ইলশেগুঁড়ি ২৯তম সংখ্যা (শারদীয়া)
ইলশেগুঁড়ি ২৯তম সংখ্যা (শারদীয়া)
বিজয়ার উদ্দেশ্যই হচ্ছে জ্ঞান অর্জন দেবী দুর্গাকে কেন্দ্র করে। এ শুভদিনে ধনী-দরিদ্র, রাজা-প্রজা, পণ্ডিত-মূর্খ, উঁচু-নিচু বিচার না করেই সকলে একাত্মবোধে আবদ্ধ। সকল ক্ষুদ্রতা ও পাশবিক বৃত্তির অবসান ঘটিয়ে ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে সহাবস্থানের ভাবনা জাগ্রত করে মানবকল্যাণে ব্রতী হওয়ার সাধনাই হচ্ছে মায়ের বিজয়া দশমীর বিসর্জন পর্ব।
পৌরাণিক দুর্গাপূজাকে আজকের দুর্গোৎসবের চেহারা দেওয়ার পেছনে বাঙ্গালী জমিদার ও বনেদী পরিবারগুলোর ভূমিকা অনেক। আজকের দুর্গোৎসবের রূপরেখা অনেকটাই তাদের হাতেই তৈরি। বর্তমানে কয়েকটি প্রাচীন বনেদি পূজায় আজও পালযুগের পাথরের মূর্তির ধ্রুপদী নির্মাণ শৈলীকে অনুসরণ করে মৃৎপ্রতিমা নির্মাণ করতে দেখা যায়। সময়ের বিবর্তনে মাতৃপূজার বিভিন্ন রূপের পরিবর্তন হওয়ার পাশাপাশি বাংলা সাহিত্যের যে সমৃদ্ধি হয়েছে সেটাও স্বীকার করতে হবে। দুর্গাপূজা উপলক্ষ্যে বাঙ্গালী কবিতা-গান-নাটক ইত্যাদি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে মেতে ওঠে। বাঙ্গালী যেখানেই গেছে সেখানেই দুর্গাপূজার প্রচলন হয়েছে। ধীরে ধীরে দুর্গোৎসবের ব্যাপ্তি বঙ্গদেশের সীমানা অতিক্রম করে সমগ্র ভারত, বাংলাদেশ ও বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে। মাতৃ পূজায় মনোনিবেশ করার সাথে মাতৃ আরাধনার বিভিন্ন দিক সম্পর্কে আমরা জানার চেষ্টা করব। পূজা আসার কয়েক মাস আগে থেকেই আমরা দূর্গাপূজার আয়োজনকে সাফল্যমন্ডিত করার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ি। শারদীয়া দুর্গাপূজার অকালবোধন থেকে মাতৃ বিসর্জন পর্যন্ত প্রতিটি পর্বের শাস্ত্রীয় ব্যাখ্যা আছে।
শুভ ষষ্ঠী তিথিতে বোধন, আমন্ত্রণ ও অধিবাসের মধ্য দিয়ে মায়ের মূর্তির উন্মোচন করা হয়। সকালে বিল্ব বৃক্ষে দেবীর মঙ্গল বোধন করা হয়। বোধন অর্থ জাগরণ অর্থাৎ বোধনে দেবী জাগরিত হন। আমন্ত্রণ মানে দেবীকে নিয়ে আসা। বোধন, আমন্ত্রনের পর সন্ধ্যায় অধিবাস করা হয়। অকালবোধন হল শারদীয়া দুর্গাপূজার প্রারম্ভিক অনুষ্ঠান। হিন্দু পঞ্জিকা অনুসারে, আশ্বিন মাসের কৃষ্ণপক্ষের নবমী তিথি অথবা শুক্লপক্ষের ষষ্ঠী তিথিতে হিন্দু দেবীপার্বতীর দুর্গা রূপের পূজারম্ভের প্রাক্কালে এই অনুষ্ঠান আয়োজিত হয়। হিন্দু বিশ্বাস অনুসারে, শরৎকাল দেবলোকের রাত্রি দক্ষিণায়নের অন্তর্গত। তাই এই সময় দেবপূজা করতে