ইলশেগুঁড়ি ২৯তম সংখ্যা (শারদীয়া)
ইলশেগুঁড়ি ২৯তম সংখ্যা (শারদীয়া)
তুষ্টু, অ তুষ্টু সত্যিই যাব আমরা মাঝেরহাট? কত্ত দিন দেখি নাই মোর বাড়িটো! কত্তটুকুন বেলায় বিয়া হইছে মোর, তা পেরায় বছর পনেরো তো হবেই। তারপর এই সবুর-বাহাত্তুরে হলুম। বাপের ঘরে গেলুমই বা কবার? তোদের চার ভায়, দু বুন, শাউড়ি, দিদি শাউড়ি আরো কত্ত লোক ছেল মোর শউর বাড়িতে, তা সামলাতেই বছর ঘুরে যেত আমার। বাপের ঘরে যাও বা পেথম পেথম যেতুম, পরের দিকে বাপ চল্যে গেল, ভেয়েরা যে যার ভেন্ন হল, তাই আর পর দিকে যাওয়া হতু কই? দু’ বুনের ভেয়েদের বিয়া হল, সবার বিয়াতেও যাওয়া হইল নি আমার। কক্কোনো আঁতুর ঘরে আবার কক্কোনো শাউড়ির শরীল খারাপ থাকলে যাওয়া ভেস্তে যেত। একন বাপের ঘরে দু ভেয়ের সমসার—মা নাই, বাপ নাই। তাদের ছেইলে মেইয়েদের আমি বুঝি চিনতেও পারবো নি। তবু তো বাপের ভিটে! জন্মএস্তান! তুষ্টু তোর ভালো হোক। তবু তো বেঁইচ্যে থাকতে বাপের ভিটে নে যাচ্চিস তুই! কত্ত দিনের ইচ্ছে পূরণ হবে রে আমার! আর বৈকালে ব্যাগ গুছ্যে রাখবো। ও তুষ্টু রা কাড়িস না কেন? এত কতা বলচি শুনস না নাকি? তুষ্টু বিরক্ত হয়। বলে, বললুম তো যাবো। তুমি বড় ঘ্যানর ঘ্যানর কর। আর তোমার নেবার আছেই বা কী? ওই তো দুখান শাড়ি, টিনের তোরঙ্গ, পানের বাটা আর দড়ি আঁটা চশমা। তাই নিয়ে গুছ্যে একবারে আলা!
যুথিবালা বিব্রত হয়। দুঃখ পেতে পেতে বুকে পাথর, তবুও চোখে জল আসে। চোখ ঝাপসা হয়। ছেলের ছেলেদের বউদের মুখ ঝামটায় ক্ষয়ে হয়ে যাওয়া মনে এখনো অনুভূতি জাগে। যাবার আনন্দে বিভোর যুথিবালা, দুঃখ আপাতত তাকে তুলে রেখে বাপের ভিটে দেখার আনন্দে জলছবি আঁকতে থাকে—ছোটবেলায় হারিয়ে যায়। সেই মাঝেরহাট। সেই হারুদার মিষ্টির দোকান—সেই রসগোল্লা, ক্ষীরমোহন ওঃ! বাপ মাঝে মদ্যে পয়সা বেশি হলে বাড়িতেও নিয়ে আসতো। যুথিবালার সে স্বাদ এখনো মুখে লেগে আছে। ভাইদের সঙ্গে ডাংগুলি খেলা, ঘুড়ি ওড়ানো সব করতো সে। আর মায়ের চেঁচানি এই দস্যি মেয়েকে কি করে পরের ঘরে পাঠাবো গো? এই গাছে উঠছে, ওই ঘুড়ি ওড়াচ্ছে। যুতি, আয় বলছি, ওসব খেলা তোর জন্য নয় রে। যুথির তো ভারী বয়েই গেল। সে একন কোঁচর ভর্তি পেয়ারা বাগ বাটোয়ারা করতে বসেছে দু ভেয়ের সঙ্গে। বড় ছোট বাছাই চলছে। মা ডাকচে ডাকুক। যুথির পাড়ায় দুই সঙ্গী ছিল বেলা আর কমলিনী। ওরা বৈকাল হলেই চুল বেঁধে, জামা পড়ে যুথির সঙ্গে খেলতে আসতো পুতুলের বিয়ে দিত। রান্না বাটি খেলত। আচ্চা, সেই বেলা, সেই কমল কেমন আছে একন? দেকা হবে কি আর ওদের সাথে? ভেবেই যুথিবালা জিভ কাটে। ওহ, এতটা বয়স হল এখনো এমন আলটপকা ভাবনা কেউ ভাবে? বেলা, কমলের বুঝি বিয়ে হয়ে যায়নি? তারা যেন শউর ঘর যায়নি? তাদের যেন বয়স হয়নি? আসলে যুথিবালার ভাবনা তাকে যে এখন সেই এগারো- বারো বছরের ফুটফুটে মেয়েটি করে দিয়েছে। চোখ বুজে তক্তপোশে বসে সেই সব কথা ভাবতে যে বেশ লাগছে, ভালোই লাগছে তার।
হঠাৎ যুথিবালার ভাবনা চিড় খায়। বড় ছেলে নবর কান ফাটানো চেঁচানিতে। কিগো মা, কী ভাবছো গো? কাল যাবার কথা? ভাবো, ভাবো। মেলা কাজ পড়ে আছে যাই গো। যুথিবালা মাথা নাড়ে। বলে, আমার কাচে একটু বোস নারে নব, কত্তদিন কাচে বসিস না। ছোটবেলায় কেমন কোলঘেঁষা ছিলিস! আমি না খাইয়ে দিলে কেমন রাগ করতি? নব এবার ছুতো খোঁজে। কে এখন বুড়ির ময়লা চাদরে বসে, বুড়ির ভ্যান ভ্যান শুনবে বাবা? মুখে বলে না গো মা যাই। কাল সাবধানে যেও বুঝলে? যুথিবালার কান জুড়ায় মন জুড়ায়। ভাবে, তার বড় ছেলে তার কথা এত ভাবে? তা হলে, সে যা ভাবে ওর সম্বন্ধে, তা ভুল? ভুলই ভালো। ছেলে কি আর মাকে দুর ছাই করবে?
