ইলশেগুঁড়ি ২৯তম সংখ্যা (শারদীয়া)
ইলশেগুঁড়ি ২৯তম সংখ্যা (শারদীয়া)
কিরে লম্বা লম্বা পা ঝুলিয়ে কি ভাবছিস? আমিতো ভাই এপারে চলে আসার পর ওপারের চিন্তাভাবনা করা একদম ছেড়ে দিয়েছি। কেনই বা ভাবতে যাবো বল?
পাত্র’দা বলল, “জয় নিতাই, তোর এলাকায় বাড়ি বাড়ি গিয়ে বেকার ছেলে মেয়েদের বলে দে কোনরকমে নিজের বাপের দেওয়া নামটা পরীক্ষার খাতায় লিখে দিতে পারলেই মাস ফুরালে কড়কড়ে কুড়ি হাজার পকেটে। আর বাকিটা পার্টি ফান্ডের চাঁদা, দেশসেবার কাজে উৎসর্গ করার জন্যে। অবশ্য শুরুতে দুই লাখ, পরে পকেট বুঝে আড়াই-তিন। কিন্তু তার থেকে এক নয়া পয়সাও কোনভাবেই বেশী নয়। আরে আমাদের তো একটা নীতি আছে নাকি? পার্টির ইমেজের সাথে কোন সমঝোতা নেই। আগেরগুলোর তো লাজ লজ্জা বলে কিছু ছিলনা প্রায় সাড়ে তিন দশক ধরে শুধু লুটপাট আর ফতুয়া গায়ে চাপিয়ে বড় বড় ভাষণ।’’
কিন্তু শেষমেশ কি পেলাম বল? বাটি, ঘটি, জমিজমা সব কিছু বেচে সেই শুধু আমারা কজনাই তো অবশেষে গলায় দড়ি দিয়ে এখানে আসতে বাধ্য হলাম।
“আরে তোমরা দুজনে কড়িকাঠে ঝুলে, আর আমিতো ধার দেনায় গলা পর্যন্ত ডুবে শেষে একবোতল ফলিডল খেয়ে’’, গর্জে উঠল পেঁচো। মানে মর্তের পাঁচুগোপাল গড়করি। মুর্শিদাবাদের ডোমজুর এলাকার শেখ আতাউর সরলাবালা প্রাথমিক স্কুলের গ্রুপ ডি ননিগোপাল গড়করির পাঁচ সন্তানের মধ্যে কনিষ্ঠ। মেয়ে মেয়ে করে চার চারটির পরে বংশের সলতে বলতে এই একটিই ছিল। প্রাথমিক স্কুলের চাকরির পরীক্ষায় আট কাঠা বাস্তু জমি জলের দরে বেঁচে সর্বসাকুল্যে চার লাখ টাকা। তার থেকে আড়াই লাখ পঞ্চায়েত প্রধানের ছেলে মিজানুরকে দিলাম চাকরি পাইয়ে দেবে এই আশ্বাসে। বাপে বারবার পইপই করে বারণ করলে। এমনকি এও বললে যে, ‘‘আরতো বছর তিনেক চাকরি আছে। বাকি দুবছর আরো করে নিয়ে এক বছর বাকি থাকতে ইচ্ছা করে এক্সপ্রেস ট্রেনের তলায় শুয়ে পরব। সরকারের কাছে এক্সিডেন্টাল কেসে মৃত্যু দেখালেই আমার পোষ্টে চাকরিটা পেয়ে যাবি। বয়স তো কম হলো না। বাপ কাকার দেওয়া হিসাব মতো গত বছরেই সত্তর পার হয়ে গেছে। আমাদের সময় তো জন্মের সার্টিফিকেটের বালাইও ছিলনা। তাহলে বাহাত্তর বছর বেঁচে থাকার পর আর কি দরকার। তার জায়গায় যদি ছেলে আরও পঁয়ত্রিশ বছর সরকারি চাকরি করতে পারে তাহলে এর থেকে লোভনীয় সুযোগ আর দ্বিতীয় কিইবা হতে পারে।’’
ঐযে গীতায় বলা আছে না গুরুজনদের কথা সর্বদা মেনে চলবে। আজকে বাপের কথা শুনলে আমার জায়গায় তোদের পাশে আমার বাপ বসে উল্টো পা ঝোলাতো।
আরে থামতো। কি হতে পারতো আর কি হয়েছে এসব আবোলতাবোল সাত সতেরো ভেবে হাড়ে দূব্বো গজিয়ে লাভ নেই। বরং মর্তের কথা ছেড়ে এখানকার মতো করে এখন থেকে ভাবতে হবে। ঐ ব্যাটা জন্মের বুড়ো চিত্রগুপ্ত হাড়বজ্জাদ। একটু হাত পা দুটো টিপে দিলে দেখবি কড়াই এর তেলটা কম গরম থাকে।
কি করে বুঝলি?
