ইলশেগুঁড়ি ২৯তম সংখ্যা (শারদীয়া)
ইলশেগুঁড়ি ২৯তম সংখ্যা (শারদীয়া)
সুকান্ত কোন এক অপার্থিব শক্তির বলে ছবিটা নামিয়ে আবার অঞ্জলি দেবীর কাছে দিল আর অঞ্জলি দেবী পরম মমতায় ব্যাণ্ডেজ বাঁধতে লাগলেন ছবির গায়ে।
পর্ব-১
‘‘আশাদি, আজ মা কেমন আছে? একটু স্বাভাবিক হয়েছে?’’
‘‘হ্যাঁ, ঠিকই আছেন। খাওয়া-দাওয়াও করছেন। শুধু একটু আপন মনে বকবক করছেন, এই যা। এতো বছরের সংসার জীবন মেসোমশাইয়ের সাথে আর এই বয়সে ছাড়াছাড়ি। যে মানুষটাকে একদিনও চোখের আড়াল করেননি, সেই মানুষটার চলে যাওয়া মানতে তো একটু সময় লাগবেই। এখন কথা বলবে তো মায়ের সাথে?’’
‘‘হ্যাঁ দাও।’’
‘‘ও মাসিমা, সুকান্ত দাদাবাবু ফোন করেছে।’’
‘‘কে সুকু? দে, দে। আমার আজ অনেক কথা বলার আছে ওকে। সুকু, কেমন আছিস তোরা? পিকুবাবু কেমন আছে? এই ফিরলি নাকি অফিস থেকে? বৌমা কখন ফিরল?’’
‘‘আমরা সবাই ভালো আছি মা। ও আর আমি একসাথেই ফিরেছি, ঘন্টাখানেক আগেই। তোমার পিকুবাবুকে পড়া দেখাতে গিয়েই দেরী হয়ে গেল ফোন করতে। তুমি কেমন আছো মা? খাওয়া-দাওয়া করেছো ঠিকমতো?’’
‘‘আমি ঠিকই আছি। তোর বাবা কিন্তু আগের থেকে বেশ সেরে উঠেছে জানিস সুকু। এখন দেখে কেমন আমার থেকেও বয়স কম মনে হয়। সুগারটাও নর্মাল হয়ে গেছে। খুব রসগোল্লা খাওয়ার জন্য বায়না করছে। দেবো রে বাবা? এখন তো সুগার নেই। জানিস তো মানুষটা চিরদিনই খেতে কতো ভালোবাসে। কিন্তু সুগার হওয়ার পর থেকে তো কতো কিছুই দিতে পারিনি, চাইলেও মানা করেছি। কিন্তু আজ যখন ভালো আছে, তখন একটু দিই না, কিছু হবে না তুই দেখিস। ঐ আশাটাকে বলে দিস তো, নাহলে এনে দেবে না। ভাববে আমি সুগার নিয়েও নিজে মিষ্টি খাবো বলে বলছি। বল দেখি আমি কেন খেতে যাবো, যেখানে তোর বাবা সাধ করে খেতে চেয়েছে, তাকে না দিয়ে! একটু বলে দে, কাল যেন এনে দেয় সকালেই। আমি ওকে ডেকে দিচ্ছি।’’
‘‘ঠিক আছে মা, কিন্তু দুটোর বেশি নয়। বাবার এখন সুগার কম আছে ঠিকই, কিন্তু বেশি মিষ্টি খেলে তো বাড়তেও পারে। তাই জাস্ট দুটো, তাও রোজ কিন্তু নয় একদমই।’’
‘‘হ্যাঁ, তা ঠিকই বলেছিস। ঠিক আছে, আমি বাবাকে বুঝিয়ে বলে দেবো। তুই কালকের জন্যই আশাকে রসগোল্লা আনতে বলে দে, ঐ দুটোই। এই আশা ফোন ধর। দাদাবাবুর কথা শুনে নে ভালো করে।’’
