ইলশেগুঁড়ি ২৯তম সংখ্যা (শারদীয়া)
ইলশেগুঁড়ি ২৯তম সংখ্যা (শারদীয়া)
স্বয়ং লেখিকার কোথায়—বলতে দ্বিধা নেই সত্তর দশকের আন্দোলন আমাকে অনেক কিছু শিখিয়েছে। গল্পের কালটা ১৯৭১ এর প্রেক্ষাপটে। পশ্চিমবঙ্গে রাজনৈতিক অবস্থার অস্থির সময়।
॥ এক॥
'দ্রৌপদী' মহাশ্বেতা দেবীর বহুচর্চিত গল্প গুলির মধ্যে একটি। সত্তর দশকের নকশাল আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে গল্পের আঙ্গিক নির্মাণ। রবীন্দ্র ছোটগল্প বাংলা সাহিত্যে অস্থি মজ্জা ও মনন নিয়ে আবির্ভূত হলেও ছোট গল্প বুননের অসংখ্য সুক্ষ্ম উপাদানগুলো সমাজ মোটাদাগে জানান দিচ্ছিল প্রগতিশীল সাহিত্যিকদের হাতে। বাংলা সাহিত্যের সনাতন লুব্ধ রোমান্টিকতার বিপুল পরিবর্তন আনে মাক্স ও ফ্রেডরিক অ্যাঙ্গেলের বস্তুনিষ্ঠ চিন্তাভাবনা। শ্রেণী বৈষম্য, একক মালিকানার অবসানের মধ্যদিয়ে শ্রেণীহীন সমাজ গড়ে তোলার লক্ষ্যে বিশ শতকের কুড়ির দশক থেকে শুরু হয় যুক্তি আবেগের আলোড়ন। সৃষ্টি হয় নতুন সাহিত্যে যা যুগমানস চেতনার স্থায়ী দলিল। গোপাল হালদার, ধূর্জটিপ্রসাদ, তারাশংকর, সুবোধ ঘোষ, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাহিত্যে বাংলা আখ্যানের যে পরিবর্তিত ধারার সূচনা করেন; মহাশ্বেতা সেই ধারারই হয়ে ওঠেন এক পথিকৃৎ উত্তরসূরী, ১৯৫৬ 'ঝাঁসীর রাণী' ইতিহাসাশ্রয়ী উপন্যাসের মধ্যে দিয়ে। সময়ের সাথে মহাকালের রথের চাকা যতই গড়িয়েছে লেখিকার লেখনি চেতনা ততই প্রশমিত হয়েছে। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছোটগল্পের বাস্তব চেতনাকে গ্রহণ ও আত্মস্থ করে মহাশ্বেতা দেবীর নতুন পথের অনুসন্ধিৎসু যাত্রী হয়েছেন। বাবা মারা যাওয়ার পর 'বর্তিকা' পত্রিকার সমস্ত দায়িত্ব গ্রহণের মধ্যে দিয়ে বঞ্চনা, দারিদ্র, অসাম্যের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করেছে। আদিবাসী সমাজ থেকে শুরু করে কৃষক আন্দোলনের কর্মীদের নিয়ে তিনি বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করেছেন দীর্ঘকাল ধরে। এর ফলস্বরূপ তাঁর সাহিত্যে উঠে এসেছে অন্তজশ্রেণীর মানুষেরা। এছাড়া পালামৌ বন্ডেড লেবার সংগঠ, লধা- সবর সমাজ কল্যাণ সমিতি, হরিজন ও মুন্ডা সমাজ কল্যাণ সমিতি ইত্যাদিতে বিশেষভাবে যুক্ত ছিলেন। তাই তিনি চরিত্রগুলির এতো কাছে আসতে পেরেছিলেন। ২০০৩ শালে অমৃতলোক এ জনৈক সমালোচক বলেছেন -নিম্নবর্গের মানুষেরা মহাশ্বেতার গল্পে উঠে এসেছে গোষ্ঠীবদ্ধ কোনো জনজীবন থেকে, তাদের নিজ নিজ সংস্কৃতি ও মিথকে সঙ্গে নিয়ে। উঠে এসেছে তাদের