ইলশেগুঁড়ি ২৯তম সংখ্যা (শারদীয়া)
ইলশেগুঁড়ি ২৯তম সংখ্যা (শারদীয়া)
যাঁরা পারেন না তাঁরা ওকে থামিয়ে দিয়ে বলেন—‘‘ডেঁপো ছেলে কোথাকার, বিষয়ে মন দাও, পরীক্ষায় যা আসবে তাতে নজর দাও।’’
সোমশুভ্রের সন্ধ্যা কাটে তারাদের সাথে কথা বলে। বড় মামার দেওয়া টেলিস্কোপটা নিয়ে ও ছাদের এক কোণ থেকে আকাশের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করে। ঐ মুহূর্তে মনে হয় ও পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে দূর নক্ষত্রলোকে হারিয়ে গেছে। নীচ থেকে ওর মা ছেলেকে খাওয়ার জন্য ডাকতে এসে অবাক হয়ে চেয়ে থাকেন, এইটুকু বয়সে এত একনিষ্ঠ বিজ্ঞান সাধনা। সম্বিৎ ফেরানোর জন্য বলে ওঠেন—‘‘খাওয়াদাওয়ার হুঁশ আছে তোর? নাকি নক্ষত্র দেখে পেট ভরবে?’’
‘‘মা, তুমি যদি ওদের দেখ তাহলে তোমারও নেশা লেগে যাবে।’’
‘‘আমার নেশা লাগিয়ে কাজ নেই, একা রামে রক্ষা নেই সুগ্রীব সহায়। আমি চাঁদ তারা দেখলে চলবে? সংসার তো মাথায় উঠবে। চল, চল খাবি চল বাবা।’’
আগ্রহের ক্ষেত্র ছেড়ে নীচে নামতে হয় সোমশুভ্রকে, তবে খেয়েদেয়েই খুলে বসে মহাকাশ সম্বন্ধীয় বইপত্র। সেখানে যেমন নীল আর্মস্ট্রং আছেন তেমন কল্পনা চাওলা, সুনীতা উইলিয়ামসও আছেন। চন্দ্রশেখর সুব্রাহ্মানিয়ণের জীবন, বিজ্ঞান চর্চাকে ও ওর আদর্শ মানে। জগদীশ চন্দ্র বোস, আচার্য্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়, বিক্রম সারাভাই এঁরা সবাই ওকে উদ্বুদ্ধ করেন। নীল আমস্ট্রংয়ের চন্দ্রাভিযানের ছবি ও ওর সংরক্ষণে রেখেছে, তবে এঁরা সবাই চাঁদের উত্তর গোলার্ধে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন। দক্ষিণ গোলার্ধ আরও দুর্গম, সেখানে সূর্যের আলো পৌঁছোয় না। শুধুমাত্র উঁচু পাহাড়ের চূড়াটুকুতে ছুঁয়ে যায় সূর্যের আলো। তার পাশেই হয়ত এমন খাদ আছে যা হাজার কিলোমিটার গভীর। ওখানের তাপমাত্রা -২৩৮ সেন্টিগ্রেড। কোন যন্ত্র ঐ ঠাণ্ডায় কাজ করে না। ও কি ছুঁতে পারবে ঐ অজানাকে বা তা নিয়ন্ত্রণে নিজের ভূমিকা রাখতে? পড়তে পড়তে রাত গভীর হয়। ওর ঘরে আলোর রেখা দেখে মা শাসন করে বলল—‘‘রাত জেগে শরীর খারাপ করবি নাকি? এই নিভিয়ে দিলাম আলো, শুয়ে পড় দেখিনি।’’