হলে, আগে দেবতার বোধন (জাগরণ) করতে হয়। একাধিক পুরাণ ও অন্যান্য হিন্দু ধর্মগ্রন্থে উল্লিখিত হয়েছে যে, রাবণ বধের পূর্বে রাম দেবী পার্বতীর কাছে আশীর্বাদ প্রার্থনা করে বিল্ববৃক্ষতলে বোধনপূর্বক দুর্গাপূজা করেছিলেন। অধিবাস মানে দেবীর অবস্থান করা। মহাষষ্ঠীর দিন নয়টি কোলস্ঘট জলপূর্ণ করে দেবীর নবশক্তিকে আহ্বান করা হয়। এই দিনই বাঙালীর শ্রেষ্ঠ উৎসবের শুভারম্ভ হয়।
মহাসপ্তমী তিথির সকাল থেকে মূল পূজার আয়োজন শুরু হয়ে যায়। পূজা কমিটি সদস্যদের মধ্যে কাজের বন্টন করে দেন কে কি কাজ করবেন। যারা ফুল তোলার দায়িত্বে থাকেন তারা ফুল সংগ্রহের কাজে চলে যান। কেউ থাকেন মন্ডপের দায়িত্বে আবার কেউ থাকেন কেনাকাটার দায়িত্বে।
মৃন্ময়ী প্রতিমায় চক্ষুদান, প্রাণ প্রতিষ্ঠা ও আবাহন মন্ত্রে মা মৃন্ময়ী হতে চিন্ময়ীরূপে পূজিতা হন। সকালে নব পত্রিকা স্নানের মাধ্যমে দুর্গাপূজার সূচনা হয়। নব পত্রিকা হল দেবী দুর্গার প্রতিনিধি। নয় ধরণের উদ্ভিদের পুজোর প্রাচীন প্রথা হল নবপত্রিকা স্নান। এই উদ্ভিদগুলো হচ্ছে এগুলি হল - কদলী বা রম্ভা (কলা), কচু, হরিদ্রা (হলুদ), জয়ন্তী, বিল্ব (বেল), দাড়িম্ব (দাড়িম), অশোক, মান ও ধান। নবপত্রিকার চারদিকে শ্বেত অপরিজিতা লতা ও হরিদাক্ত ডোর (সুতা) দিয়ে বাঁধার নিয়ম আছে। নবপত্রিকার আর এক নাম কুলবৃক্ষ। এই কুলবৃক্ষের প্রধান অধিষ্ঠিত দেবতা ও যোগিনীরা হলেন দেবীর সহচরী। জলপূর্ণ কলস বা ঘটকে দেবীর প্রতীকরূপে কল্পনা করা হয়। ঘটের গায়ে সিঁদুরের পুত্তলিকা, ঘটের মাথায় চালপূর্ণ সরা ও নারিকেল, ঘটে জল ও ঘটের মুখে পঞ্চপল্লব রাখা হয়। নবপত্রিকা প্রবেশের পরেই দর্পণে দেবীকে মহাস্নান করানো হয়। মূল পূজা, ভোগ, মাতৃ চরণে অঞ্জলি দেওয়ার মাধ্যমে পরের দিন অর্থাৎ অষ্টমী পূজার প্রস্তুতি নিয়ে আলাপ আলোচনা শুরু হয়ে যায়।
সপ্তমী পূজার পরের দিন সকাল থেকে উপবাস করে মায়েরা মহাঅষ্টমী তিথিতে পূজা দেওয়ার জন্য মাতৃমন্ডপে চলে আসেন। অষ্টমী পূজার পরই হয় সন্ধিপূজা। দুর্গাপুজার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো সন্ধিপূজা। অষ্টমী তিথির শেষ ২৪ মিনিট এবং নবমী তিথির প্রথম ২৪ মিনিটকে বলা হয় সন্ধিক্ষণ। এই সন্ধিক্ষণে তন্ত্রমতে করা হয় সন্ধিপূজা। ঠিক এই সময়েই দেবী দুর্গা চণ্ড ও মুণ্ড নামে দুই ভয়ঙ্কর অসুরের নিধন করেছিলেন। এই সন্ধিক্ষণেই মা মহিষাসুরকে বধ করেছিলেন। এই ঘটনাটি মনে রাখার জন্যই প্রতি বছর অষ্টমী এবং নবমীর সন্ধিক্ষণে এই সন্ধিপূজা