আরে প্রথম দুদিন নরমাল তেলেই ভাজছিল। কিন্তু আজকে সকালে একটু মোটা গলায় বলেছিলাম, ‘‘কি দাদু তোমার কি রিটায়ারমেন্ট বলে কিছু নেই?” একটু ইয়ার্কিই করেছিলাম। ভেবেছিলাম বয়সে তো আমি ওঁর তস্য নাতির থেকেও ছোট তাই হয়তো কিছু মনে করবে না। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে ওর ঐ জাবদা খাতায় কিসব হিজিবিজি কাটল আর বললো পাপের বোঝা নাকি আধ মণ বেড়ে গেছে। ব্যাস পাশের বড় কড়াইটার মধ্যে আরও আধা ঘন্টা বেশি ভেজে তুললো। আত্মাটাকে পুরো বেগুনের ভর্তা বানিয়ে ছেড়ে দিয়েছে। ব্যাটা আমাকেও চেনেনা। ওর ঐ খাতায় গরমিল করিয়ে দিয়ে যম’কাকুকে দিয়ে যদি না বুড়োকে কেস খাইয়েছি তো আমার নামও জয় নিতাই বিশ্বাস নয়।
বাপরে তোর ঐ কুম্ভকর্ণটাকে কাকু বলে ভাবতে ভালো লাগে। কৈলাসে শিবের যাঁড়টাকেও ওর থেকে বেশী সুন্দর দেখতে।
আরে নাড়ু, আস্তে বল যমের চেলাগুলো সবসময় কান খাড়া করে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কিছু একটা বেফাঁস শুনে নিলেই বুড়ো টিকটিকিটার কাছে খবর পৌঁছে যাবে আর বৃদ্ধ মরা পোকা খুঁটে খাওয়া টিকটিকিটা সঙ্গে সঙ্গে শাস্তির পরিমাণ বাড়িয়ে দেবে।
তুই গত পরশু লক্ষ্য করেছিলি? আরে ঐ যে ফর্সা করে বাপের বয়সি আত্মাটা, একটু জিজ্ঞেস করেছিল যে কিসের অপরাধে তাকে আজ অতিরিক্ত এক ঘন্টা কড়া রোদে লোহার উঠোনে ফেলে সেঁকা হচ্ছে? ব্যাস ওমনি সময় আরো দুই ঘন্টা বাড়িয়ে দেওয়া হলো।
ঠিক বলেছিস। সেই জন্যেই ভাবছিলাম এরকম ফর্সা একটা আত্মা হঠাৎ করে এতো কালো হয়ে গেল কিভাবে!! এখন তোর কথা শুনে সব জলের মতো পরিস্কার। নাঃ, নিতাই একদম ঠিক বলেছে। একটা কিছু না করলেই নয়। বড্ড বাড় বেড়েছে এগুলোর। একটু টাইট না দিলে দিনকে দিন বাড়তেই থাকবে। এর থেকে আমাদের মর্তলোকই অনেক ভালো ছিল রে। যা ইচ্ছা করো কুছ পরোয়া নেই। শুধু দু-চারটে পলিটিকাল দাদার সুনজরে থাকতে হবে, ব্যাস লে ফুর্তি চেটেপুটে।
তোর ঐ পলিটিকাল দাদাদের কথা আর বলিস নাতো। ঐ গিরগিটিগুলোর জন্যেই তো আজ আমাদের এই অবস্থা। ওদের স্বপ্ন দেখানো ফাঁদে পা না দিলে আজ এই দিন দেখতে হতো? বিনা পয়সায় কিংবা লোকের পকেট মেরে কত তেলেভাজা খেয়েছি মর্তে থাকতে। তখন কি দুঃস্বপ্নেও ভেবেছি যে মরার পরে যমালয়ে এসে নিজেদেরকেই তেলেভাজা হতে হবে?