স্কুলে পাঠ্য বিষয় ছাড়াও ও বিজ্ঞানের অনান্য বিষয় নিয়ে এমন সব প্রশ্ন করে যে খুব কম শিক্ষকই আছেন যারা সেসব বিষয়ে আলোকপাত করতে পারেন। যাঁরা পারেন না তাঁরা ওকে থামিয়ে দিয়ে বলেন—‘‘ডেঁপো ছেলে কোথাকার, বিষয়ে মন দাও, পরীক্ষায় যা আসবে তাতে নজর দাও।’’
শুধু অলোক স্যার ওর খোঁজ রাখেন, নতুন বই কী পড়ল, রাতের আকাশে নক্ষত্রদের কেমন দেখল, সব মন দিয়ে শোনেন আর উৎসাহ দেন। সোমশুভ্র শুনেছে রাশিয়ার সের্গেইয়ের কথা, যিনি ম্যাথ ক্লাব তৈরী করে ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের তৈরী করতেন। যারা বেশীরভাগই ইন্টারন্যাশনাল ম্যাথস্ অলিম্পিয়াডে যোগ দিত। পেরেলম্যান, আর একজন অঙ্কবিদ, যার কাজের থেকে বেশী তার মনস্তত্ব নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এইসব কারণে যিনি গবেষণা থেকে স্বেচ্ছা নির্বাসন নিয়েছেন। ও এও পড়েছে বিজ্ঞানীদের আবিষ্কার যখন রাষ্ট্রনেতারা নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করে তখন বিজ্ঞানী নিজেও অসহায় বোধ করেন। যেমন আমেরিকায় হাইড্রোজেন বোমা তৈরী করেছিলেন এডওয়ার্ড টেলার, পরে ট্রুম্যান যখন তা যুদ্ধের জন্য ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত নেয় তখন অনান্য বিজ্ঞানীদের সঙ্গে টেলরের বিপরীত মেরুতে থাকা জিলার্ডও সেই আন্দোলনে অংশ নেন। কাজেই ও যে আগ্রহ নিয়ে আলোক বিজ্ঞান, শব্দ বিজ্ঞান পড়বে সেই একই আগ্রহ নিয়ে ওকে বিজ্ঞানের ইতিহাসও জানতে হবে। মোটর নিউরন রোগে আক্রান্ত স্টিফেন হকিং ওনার সব শারীরিক প্রতিবন্ধকতা নিয়ে ছিয়াত্তর বছরের জীবনে মহাকর্ষ তরঙ্গ ও কৃষ্ণগহ্বর নিয়ে গবেষণা করে গেছেন। ওনার ‘ব্রিফ আনসার টু দ্য বিগ কোয়েশ্চেনস’ বইতে মহাবিশ্বের সূচনা, পরম বিন্দু, কৃষ্ণগহ্বর এসব নিয়ে বিশেষ আলোচনা আছে। কীভাবে মুক্তিবেগ আলোর বেগের থেকে বেশী হলে মহাবিশ্বে নিক্ষেপিত হতে পারে সে আলোচনাও আছে। পৃথিবীর সৃষ্টির সময়ে কণা প্রতিকণার ক্রিয়া, মহাবিস্ফোরণ সম্পর্কে ওনার ব্যাখ্যায় বিজ্ঞান উপকৃত হয়েছে। এত গভীর বিষয়গুলো চর্চার যোগ্যতা অর্জন করতে গেলে সোমশুভ্রকে প্রথাগত শিক্ষা মানে স্কুলের পরীক্ষা, অলিম্পিয়াড ও প্রবেশিকা পরীক্ষার যোগ্যতা মান ছুঁতে হবে এটুকু সোমশুভ্র বুঝে গেছে। তৃতীয় বিশ্বের দেশের ছাত্র বলে ও পিছিয়ে থাকবে না, ও নিশ্চয়ই নিজের দেশের মুখ উজ্জ্বল করবে। শুধুমাত্র চাকরি পাওয়ার লক্ষ্যে ও পড়াশোনা করবে না, ও বড় লক্ষ্যের দিকে এগোবে।