‘‘আশাদি, কাল মাকে দুটো রসগোল্লা এনে দিও। কিন্তু ব্যাস দুটোই, তার বেশি একটাও নয়। মনে রেখো মায়ের কিন্তু সুগার আছে। আর কোনোদিন কিছু আনতে বললে, আমায় না জিজ্ঞেস করে আনবে না।’’
‘‘দাদা, রসগোল্লাই আনতে বলেছে? কিন্তু রসগোল্লা তো মাসিমা খায় না। ও তো মেসোমশাই ভালোবাসতো।’’
‘‘আরে হ্যাঁরে বাবা। এখন দেখতেই তো পাও, বাবা যা যা খেতে ভালোবাসতো, যা যা করতো, সবটাই মা করে, সেগুলোর জন্যই বায়না করে; হয়তো ভাবে এভাবেই বাবাকে পাওয়া যাবে। এতো কষ্ট লাগে, এতো অসহায় লাগে... যাইহোক আমি এখন রাখছি, আমার আর কিছু ভালো লাগছে না। শুধু তোমায় যা বললাম, সেটাই করবে। আর মায়ের খেয়াল রাখবে সবসময়। মা এখন নিজের মধ্যে নেই, তাই মায়ের কোনো কথায় কিছু মনে করো না, আর বেশি কিছু মাকে বলতেও যেও না। মাকে তুমি দেখো ভালো করে, আমরাও তোমাকে দেখবো আজীবন। রাখি।’’
মুম্বইয়ে চাকুরিরত অজ্ঞলি দেবীর একমাত্র ছেলে সুকান্তর এটাই দৈনন্দিন রুটিন হয়ে গেছে গত একমাস থেকে। উদ্বিগ্ন অবস্থায় রোজ বহুদিনের পরিচারিকা আশার সাথে নিত্য মায়ের ব্যপারে যোগাযোগ রাখা, খবরাখবর নেওয়া আর পরিশেষে একবুক হতাশা ও অসহায়তার যন্ত্রণায় বিদ্ধ হওয়া।
পর্ব-২
‘‘মিসেস রায়, এখন কেমন আছেন? ওষুধগুলো ঠিকমতো খাচ্ছেন তো?’’
‘‘আমি তো ঠিকই আছি। আমার ঘুম-টুমও ঠিকই হয়। তাহলে এবার ঐ ঘুমের ওষুধগুলো বন্ধ করলে হয় না? আমি এইজন্যই আরো বেশি করে রাজি হলাম, আজ আপনাকে দেখাতে। ঐ ওষুধগুলো খেলে আমার সকালে উঠতে অনেক দেরী হয়ে যায়।’’
‘‘তা এই বয়সে একটু দেরী করে উঠলে ক্ষতি কি? উনি (আশাকে দেখিয়ে) তো রয়েছেন সব কাজকর্ম, আপনার দেখাশোনার জন্য।’’
‘‘হ্যাঁ, সে ও-ই সব করে বটে, তবে ওনার কাজগুলো আমি না করে দিলে ওনার পছন্দ হয় না, আর আমারও চিরকালের অভ্যাস, ভালোলাগা, যাই বলুন। সেটুকুও যদি ঠিকমতো করতে না পারি, তখন খুব খারাপ লাগে। দিনটাই খারাপ লাগা দিয়ে শুরু করতে চাই না শুধু-শুধু। তাছাড়া ঘুমের ওষুধ তো খামোখা দীর্ঘদিন খাওয়াও ভালো নয়।’’
‘‘ওগুলো ঘুমের ওষুধ নয়, অ্যান্টি ডিপ্রেশনাল ড্রাগ। হঠাৎ করে মিস্টার রায় চলে যাওয়ার পর...’’
