ইলশেগুঁড়ি ২৯তম সংখ্যা (শারদীয়া)
ইলশেগুঁড়ি ২৯তম সংখ্যা (শারদীয়া)
আর কেউ যদি অধ্যাত্মপথে অগ্রসর হয়, তাহলে কোনও কথা থাকে না। সে তো অমৃতের রাস্তা, নিজে মুক্ত হব ভববন্ধন থেকে এবং অপরকেও মুক্ত করব। মানুষকে আত্মসম্পদ দান তথা অধ্যাত্মসম্পদ দান মহাদান, সর্বশ্রেষ্ট দান।
বাংলায় ভ্রমণকাহিনীর অভাব নেই। বঙ্গ-লেখকদের অনেকে শুধুমাত্র ভ্রমণকাহিনী লিখেই সাহিত্যিক মর্যাদাপ্রাপ্ত হয়ে গিয়েছেন। সেইসব সাহিত্যিকদের ভ্রমণ-কথা নিয়ে অনেক আলাপ-আলোচনা, চিন্তা-চর্চা করেন তথাকথিত সাহিত্যরসিকদের একাংশ। কিন্তু বাংলা ভাষায় লেখা একটি ভ্রমণকাহিনী যে কেবল বাংলা নয়, বিশ্বের অন্যতম সেরা এ জাতীয় রচনা হিসেবে স্বীকৃত হতে পারে, সে খবরটা অনেকে রাখেন না। বলছি স্বামী বিবেকানন্দের ‘পরিব্রাজক’ গ্রন্থটির কথা। অবশ্য ‘পরিব্রাজক’-কে কেবল ভ্রমণ-বিবরণ বললে কিছুই বলা হয় না; ভ্রমণের সঙ্গে সঙ্গে এখানে লেখকের অসামান্য ইতিহাস-চেতনা, পাণ্ডিত্যের ব্যাপ্তি, অলোকসামান্য বিশ্লেষণ সুচারুভাবে ফুটে উঠেছে।
গ্রন্থটি আকারে কিছু বৃহৎ। অধ্যায় অনেকগুলি। একটি টানা ভ্রমণকাহিনী হিসেবে এটিকে না ধরাই উচিত। বরং নানাস্থানের পৃথক পৃথক ভ্রমণের কথা হিসেবে এটিকে বিবেচনা করা যেতে পারে।
‘ভূমধ্যসাগর’ এই গ্রন্থের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। অবশ্য গ্রন্থটির কোনও অংশই গুণমানে ন্যূন নয়। পাঠক যে-কোনও স্থান থেকে পড়া শুরু করতে পারেন, ঠকবার ভয় নেই। যাই হোক, কোনও মূল রচনা এবং তার অনুবাদ যে কতখানি পার্থক্য সূচিত করে অনেক ক্ষেত্রে, স্বামীজি এই অধ্যায়ে তার একটি বিবরণ দিয়েছেন। বিশেষত ধর্মগ্রন্থের ক্ষেত্রে এ বিষয়ে খুব সচেতন হওয়া দরকার। লেখক এবং অনুবাদকের মানসিকতা যদি মিলে যায়, সেক্ষেত্রে হয়তো অসুবিধে নেই। কিন্তু যদি তা না হয়ে থাকে, সেক্ষেত্রে যিনি অনুবাদ পড়ছেন, অনেক সময় তাঁর ঠকে যাওয়ার সম্ভাবনা। মিশর প্রত্নতত্ত্ব-বিশেষজ্ঞ গাস্তঁ মাসপেরো মিশর ও ব্যাবিলনের ইতিহাস রচনা করেছেন। সেই গ্রন্থের ইংরেজি তর্জমা করেছেন জনৈক ইংরেজ প্রত্নতত্ত্ববিদ, যিনি গোঁড়া খ্রিস্টান। স্বামীজির এই ইংরেজি গ্রন্থটি পড়া ছিল। কিন্তু মূল বইটি যখন হাতে আসে, দেখলেন, যে-সব জায়গায় মাসপেরোর অনুসন্ধান খ্রিস্টধর্মকে আঘাত করে, সে-সব জায়গার অনুবাদ অন্যরকম করা হয়েছে। এই জাতীয় গ্রন্থপাঠে লাভ কতটা কী হবে, বলাই বাহুল্য। আবার পাশ্চাত্য পণ্ডিতদের দেখা যায়, হিন্দুদের ধর্ম পুস্তকগুলিকে নির্মমভাবে তাঁরা বিশ্লেষণ করেন, এবং অধিকাংশ সময়েই সেইসব পুস্তকের বিরুদ্ধে মত প্রদান করে শ্লাঘা অনুভব করেন। স্বামীজি তাঁদের উপদেশ দিচ্ছেন, ইহুদি ও খ্রিস্টান ধর্মগ্রন্থগুলিকেও তাঁরা যেন একইরকম দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে বিচার করেন। আলোচনা থেকে এটাই বোঝা গেল, ধর্মীয় গোঁড়ামি কী সাঙ্ঘাতিক জিনিস! একটি গ্রন্থ, যা বহু মানুষ পাঠ করবেন— তাকেও পরিবর্তিত তথা বিকৃত করতে এক শ্রেণীর লেখকের বাধে না। এই জাতীয় অসৎ মানসিকতাসম্পন্ন লেখকদের ফলে জনমনে রীতিমতো ভ্রান্তি ছড়ায়। প্রকারান্তরে স্বামীজি সচেতন করে দিচ্ছেন সবাইকে। আবার পণ্ডিতি-বিবাদের ফ্যাসাদও কিছু কম নয়। আমরা অহরহ এর প্রমাণ দেখতে পাই। আজ যা স্বীকৃত, কাল তা-ই পরিত্যক্ত হয়ে যায়। অতএব ইতিহাস-ভূগোল-বিজ্ঞান বইতে যা লেখা আছে, সব অভ্রান্ত বলে মেনে নেওয়ার কোনও কারণ নেই। তাই স্বামীজি ইউজিন বর্নফ, আব্রাহাম কূনা প্রভৃতি লেখকদের মতবাদ কিছু কিছু উল্লেখ করে বলে দিয়েছেন, ‘‘যদি ভাল না লাগে, তাদের সঙ্গে ঝগড়া-ঝাঁটি কর, আমায় দোষ দিও না।’’ এ প্রসঙ্গেই এসেছে পৃথিবীতে মানুষের উদ্ভব এবং বিভিন্ন জাতির উৎপত্তি সম্পর্কে বিবিধ মত। অনেক মানুষ মনে করেন, মানবজাতি একই আদি পিতা-মাতা থেকে উদ্ভূত। আবার অনেকের এ কথায় বিশ্বাস নেই। একটা সময় ধারণা ছিল, উষ্ণদেশের মানুষের গায়ের রঙ কালো হয় এবং শীতপ্রধান দেশে সাদা হয়। কিন্তু পরবর্তীকালে এই মতের বিরুদ্ধে অনেক কথা বলা হয়েছে। অতএব এখন যে মত প্রচলিত আছে পরবর্তীকালে সেটাও পরিবর্তিত হতে পারে। স্বামীজি বলছেন, ‘‘মিসর ও প্রাচীন বাবিলের সভ্যতা পণ্ডিতদের মতে সর্বাপেক্ষা প্রাচীন।’’ উল্লেখ্য, বলছেন ‘‘পণ্ডিতদের মতে।’’ অতএব এসব মতবাদও চূড়ান্ত বা পূর্ণ অভ্রান্ত বলে মেনে নেওয়া ঠিক নয়।
পাশ্চাত্য সভ্যতার এক অপরূপ আলেখ্য পাওয়া যায় ‘পরিব্রাজক’-এ। পাশ্চাত্য সভ্যতা-সংস্কৃতির এমন নিখুঁত অনায়াস বিশ্লেষণ আর কেউ করতে পেরেছেন কিনা সন্দেহ। আমরা ইংরেজ-প্রেমে, ইংরেজি ভাষার মোহে মোহিত। কিন্তু পাশ্চাত্য সভ্যতার মূল কেন্দ্র কখনওই ইংল্যান্ড নয়, ফ্রান্স। ফরাসী জাত্যাভিমানের প্রশংসা করেছেন বিবেকানন্দ। আরও বলেছেন, ‘‘ফরাসী ভাষা সভ্যতার ভাষা— পাশ্চাত্য জগতের ভদ্রলোকের চিহ্ন— সকলেই জানে; কাজেই এদের (ফরাসীদের) ইংরেজি শেখবার অবকাশ এবং প্রবৃত্তি নাই।’’ [‘ইউরোপে’ শীর্ষক প্রবন্ধ] ‘ফ্রান্স ও জার্মানি’ প্রবন্ধে পাই, ‘‘প্যারিসের পর পাশ্চাত্য জগতে আর নগরী নাই; সব সেই প্যারিসের নকল— অন্ততঃ চেষ্টা।’’ এই প্রবন্ধেই ফ্রান্সের সঙ্গে জার্মানির তফাত কোথায়, তা দেখিয়েছেন অসামান্য মুনশীয়ানায়। কী অপূর্ব ভাষা!— ‘‘কৃষ্ণকেশ, অপেক্ষাকৃত খর্বকায়, শিল্পপ্রাণ, বিলাসপ্রিয়, অতি সুসভ্য ফরাসীর শিল্পবিন্যাস; আর এক দিকে হিরণ্যকেশ, দীর্ঘাকার, দিঙনাগ জার্মানির স্থূলহস্তাবলেপ।... ফরাসীর বলবিন্যাসও যেন রূপপূর্ণ; জার্মানির রূপবিকাশ-চেষ্টাও বিভীষণ। ফরাসী প্রতিভার মুখমণ্ডল ক্রোধাক্ত হলেও সুন্দর; জার্মান প্রতিভার মধুর হাস্য-বিমণ্ডিত আননও যেন ভয়ঙ্কর। ফরাসীর সভ্যতা স্নায়ুময়, কর্পূরের মতো— কস্তুরীর মতো এক মুহূর্তে উড়ে ঘর দোর ভরিয়ে দেয়; জার্মান সভ্যতা পেশীময়, সীসার মতো— পারার মতো ভারি, যেখানে পড়ে আছে তো পড়েই আছে। জার্মানের মাংসপেশী ক্রমাগত অশ্রান্তভাবে ঠুকঠাক হাতুড়ি আজন্ম মারতে পারে; ফরাসীর নরম শরীর— মেয়েমানুষের মতো; কিন্তু যখন কেন্দ্রীভূত হয়ে আঘাত করে, সে কামারের এক ঘা; তার বেগ সহ্য করা বড়ই কঠিন। জার্মান ফরাসীর নকলে বড় বড় বাড়ী অট্টালিকা বানাচ্চেন, বৃহৎ বৃহৎ মূর্তি—অশ্বারোহী, রথী—সে প্রাসাদের শিখরে স্থাপন করছেন, কিন্তু জার্মানের দোতলা বাড়ী দেখলেও জিজ্ঞাসা করতে ইচ্ছা হয়, এ বাড়ী কি মানুষের বাসের জন্য, না হাতি-উটের ‘তবেলা’? আর ফরাসীর পাঁচতলা হাতি-ঘোড়া রাখবার বাড়ী দেখে ভ্রম হয় যে, এ বাড়ীতে বুঝি পরীতে বাস করবে!’’ সাহিত্য হিসেবে এ কোন শ্রেণীর, নির্ণয় করা দুঃসাধ্য। তবে এটুকু বলে রাখি, এ জাতীয় ভাব এবং ভাষা বিশ্বের যে কোনও সাহিত্যের সম্পদ। যে ভবিষ্যদ্বাণী স্বামীজি করেছিলেন জার্মানি সম্পর্কে, কিছুকাল পরই তার অভ্রান্ততা দেখা গিয়েছে। এই পরাক্রম জার্মানি নিয়োজিত করল যুদ্ধক্ষেত্রে, সৈন্যবাহিনী গঠনে। হয়তো তার ফলশ্রুতিতেই হিটলারের মতো দানবের আবির্ভাব। আর যা বলেছেন স্বামীজি— আমেরিকা জার্মানির এই পথ গ্রহণ করেছে— তা-ও বহুলাংশে অভ্রান্ত প্রমাণিত হয়ে যাচ্ছে। আমরা সবাই জানি, আমেরিকা বর্তমানে একটি ঘোর যুদ্ধবাজ রাষ্ট্র। বর্তমানে ঠিক নয়, অনেক দিন থেকেই তার এই মানসিকতার প্রকাশ দেখা গিয়েছে। স্বামীজি-কথিত ‘জার্মানিত’ হওয়াই তার এই অবস্থার কারণ।