করা হয়। অসুরশক্তির বিনাশকালের এই শুভক্ষনেই সন্ধিপূজা করা হয়। ত্রেতা যুগে লঙ্কেশ্বর রাবণকে বধ করার জন্য সন্ধিপূজার শেষে শ্রীরামচন্দ্র দেবীর পায়ে ১০৮টি পদ্ম উৎসর্গ করতে চেয়েছিলেন। তাই ভক্ত হনুমানকে পাঠিয়েছিলেন দেবীদহে। কিন্তু দেবীদহ থেকে ১০৭টি পদ্ম নিয়ে ফিরেছিলেন পবনপুত্র। কারণ দেবীদহে আর পদ্ম ছিল না। সুতরাং মহামায়ার পায়ে দেওয়ার জন্য একটি পদ্ম কম পড়েছিল। সন্ধিক্ষণ চলে যাওয়ার উপক্রম হলে শ্রীরামচন্দ্র ধনুর্বাণ দিয়ে নিজের নীল পদ্মের ন্যায় চক্ষু দুটির মধ্যে একটি উৎপাটন করে মায়ের পায়ে অর্পণ করতে চেয়েছিলেন ১০৮তম পদ্ম হিসেবে। চক্ষু উৎপাটনের মুহূর্তে অবতীর্ণ হয়েছিলেন দেবী দুর্গা। মায়ের বরে বলীয়ান শ্রীরামচন্দ্র এই অষ্টমী ও নবমীর সন্ধিক্ষণেই রাবণ বধ করেছিলেন। এইদিন কোথাও কোথাও কুমারী পূজাও করা হয়। বেলুড় মঠে স্বামী বিবেকানন্দ প্রথম কুমারী পূজা চালু করেছিলেন।
কুমারী পুজা শারদীয়া দুর্গোৎসবের এক বর্ণাঢ্য পর্ব। তান্ত্রিক মতে কুমারী পুজো চলে আসছে বহু প্রাচীন কাল থেকে। কিন্তু এই পুজোর পরিচিতি সেভাবে সাধারণ মানুষের কাছে ছিল না। স্বামী বিবেকানন্দ বেলুড় মঠে কুমারী পুজোর আয়োজন করার পর থেকে এই পুজো নিয়ে আগ্রহের সৃষ্টি হয়। তন্ত্র শাস্ত্র অনুযায়ী কুমারী পুজো বলতে বোঝায় এক থেকে ষোলো বছরের কম বয়সী অরজঃসলা কুমারী মেয়ের পুজো। বয়স অনুসারে কুমারীর বিভিন্ন নামকরণ করা হয়। এক বছরের কন্যার নাম সভ্যা, দুই বছরের কন্যার নাম - সরস্বতী, তিন বছরের কন্যার নাম - ত্রিধমূর্তি, চার বছরের কন্যার নাম - কালিকা, পাঁচ বছরের কন্যার নাম - সুঙ্গা, ছয় বছরের কন্যার নাম - উমা, সাত বছরের কন্যার নাম - মাতঙ্গিনী, আট বছরের কন্যার নাম - কুষ্টিকা, নয় বছরের কন্যার নাম - কাল সন্দভা, দশ বছরের কন্যার নাম - অপরাজিকা, এগারো বছরের কন্যার নাম - রুদ্রাণী, বারো বছরের কন্যার নাম - ভৈরবী, তেরো বছরের কন্যার নাম - মহালক্ষ্মী, চোদ্দ বছরের কন্যার নাম - পঠনায়িকা, পনেরো বছরের কন্যার নাম - ক্ষেত্র, ষোলো বছরের কন্যার নাম - অম্বিকা।
মহানবমী হল দুর্গা পূজার শেষ দিন। সন্ধিপূজার পর শুরু হয় মহানবমীর পূজা। এই দিন ষষ্ঠী থেকে যত দেবদেবীর পূজা করা হয়েছে, তাদের প্রত্যেককে আহুতি দিতে হয়। এই দিনের অন্যতম অঙ্গ হচ্ছে বলিদান। শাস্ত্রমতে ছাগ বা মহিষাদি বলির রীতি আছে। কিন্তু বর্তমানে অনেক পূজাতে পশুবলি করা যায় না, তার পরিবর্তে কুস্মান্ড, ইক্ষুদান বলি দেওয়া হয়। তিনদিনের