পকেট মেরে মানে? তুই আবার পকেটমার কবে ছিলি রে পচা?
ওঃ, এই নাড়ুকে নিয়ে হয়েছে মহা বিপদ। প্রতি কথায় কথায় প্রশ্ন। আরে পকেটমার হতে যাব কেন, সরস্বতী কিংবা কালী পুজোর সময়ে একটা আসল আর দুটো করে লোক ঠকানো নকল চাঁদার বিল ছাপিয়ে টাকা তুলে একটায় জোগাড় হওয়া টাকা দিয়ে পুজো করা হতো আর বাকি দুটোর টাকায় দেদার খাওয়া দাওয়া আর ফূর্তি। এবার ঢুকেছে মাথায়?
নাড়ুর কথা ছেড়ে আগে বলতো এখানে এই নরক যন্ত্রণা আর কতদিন সহ্য করতে হবে ? আমরা কি আর মর্তে কখনওই ফিরতে পারবোনা?
কি করে ফিরবি, নিজের পাপের মাত্রাটা কখনো একবার মেপে দেখেছিস? মর্তলোকে থাকতে সব এক একটা রাজা ছিলি নিজের এলাকায়। ছোট, বড় বুড়ি, ছুড়ি কাউকে রেহাই দিয়েছিস? এখন দেখ সেইসব অগুনতি পাপের বোঝা থেকে কবে মুক্তি পাওয়া যায়।
আদৌ পাওয়া যাবেতো??
কি করে বলবো বল নাড়ু। তুইও যেখানে আমিও সেখানে। এখানকার নিয়ম কানুনও তো কিছুই জানা নেই। একমাত্র ঐ বুড়ো সজনে ডাঁটা-টাই বলতে পারতো। কিন্তু জিজ্ঞেস করার তো জো নেই। সোজা তেলের উষ্ণতা বাড়িয়ে দেবে। তবে আমিও ওকে ছাড়বোনা। এখান থেকে যাওয়ার আগে এমন কলকাঠি নাড়বো যে ব্যাটাকে লজ্জার মাথা খেয়ে বাধ্য হয়ে রিটায়ার করতে হবে। ওঃ, সেদিনটা যা মজা হবেনা মাইরি। ভেবেই তো উল্টো পায়ে ধেই ধেই করে নাচতে ইচ্ছা করছে। কিন্তু না এখন নাচবো না, আগে ব্যাটাকে উচিত শিক্ষা দিই তারপরে নাচ কাকে বলে দেখবি। ঐ ব্যাটা আঙ্কেলটাকেও টাকের ওপরে কষে চারটে গাট্টা মারতে হবে। মর্ত্যে এতো বয়স্ক লোক রয়েছে যারা খাবার না পেয়ে, রোগে ভুগে ভিক্ষাবৃত্তি করে বেড়াচ্ছে। সদা সর্বদা নিজের মৃত্যু কামনা করছে, সেগুলোকে খুঁজে পায়না? তা না, আমাদের মতো সদ্য কুঁড়ি থেকে ফুল হয়ে ফুটে ওঠা শক্ত সমর্থ উঠতি জোয়ান ছেলেগুলোকে তুলে নিয়ে চলে এলি? এই নাকি তোর বিচার? একটু নাহয় হাওয়ায় ফুঁ দিয়ে উড়ছিলাম, খেলছিলাম, তা খেলতে দেনা ভাই। তাতে তোর বাপের কি?
আরে গুরু, একটা কথাতো ঠিক বলেছিস। আচ্ছা এই কালো ধুমসো মোষটার বাবাটা কে বলতো?
