ইলশেগুঁড়ি ২৯তম সংখ্যা (শারদীয়া)
ইলশেগুঁড়ি ২৯তম সংখ্যা (শারদীয়া)
গান রচয়িতা রূপে তপন সিংহের একটা আলাদা পরিচয় আছে, সাধারণ মানুষের কাছে তাঁর সেই অনন্য পরিচয় এখন ততটা উন্মোচিত নয়। যতটা চিত্র পরিচালক হিসেবে তিনি উন্মোচিত। আমি তপনবাবুর সেই অনন্য পরিচয়টাই উন্মোচিত করার চেষ্টা করছি এই ক্ষুদ্র পরিসরে।
বাংলা চলচ্চিত্রে তপন সিনহার জনপ্রিয়তা যতটা বিস্তৃত, তাঁর বিষয় ও মেজাজের পরিধি যতটা প্রসারিত, সে তুলনায় তাঁর চিন্তা-ভাবনার ক্ষেত্রটি আড়ালেই থেকে গিয়েছে। তাঁর ছবিকে লোকমনের অন্তস্থলে পৌঁছে দিতে তিনি সতত প্রয়াসী থেকেছেন। কিন্তু নিজেকে লোকচক্ষুর কৌতুহল থেকে সযত্নে সরিয়ে রেখেছেন। তপন সিনহা ছিলেন সেই বিরল জাতের পরিচালক যিনি চিত্রনাট্য রচনায়, ধ্বনি ও সংগীতে সংযোজনায়, অভিনয় শিক্ষায় পারঙ্গমতায় তাঁর অধিকাংশ ছবিকেই চলচ্চিত্র ভাষায় সমৃদ্ধ করেছেন, অথচ দর্শকের মনোরঞ্জনের দায় কখনওই অস্বীকার করেননি।
গান রচয়িতা রূপে তপন সিংহের একটা আলাদা পরিচয় আছে, সাধারণ মানুষের কাছে তাঁর সেই অনন্য পরিচয় এখন ততটা উন্মোচিত নয়। যতটা চিত্র পরিচালক হিসেবে তিনি উন্মোচিত। আমি তপনবাবুর সেই অনন্য পরিচয়টাই উন্মোচিত করার চেষ্টা করছি এই ক্ষুদ্র পরিসরে।
চলচ্চিত্র পরিচালনার সমদায়িত্বে যাঁরা সংগীত নির্মাণের কাজটিও সমাধা করেছেন তপন সিংহ তাদের মধ্যে অন্যতম। সুর রচনার পাশাপাশি গীত রচনাতেও সফলতা ছুঁয়েছে তাঁকে– শুরুর পর্ব থেকেই তপন সিংহের সহকারী বলাই সেনের স্বাধীন নির্মিত সুরের আগুন এবং কেদার রাজা-র গান বাদে সব গানেরেই ব্যবহার আপন ছবির দাবিতেই। ‘আরোহী’ ছবিতে গান লেখার কাজ শুরু করলেও সামগ্রিক সংগীত রচনার সূত্রপাত অতিথির ছবির মাঝে নদী বহে রে গানের বহমানতায়।
সারাজীবন লালন করেছেন মা-এর সংগীত শিক্ষা। তারা ভরা আকাশের নীচে শুয়ে মা গোপাদিকে গান শোনাতেন–
‘যতবার আলো জ্বালাতে চাই
নিবে যায় বারে বারে–’
আরও একটু বড় হয়ে ওই একই রাতের তারার নীচে শুয়ে শুয়ে আমি শিখেছিলাম...
