ইলশেগুঁড়ি ২৯তম সংখ্যা (শারদীয়া)
ইলশেগুঁড়ি ২৯তম সংখ্যা (শারদীয়া)
গল্পের নামটা অন্য রকম হতে পারত। কিন্তু দিলাম না। মানে দিতে পারলাম না। ক্ষমতা নেই। ক্ষমতা হবে কি করে!
মশাই একি আর আমার জ্যোতিষগিরির ঠিকুজি কুষ্টি জন্মছক বানানো?
গল্প লেখা অত সহজ নয়। লিখতে গিয়ে টের পেয়েছি। তাই যাহোক করে একটা নাম দিলাম। আমার ডাক নাম হাবু। সেই নামটা জুড়ে দিয়েই নামকরণ করলাম।
আবার নিজের স্বপক্ষে এও যুক্তি খাড়া করলাম, আরে আমিই কি শুধু বাড়ির একমাত্র কাবু হাবু! বাংলার ঘরে ঘরে কি আমার মতো হাবা হয়ে থাকা, কাবু হয়ে থাকা সংসারী লোক ছড়িয়ে ছিটিয়ে নেই!
তা আমি যদি লিখে আমার মনের ভার হাল্কা করতে পারি তাহলে তারাই বা গল্পটা পড়ে খানিক মন হালকা করতে পারবে না কেন!
তাহলে আসুন সরাসরি গল্পের দিকে আসা যাক।
বউ বঁটিতে কুমড়োর ডাঁটা কাটছে। আমি সামনে বসে। মনে হল কুমড়োর ডাঁটা নয়,আমার রোগা ঠ্যাংদুটোকে জড় করে কাটছে। বউয়ের মুখমণ্ডল রাগে থমথম করছে। হংস ডিম্ব সাইজের চোখে আগুনে গোলার তাপ।
এমনিতেই আমি আবার বঁটি জিনিসটাকে একটু ভয় পাই। মাংস কিনতে গিয়ে দুয়েকজন দোকানদার যখন বঁটি দিয়ে মুরগি কাটে আমার সারা শরীর যেন কেমন কেমন করে। মনে হয় আমাকেই মুরগি ভেবে...
এই মুহুর্তে সেই ভয়টাই আবার আমার সারা শরীরে খেলা করছে।
কারণ আর কিছুই নয়। একটু আগেই বউয়ের সঙ্গে মেগা সিরিয়াল সাইজের ঝগড়া হয়ে গেছে। হয়েছে আরও অনেক কিছু।
পরিস্থিতি এমনিতে ঠিকঠাকই ছিল। হঠাৎ আবহাওয়া পরিবর্তনের মতো বউয়ের মেজাজ গেল পাল্টে। কি কার্য কি কারণ কিছুই মালুম করতে পারলাম না।
তবে এর আগে যতবারই বউয়ের সঙ্গে ঝগড়া হয়েছে খুচখাচ হয়েছে। কিন্তু এবার যেন সবকিছুকে ছাপিয়ে যাওয়ার রেকর্ড পতন।
আজকের এই ছুটির দিনের বিকেলের মিষ্টিমধুর ক্ষণটাতে পর্যন্ত ও ছিল ঘাইহরিণীর মতো। আমিও ছিলাম ওর উজ্জ্বল লাউ বীজ দাঁতের সৌন্দর্যে ঘায়েল আশিক হরিণ। হঠাৎ ও যেন বাঘিনী হয়ে অ্যাটাক্ করল আমাকেই! বাপ রে কি ধারালো নখ! আমার রক্তজবা রঙের পোশাকটা এক টানে ছিঁড়ে ফেলল। আমার গলার রুদ্রাক্ষের মালা এক টানে ছিঁড়ে ফেলল। সেগুলো চারিদিকে মার্বেলের গুলির মতো এখানেওখানে গড়াতে আরম্ভ করল।
আরে আর যা করার করবি কর! কেউ কখনও ব্যবসার জিনিসে হাত দেয়! ছি! ছি!
সেই সঙ্গে সেকি চিৎকার! কাচের জানালাগুলো অবধি ঝন্ ঝন্ করে উঠল। গুমগুম পদভারে কেঁপে উঠতে লাগল মেঝে। তর্জনগর্জনে কেঁপে উঠতে লাগল গোটা বাড়ি!