কি করে বলবো বল, যমের বাবার নাম কোনো শাস্ত্রেই তো কোথাও উল্লেখ আছে বলে জানা নেই।
কে আবার হবে, ঐ পরমপিতা ব্রহ্মাই হবে। কিন্তু ব্রহ্মাতো আমাদেরকেও সৃষ্টি করেছেন। আর সেই সুত্রে সেক্ষেত্রে সম্পর্কে তো আমরা যম’দার আপন ভাই।
বেড়ে বলেছিস তো। আগেতো এটা মাথায় আসেনি। যম’দাকে এই জায়গায় একটু সুরসুরি দিয়ে দেখতে হবে। যদি কাজে লেগে যায় তো দেখ চিত্র টিকটিকি তোর চাকরিটা কিভাবে খাই। প্রচুর ভেজেছিস তেলে। এইবার তোকে কিভাবে ছাঁকা তেলে ভাজবো দেখ।
অবশ্য গুরু মুখরোচক হবেনা, যা দড়ি পাকানো চেহারা। শাঁস বলে তো কিছু নেই শরীরে। জলঢোড়ার শরীরেও এর থেকে বেশি খাদ্যবস্তু থাকে।
যা বলেছিস। যম’দাকে দেখতো আশেপাশে দেখা যায় কিনা। একবার দেখা পেলেই সম্পর্কটাকে একটু বেশি করে মাখন মাখিয়ে মুখের সামনে একদম প্লেটে সাজিয়ে বেড়ে দিতে হবে। যতো শুকবে ততো জাল গোটানো শুরু। আর একবার যদি সম্পর্কটাকে ওর ঐ ভোঁতা মগজে ঢুকিয়ে দেওয়া যায় তো লে ছক্কা। পুরো মহারাজ। এক পা এগিয়ে এসে বাঁ-হাতে ফুলটস বানিয়ে নিয়ে সোজা লং-অনের উপর দিয়ে মাঠের বাইরে, বলরূপী ঐ শুটকি কাঠ ঠোকরা, চিত্রগুপ্ত। প্রচুর ঠুকরেছিস গত দুদিনে। এইবার বদলা কাকে বলে দেখবি।
এই তোরা তিনজনে এখানে কি করছিস রে। তোদের বিরুদ্ধে নালিশ আছে আমার কাছে। গতকাল চিত্রগুপ্তই বলছিল, তোরা তিনজনে নাকি সারাক্ষণ গুজুর গুজুর ফুসুর ফুসুর করে বেড়াস। কিসের এতো শলা পরামর্শ তোদের?
আরে এ যে মেঘ না চাইতেই জল। ওঃ, আমাদের কি ভাগ্য। স্বয়ং আমাদের পরম শ্রদ্ধেয় বড় ভাই আমাদের সামনে দাড়িয়ে। শিগগির প্রণাম কর সবাই, দাদার রাতুল চরণে প্রণাম কর।
এই কি মতলব রে তোদের? আমি আবার কবে থেকে তোদের দাদা হলাম? এই শোন, কোনও রকম পেঁয়াজি নয় কিন্তু। একদম আলকাতরায় আস্ত ভেজে পচা পুকুরে চোবাবো। আমার কোনো ভাই-টাই নেই। একটাই শুধু বোন আছে, যমুনা। কিন্তু দুনিয়ার যতো নোংরা আবর্জনা ফেলে আমার বোনটার তোরা মর্ত্যবাসী যা হাল করেছিস, মাঝেমধ্যে মনে হয় তোদের সবকটাকে একসাথে গরম তেলে পেঁয়াজি ভেজে কুড়মুড় করে চিবিয়ে খেয়ে ফেলি। ভাইফোঁটায় প্রতিবার ফোঁটা দিতে আসে, পাশে দুর্গন্ধে বসা যায় না। কিছু বলাও যায় না, শত হলেও আপন বাপের পেটের দিদি বলে কথা। নিজের বলতে তো ঐ একজনই আছে না।
কে বললো যম’দা, আছে তো। তোমার এই, যেটা বললে, বাপের পেটের তিন ভাই।
আবার মতলব? এবার কিন্তু রাগে ব্রহ্মতালুতে আগুন ধরে যাবে বলে দিচ্ছি।
আরে যম’দা, খামোকাই উত্তেজিত হয়ে যাচ্ছ। একটু শান্ত হও, সব বুঝিয়ে বলছি। দেখো যেটা সত্যি সেটাতো জোর করে অস্বীকার করা যাবেনা তাই না? সবটা ধৈর্য ধরে একটু শান্ত হয়ে শোনো। সব তোমার কাছে জলের মতো পরিস্কার হয়ে যাবে। তুমিই বলো পরমপিতা ব্রহ্মা তোমার কে হয়, বাবা? কারণ তিনি তোমাকে তৈরি করেছেন। এবার তাহলে তুমি বলো, আমাদের এই তিনজনকে সৃষ্টি করেছেন কে? ভেরি সিম্পল, স্বয়ং ব্রহ্মা। তাহলে তুমি আমাদের তিনজনের কে হলে? ভেরি ভেরি সিম্পল, বড় ভাই। একদম রামায়নের সেই জগত বিখ্যাত চার ভাই, তুমি শ্রী রাম, আর আমরা, আমি নিতাই, পেঁচো আর নাড়ু-তোমার পরম আদরের তিন ছোটো ভাই, লক্ষণ, ভরত আর শত্রুঘ্ন।
আমি শ্রী রাম! বলছিস? ব্যাপারটা তো আগে ভেবে দেখা হয়নি কখনো। হুঃ, কথাটার মধ্যে একটা, ইয়ে তোদের ভাষায় কি যেন বলে না বেশ... আরে দুর পেটে আসছে কিন্তু মুখে আসছে না...আরে ঐ যে বলিসনা কি যেন বলে একটা.,.