‘কেন চোখের জলে ভিজিয়ে দিলেম না–’
সেই শিক্ষাই কাজে লাগালেন ‘এখনই’ ছবিতে– শেষোক্ত গানটির অংশে গড়ে তুললেন আবহ। অতিথি পরবর্তী সমস্ত ছবির সংগীত দায়িত্বে বহু ক্ষেত্রেই সম্বল করেছেন রবীন্দ্রনাথকে– কখনও আবহে আবার কখনওবা সরাসরি গাওয়া গানে। জীবন সায়াহ্নে তাঁর অকপট স্বীকার:
এখন কী ভাল লাগে জানো– বিকেলবেলা একান্তে বসে শুধু গীতবিতানের পাতা উল্টে যেতে। বারান্দার বসে গীতবিতানের গান গুন গুন করি। কোনওটার সুর আসে। কোনটার আসে না।... এই রবীন্দ্রনাথই আমার আশ্রয়।
স্টুডিও ফ্লোরের মধ্যে চেয়ারে বসে স্টার্ট আর কাট বলে ছবি করা যায় না... বিভিন্নভাবে প্রকৃতি ও মানুষকে ধরতে হবে। তপন সিংহের এই প্রতিফলন দেখা গিয়েছে অঙ্কুশ থেকে শুরু করে চার চরিত্রর দীর্ঘ পরিক্রমায়। সদা সঙ্গী হয়েছে সংগীতের সাথ-সংগত। বহুমুখীন সহজ বিস্তারে গান হয়ে উঠেছে সিনেম্যাটিক এলিমেন্ট। চলচ্চিত্র তাত্ত্বিক K.Donnelly-র মতে...
Film music is usually fragmentary and relles on a logic that is not an organic Part of Music but a negotiation between the logic of the film and the logic of the music... Its concern has almost always been with effect, and having an immediate report with the audience.
(Film music, K. Donnelly)
এই তত্ত্বেরই প্রতিধ্বনি মেলে তপন সিংহের কথায়। এক আলোচনা সভায় তিনি বলেছিলেন... ফিল্ম মিউজিক ইজ সামথিং ডিফারেন্ট। আমার ছবিতে অনেক বড় বড় মিউজিক ডিরেক্টর কাজ করেছেন– রবিশঙ্কর, আলি আকবর, পঙ্কজ মল্লিক, হেমন্ত মুখার্জী। আমি নিজে ছবিতে সংগীত দিতে রাজি হলাম অতিথির সময় থেকে। রবীন্দ্রনাথের গান ব্যবহার করেছিলাম। কিন্তু সত্যজিৎবাবু আপত্তি করেছিলেন। বলেছিলেন, নিজে মিউজিক করলেন না কেন? মিউজিক ব্যাপারটা আসলে অর্নামেন্টেশন... নির্ভর করছে কি ধরনের ছবি করছে। তার উপর... অনেক সময় অনেক ছবিতে খুবই কম গান ব্যবহার করেছি। তবে গান আমি খুব ভালবাসি।
প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের ক্লাসিকাল টু ফোক সব গানের প্রতিই সমান আগ্রহী মনন ছিল তপন সিংহের। হারমোনিয়াম ছবির গানের প্রসঙ্গে কথায় মেলে তারই স্বীকার। এক জায়গায় তিনি বলেছেন যে গানগুলো আমি ছবির জন্য করেছি, সেগুলো বেশির ভাগই প্রচলিত গান থেকে নেওয়া। নতুন কম্পোজিশন সেরকম কিছুই করিনি আমি। প্রচলিত মানে ধরুন কীর্তন থেকে নেওয়া বা ফোক গান ইত্যাদি।
