ইলশেগুঁড়ি ২৯তম সংখ্যা (শারদীয়া)
ইলশেগুঁড়ি ২৯তম সংখ্যা (শারদীয়া)
নীলাদ্রি যখন অনেক আর্থিক উপার্জনের সম্ভাবনা বা সুযোগ সৃষ্টির পথ ছেড়ে সচেতন পরিজনদের মতে ‘ফালতু পাগলামী’ শুরু করেছিল ‘বারুদ’ নামে একটা ছোট পত্রিকা অর্থাৎ কিনা যাকে বলে লিটল ম্যাগাজিন প্রকাশ করে তখন অনেকের অনেক ধরনের বাঁকা কথা সহ্য করতে হয়েছিল। তা সত্ত্বেও তুলনামূলক সাহিত্য নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃতি ছাত্র ছিল বলেই এই মফস্বলে দুচারজন এবং কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সহপাঠী নিয়ে প্রায় জনা পনের ওর সঙ্গে সাহিত্য-সঙ্গত করেছিল। নয় নয় করে পাঁচ বছরে অনেকগুলি ভাল সংখ্যা পাঠক সমাজকে উপহার দিতেও পেরেছে। জনপ্রিয় দৈনিক সংবাদপত্রের রবিবাসরীয় পৃষ্ঠায় পত্রিকা সমালোচনা অংশে ভাল প্রশংসাও পেয়েছে। ইতিমধ্যে শুধুমাত্র এই পত্রিকায় লিখেই দুএকজন কবি ও ছোটগল্পকার হিসেবে রসিক সমাজে সমাদরও পেয়েছে। প্রথম প্রথম প্রায় সকলকেই পত্রিকা দিতে হত, ক্রেতা ছিলনা। অনেকগুলো লিটিল ম্যাগাজিন মেলা, বইমেলা, সাহিত্যসভা, কবি সম্মেলন অতিক্রম করে এখন আর পত্রিকা কাউকে দিতে হয় না, অনেকে এবং অনেকেই কেনে। পত্রিকা বিক্রির টাকায় পরের সংখ্যা ছাপা যায়। তিন তিনচারজন কবি ও গল্পকার অন্যান্য নামী পত্রিকায় লেখার ডাক পেয়েছে। নীলাদ্রি একমাত্র নিজের পত্রিকা ছাড়া অন্য কোন পত্রিকায় লেখা ছাপেনা, অনেকেই চায় নীলাদ্রির লেখা, কিন্তু দেয় না। দু’একজন নীলাদ্রিকে তাদের পত্রিকার রিভিউ ছাপতে বলেছে। নীলাদ্রি তাদের বলেছে—‘‘আমি যা সঠিক তাই লিখবো। শেষে রাগ করবেন না তো।’’ কথার ইঙ্গিত বুঝতে পেরে অনেকেই পিছিয়ে গেছে। ক্রমে ‘বারুদ’ দশ বছরে পড়লো। এবারের পূজো সংখ্যার ছাপার জন্য অনেক লেখা এসেছে।
অমলেশ সান্যালের লেখার ক্ষমতা আঝে, টুকটাক লিখত। গল্প-কবিতা। কিন্তু কোন পত্রিকায় ছাপা হয়নি আগে। ‘বারুদ’ প্রকাশের প্রথম দিকে নালাদ্রির বড়িতেই প্রতিমাসে একটা করে সাহিত্য সভার আয়োজন করতো নীলাদ্রি, সেখানেই অমলেশের গল্প বা কবিতা পাঠ করতো—সবাই শুনত। নীলাদ্রির উৎসাহে বারুদেই অমলেশের লেখা প্রথম ছাপা অক্ষরে প্রকাশ পায়। তারপর প্রায় প্রতি সংখ্যাতেই। গত দু বছর ধরে জনপ্রিয় নামী পত্রিকাতেও অমলেশের লেখা প্রকাশিত হচ্ছে।