আরে রাম’দা, ইয়ে মানে যম’দা ওটাকে বলে লজিক।
হ্যাঁ হ্যাঁ, ওই লজিক। আর এইমাত্র কি একটা নামে যেন ডাকলি বেশ, হ্যাঁ হ্যাঁ পষ্ট শুনেছি রাম’দা। এই এটা কিন্তু একটু বেশিই বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে। কোথায় রাম’দা আর কোথায় আমি, মৃত্যুলোকের অধিপতি যম।
কি যে বলো বড়’দা, ‘রাম’, নামটা কোথা থেকে এসেছে একবার একটু স্মরণ করে দেখো। দস্যু রত্নাকর প্রথমে ‘মরা’ দিয়ে শুরু করেছিল। ধীরে ধীরে মরা’ই উল্টে হয়ে গেলো রাম। আর তুমিতো মরার পরে মৃত আত্মাদেরই সামলাও। তার মানে যে যম সেই রাম, ভেরি সিম্পল।
তাহলে আজ থেকে নিজেকে ‘রাম’ বলে ভাবতে পারি বলছিস? পুরুষোত্তম রাম,ওঃ, ভাবতেই কেমন যেন একটা রোমাঞ্চ হচ্ছে। ঐ ব্যাটা ‘গুপ্ত’, কোনদিনও এটা আমাকে বোঝালো না। সারাদিন শুধু তেলেভাজা নিয়েই ব্যাস্ত!
আরে যম’দা, তুমি ঐ লোকটার সাথে এতদিন একসাথে আছো কি করে? আজকে ঐ লোকটার জন্যেই মর্তলোকে তোমার যত বদনাম। যমলোক শুনলেই লোকে ভয়ে সিঁটকে যায়। অথচ দেখো দেবলোকে সারাক্ষণ নাচ গান হৈ-হুল্লোর আর শুধুই মজা। আরে ওদের মতো তুমিও তো একজন প্রথম সারির দেবতা। মা দূর্গাকে মহিষাসুরকে বধ করতে যুদ্ধে পাঠানোর সময় তুমি দিয়েছো কালদন্ড। অথচ মর্তবাসীর কাছে তোমার প্রতি কোন শ্রদ্ধাই নেই। সেখানে পাড়ায় পাড়ায় দেখো বাকি সব দেবতাদের পুজো হচ্ছে ধুমধাম করে। ঐ একটা লোক, চিত্রগুপ্ত তোমার ইমেজটাকে গুপ্ত রেখে একেবারে তেলেভাজা বানিয়ে ছেড়ে দিয়েছে। তুমি ওকে এতকাল ধরে সহ্য করছো কি করে, আমার তো মাথাতেই ঢুকছে না।
আমাদেরও ঠিক তাই। যম’দা ঐ লোকটাকে এবার একটু পাল্টে অন্য কাউকে কিছুদিনের জন্যে দায়িত্ব দিয়ে দেখো। আমরা নিশ্চিত তুমিই হবে আগামী দিনে স্বর্গের অধিপতি।
বলছিস সেক্ষেত্রে একটা সুযোগ আছে? আরে তোরা তো একদম আমার মনের বহুদিনের সুপ্ত ইচ্ছাটাই ধরে ফেলেছিস দেখছি।