পুজার পর বিষাদের দিন। দশমীর পুজা শেষ করে মহাস্নানের যে দর্পণ ছিল সেটিতে মাকে চিন্ময়ীরূপে বিসর্জন দেওয়া হয়। বেজে ওঠে বিসর্জনের বাদ্যি। মানুষের মন ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে। বিসর্জন মানে হ’ল বিশেষ রূপে সৃজন। অর্থাৎ, অন্তের মধ্যেই আদির সূচনা। এই কারনেই বিসর্জনের মন্ত্র হল “পুনরাগমনায় চ”। এই বছরের বিসর্জন থেকেই পরের বছরের মাতৃ আরাধনার প্রস্তুতি শুরু হয়ে যায়। বিসর্জন ও বিজয়ার তাৎপর্য বুঝে ভক্তের মনের শোক কেটে যায়। মায়ের পূজার বিসর্জনমন্ত্রেও বলা হয়, ‘ওঁ গচ্ছ দেবি পরং স্থানং যত্র দেব নিরঞ্জনঃ। অস্মাকং তু সুখং দত্তা পুনরেস্যসি সর্বদা।’ তুমি নিরাকার স্বরূপে ফিরে যাও। সব সময় তুমি অবশ্য আসবে আমাদের আনন্দ দিতে। এই বিজয়া দশমীতে দেবী সপরিবারে ফিরে যাবেন কৈলাসে। মাকে প্রদক্ষিণ করা সন্তানের স্বাভাবিক রীতি। মা আমাদের ছেড়ে কোথাও যেতে পারবেন না। এই আমাদের আকাঙ্ক্ষা। প্রদক্ষিণ করে ভক্তরা স্তব করতে থাকেঃ ‘দুর্গতিনাশিনী দুর্গা, তুমি শিবা অর্থাৎ মঙ্গলকারিণী। ভক্তরা মায়ের কাছে প্রার্থনা করেন,মা তুমি বিশ্বের ঈশ্বরী, সর্বদেবময়ী। তুমি সকল ভয় ও রোগ হরণকারিণী।তুমি ঔষধিরূপে সকল রোগ নাশ করে থাক। তুমি যোগমায়া, তুমি দুঃখময় সংসার সমুদ্র পার করে দাও। আয়ু, আরোগ্য, বিজয় দাও।
রীতি রেওয়াজ মেনে মহাষষ্ঠী থেকে শুরু করে মহাসপ্তমী, মহাষ্টমী, মহানবমী পেরিয়ে দুর্গা পুজো পদার্পণ করল মহাদশমী তিথিতে। ষষ্ঠীতে দেবী দুর্গা স্বামীগৃহ ছেড়ে সপরিবারে এসেছিলেন পিতৃগৃহে। দশমী তিথিতে দেবী আবার পাড়ি দেবেন কৈলাসে। এই দিনেই মা দুর্গার প্রতিমা বিসর্জন দেওয়া হয় এবং শুরু হয় আবার এক বছরের অপেক্ষার পালা। ‘দশমী’ মানেই ঘরের মেয়ে অর্থাৎ উমার এবার বিদায় বেলা। স্বভাবতই মন খারাপ থাকে সকলের। কারো মন চায় না মেয়েকে বিদায় দিতে। কিন্তু, নিয়মানুযায়ী বিদায় তো দিতেই হবে। তাই হাজারো মন খারাপের মাঝেও হাসিমুখে সিঁদুর খেলা ও মিষ্টিমুখের মাধ্যমে মহা আড়ম্বরে ঘরের মেয়েকে তার শ্বশুরবাড়ি পাঠাতে ব্যস্ত থাকেন সকলে। মহিলারা সিঁদুর খেলায় মেতে ওঠেন। প্রাচীন যুগে এই দিনে ক্ষত্রিয়রা অস্ত্র পুজো করে পরের দিন যুদ্ধে রওনা দিতেন।
