ইলশেগুঁড়ি ২৯তম সংখ্যা (শারদীয়া)
ইলশেগুঁড়ি ২৯তম সংখ্যা (শারদীয়া)
রাকেশ, শ্যামল আর মলয় তিনজনে হরিহর আত্মা বন্ধু। মহেশপুরের সকলে বলে, ওদের একের গলায় জল ঢাললে তিনজনাই ঢোঁক গেলে। প্রতিদিন ইস্কুল শেষ হওয়ার বেশ খানিক পরে ওরা ক্লাসরুম থেকে বেরোয়। ওদের গল্প যেনো শেষই হতে চায় না। শুধুমাত্র বন্ধুত্বের টানে মাধ্যমিক পাশ করার পর তিনজনেই কমার্শ নিয়ে উচ্চমাধ্যমিক পড়েছে। আশ্চর্যজনক ভাবে, তিনজনের গড়পড়তা মেধাও এক। ওদের তিনজনের এমন গভীর বন্ধুত্বকে পরিবারের লোকজনও বেশ প্রশ্রয় দেয়। আজকের স্বার্থপর সমাজে এই তিনজনের নিঃস্বার্থ বন্ধুত্ব দীর্ঘজীবী হোক, ওদের শুভাকাঙ্ক্ষীদের হাবভাব অনেকটা সেরকমই।
উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার পরে তিনজনে মিলে এই প্রথম, বাইরে কোথাও একসাথে বেড়াতে যাবে বলে ঠিক করলো। যেমন ভাবা তেমন কাজ। অধিকাংশ ভ্রমণ প্রিয় বাঙালীর প্রথম গন্তব্যস্থল যেমন সমুদ্র, ঠিক তেমনই এই তিন ছাত্রও তাদের জীবনের প্রথম অভিভাবকহীন বেড়ানোর জায়গা হিসাবে সমুদ্রকেই বেছে নিল। নিজ নিজ বাড়ি থেকে তারা অনুমতিও পেয়ে গেলো।
বেড়াতে গেলেও তাদের সমুদ্রে দাপাদাপি করার বিশেষ ইচ্ছে নেই। বরং, কোলাহল থেকে বেশ খানিক দূরে নির্জনে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করার পাশাপাশি, তিন বন্ধু মিলে নিখাদ আড্ডাই তাদের ভ্রমণের মূল হেতু। তাই, তারা গন্তব্য স্থল হিসাবে দীঘার পরিবর্তে তাজপুরকে বেছে নিল।
প্রি বুকড হোটেলে পৌঁছানোর পর তাদের আড্ডা শুরু হয়ে গেল। শ্যামল ইদানীং সহপাঠিনী বিনিতা’র প্রেমে পরেছে। বিনিতার দিক থেকেও যথেষ্ট ইতিবাচক সাড়া আছে। শ্যামল-বিনিতা জুটির রসায়নই এখন আড্ডার মুখরোচক টপিক। বিনিতা বেশ ধনী পরিবারের মেয়ে। তাই শ্যামল ভালো চাকরি না পেলে, বিনিতার সাথে চলা প্রেম কাহিনীর সফল পরিণতি প্রায় অসম্ভব। শ্যামল আবার বিনিতাকে ছাড়া তার বাকি জীবন ভাবতেও পারে না। তাই তাকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব চাটার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট হতেই হবে। বিনিতার সাথে শ্যামল যেদিন প্রথম ডেটিংয়ে গিয়েছিল, সেদিনের ইতি বৃত্তান্তই আজকের আড্ডার মূল খোরাক।
সমুদ্রের দেশে বেড়াতে এসে যতই আড্ডা চলুক, পায়ে জল তো একটু লাগাতেই হয়। পরের দিন ভোরবেলা তিন বন্ধু অবশেষে সমুদ্রে নামলো। শ্যামল বাদে আর দুই বন্ধুর কেউই সাঁতার জানে না। তাই, সমুদ্রের খুব বেশী গভীরে তারা যাবে না। এরকম একটা সংকল্প তারা নিল। ঢেউয়ের নেশা উপেক্ষা করা যে বেশ শক্ত, তা তারা আঁচ করতে পারেনি। এক পা-দু পা করে বেশ খানিক দূরে তারা চলে গেছে। যদিও তারা তিনজনে একসাথেই আছে। একে অপরের হাত শক্ত করে ধরে আছে। অজানা চোরাগোপ্তা ঢেউ সম্পর্কে