‘‘উনি যাননি তো কোথাও, এখানেই তো আছেন। শুধু উনি এখন কারো সঙ্গে দেখা করতে চান না, আমি ছাড়া। এটা একটা সমস্যা ঠিকই। কিন্তু, ওনার বরাবরই খুব জেদ, আপনি তো ওনাকেও কম বছর দেখেননি। ওনার জেদ সম্বন্ধে আপনি ওয়াকিবহাল। তাই এই বয়সে, এই নিয়ে আমি আর কিছু বলি না। মানুষটার রোগে ভুগে ভুগে যা অবস্থা হয়েছিল। তবে এখন জানেন ডাক্তারবাবু, ও অনেক ভালো আছে। সপ্তাহ খানেক ধরে, সুগার মেপে দেখছি একদম নর্মাল। শরীর-স্বাস্থ্যও আগের থেকে বেশ ভালো হয়েছে। তাই বলছি কি, এখন একটু-আধটু মিষ্টি-টিষ্টি খেতে পারেন তো উনি? জানেনই তো মানুষটা খেতে আর খাওয়াতে খুব ভালোবাসেন চিরকালই। এখন সুস্থ শরীরে কিছু চাইলে, না দিয়ে কি পারি আমি? সারাজীবন তো বাড়ির কাউকে কোনোদিন মুখ ফুটে কিছু চাইতেই হয়নি, উনি তার আগেই যার যা পছন্দ, এনে হাজির করেছেন। তাই আজ তিনি কিছু চাইলে, আমি না করি কি করে? সেই জন্যই আপনাকে জিজ্ঞেস করলাম।’’
‘‘হুঁ, বুঝলাম। তবে বেশী ঘন-ঘন মিষ্টি-টিষ্টি না দেওয়াই ভালো, সুগার এখন কন্ট্রোলে আছে মানে এমন তো নয়, ঘন-ঘন মিষ্টি খেলেও বাড়বে না। সুস্থ যখন আছেন, সুস্থই থাকতে দিন বরং। আপনিও তো নিশ্চয়ই তাই চান, উনি সুস্থ থাকুন। আর আপনার ওষুধ তাহলে হাফ করে দিচ্ছি। এই ওষুধ একেবারে তো হঠাৎ বন্ধ করা যায় না। আস্তে-আস্তে কমিয়ে-কমিয়ে বন্ধ করে দেবো। চিন্তা করবেন না। সুগার তো আপনারও খানিক কন্ট্রোলে এসেছে দেখছি, মিষ্টি-টিষ্টি খান না তো?’’
‘‘না, না। একেতেই সুকান্ত বাইরে থাকে, আমি এখানে বারবার অসুস্থ হলে ওর তো হয়রানির শেষ থাকবে না। যতোই বাবা থাকুক, আমার শরীর খারাপের কথা শুনলে হয় ছুটে আসবে, আর না হয় মন এখানে পড়ে থাকবে, কাজে ব্যাঘাত ঘটবে; দুটোতেই তো আখেরে ওরই ক্ষতি। মা হয়ে ছেলের ক্ষতি কি করে চাইবো বলুন? তাই নিজেই সমঝে চলি।’’
‘‘খুব ভালো। আজ আসি। আপনি রেস্ট নিন, আমি বরং একটু বাইরে গিয়ে, প্রেসক্রিপশনটা লিখে ওনার হাতে দিচ্ছি, সবটা বুঝিয়ে বলে।’’
‘‘ঠিক আছে, আপনি ড্রয়িংরুমে বসে আপনার কাজ সারুন। এই আশা, চা করে দে আগে ওনাকে। নমস্কার ডাক্তারবাবু।’’
‘‘নমস্কার মিসেস রায়।’’
‘‘এবার আপনি বলুন তো ওনার এখনকার সমস্যাগুলো।’’
‘‘মাসিমা এখন পুরোপুরি মেসোমশাইয়ের ছাঁচে ঢালা হয়ে গেছেন। মেসোমশাই যা খেতে ভালোবাসতেন, তাই খান, এমনকি নিজেই অল্প করে হলেও সেইসব রান্না করেন আর সেইসব খাবারই আনতে বলেন। এই দুদিন আগেই তো দাদাবাবুকে বলে রসগোল্লা আনালেন আমায় দিয়ে, তাই খেলেন। অথচ, মাসিমা কোনোদিন রসগোল্লা খেতেনই না।’’
‘‘একমিনিট। মানে, রসগোল্লা খাওয়ার পরদিনই সুগার টেস্ট হয়েছে ওনার, অথচ প্রায় নর্মাল? স্ট্রেঞ্জ! আপনি নিজে ওনাকে রসগোল্লা খেতে দেখেছেন?’’