উচ্চ মাধ্যমিকে বিজ্ঞানে ভাল ফলাফল করার পাশাপাশি ও এআইট্রিপলইতে ভাল ফল করে ভর্তি হল কানপুর আইআইটিতে। বিষয় হিসেবে নিল ওর পছন্দের এয়ারোস্পেশ ইঞ্জিনিয়ারিং। স্বাধীন বিজ্ঞান চর্চার এক উন্মুক্ত ক্ষেত্র। সারা রাত ধরে ল্যাবরেটরিগুলো খোলা থাকে। সন্ধ্যেবেলায় কমিউনিটি হলে চলে ভাল ভাল ওয়ার্কশপ, সেমিনার।
যে ভার্মা স্যারের বই পড়ে বিজ্ঞান চর্চা করেছে তাঁকে এখানে সামনাসামনি পেল সোমশুভ্র। সকালের জলখাবার থেকে শুরু করে রাতের ডিনার পর্যন্ত খাবারের অঢেল আয়োজন দেখে বিশ্বাসই হয় না যে ও বাড়ির বাইরে আছে। এ কথা মা-কে বলাতে মা খুব অভিমান করেছিল। কোথা দিয়ে চার বছর কেটে গেল তা টের পাওয়া গেল না। জিআরইর পার্সেন্টাইলে ওর কাঙ্খিত ম্যাসাচুয়েটস ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজিতে এয়ারোস্পেশ নিয়ে এমএস করার সুযোগ পেল। দূর বিদেশে ছেলে পড়তে যাবে বলে আনন্দের সঙ্গে সঙ্গে ওর বাড়ির লোক চিন্তিতও হল। তবে ছেলে ও দেশকে স্থায়ী বাসস্থান করবে না, এ ব্যাপারে পরিবারের সকলেই নিশ্চিত। তাই ছেলেকে সমর্থন করতে অভিভাবকদের অসুবিধে হয়নি। ছাত্র বিনিময়ে প্রথায় সোমশুভ্রর ফিনল্যান্ডে যাওয়ার সুযোগ ঘটল। ওখানের শিক্ষা পদ্ধতি দেখে ও অবাক হয়ে গেল। সবচেয়ে মেধাবী শিক্ষিত শিক্ষক শিক্ষিকা প্রাইমারি শিক্ষার সঙ্গে যুক্ত। তারপরের সারির শিক্ষকেরা উচ্চ বিদ্যালয়ে ও তারও পরের সারির শিক্ষকরা কলেজ, ইউনিভার্সিটিতে পড়ান। হাতেকলমে শিক্ষা ও শিক্ষক ছাত্র অনুপাত শিক্ষনীয়। সোমশুভ্র ঠিক করল ভবিষ্যতে দেশে নিজের কাজের পাশাপাশি এরকম আদর্শ বিদ্যালয় তৈরী করবে।
আজ অনেকদিন পর সোমশুভ্রের স্বপ্নপূরণের এক অবকাশ। নাসার মঙ্গল অভিযানের দলের এক সদস্য ও। যদিও ভারতের সহযোগী হিসেবে চন্দ্রযান ২তে ও নাসার প্রতিনিধি হিসেবে যুক্ত ছিল। যেদিন চাঁদের দক্ষিণ গোলার্ধে নামার সময়ে এক গিরিখাদের অন্তরালে তলিয়ে গেল রোভার। ল্যান্ডিং পুরোপুরি ব্যর্থ হল, -২৩৮র তীব্র ঠাণ্ডায় মুষড়ে পড়ে সব যন্ত্র বিকল হয়ে খবর পাঠানো বন্ধ করে দিল। সেদিন ও সারারাত ঘুমোতে পারেনি, ভাল করে খেতে পারেনি। উপরন্তু মার্কিনী জো যখন বিদ্রুপ করে বলল—‘‘একটা তৃতীয় বিশ্বের দেশ হিসেবে এতটা এগোনোও তোমাদের জন্য অনেক। সাফল্যের মুখ দেখবে আমেরিকা, আমাদের নাসা। তুমি নাসার একজন বলে গর্বিত হও।’’