আনন্দ, দুঃখ, বেদনা, লাঞ্ছনা, শোষণ ও বেঁচে থাকার লড়াই এর মধ্যে দিয়ে। উচ্চবর্ণের বিত্তশালী পুরুষেরা ঘরের মেয়েদের জন্য কড়া অনুশাসনের বিধান দিলেও নিম্নবর্ণের যৌবনবতী- স্বাস্থ্যবতী মেয়েদের ইচ্ছামতো ভোগ করে। এই সমস্যা মিশ্রিত উপাদানগুলিকে টার্গেট করে মহাশ্বেতা দেবী বহু সৃজনশীল সাহিত্য গড়ে তুলেছিলেন। যার সংবেদনশীলতা পাঠকের হৃদয় কে সংক্রমিত করে।
স্বয়ং লেখিকার কোথায় - বলতে দ্বিধা নেই সত্তর দশকের আন্দোলন আমাকে অনেক কিছু শিখিয়েছে। গল্পের কালটা ১৯৭১ এর প্রেক্ষাপটে। পশ্চিমবঙ্গে রাজনৈতিক অবস্থার অস্থির সময়। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তা ও ভূমি আইন গুলির জন্য কৃষকদের নিরবিচ্ছিন্ন জমি হারানোর ফলে কৃষক ও জমিদারদের সম্পর্ক তিক্ত হয়ে ওঠে। ১৯৬৯ সালে খাদ্য আন্দোলন ও যুক্তফ্রন্ট সরকার প্রতিষ্ঠিত হয় অজয় মুখোপাধ্যায় হাত ধরে। এরপর প্রতি এলাকায় খাস ও বেনামী জমি দখলের আন্দোলন শুরু হয়। নতুন কর্মসূচি ও গণতন্ত্রকে সামনে রেখে সিপিআই (এম) নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন। নির্বাচনে কংগ্রেস এককভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ অর্জন করতে না পারলে পশ্চিমবঙ্গে প্রথম যুক্তফ্রন্ট সরকার গঠিত হয়। সংসদীয় রাজনীতিতে যুক্ত হওয়ার প্রশ্নে সিপিআই (এম) এর মধ্যে গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব শুরু হয়। ১৯৬৯ সালে হো-চি-মিন এর মৃত্যুর পর সিপিআই (এম) উত্থান ও সরকারের শরিক অনেক বামপন্থী নেতা কর্মীদের মধ্যে মতানৈক্য দেখা দেয়।ফলে গোটা দেশজুড়ে এক অস্থির অবস্থা বাতাবরণ সৃষ্টি হয়। ১৯৭০ যুক্তফ্রন্ট সরকারের পতন ঘটিয়ে রাষ্ট্রপতি শাসন জারির মধ্য দিয়ে সারাদেশে জঙ্গলে রাজত্ব কায়েম করে। নকশাল আন্দোলন বিস্তার লাভ করে। মনীষীদের মূর্তি ভাঙ্গা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বয়কট, নকশাল নেতা চারু মজুমদারের মৃত্যু; এরপর শুরু হয় নকশাল আন্দোলনের পুলিশি সন্ত্রাস। নকশালবাড়িকে কেন্দ্র করে আধা- ফ্যাসিস্ট সন্ত্রাস সৃষ্টিকরে মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছিল। একটি স্বপ্নময় সমাজ গড়া ও শ্রেণিশত্রু খতমের যে জেহাদ ঘোষণা করেছিল শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে তারই শোণিত প্রবাহ দ্রৌপদী গল্পের প্রত্যেক শিরা-উপশিরার মধ্যে প্রবাহিত। এই বিদ্রোহগুলি জীবন থেকে উদ্ভুত কতকগুলি প্রধান প্রধান সমস্যার সঙ্গে মোকাবিলা করতে চেয়েছিল। এই বিদ্রোহগুলি চোখের সামনে তুলে ধরেছিল