গীতিকারের ভূমিকায় প্রথম ছবি আরোহীতে প্রণব রায়ের– এমনকী চরিত্রভেদে নজরুলের সুর কাব্যের প্রচ্ছন্ন ছায়া মেনে টেলিছবি চার চরিত্রের গানের বিস্তারে। তেমনই শৈশব-স্মৃতিতে জাগর বাড়ির প্রতিমা শিল্পী গোপালের গান ও ছায়া ফেলে তাঁর হারমোনিয়ামের গানে।
পুজোর সময় নিতে আসত গোপালদা– গোপাল বৈরাগী। সে পুরুষানুক্রমে তপন সিংহের বাড়িতে ঠাকুর তৈরি করত।... দড়ি ও খড় দিয়ে বেঁধে মূর্তির একটা কাঠামো তৈরি করত। তপনবাবু ও তাঁর বোন গীতা বসে বসে তন্ময় হয়ে দেখত। গোপালদা সর্বদা গুন গুন করে গান গাইত। গোপালদার গাওয়া কোন একটা গানের প্রথম লাইন ছিল, ‘মুন বলে আমি মুনের কথা জানি না। তপনবাবু হারমোনিয়াম ছবিতে এই গানটি পরিমার্জনা করে ব্যবহার করেছিলেন।
তপনবাবু সংগীত তাঁর ছবির একটি অঙ্গ। কখনও ছবির সঙ্গে গানের আলাদা জোড় মনে হয়নি। সেক্ষেত্রেও উনি সংগীত পরিচালক হিসেবে সার্থক। তপনবাবুর দেওয়া গান ও সুর কখনও বেখাপ্পা মনে হয়নি। সংগীত পরিচালক এবং গীতিকারের যুগলবন্দিতে হেমন্ত-আরতি-সতীনাথ-উৎপলার নেপথ্য কণ্ঠের পাশাপাশি মৃণাল মুখোপাধ্যায়-অরুন্ধতী দেবী-ছায়াদেবী প্রমুখ চরিত্রাভিনেতার কণ্ঠের গান সরাসরি ব্যবহারের সাহস ও সার্থকতা প্রমাণ করেছেন তপন সিংহ। চিন্তা ভাবনায় বৈপরীত্য থাকলেও গীত ভাবনে তপনের প্রতি পূর্ণ সমর্থন ছিল সমসাময়িক চিত্রপরিচালক ঋত্বিক ঘটকের।
তপন সিংহের পাঁচ দশকের চলচ্চিত্র অনুষঙ্গে নিরন্তর থেকেছে সংগীতের ব্যবহার। তারই অকপট স্বীকার ‘আমার বন্ধুবান্ধব যাঁরা নতুন ধরনের ছবি করেন তাঁরা ছবিতে গানের ব্যবহারটা খুব নফরত করেন, গানটান ব্যবহার করেন না। আমি করি এবং গান দিয়ে যদি আমার বক্তব্যকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায় তো ব্যবহার করব। সংগীতের মতো বন্ধু আর কেউই নেই। সাহিত্য পড়তে গেলে দুটো তিনটে পরিচ্ছদ লাগে তার ভেতরে ঢুকতে। সিনেমাতেও তাই। দুটো তিনটে রোল বেরিয়ে যায় ভাল ছবির অন্তর্নিহিত কথা জানতে। কিন্তু সংগীত মুহূর্তে মনকে আচ্ছন্ন করেছেন।... সংগীতের মতো তাড়াতাড়ি কেউই মনকে আচ্ছন্ন করতে পারে না। দুঃখেরও বরসা যখন চোখ দিয়ে ঝরে, তখন দ্বারপ্রান্তেও বন্ধুর রথ এসে থামে।’
তাই শৈশব লালিত সংগীত প্রেম বারে বারে প্রকাশ পেয়েছে তাঁর ছবির গানে। কখনও ছন্দে, কখনও কাব্যে আমার কখনওবা সুরে-সুরে তাঁর সংগীত পেরিয়ে জীবনের নির্জন সৈকতে বারবার ঢেউ তোলে। হারমোনিয়ামের সুরে সে ঢেউ আপনজনের।