মায়ের বিসর্জন এর আগে মায়ের সামনে সাদা অপরাজিতা ফুল অর্পণ করা হয়। দেবী দুর্গার বিসর্জনের পর পুজো মণ্ডপের ঈশান কোণে অষ্টদল পদ্ম এঁকে অপরাজিতার লতা রেখে পুজো করা হয়। পুরান মতে অপরাজিতা আরাধনা দুর্গাপুজোর একটি অঙ্গ, কারণ উমা, দুর্গার অন্য নাম হল অপরাজিতা। তবে এই দেবীর মূর্তি অন্যরকম, অপরাজিতা চতুর্ভূজা, হাতে শঙ্খ, চক্র, বর ও অভয় মুদ্রা থাকে। দুর্গাপুজোর দশমীতে তাই সাদা আর নীল রঙের অপরাজিতা লাগে। নীল অপরাজিতা ফুলের মালা পরানো হয় দেবীকে। স্বয়ং শ্রীরামচন্দ্র দেবী অপরাজিতার পূজো প্রথম প্রচলন করেছিলেন বলে কথিত আছে। শত্রুকে দমনের জন্য এই দেবীরই আরাধনা করেন ভক্তরা। দেবী অপরাজিতা হলেন দেবী দুর্গারই এক রূপ। মূলত সাদা অপরাজিতা গাছকেই দেবী রূপে কল্পনা করে পুজো করা হয়। আগেকার দিনে সেজন্যই দশমীতে অপরাজিতা গাছের চারা রোপণ করা হত। লক্ষ্য ছিল- মঙ্গলকামনা। আর, যুদ্ধে জিতে বিজয়ী হওয়া। এই পুজোর শেষে ভক্তদের হাতে অপরাজিতা গাছের ডাল বেঁধে দেওয়া হয়।
এই বিজয়া দশমীর প্রকৃত তাৎপর্য হয়তো অনেকেরই অজানা। পিতৃগৃহ ছেড়ে উমা এবার ফিরে যাবেন কৈলাশে স্বামী মহাদেবের কাছে। তাই মর্ত্যবাসীর মন খারাপ। দুর্গাপুজোর এই শেষ দিনটিকে দশমী বা বিজয়া দশমী বলা হয়ে থাকে। কেন দশমীকে বিজয়া দশমী বলা হয়, তা এখন জেনে নেব আমরা। মহিষাসুর নামে এক অসুর ব্রহ্মার বর পেয়ে প্রবল ক্ষমতাশালী হয়ে স্বর্গ, মর্ত্য ও পাতাল দখল করে নেন। তিনি দেবরাজ ইন্দ্রকে স্বর্গ থেকে বিচ্যুত করেন। ব্রহ্মা তাঁকে বর দিয়েছিলেন যে কোনও পুরুষ তাঁকে হত্যা করতে পারবেন না। তবে কোনও নারী তাঁকে বধ করতে পারবেন না, এমন পর দেওয়া হয়নি। তখন সব দেবতার সম্মীলিত শক্তি থেকে আবির্ভূত হলেন দেবী দুর্গা। পুরাণে মহিষাসুর বধের কাহিনী অনুসারে টানা নয় দিন ও নয় রাত্রি যুদ্ধের পর শুক্লা দশমীতে দুর্গা মহিষাসুরকে বধ করেন। এই বিজয় লাভকেই বিজয়া দশমী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।
ত্রেতা যুগে লংকার রাজা রাবণ শ্রীরামচন্দ্রের পত্নী সীতাকে অপহরণ করেছিলেন। দেবী দুর্গার আশীর্বাদ নিয়ে রাম স্ত্রীকে উদ্ধার করতে লংকা আক্রমণ করেন। শুক্লা দশমীতেই তিনি রাবণকে বধ করেন। রাবণের বিরুদ্ধে যুদ্ধে রামের জয়লাভকেও চিহ্নিত করে বিজয়া দশমী। উত্তর ও মধ্য ভারতে এই দিনে দশেরা উদযাপিত হয়। তবে তার তাৎপর্য সম্পূর্ণ আলাদা। 