অবশ্য প্যারিসের নিন্দুকেরও অভাব নেই। এ প্রসঙ্গে স্বামীজি অন্যত্র [‘প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য’ গ্রন্থে] লিখছেন, ‘‘আমাদের দেশে এই পারি নগরীর বদনামই শুনতে পাওয়া যায়, এ পারি মহাকদর্য বেশ্যাপূর্ণ নরককুণ্ড। অবশ্য এ কথা ইংরেজরাই বলে থাকে, এবং অন্য দেশের যে সব লোকের পয়সা আছে এবং জিহ্বোপস্থ ছাড়া দ্বিতীয় ভোগ জীবনে অসম্ভব, তারা অবশ্য বিলাসময় জিহ্বোপস্থের উপকরণময় পারিই দেখে! কিন্তু লণ্ডন, বার্লিন, ভিয়েনা, নিউইয়র্কও ঐ বারবণিতাপূর্ণ, ভোগের উদ্যোগপূর্ণ; তবে তফাত এই যে, অন্য দেশের ইন্দ্রিয়চর্চা পশুবৎ, প্যারিসের—সভ্য পারির ময়লা সোনার পাতমোড়া; বুনো শোরের পাঁকে লোটা, আর ময়ূরের পেখমধরা নাচে যে তফাত, অন্যান্য শহরের পৈশাচিক ভোগ আর এ প্যারিস-বিলাসের সেই তফাত।’’
দেশ কেবল স্বাধীন হলেই হয় না, তাকে স্বাধীনতা লাভের যোগ্যতাও অর্জন করতে হয়।‘'তুরস্ক’ অধ্যায়ে বিবেকানন্দ বুলগেরিয়া, সার্বিয়া, রোমানিয়া প্রভৃতি দেশগুলির এই কারণজনিত দুর্দশা দেখিয়েছেন। তুরস্ক থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে এসব দেশ স্বাধীন হয়েছে, কিন্তু স্বাধীনতা-পরবর্তী পরিকাঠামো কিছু নেই। আবার তথাকথিত ইউরোপিয়ান কান্ট্রি-তে পরিণত হওয়ার ফলে ইউরোপীয ধাঁচে সৈন্যবাহিনী তৈরীর বিপুল খরচও জোগাতে পারছে না। ফলে দেশ দরিদ্রতর হচ্ছে। তবে ‘‘স্বর্ণশৃঙ্খলযুক্ত গোলামির চেয়ে একপেটা ছেঁড়া ন্যাকড়া-পরা স্বাধীনতা লক্ষগুণে শ্রেয়ঃ’’— এ কথা লেখক স্বীকার করেছেন। সেই সঙ্গে তিনি আশাবাদী, এসব দেশও একদিন নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারবে। তাঁর এ কথা অনেকাংশে অভ্রান্ত প্রমাণিত হয়েও গিয়েছে। তথাপি এসব দেশের আরও উন্নতি প্রয়োজন।
কলাবিদ্যা সম্পর্কে বিবেকানন্দ বলেছেন কম, কিন্তু সংক্ষেপে অতি গুরুত্বপূর্ণ কিছু দিক দেখিয়ে গিয়েছেন। এ বিষয়ে তাঁর ‘লুভার মিউজিয়মে’ প্রবন্ধটি উৎকৃষ্ট। গ্রীক কলাবিদ্যার চমৎকার বিশ্লেষণ করেছেন এখানে। উদাহরণস্বরূপ সামান্য উল্লেখ—‘‘গ্রীক আর অন্য প্রদেশের শিল্পের তফাত এই যে, গ্ৰীক শিল্প প্রাকৃতিক স্বাভাবিক জীবনের যাথাতথ্য জীবন্ত ঘটনাসমূহ বর্ণনা করছে।’’ আবার এই শিল্পেরই অবনতি প্রসঙ্গে বলছেন, ‘‘৩২৩ খৃঃ পূঃ কাল পর্যন্ত অর্থাৎ আলেকজান্ডারের মৃত্যুর পর হতে রোমানদিগের দ্বারা আটিকা-বিজয়কাল পর্যন্ত গ্রীক শিল্পের অবনতি-কাল। জাঁকজমকের বেশী চেষ্টা এবং মূর্তিসকল প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড করবার চেষ্টা এই সময়ে গ্রীক শিল্পে দেখতে পাওয়া যায়। তারপর রোমানদের গ্রীস অধিকার-সময়ে গ্ৰীক শিল্প তদ্দেশীয় পূর্ব পূর্ব শিল্পীদের কার্যের নকল মাত্র করেই সন্তুষ্ট। আর নূতনের মধ্যে হুবহু কোনও লোকের মুখ নকল করা।’’
‘অস্ট্রিয়া ও হুঙ্গারি’ প্রবন্ধে লিখছেন, ‘‘ভিয়েনা শহরে দেখবার জিনিস মিউজিয়ম, বিশেষ বৈজ্ঞানিক মিউজিয়ম। বিদ্যার্থীর বিশেষ উপকারক স্থান। নানাপ্রকার প্রাচীন লুপ্ত জীবের অস্থ্যাদি সংগ্রহ অনেক। চিত্রশালিকায় ওলন্দাজ চিত্রকরদের চিত্রই অধিক। ওলন্দাজি সম্প্রদায়ে রূপ বার করবার চেষ্টা বড়ই কম; জীবপ্রকৃতির অবিকল অনুকরণেই এ সম্প্রদায়ের প্রাধান্য। একজন শিল্পী বছর কতক ধরে এক ঝুড়ি মাছ এঁকেছে, না হয় এক থান মাংস, না হয় এক গ্লাস জল—সে মাছ, মাংস, গ্লাসে জল চমৎকারজনক। কিন্তু ওলন্দাজ সম্প্রদায়ের মেয়ে-চেহারা সব যেন কুস্তিগির পালোয়ান!’’
শিল্প বিষয়ে ‘স্বামি-শিষ্য-সংবাদ’-এও স্বামীজি শিল্পবিশেষজ্ঞ রণদাপ্রসাদ দাশগুপ্ত মশায়কে বলেছেন, ‘‘পৃথিবীর প্রায় সকল সভ্য দেশের শিল্প-সৌন্দর্য দেখে এলুম, কিন্তু বৌদ্ধধর্মের প্রাদুর্ভাবকালে এদেশে শিল্পকলার যেমন বিকাশ দেখা যায়, তেমনটি আর কোথাও দেখলুম না। মোগল বাদশাদের সময়েও ঐ বিদ্যার বিশেষ বিকাশ হয়েছিল; সেই বিদ্যার কীর্তিস্তম্ভরূপে আজও তাজমহল, জুম্মা মসজিদ প্রভৃতি ভারতবর্ষের বুকে দাঁড়িয়ে রয়েছে।’’
মানুষ যে জিনিষটি তৈরি করে, তাতে কোনও একটা idea express (মনোভাব প্রকাশ) করার নামই art (শিল্প)। যাতে idea-র expression (ভাবের প্রকাশ) নেই, রঙ-বেরঙের চাকচিক্য পরিপাটি থাকলেও তাকে প্রকৃত art (শিল্প) বলা যায় না। ঘটি, বাটি পেয়ালা প্রভৃতি নিত্যব্যবহার্য জিনিষপত্রগুলিও ঐরূপে বিশেষ কোনও ভাব প্রকাশ করে তৈরি করা উচিত। প্যারিস প্রদর্শনীতে পাথরের খোদাই এক অদ্ভুত মূর্তি দেখেছিলাম, মূর্তিটির পরিচায়ক এই কয়টি কথা নীচে লেখা, ‘Art unveiling nature’ অর্থাৎ শিল্প কেমন করে প্রকৃতির নিবিড় অবগুণ্ঠন স্বহস্তে মোচন করে ভেতরের রূপসৌন্দর্য দেখে। মূর্তিটি এমনভাবে তৈরি করেছে যেন প্রকৃতিদেবীর রূপচ্ছবি এখনও স্পষ্ট বেরোয়নি ; যতটুকু বেরিয়েছে, ততটুকু সৌন্দর্য দেখেই শিল্পী যেন মুগ্ধ হয়ে গিয়েছে। যে ভাস্কর এই ভাবটি প্রকাশ করতে চেষ্টা করেছেন, তাঁর প্রশংসা না করে থাকা যায় না। ঐ রকমের original (মৌলিক) কিছু করতে চেষ্টা করবেন।... আগেকার ভাস্করগণ নিজেদের মাথা থেকে নূতন নূতন ভাব বের করতে বা সেইগুলি ছবিতে বিকাশ করতে চেষ্টা করতেন; এখন ফটোর অনুরূপ ছবি হওয়ায় মাথা খেলাবার শক্তি ও চেষ্টার লোপ হয়ে যাচ্ছে। তবে এক-একটা জাতের এক-একটা characteristic (বিশেষত্ব) আছে। আচারে-ব্যবহারে, আহারে-বিহারে, চিত্রে-ভাস্কর্যে সেই বিশেষ ভাবের বিকাশ দেখতে পাওয়া যায়। এই ধরুন— ওদেশের গান-বাজনা-নাচের expression (বাহ্য বিকাশ)-গুলি সবই