সংবর্ধনাও পেয়েছে অমলেশ কয়েকটি পত্রিকার পক্ষ থেকে। যদিও প্রথমে ‘বারুদ সম্মানা’ পায় বারুদের পঞ্চম বর্ষে। অমলেশ এখন লিখে টাকাও পাচ্ছে। যেদিন প্রথম অন্য একটা জনপ্রিয় পত্রিকায় লিখে টাকা পেয়েছিল নীলাদ্রিকে বলেছিল। নীলাদ্রি অমলেশের সম্মানে একটা ছোট পার্টি দিয়েছিল। বারুদের দশ বছর পূর্তিতে পুজোসংখ্যাটা একটু মোটা হবে, এবং নীলাদ্রির রুচি পছন্দ অনুযায়ী লেখাগুলোর গুণগত মানও যেন যথেষ্ট রকমের ভাল হয়—সেই বাছাইয়ের কাজে নীলাদ্রির নাওয়া খাওয়ার সময় নেই। বেশ কয়েকটা সংখ্যায় অমলেশ লেখা দিচ্ছি- দেব করেও দেয়নি, কিন্তু নীলাদ্রি লক্ষ্য করেছে অন্য পত্রিকাগুলো যেগুলো খবরের কাগজের হকারের কাছে পাওয়া যায় সেখানে প্রায় নিয়মিত অমলেশের লেখা বেরোচ্ছে। নীলাদ্রি অমলেশের লেখা বলেই আগ্রহ নিয়ে একটা পত্রিকা পড়ছিল, ভাল লাগেনি। কেমন যেন সস্তা সেন্টিমেন্টের গল্প—অমলেশের কালমের ধার কি কমে গেল। নাকি নীলাদ্রি অবচেতনেও অমলেশের প্রতি বিরূপ ভাবছে। সেদিন কফি হাউসে একজনের সঙ্গে দেখা করতে গেছিল, কফি খেতে খেতে খেতে কথা হচ্ছিল পোষ্ট মর্ডানিজম নিয়ে। হঠাৎ পাশের টেবিলে অল্প বয়সী দুটি ছেলের কথা কানে এল। তাদের একজন বলছে—অমলেশ সান্যালের লেখা দিন দিন গেঁজে যাচ্ছে। আর একজন বলল মার্কেটে টিকে থাকতে চাইছে। নীলাদ্রি বাড়ি যাবার সময় ওই কথাগুলোই ভাবছিল।
পরের দিন বরুনকে সঙ্গে নিয়ে অমলেশের বাড়ি গেল সন্ধ্যাবেলায়। পথে যেতে যেতে বরুন বলল—যাই বলুন নীলাদ্রদা, অমলেশদা বড় কাগজে গিয়ে কম্প্রোমাইজ করছে। যে ধার আর নেই। হাঁটতে হাঁটতে ঘাড় ঘুরিয়ে নীলাদ্রি বরুনের দিকে দেখলো। অমলেশের বাড়ি যেতে অমলেশ আপ্যায়ন করলো ঠিকই তবে বেশ যেন বুঝিয়ে দিল সে এখন একজন বড় লেখক। নীলাদ্রি বললো—‘‘এবারের সংখ্যাটায় একটা লেখা দাও।’’
অমলেশ সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে বললো—‘‘তুমি নিজে এসেছো, আর বারুদে আমার হাতেখড়ি, নিশ্চয়ই লেখা দেবো তবে... বলে একটু থামলো। নীলাদ্রি বললো—‘‘তবে কি?’’
অমলেশ কি রকম একটা যেন অচেনা গলায় বললো—‘‘'এখন আমার রেট জানো তো?’’
বরুন অবাক চোখে দুজনের দিকে চেয়ে দেখল। নীলাদ্রি একট চুপ থেকে বললো—‘‘হ্যাঁ রেট। কালকেও একই কথআ বললো—রেট। যাক আজ তাহলে চলি, তুমি জানিও।’’
একটু দ্রুতই নীলাদ্রি বেরিয়ে আসছিল। অমলেশ বললো—কাল কার কাছে গেছিলে বললে না?
নীলাদ্রি দরজার কাছে দাঁড়িয়ে ঘুরে অমলেশের দিকে তাকিয়ে বললো—‘‘একজন বেশ্যা।’’