সামন্ততান্ত্রিক শাসনের উৎপীড়নের বিভিন্ন দিক, খাজনা বৃদ্ধি ও উচ্ছেদ, মহাজনী উৎপীড়ন, বেগার প্রথা, দুর্ভিক্ষজনিত সমস্যাগুলি। কাজেই এগুলিকে 'অন্ধবিদ্রোহ' বলে অবহেলা করা উচিত নয়। সকলে হাতে হাত বেঁধে লড়াই করেছিল, কেননা তারা বুঝতে পেরেছিল ঐক্যেই শক্তি। উপজাতি বিদ্রোহগুলিতে উপজাতিরা (যেমন—সাঁওতাল, কোল) হিন্দু সমাজের তথাকথিত নীচু জাতির লোকদের সঙ্গে যারা ছিল তাদের মতোই গরীব, দৃঢ় ঐক্য স্থাপন করেছিল। কাজেই এই বিদ্রোহগুলিতে অবশ্যই একধরনের চেতনার আভাস লক্ষ করা যায়। তবে এই বিদ্রোহগুলিকে আবার অতি আদর্শায়িত করে দেখা ঠিক নয়। এগুলি ছিল ইতস্তত বিক্ষিপ্ত, বিচ্ছিন্ন, আঞ্চলিক বিদ্রোহ। বিদ্রোহীরা দুর্ভেদ্য জঙ্গল বেছে নিয়ে গেরিলা যুদ্ধের আশ্রয় নিয়েছে। ব্যারিকেড তৈরি করে সেনাবাহিনীর প্রবেশে বাধা সৃষ্টি করেছে, কিন্তু এত বীরত্ব সত্ত্বেও লাঠি, তীর হাতে আধুনিক অস্ত্রেশস্ত্রে সজ্জিত সেনাবাহিনীর সামনে অসহায় বোধ করেছে। তাদের পরাজয় ছিল পূর্বনির্ধারিত এক ঘটনা।
॥ দুই॥
মহাশ্বেতা দেবীর দ্রৌপদী গল্পটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৭৭ খ্রিস্টাব্দে, শারদীয় পরিচয় পত্রিকায়। অর্থাৎ ঘটনার সময় ও বর্ণনার মধ্যে প্রায় সাড়ে ছয় বছরের বিস্তার। গল্পের মধ্য দিয়ে ১৯৭১ এর পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক অবস্থা কে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে । ওই সময় পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক অবস্থা অনেকটা টালমাটাল। গল্পকার চেনা ছন্দে নিজেকে নতুন করে পরিচিতি করানোর জন্য কলম ধরলেন দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় এর অনুপ্রেরণায়। তখন আমাকে চিঠি লেখে। ও লিখেছিল, অনেকদিন পরিচয়ের জন্য লেখেননি। এবার সবচেয়ে ভালো গল্পটি চাই।তার উত্তরে আমি যে চিঠি লিখি, সেটি স্বীকার করছি কড়া চিঠি। এবং দ্রৌপদী পাঠাই। মহাভারতের কয়েকশো বছর পরেও চেনা মোড়কে এ কোন দ্রৌপদীকে হাজির করলেন মহাশ্বেতা দেবী? পঞ্চপান্ডব সহায় থেকে যে দ্রৌপদীকে সভার মাঝে ধর্মের সূক্ষ্ম নীতিতে আবদ্ধ হয়ে বিবস্ত্র হয়েছিলেন তিনি নাকি ! উত্তর শুধু সময়ের পার্থক্যে, মধ্যযুগের দ্রৌপদী সভ্য আধুনিক যুগে ট্রানস্প্লান্ট । মধ্যযুগের যে বিবস্ত্র লাজের কাছে আমরা মুখ ফিরিয়ে ছিলাম সেই বিবস্ত্রতায় ক্ষান্ত না থেকে ধর্ষক রাস্ট্রও উলঙ্গ হয় আধুনিক দ্রৌপদীর মাংস লোভে। ঘটনার বুনন এতো কঠোর, শুধু গল্প রসাস্বাদন নয় সমাপ্তিতে মস্তিষ্ককে জট ধরানো এক রোমহর্ষক প্রতিবাদ পরিস্ফুটিত হয়। হতাশার গোলকধাঁধায় না হেঁটে বারবার বঞ্চনা নারীকে কিভাবে প্রতিবাদের পথ খুঁজে দিতে সাহায্য করেছে সেই ভাবনাকে প্রাধান্য দিয়েছেন গল্পকার।