আরে যম’দা, কোথায় তোমার এইরকম তাগড়া উঁচু লম্বা শরীর, আর কোথায় দেবরাজ ইন্দ্র। তুমি সারাদিন কাজ করে দম নেওয়ার সময় পাচ্ছোনা। প্রতিমুহূর্তে হাজার খানেক করে বিভিন্ন পাপি তাপি আত্মা এসে মরা কান্না জুড়ে দিচ্ছে আর দেবলোকে দেখো কোন কাজই নেই। শুধুই আয়েস আর আরাম। নাচ, গান আর দেদার ফুর্তি। অথচ ওদেরই দেখো মর্তলোকে জয় জয়কার। ওদের উদ্দেশ্যেই সবাই পুজো দিচ্ছে, বিভিন্ন দামী দামী ভেট চড়াচ্ছে আর ওদের আশীর্বাদ পাওয়ার জন্যে সারাক্ষণ কাকুতি মিনতি করে যাচ্ছে। আর সবটাই করছে শুধুমাত্র তোমার হাত থেকে বা বলতে পারো নরক যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্যে।
একদম ঠিক বলেছিস। তোরা তিনজনে আজ এত যুগ বাদে আমার চোখ খুলে দিয়েছিস। ঐ ‘গুপ্তর’ জন্যেই আজ আমার এই দুর্দশা। কিন্তু ওর জায়গায় দায়িত্ব দেবো কাকে। বাকি সবকটাই তো এক একটা গন্ড মূর্খ। খাতায় যে পাপের হিসেব লিখে রাখবে সেটাও তো ওগুলোকে দিয়ে হবেনা। খুবই চিন্তায় পরে গেলাম রে। আবার ঐ গুপ্তটাকে না সরালেও নয়। আমার সুনামটাকে পুরো তেলেভাজা বানিয়ে ছেড়েছে।
বড়’দা যদি কিছু মনে না করো, তাহলে ছোট মুখে বড় কথা, আমরা তোমার সেবা করার সুযোগ পাবো কবে দাদা। এই ভাইগুলোকে একবার দায়িত্ব দিয়ে দেখো, তোমাকে যদি দেবলোকের দেবরাজ না বানিয়ে দিয়েছি তো আমাদের তুমি গরম তেলে বাকি জীবনটা চুবিয়ে রেখো।
ওরে না রে, তোরা আজ আমার পুরো চোখ খুলে দিয়েছিস। এতদিন আমি পুরো অন্ধ ছিলাম, আর সেটা ঐ গুপ্তর জন্যে। আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, আমি স্বর্গের রাজ সিংহাসনে বসে আছি আর মর্ত্যে সমস্ত পাড়ায় পাড়ায় শুধু আমার পুজোপাঠ চলছে।
আর বড়’দা চারদিকে শুধু ধ্বনিত হচ্ছে, ‘‘জয়, মহারাজ যমরাজের জয়”।
ওরে আমার ভাই আমার বুকে আয় তোরা। এতদিন কোথায় ছিলি রে?
ওরে বাবা কি বোটকা গন্ধ! জন্মানোর পর থেকে মনে হয় আজ অবধি স্নান করেনি। আর গায়ের লোমগুলো যেন খাড়া খাড়া সজারুর কাটা। বুকে বিঁধে যাওয়ার জোগাড় রে জয় নিতাই।
ওরে চুপ কর তোরা। স্বপ্নের ঘোরে রয়েছে তাই শুনতে পাচ্ছেনা। শুনতে পেলে আর রক্ষা নেই। কত বিচিত্র তেলে যে কত বিচিত্রভাবে ভাজবে সেটা বোঝার চেষ্টা কর।
ওঃ, তোদের বুকে জড়িয়ে ধরে যেন শরীরে আলাদা করে শক্তি খুঁজে পাচ্ছি। তাহলে তোরা এখন থেকেই কাজে লেগে পর। তবে দেখিস, তোরা কিন্তু কথা দিয়েছিস আমাকে স্বর্গের অধিপতি বানিয়ে দিবি। কাজের ফাঁকে ওটাও মাথায় রাখিস। ওদিকে গুপ্তটার কি ব্যাবস্থা করা যায় বলতো?