তপন সিংহের কয়েকটি ছায়াছবির গান, এখানে পাঠকদের জন্য উল্লেখ করলাম।
চলচ্চিত্রের নির্মানের প্রাচীন পদ্ধতির সঙ্গে আধুনিক পদ্ধতির মৌলিক পার্থক্য সম্বন্ধে তপন সিংহর ধারনা ছিল এই যে শিল্পের ক্ষেত্রে কোনো কিছুই হঠাৎ ঘটে যায় না, কোনও পালাবদলই আকস্মিক নয়। আজ যাকে নতুন রীতি বলছি, ভেতর থেকে দেখলে যতই অস্ফুটই হোক পূর্বপক্ষের অনেক অনিশ্চিত সম্ভাবনাকে তার মতো পরিস্ফুট হতে দেখা যায়। পদ্ধতি যতই চমকপ্রদ হোক, নিরালম্ব বা স্বয়ম্ভু হওয়া নিতান্তই অশ্রদ্ধেয়। সুতরাং পদ্ধতির দিক থেকে প্রাচীন ও আধুনিক বাংলা ছবিতে মিল ও অমিলের পরিমাণ যদ্যপি নগন্য নয়, কারণ ইতিমধ্যে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন সংঘটিত হয়েছে, তথাপি অপরটি থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখাটা নিঃসন্দেহে অনিয়ম।
তবে এখানে একটা প্রশ্ন থেকে যায় এ পার্থক্য কিসের। এক কথায় দৃষ্টিকোণের, যা সতত পরিবর্তমান এবং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ভিন্ন ভিন্ন শীর্ষে অবস্থিত। পূর্বে বলতে ওই ক্ষেত্রে পুরাকল না বোঝালেও প্রাচীন আবিষ্টতা থেকে মুক্ত হয়ে আজ আমরা এক নতুন যুগে প্রবেশ করছি। জগত ও জীবন সম্পর্কে। মানুষ সম্পর্কে, তাবত কাল স্থান এবং পরিপ্রেক্ষিত সম্পর্কে আজকের মানুষের দৃষ্টি ও চিন্তা বদলে গিয়েছে। আগে চলচ্চিত্র-এ জীবন বিষয়ে দৃষ্টিভঙ্গির যে স্বত্ব সংরক্ষিত ছিল তা কতকগুলো কনভেনশন স্বীকার করে নিয়েই রূপায়িত হয়েছিল। আজকের দিনে কনভেনশনটা বড় নয়। পরিচালকের ব্যক্তিগত অবলোকন ও অধ্যয়নটাই সেখানে প্রথম ও প্রধান কথা। আগের দিনের বাংলা ছবি ছিল সাহিত্যের নিছক অনুবাদ, ধারাবিবরণী। পক্ষান্তরে কাহিনির প্রতি আনুগত্য একালের অনেক পরিচালকের কাছে কোন একটা শর্তই নয়। তাঁরা জানেন সাহিত্যের অনুবাদ ছাড়াও চলচ্চিত্রের অন্য এক উদ্দেশ্য থাকে। পদ্ধতির দিক থেকে সাহিত্য ও চলচ্চিত্র যেহেতু পৃথক, চলচ্চিত্রকে একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ সৃষ্টিকর্ম বলে মেনে নেওয়ার প্রবণতা ধীরে ধীরে তৈরি হয়েছে। সাহিত্যের প্রভাব থেকে বেরিয়ে আসাটাই আজকের লক্ষ্য। খ্যাত অখ্যাত যাই হোক, কাহিনি একটা থাকবেই। কিন্তু জীবনায়ন ও চরিত্রগুলো সম্পর্কে কাহিনিকারের দর্শন ও ব্যাখ্যা চলচ্চিত্রকার সবসময় গ্রহণ নাও করতে পারেন। আজকের দিনে টেকনিকের মাধ্যমে