যুথি আবারো আধো স্বপ্নের ঘরে তলিয়ে যান। বড় বউ স্বপ্না যুথিবালার রাতের খাবার নিয়ে ঘরে আসে। দুখানি রুটি, আলুচচ্চড়ি, সুজি। যুথিবালার চোখ ছানাবড়ার চেয়েও বড় হয়ে ওঠে। স্বপ্না, যার কিনা মুখের কোন আগল নেই, যুথিবালার ক্ষমতা অনুযায়ী কাজ করলেও সর্বক্ষণ তাকে সংসারে বসে খাবার খোঁটা দিয়ে চলে, হাসিমুখে তাকে খাবার খেতে ডাকচে! যুথিবালার স্বপ্নের ঘোর ভেঙে আর এক স্বপ্নের ঘোরে প্রবেশ করে। এরা এত ভালো ব্যবহার করছে কেন? নব, স্বপ্না। আবার চাঁপা মানে তুষ্টুর বউ, সেও কি ভালো ব্যবহার করবে ওর সঙ্গে? কেন এদের হলোটা কি? যুথিবালা কেমন তারকাটা, সুরকাটা হতে থাকে। যাকগে বাবা এরা যা করচে করুক। কাল ভোর হতে না হতেই যুখিবালা তুষ্টুর হাত ধরে বেরিয়ে পড়বে মাঝেরহাটের উদ্দেশ্যে।
পরের দিনের ভোর। হালকা আলোর পরশে যুথিবালার শরীরে শক্তির দামামা বাজে যেন। কাজ টাজ সেরে তৈরি হয়ে তুষ্টুকে হাঁক পাড়ে, তুষ্টু অ তুষ্টু, ওঠ বাবা, যাবি নে? তুষ্টু দাঁতগুলো বার করে প্যান্ট জামায় তৈরি হয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। মার তোরঙ্গ মাথায় বেরিয়ে পড়ে যুথিবালার সঙ্গে। যুথিবালার সন্দেহ তবু কাটে না আবার জিজ্ঞাসা করে, কিরে সত্যিই মাঝেরহাট নিয়ে যাচ্চিস তো? তুষ্টু একটু আমতা আমতা করে, কিন্তু জোর গলায় বলে, তো কোথায় যাচ্ছি? তুমি না? না হটাৎ এত্তদিন পর, তাই বলচি। যুথিবালা ফোকলা হাসে।
শিয়ালদা স্টেশনে লোক গম গম করছে। তুষ্টু মাকে স্টেশনে এক জায়গায় বসায়। তারপর তোরঙ্গ রাখে। যুথিবালা ততক্ষণে দড়িআটা চশমায় চারদিক দেখতে থাকেন। এমন সময় ট্রেন প্ল্যাটফর্মে ঢোকে গম্ গম্ গম্ গম্। তুষ্টু তোরঙ্গ মাথায় মায়ের হাত ধরে ট্রেনে উঠে বেশ জায়গা করে বসে। লোকেরা উঠছে আর নামছে। তুষ্টু বলে, মা তুমি বোসো, জল আনি। যুথিবালা ঠিক ভরসা পায় না। বলেন অ তুষ্টু, জলের দরকার নেই, তুই কোথা যাসনে বাবা। তুষ্টু মায়ের হাত ছাড়িয়ে জল আনতে চলে যায়। যুথিবালা ঝাপসা চোখে জানলা দিয়ে ছেলেকে আঁতিপাঁতি খুঁজতে থাকে। গাড়ির হুইসেল বাজে। লোকের ভিড়ে পা ফেলার জায়গা নেই। যুথিবালা লোকেদের জিজ্ঞাসা করে, ট্রেন যে ছেড়ে দিচ্ছে গো—আমার দুষ্টু গেল কনে? ও বাবারা, একটু দেখো না গো! ভিড় থেকে অনেক রকম আওয়াজ ওঠে। দেখ, ছেলে বোধহয় বুড়িকে ট্রেনে বসিয়ে দিয়ে ভেগেছে। অন্যজন উত্তর দেয়, এরকম ঘটনা কি নতুন নাকি? যুথিবালার মাঝেরহাট যাওয়ার আনন্দ খাবি খায়। সে চোখে অন্ধকার দেখে। ট্রেন ঝমঝম করে এগোতে থাকে। সেই সঙ্গে অসহায় যুথিবালা অনির্দিষ্ট ঠিকানায় পাড়ি দেয়, সঙ্গে শুধু সঙ্গী থাকে ফুল কাটা বোবা টিনের তোরঙ্গ।