অমন সুন্দর খোঁপা সমেত বাধাকপি সাইজের মাথাও যে অমন ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে কামানের গোলা টাইপ বাক্য বর্ষন করতে পারে তাকি একবারও আমি ভেবেছিলাম!
আহা কি অসাধারণ স্মরণ শক্তি!
কবে কোন্ কালে কি হয়েছে না হয়েছে সব একেবারে গড়গড় করে আগুন ঝরানো বক্তৃতায় পরিবেশন করে গেল!
কবে কোন্ বাড়িতে গিয়ে হোম যজ্ঞ করার সময় কোন্ মহিলার দিকে ড্যাবড্যাব করে চেয়েছিলাম, কবে শুদ্ধিকরণের নাম করে কোন্ মহিলাকে টাচ্ করেছিলাম, কবে কোন্ আত্মীয়ের নামে দুটো নিন্দেমন্দ করেছিলাম, কবে পাশের বাড়ির বউদির রূপের প্রশংসা করেছিলাম, কবে শ্বশুরবাড়ির কালচার নিয়ে সামান্য কুলকুচি করেছিলাম, সব একধারসে বলে গেল!
আর শুধু এখানেই ব্যাপারটা থেমে থাকেনি। সেই সঙ্গে রীতিমতো ঝড়ের তাণ্ডব চলেছে। চকিতে উড়ে এসেছে হাতা খুন্তি বেলুনি চা ছ্যাঁকার ছাকুনি। দেওয়ালের দিকে উড়ে গিয়েছে কতিপয় বেগুনভাজা। মুসুরির ডাল ভিজিয়ে দিয়েছে বিছানা। তাণ্ডবে ঘটিবাটি হাঁড়ি কড়াই চিড়ে চ্যাপ্টা হবার জোগাড়।
উফ! একমাত্র আমিই যে বেঁচে গেছি এই ভাগ্যি! তাও দুয়েকবার ওই রণচণ্ডী মূর্তি নিয়ে আমার দিকে তেড়ে এসেছিল। তারা মায়ের অসীম দয়া! হাত পা ভাঙে নি। লাস্ট মোমেন্টে রক্ষা পেইচি!
কিন্তু দুঃখ কি কম পেলাম! বুকের ভেতরটা হু হু করে কেঁদে উঠেছে এই ভেবে যে, আহা এই কি সেই কলেজ লাইফের কুহু মিত্র! কি রূপ! কি পেলব ব্যবহার! কি অনন্য রুচি! কলেজের হেন কোনও ছাত্র ছিল না যে ওর প্রেমে না পড়ে নি।
আমি তখন জ্যোতিষ চর্চার কিছু চটি বই পড়ে জ্যোতিষ বিদ্যায় হাত পাকাচ্ছি। দশটা ভবিষ্যৎবাণী বলে যদি দুটোও মেলাতে পারি তাতেই বাজার মাত। এই ছলে গঙ্গার ধারে কলেজের কৃষ্ণচূড়া গাছের তলায় বন্ধু বান্ধবীদের নরম হাতের স্পর্শ নিতাম।
অন্য ছেলেদের তেমন পাত্তা না দিলেও মহিলা মহলে আমার এই পপুলারিটির জোর ধাক্কায় কাত হয়ে পড়েছিল কুহু। এবং সেইসঙ্গে ওর রূপের ধাক্কায়, ওর নরম ব্যবহারে আমিও।
এক দুই নয়, নয় নয় করে ছয় বছর ওর সঙ্গে প্রেম করেছি। জীবনটাকে মনে হত সিনেমা। মুহূর্তকে মনে হত স্বপ্ন। ডানা মেলে শুধু উড়ছি আর উড়ছি। তখন আমার মুখে সবসময় লেগে থাকত গান। হেন কোনও প্রেমের গান নেই, যে গান গাইতে কার্পণ্য করেছি। মারাত্মক প্রিয় ছিল কিশোর কুমারের ‘ও হনসিনি’ গানটা। পাগলের মতো ভালবাসতাম। খুব ভাল লাগতো মহম্মদ রফির খোয়া খোয়া চাঁদ খুলা আসমান অথবা এ আর রহমানের সুরে হরিহরণের গাওয়া তুহি রে তুহি রে তেরে বিনা ম্যায় ক্যায়সে জিউ গানটা।
কিন্তু একি করলে হরি!