pointed (তীব্র, তীক্ষ্ণ); নাচছে যেন হাত পা ছুঁড়ছে! বাজনাগুলির আওয়াজে কানে যেন সঙ্গীনের খোঁচা দিচ্ছে! গানেরও ঐরূপ। এদেশের নাচ আবার যেন হেলেদুলে তরঙ্গের মত গড়িয়ে পড়ছে, গানের গমক মূর্চ্ছনাতেও ঐরূপ rounded movement (মোলায়েম গতি) দেখা যায়। বাজনাতেও তাই। অতএব art (শিল্প) সম্বন্ধে বিভিন্ন জাতির মধ্যে বিভিন্নরূপ বিকাশ হয়। যে জাতটা বড় materialistic (জড়বাদী), তারা nature (প্রকৃতি)-টাকেই ideal (আদর্শ) বলে ধরে এবং তদনুরূপ ভাবের expression (বিকাশ) শিল্পে দিতে চেষ্টা করে। যে জাতটা আবার প্রকৃতির অতীত একটা ভাবপ্রাপ্তিকেই ideal (আদর্শ) বলে ধরে, সেটা ঐ ভাবই nature-এর (প্রকৃতিগত) শক্তিসহায়ে শিল্পে express (প্রকাশ) করতে চেষ্টা করে। প্রথম শ্রেণীর জাতের nature (প্রকৃতি)-ই হচ্ছে primary basis of art (শিল্পের মূল ভিত্তি); আর দ্বিতীয় শ্রেণীর জাতগুলোর ideality (প্রকৃতির অতীত একটা ভাব) হচ্ছে শিল্প বিকাশের মূল কারণ। ঐরূপে দুই বিভিন্ন উদ্দেশ্য ধরে শিল্পচর্চায় অগ্রসর হলেও ফল উভয় শ্রেণীর প্রায় একই দাঁড়িয়েছে, উভয়েই নিজ নিজ ভাবে শিল্পোন্নতি করছে। ও-সব দেশের এক একটা ছবি দেখে আপনার সত্যকার প্রাকৃতিক দৃশ্য বলে ভ্রম হবে। এদেশের সম্বন্ধেও তেমনি— পুরাকালে স্থাপত্য-বিদ্যার যখন খুব বিকাশ হয়েছিল, তখনকার এক-একটি মূর্তি দেখলে আপনাকে এই জড় প্রাকৃতিক রাজ্য ভুলিয়ে একটা নূতন ভাবরাজ্যে নিয়ে ফেলবে। ওদেশে এখন যেমন আগেকার মতো ছবি হয় না, এদেশেও তেমনি নূতন নূতন ভাববিকাশ-কল্পে ভাস্করগণের আর চেষ্টা দেখা যায় না। এই দেখুন না, আপনাদের আর্ট স্কুলের ছবিগুলোতে যেন কোনও expression (ভাবের বিকাশ) নেই। আপনারা হিন্দুদের নিত্য-ধ্যেয় মূর্তিগুলিতে প্রাচীন ভাবের উদ্দীপক expression (বহিঃবিকাশ) দিয়ে আঁকবার চেষ্টা করলে ভাল হয়।... এই মনে করুন, মা কালীর ছবি। এতে যুগপৎ ক্ষেমঙ্করী ও ভয়ঙ্করী মূর্তির সমাবেশ। ঐ ছবিগুলির কোনখানিতে কিন্তু ঐ উভয় ভাবের ঠিক ঠিক expression (প্রকাশ) দেখা যায় না। তা দূরে যাক, একটাও চিত্রে ঐ উভয় ভাবের ঠিক ঠিক বিকাশ করবার চেষ্টা কারুর নেই !’’ বলা বাহুল্য, স্বামীজির দূরদর্শিতা এবং বিশ্লেষণ-ক্ষমতার এই দিকগুলি অধিকাংশ মানুষের আজও অজ্ঞাত। নিঃসন্দেহে এ দুর্ভাগ্যের বিষয়। কত বিষয়ে যে তিনি সুচিন্তিত মতামত দেওয়ার ক্ষমতা রাখতেন, ভাবলে স্তম্ভিত হতে হয়। প্রসঙ্গত, ‘স্বামীজীর কথা’ গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত ‘স্বামীজির স্মৃতি’ রচনায় বিবেকানন্দ বলছেন, ‘‘এশিয়াটিকের জীবন আর্টে মাখা। প্রত্যেক বস্তুতে আর্ট না থাকলে এশিয়াটিক তা ব্যবহার করে না। ওরে আমাদের আর্টও যে ধর্মের একটা অঙ্গ।... ওরা (পাশ্চাত্যবাসীরা) যতদিন এশিয়ায় এসেছে, ততদিন ওরা চেষ্টা করছে জীবনে art (শিল্প) ঢোকাতে। ...ওদের বাড়ীগুলো দেখ সব সাদামাটা।... তারপর তাদের প্যান্ট, চোস্ত কোট, আমাদের হিসেবে এক প্রকার ন্যাংটো। না ? আর তার কী যে বাহার! আমাদের জন্মভূমিটা ঘুরে দেখ। কোন building-টার (অট্টালিকার)... কিবা শিল্প! ওদের জলখাবার গেলাস, আমাদের ঘটি— কোনটায় আর্ট আছে? ওরে, একটুকরা Indian silk (ভারতীয় রেশম) চায়না (China)-য় নকল করতে হার মেনে গেল।... পাড়াগাঁয়ে চাষাদের ধানের মরাই... তাতে কত আর্ট! মেটে ঘরগুলো কত চিত্তির-বিচিত্তির !... সাহেবদের utility (কার্যকারিতা) আর আমাদের art (শিল্প)— ওদের সমস্ত দ্রব্যেই utility, আমাদের সর্বত্র আর্ট। ঐ সাহেবী শিক্ষায় আমাদের অমন সুন্দর চুমকি ঘটী ফেলে এনামেলের গেলাস এনেছেন ঘরে। ওই রকমে utility এমনভাবে আমাদের ভেতর ঢুকেছে যে, সে বদহজম হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখন চাই art এবং utility-র combination (সংযোগ)।’’
আমরা অনেকেই জানি, ফ্রান্সের জগদ্বিখ্যাত গায়িকা মাদাম কালভে বিবেকানন্দের গুণমুগ্ধ ছিলেন। অতি দরিদ্র অবস্থা থেকে তিনি ফ্রান্সের শীর্ষস্থানীয় শিল্পী হয়েছিলেন। স্বামীজি তাঁর প্রশংসায় পঞ্চমুখ, কিন্তু সেই সঙ্গে ভুলতে পারছেন না দেশের মেয়েদের দুর্দশা—‘‘আবার এ দেশে উদ্যোগ যেমন, উপায়ও তেমন। আমাদের দেশে উদ্যোগ থাকলেও উপায়ের একান্ত অভাব। বাঙালীর মেয়ের বিদ্যা শেখবার সমধিক ইচ্ছা থাকলেও উপায়াভাবে বিফল ; বাঙলা ভাষায় আছে কী শেখবার? বড় জোর পচা নভেল-নাটক!!’’ লক্ষণীয় যা, তা হল, বিবেকানন্দ এ কথা বলছেন ১৮৯৯-১৯০০ সাল নাগাদ। তখন কিন্তু বাংলা সাহিত্যে কয়েকজন তথাকথিত প্রতিভাবান লেখকের আবির্ভাব ঘটে গিয়েছে। বিবেকানন্দ সে বিষয়ে নিশ্চিতরূপে অবহিত ছিলেন, কারণ তিনি মাইকেল মধুসূদন দত্তের প্রশংসা করেছেন, অথচ তখন যাঁরা নাটক বা উপন্যাস লিখছেন এবং লিখেছেন, তাঁদের গুরুত্ব দিলেন না। স্বামীজির মতো অসামান্য প্রজ্ঞাবান পুরুষ যখন এ জাতীয় মনোভাব নেন তৎকালীন বঙ্গ-সাহিত্যিক সম্পর্কে, তাঁদের বিষয়ে চিন্তাভাবনা করার আরও প্রয়োজন আছে বোধ করি। বিশ্বের অন্যান্য ভাষার তুলনায় বাংলায় অনুবাদের ধারা যে ক্ষীণ, সে বিষয়েও তাঁর আক্ষেপ। তাই বাঙালিরা পৃথিবীর বহু জ্ঞান থেকে বঞ্চিত। বলা বাহুল্য, এখনও বাংলা ভাষায় অনুবাদের যথেষ্ট দৈন্য রয়েছে।নীচের কথাগুলি পড়ে দেখতে বলি—
‘‘ভিয়েনায় তিন দিন দিক করে দিলে! প্যারিসের পর ইউরোপ দেখা—চর্বচুষ্য খেয়ে তেঁতুলের চাটনি চাকা; সেই কাপড়চোপড়, খাওয়া-দাওয়া, সেই সব এক ঢঙ, দুনিয়াসুদ্ধ সেই এক কিম্ভূত কালো জামা, সেই এক বিকট টুপী! তার উপর— উপরে মেঘ আর নীচে পিল্ পিল্ করছে এই কালো টুপী, কালো জামার দল; দম যেন আটকে দেয়। ইউরোপসুদ্ধ সেই এক পোশাক, সেই এক চাল-চলন হয়ে আসছে! প্রকৃতির নিয়ম— ঐ সবই মৃত্যুর চিহ্ন! শত শত বৎসর কসরত করিয়ে আমাদের আর্যেরা আমাদের এমনি কাওয়াজ করিয়ে দেছেন যে, আমরা এক ঢঙে দাঁত মাজি, মুখ ধুই, খাওয়া খাই, ইত্যাদি ইত্যাদি ; ফল—আমরা ক্রমে ক্রমে যন্ত্রগুলি হয়ে গেছি; প্রাণ বেরিয়ে গেছে, খালি যন্ত্রগুলি ঘুরে বেড়াচ্ছি! যন্ত্রে ‘না’ বলে না, ‘হাঁ’ বলে না, নিজের মাথা ঘামায় না, 'যেনাস্য পিতরো যাতাঃ'— (বাপ দাদা যে দিক দিয়ে গেছে) সে দিকে চলে যায়, তার পর পচে মরে যায়। এদেরও তাই হবে! ‘কালস্য কুটিলা গতিঃ’—সব এক পোশাক, এক খাওয়া, এক ধাঁজে কথা কওয়া, ইত্যাদি ইত্যাদি— হতে হতে ক্রমে সব যন্ত্র, ক্রমে সব ‘যেনাস্য পিতরো যাতাঃ’ হবে, তার পর পচে মরা!!’’
এখানে আমরা কী পেলাম (কী পেলাম না তাই ভাবছি)? জীবনদর্শনের এক অপরূপ তথা অতিবাস্তব আলেখ্য। আমাদের, অর্থাৎ অধিকাংশ মানুষের জীবন সত্যিই স্টিরিওটাইপ। প্রাচ্য-পাশ্চাত্য নির্বিশেষে। আমরা মনে করি, আমরা যেভাবে জীবন কাটাই, সেটাই জীবন। লেখাপড়া করা, চাকরি করা, ব্যবসা করা, বিয়ে-সন্তান প্রতিপালন, তারপর একদিন মরে যাওয়া—জীবন মানে সাধারণ মানুষের কাছে এই-ই। একবারও ভেবে দেখি না, জীবপ্রবাহ অক্ষুণ্ন রাখা ছাড়া এ জাতীয় যাপনের কোনও মূল্য আছে কি? কিন্তু স্বামীজি কোনওদিন এভাবে সময় অতিবাহিত করার কথা ভাবতে পারতেন না। তাই তিনি বড় আশ্চর্য হয়েছেন, প্রবল সমালোচনা করেছেন এবং সেইসঙ্গে সচেতন করে দিয়েছেন মানুষকে যে, এই যন্ত্রবৎ জীবনযাপন সম্পূর্ণরূপে অর্থহীন, অসঙ্গত। কাজ করতে হয় মানুষকে। আত্মোন্নতিমূলক কাজ। কেবল প্রথাগতভাবে জীবন কাটিয়ে যাওয়ার কোনও অর্থ নেই, এর মধ্যে কোনও গৌরব নেই। বলা বাহুল্য, তিনি যা বলেছেন, হাতেকলমেও সেটাই করেছেন।
অনেক আধ্যাত্মিক-মানবের মধ্যে একটা বিষয় লক্ষ্য করা যায়, তাঁরা কুসংস্কারাচ্ছন্ন। স্বামীজি চিরকাল ছিলেন এর বিরোধী। ‘রেড-সী’ প্রবন্ধে এই বিষয়টি চমৎকার ফুটে উঠেছে—‘‘জাহাজ তো রেড-সীর মধ্য দিয়ে যাচ্চে। পাদ্রী বললেন, ‘এই—এই রেড-সী,—য়াহুদী-নেতা মুসা সদলবলে পদব্রজে পার হয়েছিলেন। আর তাদের ধরে নিয়ে যাবার জন্যে মিসরি বাদশা ‘ফেরো’ যে ফৌজ পাঠিয়েছিলেন, তারা কাদায় রথচক্র ডুবে, কর্ণের মতো আটকে জলে ডুবে মারা গেল।’ পাদ্রী আরও বললেন যে, ‘একথা এখন আধুনিক বিজ্ঞান-যুক্তির দ্বারা প্রমাণ হতে পারে।’ এখন সব দেশে ধর্মের আজগুবিগুলি বিজ্ঞানের যুক্তি দিয়ে প্রমাণ করবার এক ঢেউ উঠেছে।’’ শুধু যে স্বামীজির সময়ে এই ঢেউ উঠেছিল তাই নয়, সেই ব্যাপার এখনও চলেছে। তাই গণেশের হস্তিমস্তক প্লাস্টিক সার্জারির অবদান মনে করেন একালে অনেকে, রাবণের পুষ্পক রথ হয়ে যায় এরোপ্লেনের পূর্বপুরুষ, মোবাইল ফোনকে আকাশ-বাণীর সন্তান বলে চালানোর চেষ্টা করছেন কেউ কেউ। তারপর বলছেন, ‘‘যদি প্রাকৃতিক নিয়মে ঐ সবগুলি হয়ে থাকে তো আর তোমার য়াভে-দেবতা মাঝখান থেকে আসেন কেন? বড়ই মুশকিল! যদি বিজ্ঞানবিরুদ্ধ হয় তো ও-কেরামতগুলি আজগুবি এবং তোমার ধর্ম মিথ্যা। যদি বিজ্ঞানসম্মত হয়, তা হলেও তোমার দেবতার মহিমাটি বাড়ার ভাগ, ও আর সব প্রাকৃতিক ঘটনার ন্যায় আপনা-আপনি হয়েছে। পাদ্রী বোগেশ বললে, ‘আমি অত শত জানিনি, আমি বিশ্বাস করি।’ একথা মন্দ নয়— এ সহ্যি হয়। তবে ঐ যে একদল আছে—পরের বেলা দোষটি দেখাতে, যুক্তিটি আনতে কেমন তৈয়ার; নিজের বেলায় বলে, ‘আমি বিশ্বাস করি, আমার মন সাক্ষ্য দেয়’— তাদের কথাগুলো একদম অসহ্য।... পরের বেলায় সব কুসংস্কার, বিশেষ করে যেগুলো সাহেবে বলেছে; আর নিজে একটা কিম্ভূত-কিমাকার কল্পনা করে কেঁদেই অস্থির!!’’ দেখা যাচ্ছে, তিনি যুক্তির ওপরে ধর্মকে দাঁড় করাতে চাইছেন। অযৌক্তিকভাবে কোনও কিছু মেনে নেওয়ার বিরুদ্ধে তিনি। বলা বাহুল্য, এ তাঁর আবাল্য বৈশিষ্ট্য। তিনি ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের জন্য রাখা হুঁকো টেনে টেনে পরীক্ষা করেছিলেন বাল্যে, জাত যায় কিনা সেটা দেখতে। শ্রীরামকৃষ্ণের কোনও কথাই তিনি চোখ বন্ধ করে মেনে নেননি। অজস্র তর্ক-বিতর্ক করেছেন। তারপরে গ্রহণ করেছেন। অন্যান্য ধর্মাচার্যদের সঙ্গে এখানে তাঁর বিরাট তফাত। তাঁর এই তর্কপ্রিয়তার জন্য তিনি সমালোচিতও হয়েছেন এমনকি তাঁর অতি প্রিয় গুরুভাই স্বামী প্রেমানন্দের কাছ থেকে। কিন্তু কিছুই গ্রাহ্য করেননি। নিজের সিদ্ধান্তে, নিজের আদর্শে থেকেছেন অবিচল।
শ্রমিক শ্রেণীর, অবহেলিত শ্রেণীর মানুষের সমর্থনে বিভিন্ন সামাজিক, রাজনৈতিক সংগঠন নানা সময়ে সরব হয়েছে। কিন্তু কোনও ধর্মীয় মহাপুরুষ এ বিষয়ে বিশেষ কিছু বলেছেন শোনা যায় না। স্বামীজি এ বিষয়ে অনন্য ব্যতিক্রম। তাঁর বহুশ্রুত বাণী ‘‘হে ভারত...ভুলিও না—নীচজাতি, মূর্খ, দরিদ্র, অজ্ঞ, মুচি, মেথর তোমার রক্ত তোমার ভাই’’ প্রায় সকলের জানা, কিন্তু ‘সুয়েজখালে:হাঙ্গর শিকার’ প্রবন্ধে যে এই কথাগুলি আছে তা অনেকের অচেনা—‘‘হে ভারতের শ্রমজীবি! তোমার নীরব অনবরত-নিন্দিত পরিশ্রমের ফলস্বরূপ বাবিল, ইরান, আলকসন্দ্রিয়া, গ্রীস, রোম, ভেনিস, জেনোয়া, বোগদাদ, সমরকন্দ, স্পেন, পোর্তুগাল, ফরাসী, দিনেমার, ওলন্দাজ ও ইংরেজের ক্রমান্বয়ে আধিপত্য ও ঐশ্বর্য। আর তুমি?—কে ভাবে এ কথা। স্বামীজী (‘স্বামীজী’) অর্থে স্বামী ত্রিগুণাতীতানন্দ; প্রসঙ্গত, বিবেকানন্দের অন্যতম গুরুভাই স্বামী ত্রিগুণাতীতানন্দের অনুরোধে দ্বিতীয়বার পাশ্চাত্য ভ্রমণকালে বিবেকানন্দ তাঁর ভ্রমণকাহিনী লিখে পাঠান, সেই ভ্রমণকাহিনীর সংকলন-ই ‘পরিব্রাজক’ গ্রন্থ)! তোমাদের পিতৃপুরুষ দু’খানা দর্শন লিখেছেন, দশখানা কাব্য বানিয়েছেন, দশটা মন্দির করেছেন—তোমাদের ডাকের চোটে গগন ফাটছে; আর যাদের রুধিরস্রাবে মনুষ্যজাতির যা কিছু উন্নতি—তাদের গুণগান কে করে? লোকজয়ী ধর্মবীর রণবীর কাব্যবীর সকলের চোখের উপর, সকলের পূজ্য; কিন্তু কেউ যেখানে দেখে না, কেউ যেখানে একটা বাহবা দেয় না, যেখানে সকলে ঘৃণা করে, সেখানে বাস করে অপার সহিষ্ণুতা, অনন্ত প্রীতি ও নির্ভীক কার্যকারিতা; আমাদের গরীবরা ঘরদুয়ারে দিনরাত যে মুখ বুজে কর্তব্য করে যাচ্চে, তাতে কি বীরত্ব নাই? বড় কাজ হাতে এলে অনেকেই বীর হয়, দশ হাজার লোকের বাহবার সামনে কাপুরুষও অক্লেশে প্রাণ দেয়, ঘোর স্বার্থপরও নিষ্কাম হয় ; কিন্তু অতি ক্ষুদ্র কার্যে সকলের অজান্তেও যিনি সেই নিঃস্বার্থতা, কর্তব্যপরায়ণতা দেখান, তিনিই ধন্য— সে তোমরা ভারতের চিরপদদলিত শ্রমজীবি !— তোমাদের প্রণাম করি।" ভাবা যায় কি এ কোনও হিন্দু সন্ন্যাসীর মুখনিঃসৃত ? সন্ন্যাসী বললে যে মানুষের ছবি আমাদের সামনে ফুটে ওঠে তার সঙ্গে একে মেলানো কঠিন। অনেক গোঁড়া সন্ন্যাসী কিন্তু বিবেকানন্দের এসব কথা শুনলে ক্ষেপে যাবেন। সেই বোধি তাঁদের নেই যে, সাধারণ মানুষের জন্য চিন্তাভাবনা ঈশ্বর-আরাধনার ক্ষেত্রে বাধা নয়। স্বামীজির চরিত্রের বহুমুখীনতা, বহুমাত্রিকতা ধরা কিংবা বোঝা সবার সাধ্যে কুলোয় না।
‘ভারত—বর্তমান ও ভবিষ্যৎ’ প্রবন্ধেও লেখক উচ্চবর্ণদের একহাত নিয়েছেন। বলছেন, ‘‘তোমরা উচ্চবর্ণেরা কি বেঁচে আছ? তোমরা হচ্চ দশ হাজার বচ্ছরের মমি!!...‘চলমান শ্মশান’ হচ্চ তোমরা। এ মায়ার সংসারের আসল প্রহেলিকা, আসল মরু-মরীচিকা তোমরা— ভারতের উচ্চবর্ণেরা!’’ আর আস্থা রেখেছেন’’...নূতন ভারত বেরুক। বেরুক লাঙল ধরে, চাষার কুটির ভেদ করে, জেলে মালা মুচি মেথরের ঝুপড়ির মধ্য হতে। বেরুক মুদির দোকান থেকে, ভুনাওয়ালার উনুনের পাশ থেকে। বেরুক কারখানা থেকে, হাট থেকে, বাজার থেকে। বেরুক ঝোড় জঙ্গল পাহাড় পর্বত থেকে। এরা সহস্র বৎসর অত্যাচার সয়েছে; নীরবে সয়েছে—তাতে পেয়েছে অপূর্ব সহিষ্ণুতা। সনাতন দুঃখ ভোগ করছে—তাতে পেয়েছে অটল জীবনীশক্তি। এরা এক মুঠো ছাতু খেয়ে দুনিয়া উল্টে দিতে পারবে; আধখানা রুটি পেলে ত্রৈলোক্যে এদের তেজ ধরবে না; এরা রক্তবীজের প্রাণসম্পন্ন। আর পেয়েছে অদ্ভুত সদাচারবল, যা ত্রৈলোক্যে নাই। এত শান্তি, এত প্রীতি, এত ভালবাসা, এত মুখটি চুপ করে দিনরাত খাটা এবং কার্যকালে সিংহের বিক্রম!!’’—এই মানুষগুলির প্রতি। লক্ষণীয়, বক্তা নিজে উচ্চবর্ণজাত—কায়স্থ। কিন্তু স্বজাতির তমোগুণ দেখে বিশ্বাস হারিয়েছেন তাঁদের প্রতি। মুক্তকণ্ঠে জয়গান গাইছেন সমাজ যাদের অস্পৃশ্য, অচ্ছুৎ বলে—তাদের। কতখানি উদার মানসিকতা!