গল্পটি শুরু হয়েছে কয়েদির আইডেন্টিফিকেশন মার্ক দিয়ে। কয়েদি- দ্রৌপদী মেঝেন, অপরাধ- সূর্য সাহু ও তার ছেলেকে খুন । ড্রাউটের সময় আপার কাষ্টের ইঁদারা ও টিউবওয়েল দখল। গ্রেপ্তারের সহায়তায় জন্য নগদ ১০০ টাকা পুরস্কার ঘোষিত হয়েছে। ঝাড়খণ্ডের এই অনার্য সাঁওতাল মেয়ে পুলিশের ঘুম হারাম করে দিয়েছে। যে দ্রৌপদী সমাজ গড়ার স্বপ্নে নিবেদিত যৌবন; গ্রাম দিয়ে শহর ঘেরার ব্রাতে শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছিল সশস্ত্র সংগ্রামে।১৯৭১ বিধানসভা নির্বাচনে কংগ্রেসের পরাজয় ও রাষ্ট্রপতি শাসন জারি, সমগ্র দেশ উত্তাল নকশালবাড়ি আন্দোলনে; ঠিক সেই সময় পুলিশ নকশালবাড়ি দমনের নামে সন্ত্রাস চালায় আদিবাসী অন্ত্যজ শ্রেণী প্রতি, তাদের সাম্যবাদী লড়াইয়ের প্রতি। ১৮৭১ সালে ইংরেজ সরকার ক্রিমিনাল ট্রাইবস অ্যাক্ট এর মাধ্যমে আদিবাসীদের 'অপরাধপ্রবণ'জাতি হিসেবে ঘোষণা করে তাদের গায়ে স্থায়ীভাবে যে কলঙ্ক লেপে দিয়েছিল; স্বাধীনতার ৩০ বছর পরেও সেই কলঙ্ক থেকে মুক্ত হতে পারেনি দুর্ভিক্ষ ও দরিদ্রের নিত্য সঙ্গী ভূমিপুত্ররা। গল্পকার দেখায় নিয়নডার্থাল জঙ্গলে সশস্ত্র বিপ্লবীদের ধরতে না পারলে সরকারের শান্তিরক্ষার বিশেষ বাহিনী পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় সাঁওতাল দের অত্যাচার করে মেরে ফেলে। ভারতের সংবিধান সম্বন্ধে জ্ঞাত থাকা বাহিনী। (সংবিধানে জাত- ধম্মো নির্বিশেষে সকল মানুষ পবিত্র) 'তাদের চোখে সাঁওতাল কেন, অস্ট্র-এশিয়াটিক মুন্ডা গোষ্ঠীর সকল সন্তানকেই এক চেহারা মনে হওয়া।' অমনি হত্যা। বীরভূম, বর্ধমান, মুর্শিদাবাদ, বাঁকুড়া অঞ্চলে স্থায়ী নিবাসীদের নিত্যসঙ্গী অনাহার, প্রবঞ্চনা ও নির্যাতন। এক চরম দুঃখ-কষ্ট ও শোষণের যাঁতাকলে দিন দিন পৃষ্টি হচ্ছিল জোতদারদের হাতে। তাদের উপর খাজনা- ধান সাজা, কুট, জুলুম তো ছিলই সাথে সাথে অভাবের সময় জমিদারদের কাছ থেকে থেকে যে ধান কর্য করত তা চক্রবৃদ্ধি হারে সুদ সহ আসল দিতে হতো, এছাড়া আরও এক দৃষ্টান্ত হলো কোয়ালি, ঈশ্বর বৃত্তি, ঘুম ইত্যাদি। তারপর ধান ওঠার সময় যোদ্ধাদের পাওনা মেটাতে মেটাতে অনেক সময় নিজের কিছুই থাকতো না, কেবল ঝাঁটা হাতে নিয়েই ঘরে ফিরতে হতো। আবার জমিদারদের কাছ থেকে ধার করে সারাবছর সংসার চালাতে হতো। দ্রৌপদী গল্পে দেখতে পাই বিডিওকে সঙ্গে নিয়ে যোদ্ধা সূর্য