চলচ্চিত্রের ভাষাকে পরিস্ফুট করা হচ্ছে। সংবেদনশীল দর্শকের কাছে শিল্পের অন্তর্নিহিত ভাষণকে পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে। এইজন্য অতীতের চেয়ে আজকের ছবিতে বেশি সুক্ষবোধের পরিচয় পাই। এবং ছবি যেদিনকার মতো উচ্চকণ্ঠ নয়। একালে সমাজের সর্বস্তরে চলচ্চিত্রের পদসঞ্চার ঘটেছে। শিক্ষিত এবং চিন্তাশীল ব্যক্তিরা এ নিয়ে ভাবছেন, সজাগ হয়েছেন।
ছবি এবং তার সুজন দর্শক, চিন্তার রাজ্যে একভূমিতে এসে দাঁড়িয়েছেন টেকনিশিয়ানদের অপরিসীম দারিদ্র্য এবং আরও হাজাররকম বাধাবিপত্তির মাঝখানে থেকে আজ যাঁরা ভালো ছবি করছেন অথবা সেই চেষ্টায় আত্মনিয়োগ করেছেন, তাঁদের এই প্রচেষ্টা প্রশংসার দাবি রাখে।
অর্থনৈতিক দিক বজায় রেখে উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্র সৃষ্টি সম্ভব। কারণ দর্শক ভালো ছবি দেখতে চায় বলে এটাই আমার বিশ্বাস। যদি দর্শকদের এই ভাল কিছু দেখতে চাওয়ার মানদণ্ড বিচার করে রুচিপূর্ণ পরিবেশ ও মানবিক গল্প চলচ্চিত্রে সৃষ্টি করতে পারি, তখন কিন্তু সিনেমায় অর্থনৈতিক সাফল্য সুনিশ্চিত। এ বিষয়ে পরিচালক তপন সিংহর সাফল্য সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। তবে ভাল চিত্র তৈরি করার জন্য ভাল চিত্রনাট্যের প্রয়োজন। চিত্রনাট্যই চিত্রের মানদণ্ড। এ ব্যাপারে ব্যক্তিগতভাবে চলচ্চিত্র নির্মাণ করার সময়ে চিত্রনাট্যের উৎকর্ষের উপরই তপনবাবু লক্ষ্য রাখতেন একটু বেশি।
আমি বিভিন্ন চলচ্চিত্রের উৎসবের বিভিন্ন সেমিনারে দর্শক হিসেবে উপস্থিত হয়ে দেখেছি, বর্তমানে কয়েকজন ইউরোপীয় চলচ্চিত্র শিল্পীর ধারনা এই যে, চলচ্চিত্র শিল্পের চরম উৎকর্ষ তখনই সম্ভব যখন তা সাহিত্য নিরপেক্ষ হয়ে স্বাধীনভাবে শিল্প সৃষ্টিতে সমর্থ হবে। আমরা সবাই জানি সাহিত্য সমাজজীবনের সুখদুঃখ, আশা হতাশা এবং মানবজীবনের বিভিন্ন অনুভূতির দর্পন। চলচ্চিত্রে তাদেরই প্রাণ প্রতিষ্ঠা। চলচ্চিত্রে সমাজ জীবন বা ব্যক্তিজীবনের বিভিন্ন সমস্যা, ব্যাথা-বেদনা, আনন্দ উল্লাস সব সফল মানষিক পরিণতির পেছনে থাকে সাহিত্য মূল্যবোধ। এই কারণে মননশীল সাহিত্যের সঙ্গে চলচ্চিত্র শিল্পের গভীরতম আত্মীয়তা রয়েছে বলেই আমার বিশ্বাস। কবিতার মতো চিত্রেরও ছন্দ আছে, ভাব রয়েছে, গতি রয়েছে। তাই চিত্রের কাহিনির সংলাপের, ভাবের মধ্যে সাহিত্যের স্পর্শ অপরিহার্য আর এখানেই তপন সিংহের হাতে রয়েছে সাফল্যের চাবিকাঠি। বাংলা চলচ্চিত্র, শিল্পকে এগিয়ে যাওয়ার মূলমন্ত্র।