এদের ধারণাই বা কতটুকু! রাকেশ একসময় অনুভব করলো, তার বাঁ হাতটা ফাঁকা। ঐ হাতটা মলয় ধরেছিল। হঠাৎ আসা একটা বড় ঢেউ সব এলোমেলো করে দিয়েছে। রাকেশ এখন শ্যামলের থেকেও বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। মলয় আর শ্যামল এখনও হাত ধরাধরি করে আছে। কিন্তু, তারা দুজনের কেউই রাকেশকে দেখতে পাচ্ছে না। কিছুক্ষণ বাদে আবারও একটা বড় ঢেউ এসে, মলয় আর শ্যামলকে আলাদা করে দিল। এখন জলের উত্তাল স্রোতে কেউ কাউকে দেখতে পাচ্ছে না। শ্যামল দুই বন্ধুর খোঁজে দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে এগিয়ে চলেছে। তার তখন পাগল পাগল অবস্থা। দুই বন্ধুকে খুঁজে বার করতেই হবে। এর অন্যথা হলে, ভবিষ্যত ঘটনাপ্রবাহ ভেবে তার বুক শুকিয়ে যাচ্ছে। সহসা বাইরে থেকে আসা একটা হাত, তার ডান বাহুটা শক্ত করে চেপে ধরলো। শ্যামল ঘাড় ঘুরিয়ে অজানা এক ব্যক্তিকে দেখতে পেল। শ্যামলের বিধ্বস্ত চেহারা দেখে আগন্তুক তাকে জিজ্ঞাসা করলো
- কোথায় যাচ্ছ?
- আমি আমার দুই বন্ধুকে খুঁজছি। তারা স্রোতের টানে হারিয়ে গেছে।
- তুমি কি পাগল হয়ে গেছো?
-কেনো?
- তুমি সমুদ্রের বিপজ্জনক সীমানার মধ্যে ঢুকে পরেছ। এখানে সাধারণের আসা নিষেধ। আমরা জেলেরা শুধুমাত্র মাছ ধরার জন্য ট্রলার নিয়ে এখানে আসতে পারি।
- আমার দুই বন্ধুকে তুমি দেখেছ?
- কে কাকে দেখেছে গো। একটু আগে হঠাৎ আসা জোয়ারে সব লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে। সমুদ্রের চোরা বালি বহুজনকে টেনে নিয়ে চলে গেছে গো।
- মানে! বুঝলাম না। আমার বন্ধুদের কিভাবে পাব, সেটা বলো।
- সমুদ্র কাউকে ধরে রাখে না। সবাইকে ফিরিয়ে দেয়। তুমি পাড়ে অপেক্ষা করো। তোমার বন্ধুদের অবশ্যই পেয়ে যাবে। চলো, আমি তোমায় হাত ধরে পাড় অবধি এগিয়ে দিই।
শ্যামলের মনটা এবার কু গাইছে। তার খালি মনে হচ্ছে, বড় কিছু একটা অঘটন ঘটেছে। হ্যাঁ, অঘটন সত্যিই ঘটেছে। তাজপুর সী বীচে হড়পা বানে নিহত পাঁচ জনের মধ্যে মলয় ও রাকেশও আছে। প্রশাসনিক সাহায্যে উভয়ের ভগ্ন হৃদয় অভিভাবকদের সান্নিধ্যে, রাকেশ ও মলয়ের নিথর দেহ গ্রামে ফিরল।
শ্যামল দুই নিষ্প্রাণ বন্ধুর মাথার কাছে চুপচাপ বসে আছে। ঘটনার আকষ্মিকতায় বিহ্বল শ্যামল বাকরুদ্ধ হয়ে পরেছে। মৃত পরিবারের স্বজনরা শোকে আকুল হলেও, শ্যামলকে সেভাবে কেউ দোষারোপ করছে না। কিন্তু, সে নিজে অন্তরের জ্বালায় শেষ হয়ে যাচ্ছে। যদিও সে এখন এসব জাগতিক বোধবুদ্ধির অনেক বাইরে। প্রকৃত রুক্ষ ঘটনার বাস্তবতা, হতবাক শ্যামল কিছুতেই আত্মস্থ করতে পারছে না। বিগত দুদিনে সে এক ফোঁটাও চোখের জল ফেলেনি। নিদারুণ বাস্তবতার নিষ্ঠুর আঘাতে, সে আদপেই পাথর হয়ে গেছে। তিনজনের নিখাদ আড্ডা এখন শুধুই স্মৃতি, এটা সে কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না। রাকেশ আর মলয়ের সাথে এই জীবনে তার আর কখনও দেখা হবে না, এটা সে কিছুতেই হৃদয়ঙ্গম করতে পারছে না। মৃত্যুর পর জলজ্যান্ত প্রিয় মানুষগুলো আচমকাই ভ্যানিশ হয়ে যায়, এটা সে জানলেও এতো কাল উপলব্ধি করতে পারেনি। আজ ঘটনা পরম্পরায় সে হঠাৎ করেই সব বুঝে গেছে। বিগত চারদিন সে কারোও সাথে কথা বলেনি। নামমাত্র কিছু খেয়েছে বললেও ভুল হবে, পরিবারের লোকেরা জোর করে তাকে খাইয়েছে।
আজ রাকেশ ও মলয়ের শ্রাদ্ধানুষ্ঠান। অপঘাতে মৃত্যুর রীতিনীতি মেনে যথাযথ দিনক্ষণ স্থির হয়েছে। যতই দুঃখের মৃত্যু হোক না কেন, হিন্দু শাস্ত্র মেনে পারলৌকিক ক্রিয়াদি তো সম্পন্ন করতে হবে। দুই পরিবারের মানুষজন ভগ্ন হৃদয়েও তাদের সাধ্য মত আয়োজন করেছে। কিন্তু, সকাল থেকে শ্যামলকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। কাকভোরে সে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেছে। দুই বন্ধুর বিদেহী আত্মার শান্তি কামনার্থে যে ধর্মীয় অনুষ্ঠান, সেখানেও তাকে দেখা যাচ্ছে না। তাহলে শ্যামল গেলো কোথায়?
শ্যামল নিজের অজান্তে এক অজানার উদ্দেশ্যে পাড়ি দিয়েছে। সে নিজেও জানে না, সে কোথায় যাচ্ছে। উদভ্রান্তের মত হেঁটে চলেছে। প্রকৃতির চেহারাও তথৈবচ। ঈষাণ কোণে জমাট বাঁধা মেঘ জানান দিচ্ছে, কিছুক্ষণের মধ্যেই অপার বারি ধারা বর্ষিত হবে। অচিরেই, দুই ছাত্রের অকাল মৃত্যুর শোকে নিষ্ঠুর প্রকৃতিও, তার কান্নার বাঁধ ধরে রাখতে পারলো না। অহরহ বৃষ্টির সাথে মুহুর্মুহু বজ্রপাতে প্রকৃতিও জানান দিচ্ছে, নিয়তির এই অমোঘ ডাক অভিপ্রেত ছিল না। প্রকৃতির এই রোষানলেও শ্যামল নিশ্চুপ নিস্তরঙ্গ। ভাবলেশহীন মুখে সে এগিয়েই চলেছে। নির্বিকার চিত্তে বন্ধুহারা এক নি:সঙ্গ তরুণ এগিয়ে চলেছে উদ্দেশ্যহীনের পথে। আশেপাশে বজ্রপাতে শ্যামলের চোখ ঝলসে যাচ্ছে। সে খানিক দূরে একটা অর্ধসমাপ্ত বাড়ি দেখতে পাচ্ছে। এই বাড়িটা তার খুব চেনা। এই বাড়িতে তারা তিনজনে প্রায়শই আড্ডা দিতে আসতো। শ্যামল আস্তে আস্তে বাড়িটার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। প্রকৃতি আজ যেনো রুদ্রমূর্তি ধারণ করেছে। ইন্দ্র দেবের রোষানলে আজ সব ছারখার হয়ে যাবে। শ্যামল তার ক্লান্ত অবসন্ন শরীরটাকে আর চালিয়ে নিয়ে যেতে পারছে না। বাড়ির সামনে এসে সে ধপ করে বসে পরলো। তার দুচোখ বুজে আসছে। কল্পনার চোখে সে রাকেশ আর মলয়কে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে। তাদের নিখাদ আড্ডা আবার শুরু হয়েছে। ওরা আবার বিনিতা কে নিয়ে তাকে রাগাচ্ছে। বিনিতার সাথে শ্যামলের নেক্সট ডেটিং কবে জানতে চাইছে। বিনিতাকে সে কবে বিয়ে করবে, সেটা জানতেও ওরা দুজন খুব উৎসাহী। বিনিতাকে প্রোপজ করার পর তার রিঅ্যাকশন কি ছিল, সেসবও জানতে চাইছে। বিয়ের