বিবেকানন্দের দৃষ্টিতে ধরা পড়েছে এই সারসত্য, ‘‘বোগেশ আর বোগেশের পাদ্রিনী জড়াজড়ি হয়ে কোণে চার ঘণ্টা বসে থাকে। তোমার ইওরোপীয় সভ্যতা বোঝা দায়। আমরা যদি বাইরে কুলকুচো করি, কি দাঁত মাজি—বলে কি অসভ্য! আর জড়ামড়িগুলো গোপনে করলে ভাল হয় না কি? তোমরা (অর্থাৎ ভারতীয়রা) আবার এই সভ্যতার নকল করতে যাও! যাহোক প্রোটেষ্টাণ্ট ধর্মে উত্তর ইওরোপের যে কী উপকার করেছে, তা পাদ্রী পুরুষ না দেখলে তোমরা বুঝতে পারবে না। যদি এই দশ ক্রোর ইংরেজ সব মরে যায়, খালি পুরোহিতকুল বেঁচে থাকে, বিশ বৎসরে আবার দশ ক্রোরের সৃষ্টি!’’ [‘মনসুন : এডেন’ শীর্ষক অধ্যায়] বোঝাতে চাইছেন, ইউরোপীয় সভ্যতায় কতখানি অসংযম ও বাহ্যিক ভদ্রতার উৎপাত আছে, সে কথা।
‘পরিব্রাজক’-এর লেখকের বৈশিষ্ট্য, অতি অল্প কথায় অনেক কিছু বুঝিয়ে দেন। একটা গোটা জাতির প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলি তুলির আঁচড়ের মতো দু-একটি রেখায় লেখক ধরিয়ে দিয়েছেন। ‘দক্ষিণী সভ্যতা’ নামের অপরূপ আলেখ্যটি ধরা যাক। লেখকের বর্ণনা, ‘‘মান্দ্রাজ মনে পড়লে খাঁটি দক্ষিণ-দেশ মনে পড়ে। যদিও কলকেতার জগন্নাথের ঘাটেই দক্ষিণ-দেশের আমেজ পাওয়া যায় (সেই থর-কামানো মাথা, ঝুঁটি বাধা, কপালে অনেক চিত্র বিচিত্র, শুঁড়-ওলটানো চটিজুতো, যাতে কেবল পায়ের আঙুল-কটি ঢোকে, আর নস্যদরবিগলিত নাসা, ছেলে-পুলের সর্বাঙ্গে চন্দনের ছাপা লাগাতে মজবুত) উড়ে বামুন দেখে।... কিন্তু ঠিক দক্ষিণী ঢঙ মান্দ্রাজীতে। সে রামানুজী তিলক-পরিব্যাপ্ত ললাটমণ্ডল—দূর থেকে যেন ক্ষেত চৌকি দেবার জন্য কেলে হাঁড়িতে চুন মাখিয়ে পোড়া কাঠের ডগায় বসিয়েছে, যে-তিলকের শাগরেদ রামানন্দী তিলকের মহিমা সম্বন্ধে লোকে বলে, ‘তিলক তিলক সব কোই কহে, পর রামানন্দী তিলক দিখত গঙ্গা-পারসে যম গৌদ্বারকে খিড়ক্!’ (আমাদের দেশে চৈতন্যসম্প্রদায়ের সর্বাঙ্গে ছাপ দেওয়া গোঁসাই দেখে মাতাল চিতাবাঘ ঠাওরেছিল—এ মান্দ্রাজী তিলক দেখে চিতেবাঘ গাছে চড়ে!); আর সে তামিল তেলুগু মলয়ালম বুলি— যা ছয় বৎসর শুনেও এক বর্ণ বোঝবার জো নাই, যাতে দুনিয়ার রকমারি ল-কার ও ড-কারের কারখানা; আর সেই ‘মুড়গতন্নির রসম’ সহিত ভাত সাপড়ানো—যার এক এক গরাসে বুক ধড়ফড় করে ওঠে (এমনি ঝাল আর তেঁতুল!); সে ‘'মিঠে নিমের পাতা, ছোলার দাল, মুগের দাল’ ফোড়ন, দধ্যোদন ইত্যাদি ভোজন; আর সে রেড়ির তেল মেখে স্নান, রেড়ির তেলে মাছ ভাজা—এ না হলে কি দক্ষিণ মুলুক হয়?’’ বোঝাই যাচ্ছে, অসম্ভব সরস বর্ণনা। একটা জাতির খাদ্য, ভাষা, আচারের চমৎকার চিত্রণ। সেই সঙ্গে লক্ষণীয়, নিজে সাধু হওয়া সত্ত্বেও সাধুদের বহিরঙ্গ আচারের প্রতি তাঁর কটাক্ষ। এক-এক শ্রেণীর সাধু-সন্ন্যাসী তো ওই নিয়েই মেতে থাকেন। সাধকের মূল যে কাজ—সাধনভজন—তা গৌণ হয়ে যায়। চিতা-ফোঁটা, জটা, কৌপিন, তিলক, টিকি, দাড়ি, বসন, আমিষ-নিরামিষ—এই নিয়ে রাতদিন কেটে যায় তাঁদের। প্রকৃত সাধকের এসবের প্রয়োজন প্রায় পড়ে না। স্বামীজি কোনওদিনই সাধুদের এইসব বাহ্যিক আচার-বিহার নিয়ে বাড়াবাড়ি পছন্দ করতেন না। নিজেও সেইভাবে চলতেন। তৎকালে কালাপানি পার হয়েছেন, সমাজের ভ্রূকুটি উপেক্ষা করে। বিদেশে পরেছেন পাশ্চাত্য পোশাক। খেয়েছেন এমন সব খাদ্য, যা হিন্দু সন্ন্যাসীর ‘নিষিদ্ধ’। ঈশ্বর-অনুসন্ধান ব্যতীত সহস্র কর্মে নিয়োজিত রেখেছেন নিজেকে, যা বহুজনের মতে তথাকথিত সন্ন্যাসীর কাজ নয়। বস্তুত, এ তাঁর গুরুদেবের কাছ থেকে পাওয়া শিক্ষা। শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংস কোনওদিন গোঁড়ামিকে প্রশ্রয় দেননি। শিষ্যদের মধ্যেও সেই ভাব সঞ্চারিত করেছিলেন। এ প্রসঙ্গে জানাই, রামকৃষ্ণদেবের অন্যতম সন্ন্যাসী শিষ্য স্বামী শিবানন্দকে বেলুড় মঠে এক উৎসবের সময় কেউ বলেছিল, ‘এই ভিড়ের মধ্যে আপনি ধুতি-পাঞ্জাবি পরে ঘুরে আসতে পারবেন?’ তৎক্ষণাৎ শিবানন্দ মহারাজ তা করেছিলেন। বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, মূল সন্ন্যাস মনে; পোশাক গৈরিক কি ধুতি-পাঞ্জাবি তাতে কিছু আসে-যায় না।
‘জাহাজের কথা’ নিবন্ধটি অনবদ্য। বিভিন্ন ধরনের জাহাজের সরস এবং তথ্যপূর্ণ বর্ণনা এখানে দিচ্ছেন স্বামীজি। কিন্তু লেখক যেহেতু বিবেকানন্দ, নিজস্ব বৈশিষ্ট্য থাকবেই। রয়েছেও। যুদ্ধ-জাহাজের কর্মী ও যোদ্ধা সংগ্রহের নিষ্ঠুর পদ্ধতির বর্ণনা দিয়ে স্বামীজি লিখছেন, ‘‘আইন করলেন আমীরেরা, দেশ-দেশান্তরের বাণিজ্য লুটপাট করবার জন্য; রাজস্ব ভোগ করবেন তাঁরা, আর গরীবদের খালি রক্তপাত, শরীরপাত, যা চিরকাল এ পৃথিবীতে হয়ে আসছে!!’’ বলা বাহুল্য, এই গরীব মানুষদেরই ভুলিয়ে-ভালিয়ে অথবা জবরদস্তি করে যুদ্ধ-জাহাজের কাজে লাগানো হত। অত্যাচার সইতে না পেরে অনেকে মারাও যেত। দরিদ্রের কথা, শ্রমজীবী মানুষের যন্ত্রণার কথা স্বামীজি কোনওদিন ভুলতে পারেননি। বিশ্বের যে প্রান্তে যে অবস্থায় থাকুন না কেন, এই চিন্তা তাঁর মাথা থেকে কখনও যায়নি। তিনি দরিদ্রের দুঃখে সদা কাতর। শৈশব থেকে তাঁর এই স্বভাব। ভিক্ষুককে অন্নবস্ত্র দানই হোক কিংবা আতুরের সেবা— সবসময় তিনি সাধারণ মানুষের কথা ভেবে গিয়েছেন।
সেই কবে স্বামীজি লিখেছিলেন, ‘‘অল্প অল্প কলকব্জা ভাল। মেলা কলকব্জা মানুষের বুদ্ধিশুদ্ধি লোপাপত্তি করে জড়পিণ্ড তৈয়ার করে। কারখানায় লোকগুলো দিনের পর দিন, রাতের পর রাত, বছরের পর বছর সেই একঘেয়ে কাজই কচ্চে—এক এক দলে এক একটা জিনিসের এক এক টুকরোই গড়ছে। পিনের মাথাই গড়ছে, সুতোর জোড়াই দিচ্চে, তাঁতের সঙ্গে এগু পেছুই কচ্চে— আজন্ম। ফল, ঐ কাজটিও খোয়ানো, আর তার মরণ—খেতেই পায় না। জড়ের মতো একঘেয়ে কাজ করতে করতে জড়বৎ হয়ে যায়। স্কুলমাস্টারি, কেরানিগিরি করে ওই জন্যই হস্তিমূর্খ জড়পিণ্ড তৈয়ার হয়!’’ কী অসামান্য দূরদৃষ্টি! অত্যধিক কলকবজা, যন্ত্রপাতি যে মানুষকে একান্তভাবে যন্ত্রনির্ভর করে তোলে তার অজস্র উদাহরণ আমরা প্রতিনিয়ত পাই। এখন কোনও চিকিৎসকের চেম্বারে গেলে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায় চিকিৎসক একগাদা পরীক্ষা (টেস্ট) করতে দিয়েছেন। আগে কিন্তু এ ব্যাপারটা ছিল না। চিকিৎসকরা রোগীকে দেখে, নাড়ি টিপে মোটামুটি তার রোগনির্ণয় করতে পারতেন। কিন্তু এখন অজস্র যন্ত্রপাতি আবিষ্কার হয়েছে চিকিৎসাক্ষেত্রে, পাল্লা দিয়ে বেড়েছে ডাক্তারবাবুদের অত্যাধিক যন্ত্রনির্ভরতা। তাঁদের মৌলিকত্ব কমে যাচ্ছে। মাথা খাটানোর তাগিদ কিংবা প্রয়োজন কোনওটাই আর হচ্ছে না। ফলে ধীরে ধীরে তাঁদের মস্তিষ্ক ভোঁতা হয়ে যাচ্ছে। স্বামীজি কথিত ‘‘জড়পিণ্ডে’’ সত্যিই পরিণত হচ্ছেন তাঁরা। এমনকি, সামান্য যোগ-বিয়োগ-গুণ-ভাগ করার জন্যও মানুষ ক্যালকুলেটরের সাহায্য নিচ্ছে। কখনও যদি যন্ত্রটা বিগড়ে যায়, হাতে লিখে অঙ্কটা কষতে পারবেন না তাঁরা। আবার কলকারখানার শ্রমিকদের উদাহরণ দিয়ে দেখাচ্ছেন, কেন মানুষের নানা ধরনের বিদ্যে জেনে রাখা দরকার। দেশে যদি কোনওদিন কাঠের আকাল হয়, ছুতোর মিস্ত্রি কাজ পাবেন না। কিন্তু তিনি যদি ধাতুর আসবাব বানানোর পদ্ধতিটাও শিখে রাখেন, না খেয়ে মরতে হবে না তাঁকে। একজন ধুনুরির চাষবাসের কাজটা জানা থাকলে আপৎকালে কাজে লাগতে পারে। তাঁতির যদি পাঁউরুটি তৈরির পদ্ধতিটা রপ্ত থাকে, তাঁতের কারখানা বন্ধ হয়ে গেলে তিনি অন্য জায়গায় কাজ পেয়ে যাবেন। অধ্যাপক মশাই বৈদ্যুতিন যন্ত্রপাতি সারাতে পারলে, কাজ চলে গেলে রুজির অভাব হয় না।