বাংলা তথা ভারতীয় চলচ্চিত্রে তপন সিংহ এক অনন্য ব্যক্তিত্ব। তিনি চলচ্চিত্রকে উপহার দিয়েছেন তাঁর সৃষ্টিশীল কর্মের এক উজ্জ্বল সম্ভার। তাঁর চলচ্চিত্রকর্ম বিষয়ের দৃষ্টিকোণ থেকে বিচিত্রগামী। চলচ্চিত্রের সমস্ত বিভাগে তাঁর অনায়াস বিচরণ। বরণীয় এই পরিচালকের দীর্ঘ চলচ্চিত্রজীবন নানান অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ। তিনি মৃদুভাষী কিন্তু স্পষ্ট বক্তা। তিনি অতীব ভদ্রমানুষ। কিন্তু নিজের প্রত্যয়ে দৃঢ়। তিনি একজন ভীষণভাবে অনুভূতিসম্পন্ন মানুষ।
তপনবাবু খুব ভাল গান গাইতে পারতেন। যদিও তিনি তাঁর কোনও ছবিতে গান গাননি। অথচ ছাত্রজীবনে তিন চারশো গান স্বচ্ছন্দে গাইতে পারতেন। আসলে তপনবাবুর জীবন প্রথম থেকেই রবীন্দ্রপ্রভাবে প্রভাবিত। ছয় বছর বয়সে তিনি প্রথম রবীন্দ্র সংগীত শেখেন মায়ের কাছ থেকে। মা ওঁকে কঠিন ছায়ানটের ওপর তৈরি শক্ত গান ‘যতবার আলো জ্বালাতে যাই নিভে যায় বারে বারে’ গানটি শিখিয়েছিলেন। এইভাবে রবীন্দ্রনাথের একটা ইনফুয়েন্স ওঁর ওপর ছিল। তপন সিংহ চলচ্চিত্র জীবনের শুরুতে বিখ্যাত সংগীতজ্ঞদের দিয়ে ছবির মিউজিক করান। কিন্তু পরবর্তীকালে তিনি নিজেই ছবির সংগীত পরিচালনার দায়িত্ব নেন। তার কারণ হল ‘অতিথি’ করার সময় প্রোডিউসার সি.এস.এন সরকার (বি.এন. সরকারের ভাই) ওঁকে বলেন যে আপনি তো রবীন্দ্রনাথের গান সম্বন্ধে ভাল জানেন, মিউজিকটা আপনিই করুন না। এই যে শুরু হল, এরপর প্রোডিউসাররা ইনসিস্ট করতে আরম্ভ করলেন যে মিউজিকটা যেন তপনবাবুই করেন। অনিচ্ছা সত্ত্বেও এইভাবেই তপনবাবু এইভাবে সংগীত পরিচালনায় এলেন।
তপনবাবুর ছবিতে একটা ব্যাপার খুবই স্পষ্টভাবে থাকে। আর সেটা হল একজন ব্যক্তির একক সংগ্রাম। যেটা সে ছড়িয়ে দিতে চায় অন্যান্য মানুষের মধ্যে তার জীবনধারণের মধ্যে দিয়ে। আর তপনবাবু এই একক সংগ্রামকে বিশ্বাস করেন। আর এটা তপনবাবু শিখেছেন বিদেশি সাহিত্য ও আমেরিকান সিনেমা থেকে। অনেকে আমেরিকান সিনেমাকে সাম্রাজ্যবাদী বলে থাকেন। কিন্তু তপনবাবু তা মনে করতেন না। আমেরিকান গভর্নমেন্ট আর আমেরিকান সিনেমা এক নয়। ওঁরা প্রতিনিয়ত এক্সপেরিমেন্ট করে যাচ্ছেন। টেকনিকালি ওঁরা কি অসাধারণ সব কাজ করছেন। একটা উদাহরণ দিই—তাহলে ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে যাবে আমাদের ও পাঠকের কাছে—পৃথিবীতে যত রেভলিউশন হয়েছে