্যবহার গুরুত্বপূর্ণ ৷ এই গান কিছুটা উচ্চ্স্বরে গাওয়া হয় ৷ গানের সুর প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে একই রকম থাকে ৷
১৩) কীর্তন : বাংলার সঙ্গীত শাস্ত্রে কীর্তনের অবদান অনস্বীকার্য। ধর্মকেন্দ্রিক এই গানগুলি সমস্ত মানুষের মনকে আকৃষ্ট করে। কীর্তনের মধ্যে সুরের অভাবনীয় জাদু থাকে। এই গানের পাঁচটি অঙ্গ। কথা, দোঁহা, আখর, তুক, ছুট। কীর্তন দুই প্রকার। নামকীর্তন ও লীলাকীর্তন। একসঙ্গে অনেক মানুষ মিলিত হয়ে নামকীর্তন করে। কৃষ্ণনাম ও কৃষ্ণের গুণকীর্তন করা হয় এই নাম কীর্তনের মাধ্যমে। অষ্টপ্রহর, চব্বিশ প্রহর, কিম্বা মাস, বছর ধরে অখণ্ড ভাবে কীর্তন গান গাওয়া হয়। নগরের পথে সমবেতভাবে কীর্তন হলে তাকে নগরকীর্তন বলা হয়।
শ্রীকৃষ্ণের বাল্য, কৈশোর ও যৌবন লীলার বিভিন্ন প্রসঙ্গ নিয়ে লেখা হয় লীলা কীর্তন। এটি মূলত শ্রীকৃষ্ণের বৃন্দাবন লীলাকে কেন্দ্র করে পরকীয়া প্রেমের কাহিনী। তারা কৃষ্ণ কথা নিয়ে পদ লিখেছেন তাদের মহাজন বলে। মহাজনেরা লীলা কীর্তনের বিষয়কে বিভিন্ন রস বিন্যস্ত করেছেন।
লীলা কীর্তনের মূল গায়েন সুর-কথায় , ছন্দ - তালে, বাদ্যে-নৃত্যে কীর্তনকে অপূর্ব রূপ দেন। মূল গায়েনের পিছনে থাকেন দোহার। তারা মূল গায়েনের কথাকে বিস্তৃতি দান করেন। মূল পালাগান শুরুর আগে আসরে যে ভনিতা দেওয়া হয় তাকে বলে গৌরচন্দ্রিকা।
পরিশেষে বলা যায় বাংলার লোকসঙ্গীতগুলি বাঙালির খুবই প্রিয়। এগুলো তাদের নিজস্ব সম্পদ। সাধারণ মানুষের দ্বারা সৃষ্ট আত্মার আত্মীয় এই গানগুলি। বাংলার লোকসঙ্গীত বাঙালির প্রানের সম্পদ।