ঐ দিন স্বভাব শান্ত সোমশুভ্রর ইচ্ছে হয়েছিল জোয়ের মুখে সপাটে একটা চড় মারে। বহুকষ্টে নিজেকে শান্ত সংযত রেখেছিল। এখন ওর পাখির চোখ ইসরোর নতুন চন্দ্রাভিযান চন্দ্রযান২ এর দিকে। পৃথিবীর আকর্ষণ সীমা পার হয়েছে, চাঁদের দক্ষিণ গোলার্ধ যতই দুর্ভেদ্য হোক, এবার নিশ্চয়ই চাঁদের পাহাড়ে পা রেখে সূর্যের আলোটুকু শুষে নিয়ে নিজেকে গরম রাখতে পারবে। এ কাজে ল্যন্ড করতে বিক্রম সাহায্য করবে। এবার থার্মোষ্ট্যাটের সব ব্যবস্থাই আছে ওর মধ্যে। সমগ্র ভারতের সঙ্গে কয়েক লক্ষ মাইল দূরে থাকা সোমশুভ্রও আশায় বুক বেঁধে আছে। সবসময় সঙ্গে রেখেছে জাতীয় পতাকা। অভিযান সফল হলেই ওড়াবে ঐ পতাকা। ও এ দেশের গ্রীনকার্ড নেয়নি, ফিরে যাবে নিজের দেশ ভারতবর্ষে। তার আগে মঙ্গল অভিযানের পুরো ব্যাপারটা বুঝে নিতে হবে যাতে ইসরোয়ে যোগ দিয়ে ভাল কিছু করতে পারে। তাই আপাতত যোগ্যতা প্রমাণের জন্য ও জানপ্রাণ দিয়ে লড়ে যাচ্ছে। ক্ষেপক বিজ্ঞানী দলের অন্যতম হয়ে থেকে এই আলো ও নিজের দেশের মাটিতে ছড়িয়ে দিয়ে সব উপেক্ষার জবাব দেবে। পৃথিবীর শেষ কক্ষপথ ছাড়িয়ে গেছে চন্দ্রযান ৩। এবার ল্যান্ডার বিক্রমের চাঁদের মাটিতে পা রাখা সময়ের অপেক্ষা মাত্র। জো ওর উত্তেজনাকে উসকে দেওয়ার জন্য কাছেপিঠে ঘোরাঘুরি করছে। সামান্য সুযোগ পেয়েই এগিয়ে এসে বলল—‘‘তোমরা এবারেও পারবে না মনে হয়, গ্রিন কার্ডের আবেদনটা করেই দাও। এ দেশ থেকে সব শিখবে আর শেষপর্যন্ত এখানে থাকবে না, তাই কি হয়?’’
ওর ফাঁদে পা দিয়ে সোমশুভ্র বলল—‘‘গ্রিন কার্ড মাই ফুট, শুনেছি তোমার আদি বাড়ি উগান্ডায়। তুমি সেখানে ফেরোনি সেটা তোমার ব্যাপার। দেশকে ভালোবাসি শুধু মুখে বললে হয় না, করে দেখাতে হয়। ও তুমি বুঝবে না, আমার পেছনে না থেকে নিজের চরকায় তেল দাও।’
সোমশুভ্রর টিমে ভারতের এক তামিল সদস্য বিশ্বনাথনও আছে। ও এ দেশের জীবনে আরামে সুখে নিজের দেশকে ভুলেছে তাই ও বিস্ময়ে সোমশুভ্রের দিকে তাকালে সোমশুভ্র গেয়ে উঠল—‘‘ধনধান্য পুষ্প ভরা আমাদের এই বসুন্ধরা তাহার মাঝে আছে যে এক সকল দেশের সেরা, ও সে স্বপ্ন দিয়ে তৈরী সে দেশ স্মৃতি দিয়ে ঘেরা...’’
বিশ্বনাথন হেসে বলল—‘‘দেশ, আই মিন তোমার ইন্ডিয়া?’’
অকম্পিত স্বরে সোমশুভ্র বলল—‘‘তোমারও।’’