ইলশেগুঁড়ি ২৯তম সংখ্যা (শারদীয়া)
ইলশেগুঁড়ি ২৯তম সংখ্যা (শারদীয়া)
ঘড়িতে প্রায় এগারোটা বাজলেও শীতের সকালের ঘন কুয়াশা কাটিয়ে সূর্যের আলো এখনো তেমন করে মেলেনি। নবগ্রাম থানার এ এস আই পরিনতি রায় সকালের রোদ গায়ে মাখতে জানালা খুলে টেবিলে বসতেই গেটের দিকে তাকিয়ে দেখলেন জনাকয়েক লোক কিছু একটা ঘিরে দাঁড়িয়ে। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে উৎসুক মনে সেখানে উপস্থিত হতেই কিছু লোকজন বলে উঠলেন—‘‘দেখুন ম্যাডাম...দেখুন...ছেলেটির কান্ড..।’’
ম্যাডাম দেখলেন...চার-পাঁচ বছর বয়সের একটি ছেলে খবরের কাগজ মাটিতে পেতে গম্ভীর মুখ তার উপর বসে আছে। পাশে বই এর ব্যাগ। পরনে নীল-সাদা স্কুল ইউনিফর্ম। হাতে প্লাকার্ড। তাতে শিশু হাতের অক্ষরে লেখা—‘‘শাস্তি চাই, শাস্তি চাই।’’
ম্যাডাম ছেলেটির গায়ে হাত বোলাতে বোলাতে জিজ্ঞাসা করেন—তুমি এখানে এভাবে বসে কেন? তোমার নাম?
ছেলেটি কোন রকম ভয় না পেয়ে একটু আধ আধ স্বরে উত্তর দেয়—আমার নাম সমীক গড়াই। মায়ের শাস্তির দাবিতে এখানে বসেছি।
সমীকের এমন উত্তরে ম্যাডাম একটু বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞাসা করেন—তোমার বাড়ি কোথায়? তুমি কোন স্কুলে পড়? বাবার নাম কি?
ছেলেটি ঠিক একই ভাবে উত্তর দেয়—বাড়ি মতিপুর, ‘বিবেকানন্দ শিক্ষাশ্রামে’ পড়ি। বাবার নাম বিশ্বনাথ গড়াই।
—তা তোমার বাবা কি কাজ করেন?
—বাবা...! তা তো জানি না...। তবে মা বলেন, বাবা নাকি পড়া না পারলে আমার মতো ছেলেদের কান ধরিয়ে রাস্তায় দাঁড় করিয়ে দেন...।
—তাহলে তোমার বাবাকে খুব রাগি বলতে হয়?
—না...না...ম্যাডাম, আমার বাবা মোটেই রাগি নয়, আমি পড়তে বসে দুষ্টুমি করলে মা রেগে গিয়ে বলেন, এবার থেকে তোকে বাবার স্কুলে পাঠাবো...দেখবি পড়া না পারলে কান ধরে রাস্তায় দাঁড় করিয়ে দেবে...।’’
—তাহলে কি মায়ের একটু রাগ বেশি…?
একটু হেসে প্রসন্নতার ভাব মিশিয়ে সমীক বলে—হ্যাঁ...হ্যাঁ...ম্যাডাম, আমার মায়ের রাগ অনেক বেশি। পড়তে বসলে বলেন—এবার পড়া না পারলে কান টেনে ছিঁড়ে দেব...ঘুম থেকে দেরি করে উঠলে বলেন...দেখবি গায়ে এবার জল ঢেলে দেব...মোবাইল নিয়ে কার্টুন দেখলে বলেন...আবার মোবাইলে হাত দিয়েছ? এবার হাত ভেঙে দেব...বেশি লজেন্স খেলেও খুব বকেন। এই তো সে দিন বাবা আমাকে এক বয়াম লজেন্স এনে দিয়ে বললেন—‘‘সুমু তুমি লজেন্স খেতে ভালোবাস না! দেখ তোমার জন্যে কতো লজেন্স এনেছি...তুমি রোজ খাবে।’’
অথচ আমি খেলেই মা চেঁচিয়ে উঠে বলেন—‘‘আবার লজেন্স মুখের মধ্যে...দাঁতগুলো কি থাকবে এবার...দাঁত যন্ত্রণা করছে বললে দাঁত উপড়ে ফেলব।’’
আজ সকালে ঘুম থেকে উঠে লজেন্স খেতে গিয়ে দেখি লজেন্সের বয়ামটা আর সেখানে নেই। মা চুরি করে সরিয়ে রেখেছে। তাই মায়ের চুরির অপরাধের শাস্তি চাইতে থানায় এসেছি...।
—তা সুমু, তুমি জানলে কি করে থানায় আসলে মায়ের শাস্তি হবে?
—কেন! বাবা বলেছেন। আমি তো রোজ এখান থেকে বাবার সঙ্গে স্কুলে যাই। একদিন একটা লোক আমার মতো কাগজে লিখে বসে ছিল। আমি বাবাকে জিজ্ঞেস করতে বাবা বললেন—‘‘চোরের শাস্তি চাইতে থানায় এসেছে...।’’ আমিও মায়ের শাস্তির জন্য এখানে..।
—ও...এই জন্যে আজ স্কুলে না গিয়ে এখানে এসেছ?
—হ্যাঁ, বাবা আমাকে স্কুলের গেটে নামিয়ে দিয়ে চলে যেতেই হেঁটে চলে এসেছি।
—বেশ। তাহলে তো মায়ের শাস্তি দিতেই হয়...।
—হ্যাঁ ম্যাডাম মায়ের শাস্তি দিন।
—ঠিক আছে! মায়ের শাস্তি তো দিতেই হবে। তুমি বস আমি একটা দড়ি আর লাঠি নিয়ে আসি।
—দড়ি লাঠি কি হবে?
—কেন! মাকে ধরে আনতে হবে না? মা আসতে না চাইলে দড়ি দিয়ে হাত বেঁধে মারতে মারতে নিয়ে আসব। তারপর জেলে আটকে রাখবো। আর বাড়ি যেতে পারবে না তোমাকে বকতেও পারবে না। তুমি বস আমি আসছি...
ঘুমের ঘোরে গভীর অন্ধকারে মাকে হারিয়ে শিশু যেমন হঠাৎ ভয়ে আতকে উঠে তেমনি সুমু কাঁদতে কাঁদতে চিৎকার করে বলে—‘‘না..না..ম্যাডাম। মাকে আনতে হবে না। মাকে ছাড়া আমি থাকতে পারবো না। মা যে আমার ভালো মা..মা যে আমার সোনা মা..।’’ সূমু কেঁদেই চলেছে। চোখের জল কচি চিবুক বেয়ে টপটপ করে বুকের জামায় পড়তে থাকে।
—তুমি যে বললে মাকে শাস্তি দিতে?
সুমু ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে বলে—আমি কি সত্যি সত্যি বলছি..? মা লজেন্স খেতে দেয়নি তাই রাগ করে বলছি...।
ইতিমধ্যে ছেলের এই কান্ডের কথা কেউ মায়ের কানে দিতে সুমুর মা থানায় এসে হাজির। মাকে দেখে সুমু এক দৌঁড়ে ঝাঁপিয়ে কোলে উঠে। পা দুটো মায়ের কোমরে পেঁচিয়ে হাত দুটো দিয়ে গলা জড়িয়ে মুখটা মায়ের বুকের মধ্যে লুকিয়ে ফেলে।