‘‘না, তা দেখিনি। আমার তো নানারকম কাজ থাকে। তবে আর কে খাবেন, বলুন? বাড়িতে আমি আর মাসিমা ছাড়া তো আর কেউ থাকে না। আর আমি খেলে, মাসিমা বলতেন দাদাকে। এখন তো উনি এরকমটাই করেন। মেসোমশাইয়ের প্রিয় সব জিনিস আনান, তারপর প্লেটে সাজিয়ে ছবির সামনে দেন, তারপর কখন দেখ না দেখ সেটা খেয়ে নেন, তা জানি না। ঘুরে এসে দেখি প্লেট ফাঁকা। তবে সত্যিই বড়ো আশ্চর্য্যের, আপনি বলছেন মাসিমার সুগার কমেছে, কিন্তু তা কি করে হয়? উনি তো এখন দুবার ভাত আর দুবার রুটি খান। তাই তো আমি, দাদাবাবুকে বলে, টেস্টগুলো সব তাড়াতাড়ি করলাম। আর আপনাকে ডেকে আনলাম। দাদাবাবু তো খুব টেনশন করছেন মাসিমার এরকম পাগলামোয়।’’
‘‘হোয়াট্? আর ইউ শিওর? আপনি নিজে দেখেছেন ওনাকে এতোবার খেতে?‘‘
‘‘না। বললাম তো, আমি কাজ করি। সবসময় কি চোখ দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারি? না মাসিমা এইসব সময় দাঁড়িয়ে থাকতে দেবেন আমায়? তবে, না খেয়ে ফেলে দিলে তো ডাস্টবিনেই পড়ে থাকবে। কই, একদিনও তো খাবার আমি ডাস্টবিনে পড়ে থাকতে দেখিনি। আর অন্য কোথাও দিয়ে ফেলারও লোক নন মাসিমা, যা পরিস্কার বাতিক এখনো। আর তাছাড়া হাঁটুর ব্যথা নিয়ে তো আর ছাদে যেতে পারেন না। আর জানলা দিয়ে ফেললে কার্ণিশে পড়বে, ব্যালকনি দিয়ে ফেললে চাতালে। কোথাওই তো কখনো কোনো খাবার বা নোংরা পড়ে থাকতে দেখিনি। তাহলে? প্রায়ই দাদাবাবুর কথামতো নিজেই প্রেসার, সুগার মাপেন, বলেন সব ঠিক আছে। আমি তাই ভাবলাম, দাদাবাবুকে বলি বাইরে থেকে যেই ছেলেটা টেস্ট করতে আসে, তাকে দিয়ে করাতে। তাহলে তো সত্যিটাই ধরা পড়বে, কিন্তু, এখানেও তো নর্মাল। এই রিপোর্ট তো আর মিথ্যে হতে পারে না। আশ্চর্য্য!’’