সেই মেয়ে আজ পাড়া প্রতিবেশীর সামনে আমার মাথা চিরতরে হেঁট করে দিল! মনের অস্থিরতায় দিশা হারিয়ে ওর কাছে ক্ষমা অবধি চেয়েছিলাম।
কিন্তু ও কি সেটা বুঝল!
তবে মন বলল, এ পর্যন্ত যাইহোক পরিস্থিতি আর স্বাভাবিক হবে না। চান্স নেই।
অগত্যা মনের দুঃখে চলে এলাম এক ব্যাচেলর বন্ধুর বাড়ি। এটা আমাদের বিবাহিত বন্ধুদের আড্ডাখানা।
আমার ডাকনাম হাবু হলেও আসল নাম তারা দাস। বন্ধুমহলে আমাকে তারা ত্রাস বলেও ডাকে। কেননা আমার কুহুরাণী আমাকে হরদম তাড়িয়ে বেড়ান। আগে যতবার ওর সঙ্গে ঝগড়া অশান্তি হয়েছে আমি ততবার সবিস্তারে এ মহলে সেসব বর্ণনা করেছি।
এবং আমি এও জানি, যতই আমি আমার জ্যোতিষের চেম্বারে বসে লোকজনকে নানান কায়দায় ভয় দেখিয়ে আমার ব্যবসা গোছাই না কেন, ভেতর ভেতর আমি খুব ভীতু মানুষ। তাই আজ আড্ডায় এসেই চোখের জল ফেললাম। আড্ডার বন্ধু রীতেশ বলে, ‘‘ছ্যা ছ্যা তারা তুমি না তান্ত্রিক! তায় আবার পিশাচ সিদ্ধ। যারা তন্ত্রসাধনা করে তারা আবার বউকে ভয় পায় নাকি? কোথায় তোমার পিশাচসিদ্ধ সত্তা? তুমি যেভাবে বেঁচে আছো সে-তো আলুর ভর্তা! কেন বউকে শায়েস্তা করতে পারছ না?’’
আমি ছন্দ মিলিয়ে বলি, ‘‘ভায়া বউয়ের অশরীরী কায়া, পোকার মতন আঙুলে তোলেন ভুলে বেবাক মায়া! আমি তো কোন ছার, পৃথিবীর হেন কোনও পুরুষ মানুষ নেই যে মান সম্মানের ভয়ে বউকে ভয় না পায়। ঝগড়ার সময়ে বউকে মনে হয় তাড়কা রাক্ষসী। মুখ দিয়ে যেসব অসভ্য বাক্য বের করে তার সামনে টেঁকে কার সাধ্যি! যার মধ্যে কুযুক্তি আর ভারসাম্যহীন আচরণের মালমশলায় ঠাসা!’’
‘‘আর বউ?তাদের বুঝি কোনও মানসম্মান জ্ঞান নেই?’’
‘‘না। বউয়েরা হল মহাজ্ঞানী মহামানব পর্যায়ের। ওদের এসব সামান্য জিনিসের জ্ঞান বোধ থাকে না। পুরুষ মানুষের সঙ্গে বিয়ে হবার আগে তারা থাকে একরকম আর বিয়ের পর হয়ে যায় সম্পূর্ণ আলাদা রকম। হরবখত খালি জ্ঞানের বাণী।’’
দীনেশ বলল, ‘‘ব্রাদার, তোমার উপমাটা পছন্দ হল না। কোথায় মহাজ্ঞানী মহামানবগণ আর কোথায় তোমার বিগড়ে যাওয়া বউ!’’
‘‘সে উপমা তোমার পছন্দ না হতেই পারে কিন্তু এ কথাটা সত্য যে বউয়েরা হল গিয়ে যিশু বুদ্ধ কনফুসিয়াস সক্রেটিস প্লেটো সহ সব বড় বড় মহাপুরুষের কম্বিনেশন! পারলে তারও ওপরে। কেন জানো? একমাত্র এইসব মহাপুরুষদের কাছাকাছি গেলে তবেই এদের জ্ঞানের বাণী আমরা পাই কিন্তু বউ সর্বক্ষণ কানের কাছে টিকিরটিকির করে জ্ঞান শোনাতেই থাকেন। সেইসঙ্গে চলে মেন্টাল টর্চার। প্রয়োজন বুঝে মারধর।’’
‘‘বল কি? মামলা অ্যাদ্দূর গড়িয়েছে! থানা পুলিশ করো নি?’’