'দশেরা' শব্দটির উৎপত্তি সংস্কৃত শব্দ ‘দশহর’ থেকে। যার অর্থ দশানন রাবণের মৃত্যু। বাল্মীকি রামায়নে বলা হয়েছে, আশ্বিন মাসের শুক্লা দশমী তিথিতেই লঙ্কেশ্বর রাবণকে বধ করেছিলেন রাম। কালিদাসের রঘুবংশ তুলসীদাস রামচরিত মানস সূত্রের সঙ্গে সংযোগ রেখেই বলা হয়েছে রাবণ বধের পরে আশ্বিন মাসের ৩০ তম দিনে অযোধ্যা প্রত্যাবর্তন করেন রাম, সীতা, লক্ষণ। রামচন্দ্রের প্রত্যাবর্তনকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য যথাক্রমে দশেরা ও দীপাবলি পালন করা হয়ে থাকে। দশেরা অর্থাৎ নবরাত্রি, এর প্রথম নয় দিন মা দুর্গাকে পুজো করা হয় নানা ভাবে। নবরাত্রি মানে নয়টি রাত্রি, যা নয়টি গ্রহের পরিচালনায় ঠিক মতো চালিত করতে পারে। শুধুমাত্র দুর্গাপুজোর বাহ্যিক আড়ম্বরই নয়, মনের অন্তর থেকে দেবীকে পুজো করে প্রতিটা গ্রহের প্রভাবে যেন ঠিক ভাবে শরীর চালিত হয়, সেই প্রার্থনা করা। উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, পঞ্জাব, হরিয়ানা, দিল্লি, মহারাষ্ট্রের কয়েকটি জায়গায় নবরাত্রিতে রামের পুজো হয়। রামায়ণকে কেন্দ্র করে নাচ, গান, নাটক চলতে থাকে ন’দিন। অবশেষে দশেরার দিন রাবণের কুশপুত্তলিকা জ্বালানো হয়। সমস্ত ধ্বংসকারীর বিনাশ স্বরূপ এই পুত্তলিকা জ্বালানো হয়।
মহাভারতের বিরাট পর্বে দেখা যায়, পাণ্ডবেরা চোদ্দো বছর বনবাসের পরে এক বছরের অজ্ঞাতবাসের সময় বিরাট রাজার রাজ্যে পরিচয় বদলে ছদ্মনামে বসবাস করছিলেন। এই সময় কীচক দ্রৌপদীকে লাঞ্ছনা করায় ভীম তাঁকে হত্যা করেন এবং এই সংবাদ দুর্যোধন কোনওভাবে জানতে পেরে অনুমান করেন বিরাট রাজ্যেই পাণ্ডবেরা লুকিয়ে আছে। তাই কৌরবেরা সসৈন্যে বিরাট রাজ্য আক্রমণ করে বসেন। বিরাট রাজার পুত্র উত্তর বৃহন্নলারূপী অর্জুনকে নিয়ে শমী গাছের নীচে গিয়ে অস্ত্র সংগ্রহ করেন। তখনই উত্তর সব ঘটনা জানতে পারেন। কুরুবাহিনীর সঙ্গে অর্জুন একা লড়েন। অর্জুন মহাশক্তিতে বলীয়ান হয়ে তাদের প্রত্যেককে পরাজিত করেন। মহাসম্মোহন অস্ত্র প্রয়োগ করে তিনি সমস্ত কুরু সৈন্যকে ঘুম পাড়িয়ে দেন। কিছু কিছু পৌরাণিক ব্যাখ্যায় বলা হয়, অর্জুনের এই বিজয়ের দিনটি এবং রামচন্দ্রের বিজয়ের দিনটি একই। রামচন্দ্রের মতোই অর্জুনেরও জয়ের সূচক বিজয়া দশমী। জয় থেকেই বিজয়া এসেছে।
রানী রাসমনির জামাতা মথুরবাবু একদা আবির্ভূত হয়ে বিজয়ের দিনে দেবীকে বিসর্জন দেবেন না বলে জেদ ধরে বসে ছিলেন তখন ঠাকুর রামকৃষ্ণ তাকে বোঝান যে বিজয়ের অর্থই মা এবং সন্তানের বিচ্ছেদ নয়। মা কখনোই সন্তানকে ছেড়ে থাকতে পারেন না। রামকৃষ্ণদেব আরো বলেন যে, এতদিন বাইরে দালানে বসে মা পুজা নিয়েছিলেন, আজ থেকে মা মনের মন্দিরে বসে পূজা নেবেন। এই ব্যাখ্যায় মথুরবাবুর মনের আঁধার দূর হয়।