যেমন ফ্রেঞ্চ রেভলিউশন, রাশিয়ান রেভলিউশন, মেক্সিকান রেভলিউশন সহ সমস্ত রেভিলিউশন নিয়েই আমেরিকাতে ছবি হয়েছে। আমেরিকান সিনেমা দারুণ পাওয়ারফুল। ওখানে বিভিন্ন দেশ থেকে লোক মাইগ্রেট করে গিয়েছে। ওখানে রাশিয়ান আছে, ফরাসি আছে, ইংরেজ আছে, জার্মান আছে, সব দেশের লোকই আছে। তাই তাদের বিভিন্ন স্রোত আমেরিকান সিনেমায় মিশেছে। একক সংগ্রাম নিয়ে ওরা আজও কাজ করে যাচ্ছে।
সোসাইটির যে অন্যায় অবিচার তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াচ্ছে। ওরা এখন ক্যামেরা নিয়ে রিয়েল লাইফের ডকুমেন্টারি করছে। একটা ঘটনার কথা বলি। একজন বৃদ্ধ ভদ্রলোক গাড়ি নিয়ে ব্যাঙ্কে টাকা তুলতে এসেছেন। যে মেয়েটি ব্যাঙ্কের কর্মচারী সে দেখল ভদ্রলোক স্বাভাবিক আচরণ করছেন না। টাকা পাওয়ার পর গুনে দেখলেন না। তারপর টলতে টলতে গাড়িতে উঠলেন। এরপর গাড়ি চালিয়ে পাশের একটা মাঠে উঠে গেলেন। আর ঠিক তারপরে পাশের পুকুরে গাড়িটা পড়ে গেল। মেয়েটি সমস্তটা লক্ষ করেছিল। সে ওঁকে অনুসরণ করে জলে ঝাঁপিয়ে পড়ল ভদ্রলোককে বাঁচাতে। ওর দেখাদেখি অনেক মানুষ ঝাঁপিয়ে পড়ল। দিস ইজ রিয়েল আমেরিকা, আমেরিকান পিপ্ল।
হ্যাঁ এইভাবেই তপনবাবুর ছবিতে একক সংগ্রামের ছবি উঠে আসে ওঁর এক ডক্টর কী মউত, আদমী আউর আউরত, এইসব ছবিতে। হাঁসুলি বাঁকের উপকথা আর হুইলচেয়ার-এও সেটা আছে। হাঁসুলি বাঁকের উপকথায় অসাধারণ চরিত্র করালী। মনস্তাবিক ব্যাপারটা ওঁর জাতুগৃহ ছবিতেও আছে। অবশ্য আরও ছবিতেও আছে। তপনবাবুর ছবিতে একটা কাব্যিক মেজাজ আছে। প্রকৃতিকে উনি নানাভাবে দেখেছেন। প্রকৃতি আর মানুষকে কাছাকাছির আনার চেষ্টা করেছেন। এই যে প্রকৃতিকে এইভাবে দেখা আর ছবির কাব্যিক মেজাজ এর উৎস কোথায়?
আসলে সমস্ত বিষয়ের মধ্যে একটা রস আছে। কোনও বিষয়ই রসকষহীন নয়। আমি তো বিজ্ঞানের ছাত্র। আমাদের অধ্যাপকেরা বলতেন ফিজিক্সের মধ্যেও কাব্য আছে, এটা কোনও নীরস ব্যাপার নয়। হায়ার ম্যাথামেটিক্সের যে ফর্মুলা তাঁর যে সংখ্যাগুলো সেগুলো শুধু সংখ্যা নয়। সেগুলো এক একটা চরিত্র। এইভাবেই আমার শিক্ষা হয়েছে, আমার মানসিক গঠন হয়েছে।
তথ্য ও ঋণ স্বীকার:
তপন সিংহর গান-দেবজিত্ বন্দ্যোপাধ্যায়, ঋদ্ধি বন্দ্যোপাধ্যায়, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়, লিটল ম্যাগাজিন গবেষণা কেন্দ্র।
আনন্দবাজার পত্রিকা, দেশ, আনন্দলোক, আজকাল, প্রতিদিন, সানন্দাসহ আর কিছু বই।