সাহু বাড়িতে তিনটি টিউবওয়েল খুললেন অথচ তখন খরা, জলের জন্য হাহাকার জল নিতে হবে ট্যাক্স দিয়ে তবে চাষ করতে হবে। এই সকল শোষণ ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে অন্তজ বাসীরা বিভিন্ন এলাকায় ধীরে ধীরে সংগঠিত হতে থাকলে ক্রমে আন্দোলনের রূপ নেয়। আন্দোলনের প্রবাহ জমিদার - জোরদারদের বিরুদ্ধে যখন ধাবিত হয় ঠিক তখনই শাসক শ্রেণীর প্রতিনিধিরা বিপুল পরিমাণ উৎকোচ ও নারী লালসায় বিক্রিত হয় জমিদারদের কাছে। সমগ্র রাস্ট্র আদিবাসীদের পুনরায় অপরাধপ্রবণ জাতিতে ঘোষণা করে করে চরম নির্যাতনের শামিল করায়। দ্রৌপদী মেঝেনের মতো আসামিকে অ্যাপ্রেহেন্ড এর জন্যে শুরু হয় অপারেশন বাকুলি।
॥ তিন॥
জোদ্দার সূর্য সাউ হত্যার অপরাধে দ্রৌপদী ও তার সংগঠনের বিরুদ্ধে ক্যাপ্টেন অর্জন সিং এর প্রতিনিধিত্বে যৌথবাহিনী বাকুলি অপারেশনে যায়। কিন্তু বাহিনীর চোখে ধুলো দিয়ে দ্রৌপদী দম্পতি লাশের স্তুপ থেকে নিয়ানডার্থাল জঙ্গলে গা ঢাকা দেয়। অর্জন সিং দুশ্চিন্তায় ও উদ্বেগে ব্লাডসুগারে আক্রান্ত হয়। সে শত্রুপক্ষকে ভয় পায়, আবার তাদের আদর্শকে শ্রদ্ধাও করে। বাবুদের ডিমোলিশ করে ওদের দাবিকে হাইলাইট করে বই লেখার স্বপ্ন দেখেন। এ্যান্টিফাসিস্ত গ্রন্থ পড়েন, তার সেজো ঠাকুরদার মতো কাউন্টারে হত্যার রক্তে তার শরীর আনন্দে পুলকিত হয়। ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে দেখাতে চায় কতটা পারস্পেক্টিভ, তাই এনকাউন্টার তার চাই চাই । কালো আদিবাসী সাঁওতালদের এনকাউন্টার। সে দোষী হোক বা নির্দোষ- "জান লে লি" করে উত্তেজনায় চিৎকার করে। বাহাদুরের খাতিরে দ্বিতীয়বার ঝাড়খানী জঙ্গলে অপারেশনে আসে আর্মির হ্যান্ড বুকের সাথে; অর্জন সিং নতুন মিশন নিয়ে- "যোদ্ধাদের দর্শন মাত্র নিধন হলো সেনা মাত্রে পবিত্র কর্তব্য।" সেনাদের খোঁজিয়াল দুখীরামের সহায়তায় পাথরে শুয়ে মুখ ডুবিয়ে জল খাওয়া অবস্থায় দ্রৌপদীর স্বামী দুলন মাঝিকে হত্যা করে। এরপর চলে দ্রৌপদির খোঁজ। বয়স সাতাশ, কাঁধে গুলির ক্ষত চিহ্ন। এই মিশনের পিছনে বহু সময় ও অর্থব্যয় হলেও হাইপোথিসিস সম্বন্ধে ক্যাপ্টেন নিরব থেকেছেন। "সম্মুখ সংঘর্ষের পর কঙ্কাল সমূহের হাত ভাঙ্গা বা কাটা কেন ?...কন্ঠাস্থি লটরপটর পা ও পাঁজর অস্থি চূর্ণীত কেন?" ক্যাপ্টেন এ প্রশ্নের জবাব দিতে নারাজ; তিনি শুধু মহাজন, জোতদার, শুঁড়ি, বেশ্যালয়ের বেনামী মালিক, অতীতের খোঁচড়- এরা আজও সন্ত্রস্ত। নিরন্ন নেংটিরা আজও উদ্ধত ও অনমনীয় । " তাই সে শান্তি ফিরিয়ে আনতে চায়, মনের প্রশান্তি।" অতএব অপারেশন ঝাড়খানি ফরেস্ট থামাতে পারেনা..." দোপদি মেঝেনকে ধরো সে ওদেরকে ধরিয়ে দেবে।