ক্রমেই সমস্যা যেন জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছিল। যেন এক রহস্যের গোলকধাঁধা। শুধু অঞ্জলি দেবী সত্যিই ভালো ছিলেন কোনো এক অদ্ভুত, অদৃশ্য শক্তির বলে, যার জন্য তাঁর শারীরিক সমস্যাও কমছিল দিনে-দিনে। কিন্তু এই রহস্যের জাল ক্রমেই আষ্টেপৃষ্টে বাঁধছিল বাকিদের।
পর্ব- ৩
‘‘শুনছো, যখন পিকুর এবারের এই গরমের ছুটিতে যাচ্ছিই আমরা মায়ের কাছে, তখন এবার মাকে একজন ভালো সাইক্রিয়াটিস্টের কাছে নিয়ে গেলে হয় না? আর পাঁচটা সাধারণ অসুখের মতোই এটাও কিন্তু একটা অসুখ মাত্র। সময়ে চিকিৎসা করলে সেরে যায়। আর মা তো চরম পাগলামি কিছু করেন না, যে ট্রিটমেন্টের জন্য নিয়ে গেলেই অ্যাসাইলামে রাখবেন ওনারা। কিছু ওষুধ, হয়তো কয়েকটা সেশন, ব্যাস। সময় থাকতে ট্রিটমেন্ট করলে উনি পুরো সুস্থ হয়ে যাবেন, আর ফেলে রেখে দিলে পরে হিতে-বিপরীত হতে পারে। তখন কিন্তু সবকিছুই হাতের বাইরে চলে যাবে, হোপ ইউ উইল আণ্ডারস্ট্যান্ড মি। এতো নার্ভাস হয়ো না। কাম ডাউন। আমি আছি তো তোমার পাশে, তোমার সাথে। কাউকেই এ নিয়ে কিছু বলার দরকার নেই। এমনকি আশাদিকেও নয়, কারণ এখনো মানুষের মন প্রপার শিক্ষিত হয়নি। এই নিয়ে কোনোকারণে জলঘোলা হোক, আমি তা একেবারেই চাই না। আগে চিকিৎসাটা শুরু হোক ভালোভাবে। তবে, মাকে কিছু একটা বলে বুঝিয়ে বার করতে হবে সাইক্রিয়াটিস্ট দেখানোর জন্য। কিছু না কিছু ঠিক মাথায় আসবে আমার, ও নিয়ে ভেবো না। চিকিৎসা করাতে নিয়ে তো যেতেই হবে।’’
‘‘বাবান, মাম্মি...’’
‘‘আরে পিকাই, আয় আয়। ম্যাথস কমপ্লিট?’’
‘‘হ্যাঁ। বাবান, তোমরা থাপ্পিকে কোথায় নিয়ে যাবে? থাপ্পিও কি তারা হয়ে যাবে? প্লিজ না, প্লিজ না।’’
‘‘পিকু, কিসব আবোলতাবোল বকছো?’’
‘‘সহেলি স্টপ। আই উইল হ্যাণ্ডল ইট। (পিকুকে সযত্নে বুকের ওমে নিয়ে আগলে) না বেটা, একদম নয়। থাপ্পিকে কোত্থাও যেতে দেবো না আমরা। আমাদের কাছে নিয়ে আসবো। মা এটাই বুঝিয়ে-সুঝিয়ে বলার কথা বলছিল। দ্যাটস্ ইট।’’ কথাগুলো বলার সময় অজান্তেই সুকান্তর হাতের বাঁধনটা আরো দৃঢ় হচ্ছিল। হয়তো নিজেকেও বিশ্বাস করানোর তাগিদেই। ঠিক এমন সময়েই তার ফোনটা বেজে উঠল।
‘‘হ্যাঁ বলো আশাদি। একমিনিট। পিকাই, তুমি তোমার বইপত্র গুছিয়ে নাও তো ঘরে গিয়ে। আমরা পরশু যাবো তো থাপ্পির কাছে, অনেকদিনের জন্য। হোমওয়ার্কগুলোও কমপ্লিট করতে হবে তো তারই ভিতর, তাই বই-খাতা তো নিতে হবে। গো গো, ডু ইট ফাস্ট।’’
‘‘ওকে বাবাই।’’
‘‘হ্যাঁ আশাদি, এবার বলো। সরি, পিকুর সামনে সবকিছু বলা ঠিক নয়, তাই...’’
‘‘আজ মাসিমা কয়েদবেল মাখা খেয়েছে। আমি আনিনি। আমি মাখিওনি। কি করে? জানি না!’’
‘‘ওয়েট, ওয়েট, রিল্যাক্স। এতো হাঁপাচ্ছো কেন? এতো ভয়ই বা পাচ্ছো কেন?’’