একজন শিক্ষক কী করেন? ছাত্র পড়ান। আপাতভাবে এ কাজ অতীব প্রশংসনীয়। কিন্তু একটু বিশ্লেষণ করলেই বোঝা যায় যে, তিনি যা করেন সেটা হল—বছরের পর বছর একই পাঠ্যক্রম অনুযায়ী পড়ানো। যতদিন পর্যন্ত না সেখানে বদল আসে, তাঁকে সেই একই জিনিস পাঠন করিয়ে যেতে হয়। ফলে মস্তিষ্ক উন্নত হওয়ার, প্রসারিত হওয়ার সুযোগ পায় না। তিনি যদি কোনও উচ্চাঙ্গের চর্চা ব্যক্তিগতভাবে করেন আলাদা কথা, কিন্তু কর্মক্ষেত্রে তাঁর সেই সুবিধা নেই। অন্যত্রও [‘স্বামি-শিষ্য-সংবাদ’ গ্রন্থ, ১৮ পরিচ্ছেদ] বিবেকানন্দ বলেছেন, ‘‘অনেকদিন মাস্টারি করলে বুদ্ধি খারাপ হয়ে যায়; জ্ঞানের বিকাশ হয় না। দিনরাত ছেলের দলে থেকে ক্রমে জড়বৎ হয়ে যায়।’’ একই রকম ভাবে অফিসের কেরানীকুল সমগ্র চাকরিজীবনে প্রায় একই ধরনের কাজ করে করে স্থবির হয়ে যায়। নতুন কিছু উদ্ভাবনের প্রশ্নই সেখানে থাকে না। যেটুকু তাঁদের শিখিয়ে দেওয়া হয়, জীবনভর তাই তাঁরা করে যান।
এসেছে ইংরেজের অমানবিকতার প্রসঙ্গ। স্বামীজি বহু স্থানে ইংরেজের সঙ্গত প্রশংসা করেছেন; আবার দোষ-ত্রুটির উল্লেখ করতেও কসুর করেননি। ভারতীয় মাত্রেই ইংরেজের কাছে ‘নেটিভ’। তাদের প্রতি ব্যবহারও ছিল তদ্রূপ। কেবল ইংরেজ নয়, অন্যান্য দেশেরও শ্বেতাঙ্গ মানুষদের অশ্বেতাঙ্গের প্রতি অবজ্ঞা ছিল সাঙ্ঘাতিক। স্বামীজি লিখছেন, ‘‘আর যা কিছু সাহেব হবার সাধ ছিল, মিটিয়ে দিলে মার্কিন-ঠাকুর। দাড়ির জ্বালায় অস্থির, কিন্তু নাপিতের দোকানে ঢোকবামাত্রই বললে ‘ও চেহারা এখানে চলবে না’! মনে করলুম, বুঝি পাগড়ি-মাথায় গেরুয়া রঙের বিচিত্র ধোকড়া-মন্ত্র গায়, অপরূপ দেখে নাপিতের পছন্দ হল না; তা একটা ইংরেজী কোট আর টোপা কিনে আনি। আনি আর কি—ভাগ্যিস একটি ভদ্র মার্কিনের সঙ্গে দেখা; সে বুঝিয়ে দিলে যে বরং ধোকড়া আছে ভাল, ভদ্রলোকে কিছু বলবে না, কিন্তু ইওরোপী পোষাক পরলেই মুশকিল, সকলেই তাড়া দেবে। আরও দু-একটা নাপিত ঐ প্রকার রাস্তা দেখিয়ে দিলে। তখন নিজের হাতে কামাতে ধরলুম। খিদেয় পেট জ্বলে যায়, খাবার দোকানে গেলুম, ‘অমুক জিনিষটা দাও’; বললে ‘নেই’। ‘ঐ যে রয়েছে’। ‘ওহে বাপু সাদা ভাষা হচ্চে, তোমার এখানে বসে খাবার জায়গা নেই’। ‘কেন হে বাপু’? ‘তোমার সঙ্গে যে খাবে, তার জাত যাবে’।’’ ঠিক এরপরই বর্ষিত হয়েছে তীব্র শ্লেষ, ‘‘তখন অনেকটা মার্কিন মুলুককে দেশের মত ভাল লাগতে লাগল। যাক পাপ কালা আর ধলা, আর এই নেটিভের মধ্যে উনি পাঁচ পো আর্য রক্ত, উনি চার পো, উনি দেড় ছটাক কম, ইনি আধ ছটাক, আধ কাঁচ্চা বেশী ইত্যাদি—বলে ‘ছুঁচোর গোলাম চামচিকে, তার মাইনে চোদ্দ সিকে’। একটা ডোম বলত, ‘আমাদের চেয়ে বড় জাত কি আর দুনিয়ার আছে? আমরা হচ্চি ডমমমম’! কিন্তু মজাটি দেখছ? জাতের বেশী বিটলেমিগুলো—যেখানে গাঁয়ে মানে না আপনি মোড়ল, সেইখানে!’’ আরও লিখছেন, ‘‘তবে আমরা দেশে শুনি আমাদের ভেতর অমুক ভদ্র জাত, অমুক ছোট জাত; সরকারের (ইংরেজ সরকার) কাছে সব ‘নেটিভ’। মহারাজা, রাজা, ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র— সব এক জাত—‘নেটিভ’। কুলীর আইন, কুলীর যে পরীক্ষা, তা সকল ‘নেটিভের’ জন্য— ধন্য ইংরেজ সরকার! এক ক্ষণের জন্যও তোমার কৃপায় সব ‘নেটিভের’ সঙ্গে সমত্ব বোধ করলেম। বিশেষ, কায়স্থকুলে এ শরীরের পয়দা হওয়ায়, আমি তো চোরের দায়ে ধরা পড়েছি।’’
কতখানি সীমাবদ্ধ এই জাতপাত নামক ব্যাপারটা, এখানে চমৎকার বুঝিয়েছেন। অবশ্য এ কথা কেবল হিন্দুদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়, বিশ্বের প্রায় প্রতিটি জাতের মধ্যেই বর্ণভেদ আছে। কিন্তু, দেখবার বিষয়—সেগুলির গুরুত্ব কেবল সংশ্লিষ্ট জাতের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। ভিন ধর্মাবলম্বী মানুষদের সে বিষয়ে বিশেষ কোনও ধারণা বা আগ্রহ নেই। তাই হিন্দুদের ভেতরে ব্রাহ্মণ-কায়স্থ-শূদ্র-দলিত নিয়ে যে মারপিট, ইংরেজের কাছে ও-সবের কোনও মূল্য নেই। অতএব বহির্জগতে বেরোলেই এইসব সংস্কারের প্রকৃত চেহারাটা মানুষ বুঝতে পারে। তার কাছে যা অমূল্য, অন্যের কাছে তা ভিত্তিহীন; বিপরীতভাবে অন্যের কাছে যার গুরুত্ব অপরিসীম, তার কাছে তা মূল্যহীন। ইংরেজ যেভাবে ভারতীয়দের তথা হিন্দুদের ব্রাহ্মণ-কায়স্থ মানে না, ভারতীয়রাও ইংরেজের ‘ব্লু ব্লাড’-‘নন-ব্লু ব্লাড’ সম্পর্কে উদাসীন। এই জাতপাত বিষয়টা একান্তভাবে গোষ্ঠীনির্ভর— স্বামীজি একথাই বলতে চেয়েছেন। জাতপাত নিয়ে আরও তামাশা করছেন, ‘‘এখন সকলে জাতির মুখে শুনছি, তাঁরা নাকি পাকা আর্য! তবে পরস্পরের মধ্যে মতভেদ আছে—কেউ চার পো আর্য, কেউ এক ছটাক কম, কেউ আধ কাঁচ্চা! তবে সকলেই আমাদের পোড়া জাতের চেয়ে বড়, এতে একবাক্য! আর শুনি, ওঁরা আর ইংরেজরা নাকি এক জাত, মাসতুতো ভাই; ওঁরা কালা আদমী নন। এ দেশে দয়া করে এসেছেন, ইংরেজের মতো। আর বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ, মূর্তিপূজা, সতীদাহ, জেনানা পর্দা ইত্যাদি ইত্যাদি—ও-সব ওঁদের ধর্মে আদৌ নাই। ও-সব ঐ কায়েত-ফায়েতের বাপ-দাদা করেছে। আর ওঁদের ধর্মটা ঠিক ইংরেজদের ধর্মের মতো। ওঁদের বাপ-দাদা ঠিক ইংরেজদের মতো ছিল; কেবল রোদ্দুরে বেড়িয়ে বেড়িয়ে কালো হয়ে গেল! এখন এস না এগিয়ে? ‘সব নেটিভ’, সরকার বলছেন। ও কালোর মধ্যে আবার এক পোঁচ কম বেশী বোঝা যায় না ; সরকার বলছেন, সব নেটিভ। সেজেগুজে বসে থাকলে কী হবে বলো? ও টুপি-টাপা মাথায় দিয়ে আর কী হবে বলো? যত দোষ হিঁদুর ঘাড়ে ফেলে সাহেবের গা ঘেঁষে দাঁড়াতে গেলে, লাথি-ঝাঁটার চোটটা বেশী বই কম পড়বে না। ধন্য ইংরেজরাজ! তোমার ধনে-পুত্রে লক্ষী লাভ তো হয়েছেই, আরও হোক, আরও হোক। কপনি, ধুতির টুকরো পরে বাঁচি। তোমার কৃপায় শুধু-পায়ে শুধু-মাথায় হিল্লি দিল্লি যাই, তোমার দয়ায় হাত চুবড়ে সপাসপ দাল-ভাত খাই। দিশি সাহেবিত্ব লুভিয়েছিল আর কি, ভোগা দিয়েছিল আর কি। দিশি কাপড় ছাড়লেই, দিশি ধর্ম ছাড়লেই, দিশি চাল-চলন ছাড়লেই ইংরেজ রাজা মাথায় করে নাকি নাচবে শুনেছিলুম, করতেও যাই আর কি, এমন সময় গোরা পায়ের সবুট লাথির হুড়োহুড়ি, চাবুকের সপাসপ! পালা পালা, সাহেবিতে কাজ নেই, নেটিভ কবলা। ‘সাধ করে শিখেছিনু সাহেবানি কত, গোরার বুটের তলে সব হৈল হত’। ধন্য ইংরেজ সরকার! তোমার ‘তখৎ তাজ অচল রাজধানী’ হউক।’’ স্বামীজি বোঝাচ্ছেন, কাক ময়ূরপুচ্ছধারী হলেও কাক-ই থাকে (কথাটা এখানে তুলনা হিসেবে নয়, উদাহরণ হিসেবে ধরতে হবে)। অর্থাৎ কারও অনুকরণ করতে যাওয়াটা নির্বুদ্ধিতার পরিচায়ক। বিশেষত, তথাকথিত মর্যাদায় যে উঁচু, তার অনুকরণ করে তার কাছাকাছি ঘেঁষার চেষ্টা অতি অনুচিত ও হাস্যকর। এভাবে কখনওই ভৃত্য, প্রভুর সমান হতে পারে না। প্রভু চিরকাল তাকে পায়ের নিচেই রাখবে। মনে পড়ে যাচ্ছে খুশবন্ত সিং-এর ‘কর্ম’ গল্পটির কথা। সাহেব সাজতে গিয়ে ভারতীয় ভদ্রলোক কী অপদস্থ! সঙ্গে সঙ্গে ইংরেজের চরম অসভ্যতার দিকেও ইঙ্গিত করেছেন স্বামীজি—একটা দেশে উড়ে এসে জুড়ে বসল, সেই দেশের যথাসর্বস্ব গ্রাস করল, তথাপি সেই দেশের লোকেদেরই অপমান করতে লাগল।