‘প্রাধানিক রহস্য’ গ্রন্থে স্পষ্টই বলা হয়েছে ‘নিরাকারা চ সাকারা সৈব…।’ অর্থাৎ যিনি নিরাকার, তিনিই সাকার। দেবী সাকার রূপে মর্ত্যে পূজা গ্রহণ করেছেন, তারপর নিরাকার রূপে ফিরে গিয়েছেন কৈলাসে। তার অর্থ সন্তানের সঙ্গে তাঁর বিচ্ছেদ নয়। মা-সন্তানের চিরমিলনের এই শাস্ত্রীয় তত্ত্বই প্রাঞ্জলভাবে মথুরবাবুকে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন ঠাকুর রামকৃষ্ণ।
দশমীর সকালে এক কৌটা সিঁদুর নিয়ে মায়ের মন্দিরে যাওয়া এবং সেই সিঁদুর থেকে কিছুটা মায়ের চরণে অর্পণ করা বাকিটা বাড়ি নিয়ে চলে আসা। সেই সিঁদুর সারাবছর পুরুষ-মহিলা নির্বিশেষে ব্যবহার করেন বিপদ দূর করার শক্তি হিসেবে। বিজয়া দশমীর দিন সকালে রাম মন্দিরে যাওয়া এবং সেখানে গিয়ে একটি ঘিয়ের প্রদীপ জ্বালানো।
দশমী পূজার অঞ্জলি দেওয়ার সময় সাদা বা নীল অপরাজিতা ফুল অর্পণ করা। শক্তির আরাধনা চলতে থাকে। অতঃপর দশম দিনে মাকে বিশেষ ভাবে সম্মান জানানো হয়। তার পর মাকে বিসর্জন দেওয়া হয়। আসছে বছর আবার এসো, এই বলে তাঁকে আবাহন জানানো হয়। শুরু হয় সকল বিভেদ ভুলে একে অপরের সঙ্গে আলিঙ্গন করে মিষ্টিমুখ করা। দশমীর এই আনন্দ চলতে থাকে লক্ষীপুজো পর্যন্ত। সকলেই এই উপলক্ষে এক সাথে মেলবন্ধনে আবদ্ধ হয়।
মাতৃজাতি তথা নারী জাতিকে সম্মান করা অবশ্য কর্তব্য। যখনই সংসারে কোনও সমস্যা আসে, নারী তার সকল শক্তি দিয়ে রক্ষা করে। মানবিকতা, ন্যায় বিচার, ভালবাসা, সেবা দিয়ে সকল সমস্যার সমাধান করে। মা দুর্গার পুজোতে নারী জাতিও উদ্বুদ্ধ হয়। মা যেমন পরিবারকে সঙ্গে আনেন এবং শত্রু বিনাশ করে শান্তি প্রতিষ্ঠা করেন, তারাও তেমনই তাদের পরিবারকে অটুট বন্ধনে আবদ্ধ রেখে সংসারে শান্তি প্রতিষ্ঠা করে। ছোটোরা গুরুজনদের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করেন, সমবয়সীরা আলিঙ্গন করেন আর গুরুজনেরাও ছোটদের প্রাণভরে আশীর্বাদ করেন। আবার শুরু হয় প্রতীক্ষা। মায়ের কাছে প্রার্থনা ‘দুর্গোত্তারিণী দুর্গে ত্বং সর্বাশুভবিনাশিনী। ধর্মার্থকামমোক্ষায় নিত্যং মে বরদা ভব।…তুমি সকল অশুভবিনাশকারিণী ধর্ম-অর্থ-কাম-মোক্ষের বরদানকারিণী।
বিজয়ার উদ্দেশ্যই হচ্ছে জ্ঞান অর্জন দেবী দুর্গাকে কেন্দ্র করে। এ শুভদিনে ধনী-দরিদ্র, রাজা-প্রজা, পণ্ডিত-মূর্খ, উঁচু-নিচু বিচার না করেই সকলে একাত্মবোধে আবদ্ধ। সকল ক্ষুদ্রতা ও পাশবিক বৃত্তির অবসান ঘটিয়ে ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে সহাবস্থানের ভাবনা জাগ্রত করে মানবকল্যাণে ব্রতী হওয়ার সাধনাই হচ্ছে মায়ের বিজয়া দশমীর বিসর্জন পর্ব।