‘‘করি কোন্ লজ্জায় বল দেখি? থানার বড়বাবুই যে আমার কাস্টমার। মাঝেমধ্যেই আসেন গৃহ শান্তির রক্ষাকবচ চেয়ে। ওর বউ? সে এক যন্ত্র। পুলিশের বউ হয়ে চোরের সঙ্গে প্রেম করছে। রোজ অশান্তি।’’
‘‘কেন পুলিশ হয়ে চোরকে ধরতে পারছে না!’’
‘‘এ যে সে চোর নয়! বড় ধরনের চোর। রাত্তিরে কালো রং মেখে চুরি করে। দিনে পার্টিপলিটিক্স করে। মাঝেমধ্যে ওই পুলিশকেই নিজের বউকে সেই চোরের হাতে তুলে দিয়ে আসতে হয়!’’
‘‘এই সেরেছে! তাহলে তো সব মানসম্মান গন ফট্!’’
‘‘ঠিক তাই। কিন্তু হতভাগা পুলিশের কিস্যু করবার ক্ষমতা নাই! মুস্কিল হল এত কিছুর পরেও ও বউটাকে ভালবাসে।’’
‘‘যাঃ! তা আবার হয় নাকি!’’
‘‘এই তো এই সময়ের ট্রেণ্ড! যার বউ যত বেশি দুষ্টু তার স্বামী তত বেশি করে বউ ভক্ত। এই কারণে কারওর বউ পালালে সেই বউকেই আবার সংসারে ফিরিয়ে আনার জন্য স্বামীর সেকি কুঁইকাঁই! আবার সে বউ দিব্যি ফিরেও আসে। দিব্যি সংসারটংসারও করে। আকছার হচ্ছে। যাইহোক ওই পুলিশটাকে পারিবারিক অশান্তি দূর করার আংটি দিয়েছি। বাস্তু দোষ কাটানোর যজ্ঞ পর্যন্ত করে এসেছি ওর বাড়িতে। এখন আমিই যদি আমার বউয়ের বিরুদ্ধে ওর কাছে থানায় নালিশ করতে যাই, ব্যবসা মার খাবে না?’’
‘‘ঠিক। কথাটা ঠিক।’’
‘‘তাছাড়া আমি কি শুধু আমার কথাই বলছি? তা তো না। সমগ্র পুরুষ সমাজের হয়ে কথা বলছি।’’
‘‘হুম। খুব বুঝেছি। তা তোমার বশীকরণ মন্ত্রের কি হল? ওই যে কথায় কথায় টিভিতে খবরের কাগজে বড় বড় ফ্লেক্স ব্যানারে বিজ্ঞাপন ঠোকো, এক মিনিটে তীব্র বশীকরণ বিফলে মূল্য ফেরত, সেসব কি লোক ঠকানো?’’
‘‘আর বল কেন। আমরা যারা জ্যোতিষ তন্ত্রমন্ত্রের চর্চা করি সে কেবল সাধারণ মানুষের উপকারের জন্য। সেগুলো নিজেদের ওপরে কাজ করে না। গুরুর আদেশ।’’
‘‘বল কি!’’
‘‘তবে আর বলছি কি। নাহলে যে কৃষ্ণ সবার রক্ষা কর্তা সেই কৃষ্ণই কিনা সামান্য ব্যাধের হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারেন না?’’
বিমল বলল, ‘‘যাক ছাড়ো ওসব কথা। সত্যি বলতে আমাদের মধ্যেকার কেউ কি বউকে ভয় না পেয়ে বেঁচে আছে! ভালবাসার অপর নাম হল ভয়। ভালবাসা একটু বেশি হলে পকেট খরচের ভয়, কম হলে বেইজ্জতের ভয়। আসলে বউয়েরা আমাদের ভালবাসে না। ভালবাসে আমাদের মাস মাইনে আর বাড়ির বেড়ালকে।’’
দীনেশ বলল, ‘২হাঃ হাঃ হাঃ। যা বলেছিস! যাক এখন এক দান কলব্রিজ হয়ে যাক!’’