একটু অন্য প্রসঙ্গে যাই। জাহাজের অধঃস্তন কর্মচারীদের দেখে বিবেকানন্দ যারপরনাই প্রীত, ‘‘এই সকল বাঙালী খালাসী, কয়লাওয়ালা, খানসামা প্রভৃতির কাজ দেখে, স্বজাতির উপর যে একটা হতাশ বুদ্ধি আছে, সেটা অনেকটা কমে গেল। এরা কেমন আস্তে আস্তে মানুষ হয়ে আসছে, কেমন সবলশরীর হয়েছে, কেমন নির্ভীক অথচ শান্ত! সে নেটিভি পা-চাটা ভাব মেথরগুলোরও নেই—কি পরিবর্তন!’’ চিরকালই ব্যবহারিক উন্নতিকে স্বামীজি উঁচু মর্যাদা দিয়ে এসেছেন। নিজে সন্ন্যাসী হওয়া সত্ত্বেও কেবল অধ্যাত্ম-চর্চাকেই যে সর্বস্ব করে নেননি—সে কথা আগেই বলেছি। এখানে, ‘‘কেমন নির্ভীক অথচ শান্ত’’—গভীর উপলব্ধিসম্ভূত বাক্য। নির্ভীক বা সাহসী হওয়ার অর্থ অনেকে বোঝেন—কারও দিকে তেড়ে যে যায় অথবা তেড়ে যাওয়া, লম্ফঝম্প করা। স্বামীজি সেই ত্রুটি নরমভাবে শুধরে দিয়েছেন। কূপমণ্ডূক বাঙালি ঘর ছেড়ে জাহাজে চাকরি করতে এসেছে, এতে স্বামীজি পরম আনন্দিত। নিষ্কর্মা হয়ে বাড়িতে বসে থাকা তিনি কোনওকালেই পছন্দ করতেন না। নানা জায়গায় বলেছেন বাঙালিকে বাণিজ্য করতে, দূর দেশে যেতে। আর যদিও চাকরির ওপর ছিলেন হাড়ে চটা, তবে জাহাজের চাকরি কেরানির চাকরির মতো নয় বলে স্বামীজি এর প্রশংসা করেছেন। এ কাজ ব্যতিক্রমী, অনেক সাহসের প্রয়োজন। তাঁর চাকরি-বিষয়ক আরও কিছু মন্তব্য ‘স্বামীজির স্মৃতি’ রচনায় আছে—‘‘একটু technical education (কারিগরি শিক্ষা) পেলে লোকগুলো কিছু করে খেতে পারবে, চাকরি চাকরি করে আর চেঁচাবে না।’’ পুনরায় বলছেন, ‘‘আমাদের চাই কী জানিস? স্বাধীনভাবে স্বদেশী বিদ্যার সঙ্গে ইংরেজি আর science (বিজ্ঞান) পড়ানো; চাই technical education (কারিগরি শিক্ষা), চাই যাতে industry (শিল্প) বাড়ে; লোকে চাকরি না করে দু-পয়সা করে খেতে পারে।’’ চাকরি সম্পর্কে যখন কথা বলা হচ্ছে, তখন স্বামীজির এই কথাগুলিই বা বাকি রাখি কেন? কী ভাষায় তিনি আক্রমণ করেছেন দেখা যাক ‘স্বামি-শিষ্য-সংবাদ’-এ শিষ্য শরচ্চন্দ্র চক্রবর্তীকে—‘‘তোরা কী করছিস? এত বিদ্যা শিখে পরের দোরে ভিখারীর মত ‘চাকরি দাও, চাকরি দাও’ বলে চেঁচাচ্ছিস। জুতো খেয়ে খেয়ে—দাসত্ব করে করে তোরা কি আর মানুষ আছিস! তোদের মূল্য এক কানাকড়িও নয়। এমন সজলা সফলা দেশ, যেখানে প্রকৃতি অন্য সকল দেশের চেয়ে কোটিগুণে ধন-ধান্য প্রসব করছেন, সেখানে দেহধারণ করে তোদের পেটে অন্ন নেই, পিঠে কাপড় নেই! যে দেশের ধন-ধান্য পৃথিবীর অন্য সব দেশে civilization (সভ্যতা) বিস্তার করেছে, সেই অন্নপূর্ণার দেশে তোদের এমন দুর্দশা? ঘৃণিত কুক্কুর অপেক্ষাও যে তোদের দুর্দশা হয়েছে! তোরা আবার তোদের বেদবেদান্তের বড়াই করিস! যে জাত সামান্য অন্নবস্ত্রের সংস্থান করতে পারে না, পরের মুখাপেক্ষী হয়ে জীবনধারণ করে, সে জাতের আবার বড়াই! ধর্মকর্ম এখন গঙ্গায় ভাসিয়ে আগে জীবনসংগ্রামে অগ্রসর হ। ভারতে কত জিনিষ জন্মায়। বিদেশী লোক সেই raw material (কাঁচা মাল) দিয়ে তার সাহায্যে সোনা ফলাচ্ছে। আর তোরা ভারবাহী গর্দভের মত তাদের মাল টেনে মরছিস। ভারতে যে-সব পণ্য উৎপন্ন হয়, দেশবিদেশের লোক তাই নিয়ে তার ওপর বুদ্ধি খরচ করে, নানা জিনিষ তয়ের করে বড় হয়ে গেল; আর তোরা তোদের বুদ্ধিটাকে সিন্দুকে পুরে রেখে ঘরের ধন পরকে বিলিয়ে ‘হা অন্ন, হা অন্ন’ করে বেড়াচ্ছি। ’’ শুধু বলেই থামেননি, ব্যবসার রাস্তা দেখিয়ে দিয়েছেন—‘‘ টাকা না জোটে তো জাহাজের খালাসী হয়ে বিদেশে চলে যা। দিশী কাপড়, গামছা, কুলো, ঝাঁটা মাথায় করে আমেরিকা-ইওরোপে পথে পথে ফেরি করগে। দেখবি—ভারত-জাত জিনিষের এখনও কত কদর! আমেরিকায় দেখলুম, হুগলী জেলার কতকগুলি মুসলমান ঐরূপে ফেরি করে করে ধনবান হয়ে পড়েছে। তাদের চেয়েও কি তোদের বিদ্যাবুদ্ধি কম? এই দেখ না—এদেশে যে বেনারসী শাড়ী হয়, এমন উৎকৃষ্ট কাপড় পৃথিবীর আর কোথাও জন্মায় না। এই কাপড় নিয়ে আমেরিকায় চলে যা। সে দেশে ঐ কাপড়ে গাউন তৈরী করে বিক্রী করতে লেগে যা, দেখবি কত টাকা আসে।... আমার বহু বন্ধুবান্ধব সে দেশে আছে। আমি তোকে তাদের কাছে introduce (পরিচিত) করে দিচ্ছি। তাদের ভেতর ঐগুলি অনুরোধ করে প্রথমটা চালিয়ে দেব। তারপর দেখবি—কত লোক তাঁদের follow (অনুসরণ) করবে। তুই তখন মাল দিয়ে কুলিয়ে উঠতে পারবিনি।... আমি যে করে হোক তোকে start (আরম্ভ) করিয়ে দেব। তারপর কিন্তু তোর নিজের উদ্যমের উপর সব নির্ভর করবে।... চাকরিতে গোলামিতে এত দুঃখ দেখেও তোদের চেতনা হচ্ছে না, কাজেই দুঃখও দূর হচ্ছে না! এ নিশ্চয়ই দৈবী মায়ার খেলা! ওদেশে (আমেরিকায়) দেখলুম, যারা চাকরি করে, parliament-এ (জাতীয় সমিতিতে) তাদের স্থান পেছনে নির্দিষ্ট। যারা নিজের উদ্যমে বিদ্যায় বুদ্ধিতে স্বনামধন্য হয়েছে, তাদের বসবার জন্যই front seat (সামনের আসনগুলি)। ও-সব দেশে জাত-ফাতের উৎপাত নেই। উদ্যম ও পরিশ্রমে ভাগ্যলক্ষ্মী যাঁদের প্রতি প্রসন্না, তাঁরাই দেশের নেতা ও নিয়ন্তা বলে গণ্য হন। আর তোদের দেশে জাতের বড়াই করে করে তোদের অন্ন পর্যন্ত জুটছে না। একটা ছুঁচ গড়বার ক্ষমতা নেই, তোরা আবার ইংরেজদের criticize (দোষগুণ-বিচার) করতে যাস— আহম্মক! ওদের পায়ে ধরে জীবন-সংগ্রামোপযোগী বিদ্যা, শিল্পবিজ্ঞান, কর্মতৎপরতা শিখগে। যখন উপযুক্ত হবি, তখন তোদের আবার আদর হবে। ওরাও তখন তোদের কথা রাখবে। কোথাও কিছুই নেই, কেবল Congress (কংগ্রেস—জাতীয় মহাসমিতি) করে চেঁচামিচি করলে কী হবে?...