দ্রৌপদী বিদ্রোহীনি নন প্রতিবাদী, যুক্তিবাদী।চম্পাভূমির পবিত্র কালো রক্ত তার শরীরের প্রতিটি ধমনীতে প্রবাহিত। প্রতিবাদ তার জমিদারদের বিরুদ্ধে, সশস্ত্র রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে । সে কমরেড,সমস্ত শোষণ- অত্যাচারের সমাপ্তি দেখে ভাবী প্রজন্মকে বাসযোগ্য করে দিতে অঙ্গিকার বদ্ধ। প্রকৃতি তাকে নারী বানিয়েছে, নারীর লালিত্য দিয়েছে। জগতকে স্নেহ ভালবাসার বন্ধনে আগলে রাখার জন্য কিন্তু জীবন যুদ্ধে সেই লালিত্য সংসার,ভালোবাসার বন্ধন সব ছেড়ে বেরিয়ে পড়তে হয়েছে। জীবিত বা মৃত দ্রৌপদীর জন্য বখশিশ ঘোষণা হয়েছে- তা সে জানে। তবুও তার উদ্দেশ্যে সকল আন্দোলনের কর্মীদের জন্য রসদ পৌঁছে দেওয়া। প্রতিটি মুহূর্তে জীবনের ঝুঁকি নেয় সংগঠনের হিতোকল্পে। মসাই টুডুর বৌ তাকে সাবধান করতে চেয়েছে -"তু পালাতে পারিস না? "উত্তর একটাই"না; কতবার পালাবো বল? ধরলে বা কি করবে বল? কাঁউটার করে দিবে, দিক।" মৃত্যুকে ভয় পায় না। তাই তাকে আয়ত্ত্ব করতে হয় শত্রুর সাথে মোকাবেলা করার কায়দা, সমস্ত কৌশলও। ধরা পড়ে যদি নির্যাতনে অত্যাচারে শরীর- মন ভেঙে যায় তবুও সে কারো নাম বলবে না; নিজের জিভ দাঁতে কেটে ফেলবে।দলের কর্মীদের ডেসট্রয় হতে দেবে না'র মন্ত্র তার কপালে।
দ্রৌপদীর ভাগ্য বিপর্যয় ঘটে। গল্পকার ভয়ানক শোচনীয় ঘটনার অনুররণ অনুভব করায় পাঠকদের। That which comes from pity and Fear through Imitation। ক্যাথারসিসের চমক আনে গল্পে। সহকর্মী সোমাই ও বুধনার ষড়যন্ত্রে দ্রৌপদী সন্ধ্যা ছটা সাতান্ন মিনিটে গ্রেফতার হয়। জেরা চলে এক ঘন্টা ; দ্রৌপদীর জীবনে এবার দ্বিতীয় পর্ব শুরু হয়, সভাপর্ব। জন্ম থেকে লড়াই করেছে শোষণমনস্ক জোতদারদের বিরুদ্ধে, অত্যাচারের বিরুদ্ধে এবার তাকে সংঘাতে নামতে হয় গণতন্ত্রের রক্ষক মাংস লোভী পুরুষদের যৌন বিকৃতির বিরুদ্ধে। এ লড়াই সম্পূর্ণ দ্রৌপদীর অজানা। এ কৌশল তার আয়ত্তের বাইরে, এ এক নতুন দূতক্রিড়া, নতুন চক্রবূহ। ডিনার শেষে সেনানায়েকের আদেশে - "ডু দি নীডফুল।...কতজন ওকে বানিয়ে নিতে এসেছিল?" বেহুঁশ দ্রৌপদীর হুঁশ ফিরলে দেখে "ঘোলাটে চাঁদের আলোয় বিবর্ণ চোখে নিচের দিকে নামতে নিজের স্তনদুটি চোখে পড়ে ...