আড্ডার সব্বাই সমস্বরে কলব্রিজের পক্ষে রায় দিল। তাস খেলতে খেলতে রাত বারোটা বেজে গেল। যার বাড়িতে আড্ডা সেই বিপত্তারণ মিশ্রের বাড়ি থেকে বেরোতে বেরোতে রাত প্রায় সাড়ে বারোটা বাজল।
ওদিকে একেই অমাবস্যা, তায় লোডশেডিং।
আমার বাড়ির রাস্তা আবার অন্যদিকে। আর সব্বাইয়ের বাড়ির রাস্তা আরেক দিকে।
এলাকাটা বড় নির্জন। ঝোপঝাড় বাঁশঝাড় শ্যাঁওড়াগাছে ঘেরা একটা পুরনো বাড়ি। সেখানে প্যাঁচা বাদুড় চামচিকের বাস।
উফ্! আমি আবার আজই একটা গণ্ডগোল পাকিয়ে বসে আছি। গুরুর দেওয়া রক্ষাকবচটা পড়তে গেছি ভুলে। হাতে যে আংটিগুলো রয়েছে তাতে দু’চারটে গ্রহদোষ হয়তো কাটতে পারে কিন্তু ভূতের হাত থেকে বাঁচার কোনও নিদান নেই।
এরই মধ্যে শন্ শন্ করে হাওয়া ঝোড়ো হাওয়া দিতে আরম্ভ করেছে। কথা নেই বার্তা নেই একি অলুক্ষুণে কাণ্ড!
আমার রীতিমতো ভয় করতে শুরু করল। কেননা ওই রাস্তার পাশে যে শ্যাওড়া গাছ তাতে একটা ভূত থাকে।
ব্যাটা হাড় বজ্জাত। যার তার ঘাড়ের কাছে, কানের কাছে শিরা উপশিরায় ঠান্ডা বাতাস ছড়িয়ে দেয়। ক্ষণে ক্ষণে হা হা হা হো হো হো করে এমন পিলে চমকানো হাসি হাসে যে বাচ্চা থেকে বুড়ো সবাই কেঁদে ফ্যালে।
এলাকার কতজন যে ওর ভয়ে হার্টফেল করে মারা গেছে, কতজন যে ভয় পাওয়ার পর উন্মাদের পর্যায়ে চলে গেছে তার ইয়ত্তা নেই। শোনা যায় কয়েকজন এলাকাবাসীর ঘাড়ও নাকি মটকে দিয়েছে এই খচ্চর ভূতটা।
এছাড়াও আমার ভয় পাবার আরেকটি কারণ হল এর আগে আমি ওই গেবো ভূতের বাপ হেবো ভূতকে তন্ত্রমন্ত্র বলে, বাড়িতে গেঁড়ে বসে থাকা এক ব্যক্তির বাড়ি থেকে তাড়িয়ে ছিলাম। সেই বাপ নিশ্চয় ছেলেকে একথা জানিয়েছে। তার উপর এমন অসময়ে ছেলের স্যাঙাত্ হয়ে সেই ধাড়ী বজ্জাতও যে হাজির হবে না তার কি মানে!
অথচ আমার বাড়ি যাবার এই একটিই মাত্র রাস্তা। হায় হায়! কি যে করব ছাই ভেবেও পাচ্ছি না। এদিকে বউয়ের ভয়ে পালিয়ে আসার সময় মোবাইলটাও আনতে গেছি ভুলে। কাজেই কোনওরকম আলোর বন্দোবস্ত করা গেল না।
অবস্থা এমনই বেগতিক যে আমাকে একইসঙ্গে বউয়ের ভয় এবং ভূতের ভয় এই দুই ভয়ই অ্যাটাক্ করল।
ভয়ে পড়িমরি করে ছুট লাগালাম আমি। ছুটে যেই সেই শ্যাওড়াগাছটার কাছাকাছি এসেছি অমনি কোত্থেকে বিকট হাসির শব্দ কানে এল।
সেই সঙ্গে সেকি সাংঘাতিক কাণ্ড!এক্কেবারে আমার চোখের সামনেই গাছের ডালে দু ঠ্যাং দুলিয়ে ভূতটা ভয়াঙ্কর হাসছে হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ।
উফ! ভয়ে আমার বুকের ভেতর ধড়াস্ ধড়াস্ করতে আরম্ভ করল। হাত পা কাঁপতে লাগল। মাথাটা বোঁ বোঁ করে ঘুরতে আরম্ভ করেছে, আরেকটু হলেই ভয়ে মূর্ছা যেতাম অমনি কোত্থেকে কি যেন কি একটা হয়ে গেল। ভূতের হাত থেকে বাঁচতে ত্রাস সঞ্চারী কণ্ঠে উচ্চারণ করতে চেয়েছিলাম রাম রাম। তার বদলে আমার মুখ থেকে বেরোল—‘‘বউ! বউ!’’