পর ফ্যামিলি প্ল্যানিং সংক্রান্ত চিন্তাভাবনা নিয়েও ওরা শ্যামলকে খেপাচ্ছে। শ্যামল দৃঢ় ভাবে জানে, ওরা দুজনে যতই বিনিতার সাথে তাকে জড়িয়ে খেপাক, বিনিতা সামনে এলে ওরা বিনিতাকে ভাবি’র সন্মানই দেবে। এখানেই বন্ধুত্বের মহিমা। তাই তো ওদের তিনজনকে মহেশপুরের সবাই থ্রি মাস্কেটিয়ার্স বলে। শ্যামলও ছেড়ে কথা বলছে না। মাঝেমধ্যেই ওদের দুজনের উদ্দেশ্যে চোখা চোখা বাক্যবাণ ছুঁড়ে দিচ্ছে। ‘‘তোরা যে আমার মত ভাগ্যবান কবে হবি!’’ ইত্যাদি। ওরা তিনজনে আড্ডা শুরু করলে সময়ের খেয়াল থাকে না। আজও তার অন্যথা হচ্ছে না। সময় তার নিয়মে চললেও আড্ডা শেষ হচ্ছে না।
প্রকৃতি এখন অনেক শান্ত। আকাশ হালকা মেঘাচ্ছন্ন। কিন্তু, বৃষ্টি পুরোপুরি থেমে গেছে। সূর্য পশ্চিম আকাশে দিনের শেষ কিরণ ছড়াচ্ছে। এমতাবস্থায়, হঠাৎ শ্যামলের ঘুমটা ভেঙে গেলো। সে বোধহয় এতক্ষণ কোনো স্বপ্ন দেখছিল। আশেপাশে রাকেশ বা মলয়কে সে দেখতে পাচ্ছে না। বরং, সামনে বিনিতা সহ বেশ কিছু পরিচিত জনকে দেখতে পাচ্ছে। ওরা বোধহয় শ্যামলকে খুঁজতে এসেছে। বিনিতাকে দেখে শ্যামলের মনটা ফুরফুরে হয়ে গেলো। তার নিজেকে এখন অনেক হালকা লাগছে। এতোদিন একটা চাপা অনুশোচনায় মনটা ভারাক্রান্ত ছিল। এখন নিজেকে অনেক শান্ত ও স্থিতধী মনে হচ্ছে। সে আজ বিনিতার হাত ধরেই বাড়ি ফিরবে। বিনিতাকে একটু স্পর্শ করার সাধটা সে আজকেই মিটিয়ে নেবে। এক অপার সাহস তার মনে আজ ভর করেছে। সে বিনিতাকে ডাকছে, ‘‘বিনি আমি এখানে’’। বিনিতা কোনো সাড়াশব্দ দিল না। শ্যামলের বিনি কি অভিমান করেছে? করতেই পারে, অভিমান করাটাই স্বাভাবিক। সে এই কদিন যা কান্ডজ্ঞানহীনের মত কাজ করেছে। সেসব ভেবেই এখন শ্যামলের কেমন লজ্জা লাগছে। শ্যামল আরোও জোরে ডাকছে, ‘‘বিনি আমি এখানে’’। তাতেও বিনির কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। বিনি যেন শ্যামলকে পাত্তাই দিচ্ছে না। অন্য একজনের সাথে কথা বলেই যাচ্ছে। বিনি কি শ্যামল কে অ্যাভয়েড করছে? তাহলে বিনি তাকে খুঁজতে এতোদূরে এলো কেন? অভিমান একটু করতেই পারে, তা বলে বিনির এতোটা বাড়াবাড়ি করা কি ঠিক হচ্ছে! শ্যামল তো ওর কাছে ক্ষমা চেয়েই নেবে। এবার শ্যামল তার সর্বশক্তি প্রয়োগ করে চেঁচালো, ‘‘বিনি আমি এখানে, তুমি কি শুনতে পাচ্ছ না!’’ তাতেও বিনি নির্বিকার ও নিরুত্তর। এবার শ্যামলের ধৈর্য্যের বাঁধ ভাঙলো। সে আবার কিছু একটা বলতে যাচ্ছে, এমন সময় পাশ থেকে কে একজন বলে উঠলো, ‘‘ওরে বোকা ছেলে, আমরা সবাইকে দেখতে পাই কিন্তু আমাদের কেউ দেখতে পায় না’’। শ্যামল স্পষ্ট বুঝতে পারলো, এটা মলয়ের গলা।
পরের দিন সকালে সবকটা দৈনিক বাংলা সংবাদ পত্রের পাঠক চা খেতে খেতে একটা সংবাদ পড়লো, ‘‘গতকাল দুপুরে বজ্রপাতে মহেশপুর এলাকায় এক কিশোরের মৃত্যু হয়েছে’’।