আরে বড়’দা, ওটা আমাদের উপরে ছেড়ে দাও। তবে বড়’দা, ওর একটা ছোটখাট শাস্তি পাওয়া খুব দরকার। আজকে তুমি সুনাম পাওনি শুধুমাত্র ওর বিকৃত বুদ্ধির জন্য।
সেটাতো বুঝতে পারছি। তবে বয়সের কথা ভেবে যা কিছুই করিসনা কেন একটু ভেবে চিন্তে করিস। মেরে ফেলিসনা আবার। এই যমলোকে আজ পর্যন্ত কোনো মৃত্যুর ঘটনা ঘটেনি।
ঠিক আছে বড়’দা, আমরা দেখে নিচ্ছি পুরো ব্যাপারটা। তুমি একদম নিশ্চিন্তে তোমার স্বর্গের রাস্তাটা প্রশস্ত করো।
এইবার দেখ কাকে বলে মজা। এই ব্যাটা মামদো, এদিকে আয়। এখানকার নিয়ম কানুনে কিছু রদবদল হয়েছে জানিসতো? এখন থেকে আমরা এই তিনজন যা যা বলবো সেটাই হবে এখানকার আইন। ঐ বুড়ো টিকটিকি চিত্রগুপ্ত ব্যাটাকে চ্যাংদোলা করে ধরে নিয়ে আয়। বহুত ভেজেছে, এবার কে কাকে ভাজবে সেটা ও টের পাবে।
ছোটে ওস্তাদ স্যার, ওটাকে কি কান ধরে হিরহির করে টেনে নিয়ে আসবো নাকি গরম তেলে ভেজে কুরমুরে করে নিয়ে আসবো? আমারও প্রচুর ক্ষোভ জমে আছে ওর উপর।
যেভাবে খুশি নিয়ে আয়, তবে দেখিস যেন বেশি চোট আঘাত লেগে টেঁসে না যায়। যম’দাকে কথা দিয়েছি, শিক্ষাটাই শুধু দেবো, কোনরকম আঘাত নয়।
ঠিক আছে ছোটে ওস্তাদ স্যার। আমি এখুনি যেখান থেকে পারি ওকে ধরে নিয়ে আসছি। ব্যাটা মনে হয় কোথাও গা ঢাকা দিয়ে রয়েছে। তবে ও ভালো মতই জানে এখানে কোনো লুকানোর জায়গা নেই। পালিয়ে যাবে কোথায়।
“এই ছাড় বলছি, ছাড় আমাকে। আরে কি হলো কানটা কি খুলে নিবি নাকি?”
খুলে নেওয়াই উচিত। তুমি আমার সাথে যা ব্যবহার করেছ আমি জীবনে ভুলবো না। তুমি আমার জায়গায় ব্রহ্মদৈত্যকে মাতব্বর বানিয়ে দিলে। আর আমার কোনও প্রমোশন হলোনা। সেই আসার পর থেকে তিন যুগ ধরে শুধু তেলেভাজাই ভেজে চলেছি। এখানে কাজ বলতে তো শুধুই বড় বড় লোহার কড়াইতে গরম তেলে চুবিয়ে ভাজো আর তোলো। আত্মাগুলোর যন্ত্রণায় ছটফটানির চোটে ছিটকানো গরম তেলে প্রতিদিন হাড়ে অগুনতি ফোসকা পড়ে আর যন্ত্রণায় ছটফট করি। এবার দেখো, ছোটে ওস্তাদ স্যার তোমার কি হাল করে।
নিয়ে এসেছিস? বেশ করেছিস। কিরে টিকটিকি চিত্রগুপ্ত, ভালোবেসে দাদু ডেকে একটা প্রশ্ন করেছিলাম আর তার বদলে আরো আধ ঘন্টা গরম তেলে ভেজে তুলে ছিলি, মনে পরে? এবার তোর ঘুণে ধরা হাড়ে কি চাষ করি দেখ। মামদোওওওও....।
আজ্ঞা করুন ছোটে ওস্তাদ।
এটাকে তেলে ভেজে তেল নষ্ট করে লাভ নেই। তেলের প্রচুর দাম। তার থেকে একটা বিনে পয়সার শাস্তি খুঁজে বার করতে হবে। হ্যাঁ, একটা মোক্ষম পাওয়া গেছে। এটাকে কান ধরে উঠবোস করা যতক্ষণ না তোর ঘুম পায়।
“এই, এটা কিন্তু ঘোর অন্যায় হচ্ছে। মামদো কবে আবার ঘুমিয়েছে? ওর তো কোটরে চোখই নেই, ঘুম আসবে কোথা থেকে?”