কয়েকটা পাস দিলে বা ভাল বক্তৃতা করতে পারলেই তোদের কাছে শিক্ষিত হল! যে বিদ্যার উন্মেষে ইতর-সাধারণকে জীবনসংগ্রামে সমর্থ করতে পারা যায় না, যাতে মানুষের চরিত্রবল, পরার্থতৎপরতা, সিংহসাহসিকতা এনে দেয় না, সে কি আবার শিক্ষা? যে শিক্ষায় জীবনে নিজের পায়ের উপরে দাঁড়াতে পাড়া যায়, সেই হচ্ছে শিক্ষা। আজকালকার এই সব স্কুল-কলেজে পড়ে তোরা কেমন এক প্রকারের একটা dyspeptic (অজীর্ণ রোগাক্রান্ত) জাত তৈরী হচ্ছিস। কেবল machine (কল)-এর মত খাটছিস, আর ‘জায়স্ব ম্রিয়স্ব’ এই বাক্যের সাক্ষিস্বরূপ হয়ে দাঁড়িয়েছিস। এই যে চাষাভুষো, মুচি-মুদ্দাফরাশ—এদের কর্মতৎপরতা ও আত্মনিষ্ঠা তোদের অনেকের চেয়ে ঢের বেশী। এরা নীরবে চিরকাল কাজ করে যাচ্ছে, দেশের ধন-ধান্য উৎপন্ন করছে, মুখে কথাটি নেই। এরা শীঘ্রই তোদের উপরে উঠে যাবে! Capital (মূলধন) তাদের হাতে গিয়ে পড়ছে—তোদের মত তাদের অভাবের জন্য তাড়না নেই। বর্তমান শিক্ষায় তোদের বাহ্যিক হাল-চাল বদলে দিচ্ছে, অথচ নূতন নূতন উদ্ভাবনী শক্তির অভাবে তোদের অর্থাগমের উপায় হচ্ছে না। তোরা এই-সব সহিষ্ণু নীচ জাতদের ওপর এতদিন অত্যাচার করেছিস, এখন এরা তার প্রতিশোধ নেবে। আর তোরা ‘হা চাকরি, জো চাকরি’ করে করে লোপ পেয়ে যাবি।’’ কিন্তু বক্তা যখন বিবেকানন্দ, কিছু বৈশিষ্ট্য থাকবেই কথায়—যা আগেও বলেছি। এতসব বলার পর তিনি বলছেন, ‘‘হয় ঐ-প্রকার উদ্যোগ উদ্যম করে সংসারে successful (গণ্য মান্য সফল) হ—নয় তো সব ছেড়ে-ছুড়ে দিয়ে আমাদের পথে আয়। দেশ-বিদেশের লোককে ধর্ম উপদেশ দিয়ে তাদের উপকার কর।’’ অর্থাৎ, হয় ব্যবহারিক নয় আধ্যাত্মিক—যে কোনও একটা উন্নতির রাস্তা যেন মানুষ ধরে। একান্তই আধ্যাত্মিক উন্নতির পথে যাওয়া যদি কারও পক্ষে সম্ভব না হয়, সেক্ষেত্রে তার অবশ্যই ব্যবহারিক উন্নতির চেষ্টা করা উচিত। তারও একটা উপকার বা প্রয়োজনীয়তা আছে। সৎ-পরোপকারী মানুষ টাকাকড়ি-ধনদৌলত উপার্জন করলে অনেক সময় দরিদ্রের কথা ভাবে, তাদের উন্নতিতে সহায় হয়। বর্তমান সময়ের বেশিরভাগ ধনী ব্যক্তি হয়তো অসৎ; বিবিধ অনৈতিক উপায়ে অর্থ উপার্জনের মাধ্যমে তাঁরা সমৃদ্ধশালী হয়েছেন। কিন্তু কিছু মানুষ চিরকাল সৎ ছিলেন, এখনও আছেন। তাঁরা সৎ উপায়েই ধন উপার্জন করেন। এবং অনেকেই দরিদ্রের জন্য দানধ্যান, দরিদ্র ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা, কাজকর্ম জুটিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে সহায় হন।
আর কেউ যদি অধ্যাত্মপথে অগ্রসর হয়, তাহলে কোনও কথা থাকে না। সে তো অমৃতের রাস্তা, নিজে মুক্ত হব ভববন্ধন থেকে এবং অপরকেও মুক্ত করব। মানুষকে আত্মসম্পদ দান তথা অধ্যাত্মসম্পদ দান মহাদান, সর্বশ্রেষ্ট দান।
এই প্রবন্ধটির (‘জাহাজের কথা’) শেষে সিপাহী বিদ্রোহ সম্পর্কে যে কথা বলেছেন তা অতুলনীয়—‘‘জেনারেল ষ্ট্রঙ নামক এক ইংরেজ বন্ধু সিপাহী-হাঙ্গামার সময় এদেশে ছিলেন। তিনি ‘গদরে’র গল্প অনেক করতেন। একদিন কথায় কথায় জিজ্ঞাসা করা গেল যে, সিপাহীদের এত তোপ বারুদ রসদ হাতে ছিল, আবার তারা সুশিক্ষিত ও বহুদর্শী, তবে এমন করে হেরে মলো কেন? জবাব দিলেন যে, তার মধ্যে যারা নেতা হয়েছিল, সেগুলো অনেক পেছনে থেকে ‘মারো বাহাদুর’ ‘লড়ো বাহাদুর’ করে চেঁচাচ্ছিল; অফিসার এগিয়ে মৃত্যুমুখে না গেলে কি সিপাহী লড়ে? সকল কাজেই এই। ‘শিরদার তো সরদার’; মাথা দিতে পারো তো নেতা হবে। আমরা সকলেই ফাঁকি দিয়ে নেতা হতে চাই; তাইতে কিছুই হয় না, কেউ মানে না!’’ বর্তমান নেতাদেরও এ কথাটা স্মরণে রাখা উচিত মনে করি।
স্বামীজির বিদ্যোৎসাহিতার কথা অনেকেই জানেন। বেলুড় মঠে তিনি গুরুভাইদের ধর্ম-আধ্যাত্মিকতা ছাড়াও নানা বিষয়ে লেখাপড়া করার উৎসাহ দিতেন। নিজে অজস্র পড়াশোনা তো করতেনই। ‘ইউরোপী সভ্যতা’ প্রবন্ধে বলেছেন, ‘‘পাশ্চাত্য বুধমণ্ডলী এই প্রকার দেশ-দেশান্তরের ধর্ম, নীতি, জাতি ইত্যাদির আলোচনা করছেন। আমাদের বাঙলা ভাষায় কিছুই নাই। হবে কী করে?—এক বেচারা ১০ বৎসর হাড়গোড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করে যদি এই রকম একখানা বই তর্জমা করে তো সে নিজেই বা খায় কী, আর বই বা ছাপায় কী দিয়ে? একে দেশ অতি দরিদ্র, তাতে বিদ্যা একেবারে নেই বললেই হয়। এমন দিন কি হবে যে, আমরা নানাপ্রকার বিদ্যার চর্চা করব?’’ আশ্চর্যের বিষয়, এখনও পর্যন্ত অবস্থার বিশেষ পরিবর্তন হয়নি। বঙ্গ-লেখককুলের অধিকাংশই এখনও দরিদ্র অবস্থায় পতিত। কেবল সৎভাবে সাহিত্যচর্চা করে পেট চালানোটুকুই কঠিন একজন বাঙালি লেখকের। আর সে সাহিত্য যদি উচ্চাঙ্গের হয়, পরিস্থিতি অধিকতর কঠিন হয়ে পড়ে। কারণ, বাজে গল্প-উপন্যাসের পাঠক যদি বা কিছু আছে, বইপত্র যদি বা কিছু বিক্রি হয়, উচ্চস্তরের গবেষণাঋদ্ধ লেখালেখির গ্রাহক অতি অল্প। ফলে উপার্জনের দিকটা একেবারে বন্ধ হয়ে যায়। বাঙালি লেখককে তাই সংসারের জোয়াল টানতে নানাপ্রকার অবান্তর কাজ করতে হয়, যা তার সৃষ্টিতে ব্যাঘাত ঘটায়। কিন্তু কিছু করারও থাকে না। ফলে এখনও পর্যন্ত বিশ্বসাহিত্যের, বিশ্ব-সভ্যতাসংস্কৃতির অজস্র সৃষ্টি বাংলা ভাষায় অধরা থেকে গিয়েছে। যেটুকু অনুবাদ হয়, তারও অধিকাংশই নিম্নমানের। কারণ যোগ্য ব্যক্তিরা নানা কারণে কোনও কিছু বাংলায় অনুবাদ করার উৎসাহ পান না। এই প্রবন্ধেই ইউরোপ ও বিশেষত আমেরিকার উন্নতি প্রসঙ্গে স্বামীজি কয়েকটি অমোঘ উক্তি করেছেন, ‘‘গরীব নিম্নজাতিদের মধ্যে বিদ্যা ও শক্তির প্রবেশ যখন থেকে হতে লাগল, তখন থেকেই ইওরোপ উঠতে লাগলো। রাশি রাশি অন্য দেশের আবর্জনার ন্যায় পরিত্যক্ত দুঃখী গরীব আমেরিকায় স্থান পায়, আশ্রয় পায়; এরাই আমেরিকার মেরুদণ্ড! বড়মানুষ, পণ্ডিত, ধনী—এরা শুনলে বা না শুনলে, বুঝলে বা না বুঝলে, তোমাদের গাল দিলে বা প্রশংসা করলে কিছুই এসে যায় না; এঁরা হচ্চেন শোভামাত্র, দেশের বাহার। কোটি কোটি গরীব নীচ যারা, তারাই হচ্চে প্রাণ।’’ অনেক বড় বড় ঐতিহাসিক, চিন্তাবিদ-দার্শনিকও এত প্রাঞ্জলভাবে বিষয়টা বোঝাতে পারতেন কিনা, কে জানে।
নির্মোহ দৃষ্টি ছিল বিবেকানন্দের। তাই বুদ্ধদেবের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা থাকলেও একশ্রেণীর বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীকে রেয়াত করেননি—‘‘বৌদ্ধরা বড় শান্ত, সকল ধর্মের উপর সমদৃষ্টি— এই তো শুনেছিলুম। বৌদ্ধ প্রচারকেরা আমাদের কলকেতায় এসে রঙ-বেরঙের গাল ঝাড়ে; অথচ আমরা তাদের যথেষ্ট পূজো করে থাকি। অনুরাধাপুরে প্রচার করছি একবার, হিঁদুদের মধ্যে—বৌদ্ধদের [মধ্যে] নয়—তাও খোলা মাঠে, কারুর জমিতে নয়। ইতিমধ্যে দুনিয়ার বৌদ্ধ ‘ভিক্ষু’-গৃহস্থ, মেয়ে-মদ্দ, ঢাক ঢোল কাঁসি নিয়ে এসে সে যে বিটকেল আওয়াজ আরম্ভ করলে, তা আর কী বলব! লেকচার তো ‘অলমিতি’ হল; রক্তারক্তি হয় আর কি! অনেক করে হিঁদুদের বুঝিয়ে দেওয়া গেল যে, আমরা নয় একটু অহিংসা করি এস—তখন শান্ত হয়।’’ নিজের মধ্যে কখনও এই সহিষ্ণুতার অভাব ছিল না বিবেকানন্দের। তিনি যে-ধর্মের প্রতিনিধি, তার অসঙ্গত নিন্দা কেউ করলে প্রতিবাদ করেছেন, যুক্তি দিয়ে বুঝিয়ে। তেজ আর হিংসা যে এক নয়— স্বামীজির চরিত্র থেকে এটি শেখা দরকার।