‘‘মাসিমা ভীষণ খুশি, কয়েদবেল খাওয়ার পর থেকে। ঠিক মেসোমশাই কিছু রান্না করে দিলে যেমন খুশি থাকতো, তেমনই। অথচ আমাকে বলেওনি আনতে, আমিও আনিনি। তাহলে?’’
‘‘কি যা তা বলছো! তাহলে অন্য কাউকে দিয়ে আনিয়েছে হবে, বাড়িতে কেউ এসেছিল?’’
‘‘না, না, কেউ আসেনি, তো আনাবে কাকে দিয়ে? আমি কিচ্ছু জানি না।’’
‘‘ঠিক আছে, তুমি মাকে দাও, আমি দেখছি।’’
‘‘মাসিমা আজ মনের আনন্দে তাড়াতাড়ি খেয়ে শুয়ে পড়েছে। তাই সেই সুযোগেই তোমাদের জানাতে এলাম। তোমরা শিগগির এসো। আমার খুব ভয় করছে।’’
‘‘আশাদি রিল্যাক্স। আর কালকের দিনটা, পরশু সন্ধ্যের মধ্যেই তো আমরা পৌঁছে যাচ্ছি ওখানে। প্লিজ টেক কেয়ার ইওরশেল্ফ এণ্ড টেক কেয়ার এবাউট মা। প্লিজ আশাদি, প্লিজ।’’
‘‘কি হয়েছে কি কান্ত? এভাবে রিঅ্যাক্ট করছো কেন? কি বলল আশাদি? হোয়াটস্ রঙ?’’
‘‘আমি জানি না। আমি বোধহয় নিজেই এবার পাগল হয়ে যাবো।’’
‘‘কান্ত, টেল মি হোয়াট হ্যাপেন।’’
‘‘মা কোথা থেকে কয়েদবেল মাখা খেয়েছে, আশাদি জানে না। আশাদি কয়েদবেল আনেওনি, মাখেওনি। বাড়িতেও কেউ আসেনি, যাকে দিয়ে মা আনাতে পারে, তবে নয় নিজেই মেখে খাওয়াটা মানা যায়। আর মা নাকি বাবা কিছু রান্না করে দিলে যেমন খুব খুশি হতো, তেমনই সারাদিন খুশি আছে, এমনকি আনন্দে তাড়াতাড়ি খেয়ে শুয়েও পড়েছে।’’
‘‘রিল্যাক্স। দেখো হয়তো আশাদির চান করার সময় ওখানকারই কোনো বাচ্চা এসে মাকে তাদের গাছের কয়েদবেল দিয়ে গেছে আর মা নিজেই মেখে খেয়েছে। মাকে তো পিকুর মতোই ওখানকার সব বাচ্চাই খুব ভালোবাসে। আর মায়ের তো কয়েদবেল খুব প্রিয়, এতোদিন বাদে প্রিয় জিনিস পেয়ে বাচ্চাদের মতোই আনন্দে মেতে আছে। এই বয়সে এরকমটাই হয়। মানুষ আবার ছোট হয়ে যায় বৃদ্ধ বয়সে পৌঁছে। বুঝেছো। সো রিল্যাক্স।’’
‘‘হুম্, তা না হয় বুঝলাম, কিন্তু আশাদির এভাবে ভয় পাওয়াটা যে ভাবাচ্ছে।’’
‘‘হ্যাঁ, তা একটু ওরিডই বটে। আসলে কি হয় জানো তো, মা এখন যেমন বিহেইভ করে, যে ধরনের কথাবার্তা বলে, সেরকম পরিবেশে, সেরকম কাউকে একনাগাড়ে, একা হাতে সামলাতে-সামলাতে মানুষ ঐ পরিবেশের বশ হয়ে পড়ে। খানিকটা ইমাজিনারি, খানিকটা হ্যালুসিনেশন থেকে এরকমটা হতে পারে। আসলে আশাদিরও তো কথা বলার সঙ্গী নেই। তার মধ্যে মায়ের এইসব কথাবার্তায় খানিকটা এফেক্ট ফেলেছে নার্ভের উপর। চলো, সেরকম হলে, আশাদিরও ট্রিটমেন্ট করাতে হবে। এখন এতো ভেবে তো লাভ নেই। মাঝে আর একটা দিন। তারপর তো আমরাই হ্যাণ্ডল করতে পারবো সবটা।’’
পর্ব- ৪
‘‘থাপ্পি, তুমি কেমন আছো?’’
