ইলশেগুঁড়ি ২৯তম সংখ্যা (শারদীয়া)
ইলশেগুঁড়ি ২৯তম সংখ্যা (শারদীয়া)
প্রদীপের আলোতে ঝলমল করছে পুচকে ‘‘ডেনে’’ এর মুখ। ‘‘ডেন’’ নামটা শতাব্দীর দেওয়া। ‘‘ডেসান’’ এর ক্ষুদ্র সংস্করণ। ‘‘ডেসান’’ এর নাম, শরীরের ভিতরেই ‘‘ডেন’’ এর গন্ধ লুকিয়ে আছে। মিতাদেবী পুজো দেখতে দেখতে কোথায় যেন হারিয়ে গেলেন।
আজ অনেকদিন হল আমি ঘর ছাড়া। আপাতত আমার ঠিকানা এই প্রকৃতি ঘেরা গ্রাম। তবে পূর্ব কোলকাতায় আমার একটা সাজানো ফ্ল্যাট আছে। সন্তু কিনে দিয়েছে। ওখানে আমার সাথে থাকে সাবিত্রী। ঘরের সব কাজ ওই করে। বয়স বাইশ তেইশ হবে। আমার থেকে প্রায় বছর কুড়ির ছোট। অথচ বর্তমানে ঐ আমার অভিভাবক। ওকে সাথে নিয়ে আসলে ভালো হত! ওর সঙ্গে কিছু কথা বলে সন্ধ্যেটা কাটানো যেত। সন্তুকে বলেও ছিলাম। ও বলল—বাড়ির কাছে কাজের মেয়ে বাড়িতেই থাক।
আসল কথা সাবিত্রী থাকলে সন্তুর অসুবিধা হয়।
কিছুক্ষন পরে সন্তু আসবে। ইউনিটের সকলের টাকা পয়সা বুঝিয়ে দিয়ে, কালকের শুটিং এর সব রেডি করে আমার ঘরেই ঢুকবে। প্রথমে হুইস্কি, তারপর আমার শরীর।
বাইরে কোথাও কাজে আসা মানে এটাই রুটিন।
প্রথম প্রথম ভয় লাগতো। তারপর ভালো লাগতো। এখন অসহ্য লাগে। মরার মতো পরে থাকি, শরীরে ব্যাথা হয়। অথচ না বলতে পারিনা।
এ লাইনে ক্যারিয়ার করতে হলে ছেলেদের টাকা দিতে হয় আর মেয়েদের নিজের শরীর।
সমাজ এখন বদলেছে। বিশ্বায়নের জোয়ার আমাদের সমাজ ব্যবস্থাকেও ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে, আর তাই আমরাও বেঁচে আছি সেলিব্রেটি হয়ে। আর না হলে এতো দিনে আমাদের মতো মেয়েদের পরিচয় হতো বেশ্যা। সমাজের কলংকিত নারী। কিন্তু আজ নারীপুরুষের সম্পর্ক অবাধ, একমাত্রিক। সে সম্পর্ক শুধুই যৌনতার। আজ তাই ব্যাক্তি স্বাধীনতার জোয়ারে সবাই গা ভাসাচ্ছে।
প্রথম যখন অভিনয়ে পা রাখছি তখন আমার বয়েস ছিল ঐ সাবিত্রীর মতোই। শরীরে জৌলুশ, মনে কামনা, চোখে স্বপ্ন। সিনেমা জগতে আমার নাম হবে, প্রাণ খুলে খরচ করার মতো টাকা থাকবে, কাগজে ছবি বের হবে। নিজের গাড়ি, বাড়ি, মোবাইল... কত কি!
অভিজিৎ ঠিকই বলেছিলো, কিছু পেতে গেলে কিছু হারাতে হয়। এই জীবনে, এই জগতে সবই দেওয়া নেওয়ার হিসেবে চলে। আজ আমি অনেক কিছুই পেয়েছি, কিন্তু হারিয়েছি তার চেয়ে বেশী।
বাড়ির কারোর সাথে দেখা নেই প্রায় সাত বছর হচ্ছে। মাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করে। অভিজিৎকেও! কি জানি এখনো সেই নাটক নিয়েই পরে আছে কিনা!
ভাইকে মাঝে মাঝে চোখে পড়ে। সাইকেলের পেছনে ওষুধের পেটি নিয়ে দোকানে দোকানে ছুটছে। এখন ওকে বেশ বড় বড় লাগে। কেমন লোক লোক মনে হয়। দুএকদিন চোখাচুখি হয়েছিল। দাঁড়ায়নি। সজোরে সাইকেলটা নিয়ে চলে গেছে। আমাকে চিনতে চায়নি। ইচ্ছে করছিলো একবার ডাকি। জিজ্ঞেস করি—‘‘টোটো শোন, মা কেমন আছে রে?’’ কিংবা হাতে কিছু টাকা দিয়ে বলি—‘‘এগুলো নে, মাকে দিস।’’ কিন্তু সাহস পাইনি যদি বলে বসে—‘‘তুই আমাদের কে হোস যে তোর ঐ নোংরা টাকা নেবো?’’ যেমন বাড়ি ছেড়ে আসার দিন মা বলে ছিল—‘‘তোর মতো নষ্ট মেয়ে থাকার চেয়ে না থাকা ভালো।’’ হ্যাঁ! সেই আমার প্রথম নষ্ট হওয়া। মঞ্চ থেকে পর্দায় পৌঁছাবার লোভে নিজের শরীর নিয়ে জুয়া খেলা, যার ফল—আজ আমি সেলিব্রেটি। কলকাতার বহু পুরুষের স্বপ্ন-নারী। কিন্তু অভিজিতের হতে পারলাম কই!