এবং ও বোঝে হ্যাঁ, ওকে ঠিকমত বানানো হয়েছে । দুটি স্তন কামড়ে ক্ষতবিক্ষত, বৃন্ত ছিন্নভিন্ন" যে চম্পা ভূমির পবিত্র রক্তে দ্রৌপদীর গর্ব হতো পূর্বপুরুষদের জন্য, কালো কুচিলার তীর মেয়েদের রক্ত পাহারা দিত, তা আজ নির্যাতিত। কিন্তু এর পরিসমাপ্তি এখানে শেষ হয়নি; রাবণের চিতার মতো প্রজ্বলিত লালসা মাথাচাড়া দেয়। "অপেক্ষা করতে হয় না বেশিক্ষণ। আবার বানিয়ে নেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয় । চলতে থাকে। চাঁদ কিছু জ্যোৎস্না বমি করে ঘুমাতে যায় । থাকে শুধু অন্ধকার। এক ভাবে পা ফাঁক করে চিতিয়ে থাকা নিশ্চল দেহ। তার উপর সক্রিয় মাংসের পিস্টন ওঠে ও নামে, উঠেও নামে।" আজ এ কৃষ্ণ সখা দ্রৌপদী নয়, সামনে একটা দুর্যোধন আজ দাঁড়িয়ে নেই কিংবা একটা দূঃশাসন; সবাই অন্ধ ধৃতরাষ্ট্র রূপ অজেয় পৌরুষ হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
যারা প্রতিকূল প্রাকৃতিক পরিবেশে হিংস্র জানোয়ারদের পর্যুদস্ত করে বনভূমি জয়করে সোনার দেশ গড়ে তুলেছিল। তারপর? শ্বাপদের চেয়েও হিংস্র, শৃগালের চেয়েও কৌশলী ও সাপের চেয়েও ভয়াবহ এক জাতের মানুষরূপী জানোয়ার এলো শাসকের ছদ্মবেশে। এই অসম লড়াইয়ে প্রকৃত কমরেড তাই দ্রৌপদীকেই হতে হয়। সেনাদের ছুড়ে দেওয়া শাড়িকে প্রত্যাখ্যান করে বলে - "কাপড় কী হবে কাপড়? লেংটা করতে পারিস, কাপড় পরাবি কেমন করে ? মরদ তুলে?... হেতা কেও পুরুষ নাই যে লাজ করবো। কাপড় মরে পড়াতে দিবোনা...লে কাঁউটার কর ... দ্রৌপদী দুই মর্দিত স্তনে সেনানায়ককে ঠেলতে থাকে এবং এই প্রথম সেনানায়ক নিরস্ত্র টার্গেটের সামনে দাঁড়াতে ভয় পান, ভীষণ ভয় ।" এ এক অনন্য প্রতিবাদের প্রতীক।একটি ছোটগল্প মানব মনের অনুভূতি প্রকাশের বাহক হিসেবে দায়িত্ব নেয়। বিষয় নির্বাচনের জন্য একটি গল্পকারকে অবশ্যই সমাজ মানবতা ও সচেতনতার প্রত্যয়ী হতে হবে, যার একটি সংবেদনশীল প্রতীতি থাকবে যা পাঠক হৃদয়কে সংক্রমিত করে। মহাশ্বেতা দেবীর গল্প গুলি এই দ্যোতনার মধ্যে দিয়ে সমাজে প্রতিবাদে ধ্বজা প্রোথিত করেছে।
১) মহাশ্বেতা দেবী রচনা সমগ্র (দে'জ-২০০৩)
২) প্রান্তিকের কণ্ঠস্বর : মহাশ্বেতাদেবী- বদরুন নাহার
৩) ছোটগল্প সংকলন (ন্যাশনাল বুক ট্রাস্ট, নিউ দিল্লি ১৯৯৩ খ্রিস্টাব্দ)
৪) অজয় গুপ্ত সম্পাদনা মহাশ্বেতা দেবী (দে'জ পাবলিশার্স, কলকাতা ২০০৮ )
৫) সুবোধ দেবসেন-বাংলা কথাসাহিত্যে ব্রাত্য সমাজ, (পুস্তক বিপণি, কলকাতা , ১৪০৫ বঙ্গাব্দ )
৬) শতাব্দী শেষের গল্প- রামকুমার মুখোপাধ্যায়
৭) ভারতের কৃষক বিদ্রোহ ও গণতান্ত্রিক সংগ্রাম -সুপ্রকাশ রায়
৮) বাংলা কৃষক আন্দোলনের ইতিহাস- রসুল সাহেব।
৯) The history of Indian Literature-A Weber
১০) Women's work and Woman's Culture-Sankar Sengupta, Appendix;1970