এই বুড়ো থামবি? তুই যখন শাস্তি দিতিস ভেবে দেখতিস? মামদো, কোনও সহানুভূতি নয় তুই শুরু করে দে। বেশি চেল্লালে মুখে একটা তেলেভাজা গুঁজে দিবি।
“দাড়া, কোথা থেকে উড়ে এসে ঐ গবেট-টার মাথা ভেজে আমার জায়গায় জুড়ে বসেছিস। আমিও এর শেষ দেখে ছাড়বো। আমি ত্রিদেবের সাথে দেখা করে তোদের বিরুদ্ধে চরম ব্যবস্থা নেবো।’’
সে গুড়ে বালি। আগে কান থেকে হাত সরিয়ে তো দেখা। মামদো, কান থেকে হাত সরালেই গরম তেলে হাত দুটো কড়া করে ভেজে দিবি, বুড়োর হাড়ে বহুত তেল জমেছে। সব তেল নিংড়ে বের করে নেবো। শোন মামদো মিনিটে একশ কুড়িবার করে উঠ-বোস করাবি। একচুলও যেন এদিক ওদিক না হয়। আর তোর প্রমোশনের ব্যাপারটা নিয়ে শিঘ্রই একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে নেবো।
এখন আগের সেই অবৈজ্ঞানিক বস্তা পচা নিয়ম আর মর্তবাসীর জন্যে নেই। এখন মানুষের গড় আয়ু পচাঁত্তর। যা কিছু মৃত্যু, অপমৃত্যু সব পচাঁত্তরের পরে। সমস্ত মর্ত্যবাসী স্বাভাবিক ভাবেই খুব খুশি। কোনো বাবা-মা কেই আর সন্তানের মৃত্যু যন্ত্রণা ভোগ করতে হচ্ছেনা। সবাই এখন পাড়ায় পাড়ায় প্রতি শনিবারে শনিদেবের বদলে যমদেবের ধুমধাম করে পুজো করে। সমস্যা দেখা দিয়েছে দেবলোকে। ইন্দ্রের রাজসভায় আর নাচ গান বা হৈহুল্লোড় হয়না। ভিড়ভাট্টাও সেই আগের মতো নেই। দেবতারা সব মন মরা হয়ে এদিক ওদিক ইতস্তত ঘুরে বেড়ায়। গোটা স্বর্গ রাজ্যটা যেন মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়েছে। কয়েকজন ছোটখাট দেবতা তো যমলোকে চলে যেতে চাইছেন স্বর্গের নিবাস ছেড়ে। কিন্তু দেবতাদের তো মৃত্যু নেই। ফলে তাদের কোনভাবেই যমলোকে যাওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু তাদের যমলোকে যাওয়ার ইচ্ছা দিনকে দিন এতটাই প্রবলতর হয়ে উঠছে যে, দেবরাজ ইন্দ্র বাকি দেবতাদের নিয়ে ‘অমরত্ব’ আইনও পরিবর্তনের কথা ভেবে দেখছেন। সেই জায়গায় যমলোকে এখন তেলেভাজার সরঞ্জাম সব তুলে দেওয়া হয়েছে। শাস্তি বলতে সেই কড়াকড়ি আর আগের মতো নেই। বদলে সব মৃত আত্মারা মিলে বিভিন্ন কাজে যৌথভাবে অংশগ্রহণ করে। যম রাজ্য এখন আর সেই আগের মতো পচা গন্ধ যুক্ত অন্ধকারময় জগত আর নেই। বিভিন্ন জায়গায় রঙবেরঙের স্নিগ্ধ আলোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। সর্বত্র উচ্চাঙ্গ সংগীতের শান্ত কিন্তু মায়াময় সুরের মূর্ছনার আবেশ। পৃথিবীর মানুষ আর যমলোকে যেতে ভয় পায়না। মৃতের আত্মীয়রা হাসিমুখে তাদের প্রিয়জনকে বিদায় জানায়। উল্টে এখন মর্ত্যেই বরং কেউ চট করে আসতে চায়না যমলোক ছেড়ে। কারণ ওখানে ক্ষিধা, তৃষ্ণা বলে কিছু নেই। আছে শুধু অপার শান্তি। ফলে পৃথিবীর লোকসংখ্যা বৃদ্ধির হারও অনেকাংশে কমে গেছে।
এখন যমলোকে নিত্য রম্ভা, মেনকা, উর্বশী’দের আনাগোনা।