অমনি দেখি কোথায় কি!দেখি সেই ভূতটা উধাও!
ভূত উধাও হতেই আমি পড়িমরি করে ছুটে গিয়ে বাড়ির দোরের কাছে গিয়ে মূর্ছা গেলাম।
বউকে সবটা বলিনি। বলা সম্ভব! বলা কি সম্ভব যে তোমার ভয়েই এতসব কাণ্ড!
তবে ভূতে ভয় পাওয়ার কথাটা বলেছি।
আমি এখন ভাল আছি। তবে আমার বউকে কথা দিয়েছি দিনকতক শেওড়াফুলি মেচেদা বর্ধমান বেহালার চেম্বারে জ্যোতিষগিরি করব না। আর এরইমধ্যে বাড়িতে ভাল করে হোম যজ্ঞ করে, বাড়ির চারধারে মন্ত্রপূত লোহার গজাল পুঁতে,একেবারে ফুল প্রোটেকশন নিয়ে রেখেছি। এখন আমার গলা বুক বাহু ভর্তি তাবিজ কবচ। দশ আঙুলে
দশ আংটি।
আচ্ছা এমন কেন হল! ভূতটা আমাকে বাগে পেয়েও ছেড়ে দিল কেন! ওই কয়েকদিন বাড়িতে বসে শুধু একবার নয় বারবার সেইদিনের সেই ভয়ঙ্কর মুহূর্তটার বিষয় নিয়ে ভেবেছি।
সেদিন অমন চরম মুহূর্তে ভূতটা ইচ্ছে করলেই তো আমার ঘাড় মট্টাং করে মটকে ফেলতে পারতো। ইচ্ছে করলেই পুকুরের পাঁকে পুঁতে ফেলতে পারতো। কিন্তু কি এমন হল যাতে ভূতটা আমার ঘাড় না মটকে আমাকে ছেড়ে দিয়ে সেই মুহূর্তে উধাও হয়ে গেল! কি এমন কারণ যার জন্য ভূতটা ভয় পেয়ে পালিয়ে গেল!
নিজে অনেক ভেবে কুল কিনারা না পেয়ে, শেষে আমার তন্ত্রসাধক জ্যোতিষ ভাই ব্রাদারদের কাছে জানতে পারলাম আসলি কাহানি।
বেশ কিছুদিন ধরেই নাকি সেই ভূতব্যাটা এ তল্লাট ছেড়ে চলে গিয়েছিল। কিন্তু সেদিন তার সঙ্গে তার বউয়ের বিকট ঝগড়া হওয়াতে বউ তাকে নতুন জুতো মুড়ো ঝাঁটা আড় মাছের কাঁটা দিয়ে বেধড়ক ঠ্যাঙাচ্ছিল। মার খেতে খেতে কোনওক্রমে পালিয়ে সে ওই শ্যাওড়াগাছে আস্তানা গেড়েছিল।
ঠিক ওই মোমেন্টে সেই ভূতটা তার দজ্জাল বউয়ের কথা যতই ভাবছিল ততই তার হাত পা ঠাণ্ডা হবার জোগাড় হচ্ছিল। সে ভাবছিল এই ভয়ঙ্কর ভয়ের হাত থেকে কিভাবে উদ্ধার পাওয়া যায়? এমন সময় গাছের তলায় আমাকে দেখতে পেয়ে সে ভাবল কোনও মানুষকে ভয় দেখাতে পারলে হয়তো তার নিজের ভয়টা একটু কেটে গেলেও যেতে পারে।
যথারীতি কাজও সেইভাবেই এগোচ্ছিল কিন্তু সেই মুহূর্তেই অজান্তে আমি যে সেই বউ নামক শমনেরই নাম ফেঁদে বসব,সে কি আর তা জানত!