‘‘খুব ভালো আছি পিকুবাবু। আর এখন তুমি এসেছো, এখন তো আরোই ভালো আছি।’’
‘‘আমি এখন অনেকদিন থাকবো থাপ্পি। পুরো সামার ভেকেশনটা, বাবাই বলেছে। তারপর যাওয়ার সময় তোমাকেও আমাদের কাছে নিয়ে যাবো। এখন থেকে তুমিও আমাদের সাথেই থাকবে। কি মজা।’’
‘‘পাগল ছেলে। আমি এখান থেকে চলে গেলে থাপ্পু কার কাছে থাকবে? থাপ্পুকে কে দেখবে? থাপ্পুর মন খারাপ হবে না? ভাববে, সব্বাই আমায় ছেড়ে চলে গেল? কাঁদবে তো থাপ্পু।’’
‘‘থাপ্পু? থাপ্পু এখানেই আছে? কই দেখতে পাচ্ছি না তো।’’
‘‘থাপ্পু আজকাল খুব দুষ্টু হয়েছে। সবসময় হাইড এণ্ড সিক খেলে। আমাদের পিকুবাবুর থেকেও দুষ্টু। তাই সে লুকিয়ে লুকিয়ে তোমাদের দেখছে, কিন্তু তোমাদের দেখা দিচ্ছে না। আচ্ছা আমি বলবো, আমার পিকুবাবুকে একবার দেখা দিতে। কেমন?’’
‘‘তাহলে তুমি যাবে না? একা একা থাকবে এখানে? মা-বাবা খুব টেনশন করে তোমায় নিয়ে। চলো না।’’
‘‘একা কোথায়? বললাম যে থাপ্পু আছে, থাপ্পুই তো দেখেশুনে রাখে আমাকে। আর তাছাড়া আশাপিপিও তো আছে। আর এই তো ভালো হলো, আমার পিকুবাবুর দু-দুটো বাড়ি হলো। পিকুবাবু যখন খুশি যেটাতে খুশি থাকতে পারবে, বেড়াতে আসতে পারবে। আর আমি সবসময়ের জন্য তোমাদের ওখানে চলে গেলে তো, এখানে আর কখনো বেড়াতে আসাই হবে না পিকুবাবুর। সেটা কি খুব একটা ভালো হবে?’’
‘‘না, তা হবে না। কিন্তু...’’
‘‘ওরে বাবা, পিকুবাবুর তো বেজায় চিন্তা দেখছি তার থাপ্পিকে নিয়ে। আচ্ছা বেশ, আমি থাপ্পুকে বলবো একবার দেখা দিতেই হবে পিকুবাবুকে, যাতে পিকুবাবুর চিন্তা দূর হয়। ঠিক আছে?’’
‘‘ঠিক আছে।
পর্ব - ৫
‘‘না, না, আমি কোথাও যাবো না তোমায় ছেড়ে। তুমি এতো উত্তেজিত হচ্ছো কেন আজ আবার আগের মতো? আবার প্রেসারটা বাড়বে। এখন তো কতো ভালো আছো তুমি। আবার শরীর খারাপ করে হাসপাতালে যেতে চাও? সবার কথা শুনে সিঁথির সিঁদুর তো মুছে ফেলেছি, এই খয়েরি টিপে আর রঙিন শাড়িতে সবার অলক্ষ্যে আমি সধবা বেশ ধরে আছি, যবে থেকে জেনেছি তুমি আছো, আমার কাছেই আছো। এবার তুমি অসুস্থ হয়ে কি চাও, সেটুকুও ঘুচুক? বলছি তো আমি সুকুকে বুঝিয়ে বলবো। ওর কি দোষ? আজকালকার দিনে এমন হীরের টুকরো ছেলে কটা পাওয়া যায়? তোমারও বাপু দোষ কম নয়, কাউকে দেখা দেবে না। কেন শুনি? তাহলে তো ওরা আর চিন্তা করে না খামোখা এতো আমায় নিয়ে। আরে, ঐ দেখো রাগের মাথায় হন হন করে কোথায় চললে? পড়ে যাবে তো। দাঁড়াও...’’
