ইলশেগুঁড়ি ২৯তম সংখ্যা (শারদীয়া)
ইলশেগুঁড়ি ২৯তম সংখ্যা (শারদীয়া)
এখনো গ্রামটা গ্রামের মতোই আছে। নন্দীদের তিনশো বছরের সাবেক ঠাকুর দালান। নেমে এসে চন্ডী মন্ডপে বাচ্চাদের হুড়োহুড়ি। বিশাল তেঁতুলগাছটা বিরাট ছায়া ফেলে সবাইকে যেন কাছে ডাকে। বলে আমায় ঘিরে এই নবাসন গ্রাম বেড়ে উঠেছে। আমি হাজারো জল ঝড়ে ঠিক দাঁড়িয়ে থাকি। এই সব সাত পাঁচ ভাবনা শুভকে নতুন করে বাঁচার রসদ দেয়। বিলের পশ্চিম প্রান্তে কমলা সূর্যটা ডুব দেয়। শুভর মেয়ে রোহিনী সান্ধ্যকালীন রেওয়াজে গাইতে থাকে ‘শিউলি তলায় ভোরবেলায় কুসুম কুড়ায় পল্লীবালা...’।
সে এক মাঘের সন্ধ্যে। বছর ত্রিশ আগেকার কথা। শুভ দুদিন বাদে যাবে সৌদি আরব। তাই নিভু নিভু সন্ধ্যেতে রক্তিমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছে। চোখের জল বাঁধ মানেনা। তবু শুভ কথা দেয় বড় জোর বছর দুই। তারপর সে সশরীরে এসে রক্তিমাকে নিয়ে সৌদিতে ফিরবে। পাছে শুভ ভুলে যায় তাই রক্তিমা তার একটা রুমালে গেরো বেঁধে শুভর কাজ থেকে কথা আদায় করে। সব কিছু শুভর মনে জ্বলজ্বল করে জ্বলছে। সত্যি জীবন তো নয় যেন সিনেমা। হ্যাঁ রক্তিমা শেষমেশ গিয়ে শুভর সঙ্গে ঘর বেঁধেছিলো। ঝকঝকে রোদ্দুরের মাঝে এক টুকরো কাল মেঘের মতো একটা বিপদ আটকে দিল। অতো সুন্দর চিকিৎসা ব্যবস্থা রক্তিমাকে প্রাণ ফিরিয়ে দিতে পারল না। রোহিনী পৃথিবীর প্রথম আলো দেখল মৃত মায়ের বুকের উপর শুয়ে। এক বিশাল সুনামি শুভর সাজানো সংসারটাকে গ্রাস করলো। যাই হোক মেঘে মেঘে বিরাট বেলা কখন গড়িয়ে গেলো শুভ টের পায় না। বছর ত্রিশ বাদে সে গ্রামে ফিরলো।
রোহিনী গ্রামের কলেজে পড়ায়। শুভ চাকরি জীবন শেষ করে পৈতৃক জমির চাষবাষ নিয়ে ব্যস্ত থাকে। দিন তার হিসেব মতো চলে। শুভ কিছুতেই ভুলতে পারে না রক্তিমার সঙ্গে তার শেষ আলাপের মুহূর্ত। গ্রামে তার খুব সুনাম। যে সর্বতোভাবে সবার কাজে লাগার চেষ্টা করে। রক্তিমার নামে একটা পাঠশালা চালু করে। তার উদ্দেশ্য সেই পুরোন তেঁতুল গাছ তলায় ছেলেবেলাকে ফিরিয়ে আনা।
না, কিছুই ফেরে না। বার্ধক্য আজ শুভকে গ্রাস করেছে। বাপ ঠাকুরদার ভিটে মাটি আজ হাইওয়ে আর প্রোমোটারের কবলে। গ্রামের নতুন নাম হয়েছে নবীন নগর। কিছুই চেনা যায় না। ছানি পড়া চোখ নিয়ে বৃদ্ধাশ্রমের জানলা দিয়ে শুভ তাকিয়ে থাকে সেই পুরোনো তেঁতুল গাছটার দিকে। কি আশ্চর্য তার কোনো বদল ঘটেনি। তবু শুভর মনে হয় তার হারিয়ে যাওয়ার সব কিছু পাওয়া যায় ঐ তেঁতুল গাছটার দিকে তাকালে। রোহিনী নিজে এসে বা ফোনে মাঝে মাঝে বাবার খোঁজ নেয়। সে আর গ্রামে ফিরতে চায় না। শুভ তাই মন খারাপের দিনে তেঁতুলগাছটার দিকে তাকিয়ে বলে—কি গো গাও! ভেসে আসে গান—‘ভোরবেলায় শিউলিতলায়, কসুম কুড়ায় পল্লীবালা...’
গানটা আজও রক্তিমাকে মনে করায়।