ঐ গাড়ি এসে দাঁড়ালো। সন্তু নামছে। এদিকে আসছে।
মলি তুমি এখনও বাইরে? ভেতরে যাও, ঠান্ডা লেগে যাবে।
আজকে তুমি এত তাড়াতাড়ি?
তোমাকে একটা সারপ্রাইস দেব বলে। তুমি ভেতরে যাও, আমি একটু চেঞ্জ করে আসছি।
সারপ্রাইজ! গত তিন বছর ধরে প্রতিদিনই তো ও আমায় সারপ্রাইস দিচ্ছে। হয় কোনো নতুন ব্র্যান্ডের সিগারেট নয়তো নতুন ব্র্যান্ডের হুইস্কি। আর নাহলে কিছু উগ্র পোশাক। এসেই বলবে—‘‘মলি এটা তোমার জন্য!’’ তারপর ... তারপর ... সারা রাত নারীপুরুষের আদিমতম খেলা।
মলি, এই শাড়িটা পরে আসবে!
এটাই বুঝি তোমার আজকের সারপ্রাইস? তা ব্যাগে কি?
বলছি, যাও আগে...
কি আর বলবে সন্তু। বলবে—‘‘তোমাকে দারুন দেখাচ্ছে, ইচ্ছে করছে তোমাকে নিয়ে কোনো কোথাও পালিয়ে যাই।’’
সন্তু, আমিও একদিন তোমাকে নিয়ে পালিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখেছিলাম, কিন্তু সে স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে গেছে।
নাও, দেখো কেমন লাগছে!
বাহ্! ঠিক যেমন ভেবেছিলাম। কি সুন্দর লাগছে তোমায়!
তোমার চোখে আমিতো সব সময় বিশ্বসুন্দরী। তা আজ আবার নতুন কি পেলে?
পাইনি, পেতে চাই। নতুন জীবন। মলি আমার আর ভালো লাগছে না। যে দাম্পত্যে সুখ নেই, শান্তি নেই, সে দাম্পত্য কিসের জন্য?
মানে?
—মলি আমি তোমাকে বিয়ে করতে চাই, প্লীজ... প্লীজ আর না বলোনা।
—ছি: সন্তু! কিসব আজে বাজে বকছো। তোমার ঘরে তোমার স্ত্রী আছে, তোমার ছেলে আছে। তুমি এসব ভাবলে কি করে?
—আমি তোমাকে আমার করে পেতে চাই।
—আমি তো সবসময় তোমারই আছি সন্তু।
—না..না, ওভাবে আর নয়, আমি তোমাকে আমার স্ত্রী হিসাবে পেতে চাই। তুমি আমার সন্তানের মা হবে। আমাদের একটা সংসার হবে, পরিবার হবে।
—হাসালে সন্তু। জীবনে প্রথমবার তোমার কথা শুনে হাসি পাচ্ছে। তুমি তো জানো সন্তু, একটা সময় আমারও স্বপ্ন ছিল আমার বিয়ে হবে, সন্তান হবে, সংসার হবে কিন্তু তা কখনোই কোনো সম্পর্ককে নষ্ট করে নয়।
—তুমি জয়িতার কথা বলছো! ওটা একটা নষ্ট মেয়ে। ওর সাথে থাকা যায়না। ওরতো আমাকে আর প্রয়োজনও নেই। নষ্ট মেয়েদের কাউকে প্রয়োজন হয়না।
—হ্যাঁ, ঠিকই বলেছো! আমারও যে কাউকে প্রয়োজন নেই, আমিও যে নষ্ট মেয়ে।
—কে বলেছে?
—আমার মা বলেছে, ভাই বলেছে... আরও অনেকে বলেছে।
—কিন্তু আমি তো বলিনি!
—হ্যাঁ বলোনি। কারণ তুমি বলতে চাওনি। আসলে মানুষের চেহারায় তোমরা এক একটা সেক্সওয়ালী পার্ভার্টেড ক্রিচার্স। আমাদের মতো মেয়েদের নষ্ট করাই তোমাদের শখ। মুখে ব্যক্তি স্বাধীনতার কথা বোলো, নারী স্বাধীনতার ছবি বানাও, নিজের প্রয়োজনে সমাজকে সাবালক করে তোলো, অথচ... অথচ মানুষকে মানুষ ভাবতে পারোনা।
—প্লিজ মলি, আমাকে একবার একটু বোঝার চেষ্টা করো। আমি তোমাকে ভালোবাসি! আর...আর তুমিও তো আমায় ভালোবাসো। একদিন বিয়ে করতে চেয়েছিলে।
—চিনতে ভুল করেছিলাম, তোমাকে অন্য রকম ভেবে ছিলাম। কিন্তু তুমিওতো ওদের মতো। তোমার মতো নোংরা হিংস্র জন্তুকে কখনো ভালবাসা যায়না। তোমরা ঘৃণারও অযোগ্য।
গল্পটা এখানেই শেষ হতে পারতো। কিন্তু হয়নি। এর পরেও রয়ে গেলো সন্তুর মৃত্যুর রহস্য। সকলে জানে সন্তু হার্ট এটাকে মারা গেছে। ডাক্তারও তাই লিখেছে। অথচ মল্লিকা জানে ওটা সিম্পল হার্ট এটাক নয়। সুইসাইড। সন্তু সেই রাতে ড্রিঙ্কস করতে বসে যে সুইসাইড নোটটি লিখেছিলো সেটি এখন মল্লিকার আলমারির লকারে। সময়ে অসময়ে মল্লিকা সেটা বের করে দেখে আর আপন মনে বলতে থাকে...
—‘‘মরে গিয়ে তুমি কী প্রমান করতে চাও সন্তু? তুমি আমায় ভালোবাসতে? মিথ্যে কথা, মিথ্যে...মিথ্যে...মিথ্যে!’’