সুকুউউউ, তোর বাবা পড়ে গেছে, শিগগির আয়।’’
সুকান্ত আর সহেলী আশার ডাকে অঞ্জলি দেবীর ঘরের ভেজানো দরজার আড়ালেই ছিল এতোক্ষণ আর একনাগাড়ে বলা মায়ের কথাগুলো শুনছিল। তার মধ্যেই তিনি এমন উদ্বিগ্ন অবস্থায়, হন্তদন্ত হয়ে ছুটে বেরোতেই, ওরাও পিছু নিয়েছিল। আর ঠিক তখনই তাঁর, ‘‘বাবা পড়ে গেছ’’ বলার সাথে-সাথেই প্রায় একটা ধুপ করে কিছু পড়ার আওয়াজ হলো ড্রয়িংরুম থেকে। অঞ্জলি দেবীর সাথে-সাথেই যখন সবাই এসে পৌঁছল, তখন দেখে সৌমেন বাবুর ছবিটা উল্টে পড়ে গেছে। অথচ ঝড় কেন, হাওয়া-বাতাস কিছুই নেই কোথাও। সুকান্ত তাড়াতাড়ি ছবিটা জায়গায় লাগাতেই দেখে ছবির কপাল থেকে, নীচে দাঁড়ানো মায়ের সিঁথিতে ফোঁটা ফোঁটা রক্ত পড়ে সিঁথি রাঙিয়ে দিচ্ছে। আর মা চিৎকার করে বলছে, ‘‘বাবার কপাল ফেটে গেছে দেখছিস না। বাবাকে দে আমার কাছে, ব্যাণ্ডেজ বাঁধতে হবে।’’
সুকান্ত কোন এক অপার্থিব শক্তির বলে ছবিটা নামিয়ে আবার অঞ্জলি দেবীর কাছে দিল আর অঞ্জলি দেবী পরম মমতায় ব্যাণ্ডেজ বাঁধতে লাগলেন ছবির গায়ে।
এইসব চিৎকার-চেঁচামেচির মধ্যে পিকুও ঘুম ভেঙে চলে এসে ভয়ে-ভাবনায় গুটিসুটি মেরে থাপ্পির কোল ঘেঁষেই গিয়ে বসলো। আর ঠিক তখনই সারা ঘর এক অপার্থিব সাদা আলোর ঝলকে ভাসিয়ে, তার মাঝে এসে দাঁড়ালেন ছ’মাস আগে হার্টঅ্যাটাকে মারা যাওয়া সৌমেন রায়, অঞ্জলি দেবীকে ঘিরেই। যেন এই বার্তা দিয়ে, ‘‘অঞ্জলির আজও আমি আছি।’’
সবার শিরদাঁড়া দিয়ে তখন বইছে হিমেল স্রোত, শুধু পিকু হাসিমুখে বলে উঠল, ‘‘থাপ্পু, তুমি আছো? থাপ্পি তাহলে ঠিকই বলেছিল। তুমি ভালো থেকো থাপ্পু, থাপ্পিকেও খুব ভালো রেখো। আর দুষ্টুমি করো না কিন্তু।
সৌমেনবাবু একরাশ হাসি ছড়িয়ে অদৃশ্য হলেন। রেখে গেলেন নিজের রক্তে রঞ্জিত অঞ্জলি দেবীর সিঁথি সর্বসমক্ষে, তথাকথিত সধবার প্রতীক চিহ্ন পুনরায় এঁকে দিয়ে।