ইলশেগুঁড়ি ২৯তম সংখ্যা (শারদীয়া)
ইলশেগুঁড়ি ২৯তম সংখ্যা (শারদীয়া)
বর্ষণমুখর সন্ধ্যা। আকাশে কালোমেঘের ঝলকানি। বিকট শব্দে কোথায় যেন বাজ পড়ল।
ছোটদের পড়াশুনায় মন নেই। ঠাকুর্দার ঘরে এসে সমস্বরে আব্দার—দাদু, একটা গল্প বল না।
দুর্গাপ্রসন্ন তাড়িয়ে তাড়িয়ে হুঁকায় টান মারছিলেন একমনে। মৌতাতে চোখদুটো বোঁজা। এরকম আব্দার মাঝেমধ্যেই নাতি নাতনীরা নিয়ে এসে বসে ঠাকুর্দার কাছে। ঠাকুর্দার ঝুলিতে মজার মজার নানা রকম গল্পের উপাদান; বাচ্চারা শুনতে পছন্দ করে। গল্পগুলো দুর্গাপ্রসন্ন বলেনও বেশ রসিয়ে রসিয়ে।
নিবু নিবু হুঁকোখানা একপাশে সরিয়ে রেখে চোখ খুলে বলেন, কীসের গল্প শুনতে চাস? ভূতের?
ভূতের গল্প অনেক শুনেছি। অন্য কিছুর বল।
ডাকাতের গল্প শুনবি?
হ্যাঁ হ্যাঁ, তাই বল।
এদের মধ্যে ঝুমুর বড়। বলে, বড় জ্যেঠি বেগুনি ভাজছিল দেখেছি, বলে আসি এখানে দিয়ে যেতে। সাথে আচারের তেলে মাখা মুড়ি।
বাচ্চারা আনন্দে হৈ হৈ করে ওঠে।
ঝুমুর বলে, আমি ফিরে না আসা পর্যন্ত গল্প শুরু করবে না দাদু।
তাই হবে যা। প্রশ্রয়ের হাসি হেসে দুর্গাপ্রসন্ন আশ্বস্ত করেন তাকে।
মিনিট তিনেক বাদ তেলেভাজা ও মুড়ি নিয়ে ঝুমুর হাজির।
মহানন্দে মুড়ি চিবোতে চিবোতে কচিকাঁচার দল বলে, এবার শুরু কর দাদু।
আকাশের বুক চিরে দূরে কোথায় বাজ পড়ল। ভয়ে সবাই দাদুর আরাম কেদারার সামনে এগিয়ে আসে।
দুর্গাপ্রসন্ন বলে চলেন, অনেক আগেকার কথা। আমার দূর সম্পর্কের এক কাকা ছিলেন নিমতিতা রাজবাড়ির নায়েব। বাড়ি সৈদাবাদে। কর্মসূত্রে বেশীরভাগ সময় কাটত নিমতিতায়। এসটেটের এক বাড়িতে নিজেই থাকতেন একা একা। দুসপ্তাহ কী মাসে একবার করে আসতেন সৈদাবাদের পৈত্রিক বাড়িতে। বাড়ির লোকেরাও কখনও কখনও নিমতিতায় যেতেন দোল, দুর্গোৎসব উপলক্ষ্যে।
রাজবাড়ির অনুষ্ঠান জাঁকজমকপূর্ণ। আতসবাজি পুড়ত; গোটা রাজবাড়ি আলোয় আলোয় আলোকিত, ঝলমলে। গান, বাজনা হত। রাজবাড়ির নাট্যশালায় নাটক অভিনীত হত। এখানে পদধূলি পড়েছিল নাট্যাচার্য শিশির কুমার ভাদুড়ি, ক্ষিরোদ প্রসাদ বিদ্যাবিনোদ, তদানীন্তন জেলাশাসক তথা প্রথিতযশা সাহিত্যিক শ্রী অন্নদাশংকর রায়ের।
এখানেই জলসাঘর সিনেমার শুটিং হয়েছিল না দাদু?
কচিকাঁচাদের মধ্যে সন্দীপ সামান্য বড়। বয়েস আন্দাজ চোদ্দ। স্মার্ট ফোন ঘাঁটার অভ্যেস রয়েছে। প্রশ্নটা সেই করে।
ঠিক ধরেছিস। সত্যজিত রায় ঐ সিনেমার জন্য বহু জায়গা ঘুরে শেষবেশ এই লোকেশনকে বেছে নিয়েছিলেন আউটডোর শুটিংস্পট হিসাবে। জলসাঘর ছাড়া দেবী, মহানগর ছবির শুটিংও হয়েছিল এখানে। বাকীটা ইতিহাস।
পল্টু সব কিছু খুঁটিয়ে জানতে পছন্দ করে। শুধায়, দাদু, নিমতিতা রাজবাড়ির প্রতিষ্ঠা কে করেছিলেন?
ভাল প্রশ্ন। দুর্গাপ্রসন্ন খুশী হন। বলেন, গল্প বলার আগে রাজবাড়ি পত্তনের ইতিহাসটাও জেনে রাখা প্রয়োজন। নবাবী আমলে ১৮৬৬-১৮৬৯ সালে গৌরসুন্দর ও দ্বারিকানাথ চৌধুরী দুই ভাই অনেকখানি জায়গা কিনে নিমতিতা রাজবাড়ি ও এসটেটের সূচনা করেন। সঙ্গীত ও নাটক বিষয়ে তাঁরা ছিলেন বিশেষ আগ্রহী। পরে দ্বারিকানাথের ছেলে মহেন্দ্র নারায়ণ নিমতিতাকে সাংস্কৃতিক ক্ষেত্র হিসাবে বিশেষ পরিচিতি এনে দেন। তিনি নিজেও বহু নাটকে অভিনয় করেছিলেন। যা হয়, পরে সম্পত্তি, অধিকার, আভিজাত্যের চোরা লড়াইয়ে দুপক্ষ বিশেষ করে গৌরসুন্দরের বংশধররা দ্বারিকানাথের বংশধরদের খ্যাতি-প্রতিপত্তিতে ঈর্ষান্বিত হয়ে পড়েন। গোপনে গোপনে মহেন্দ্র নারায়ণের পরবর্তী প্রজন্মের উপর বিদ্বেষবশতঃ অনিষ্টচিন্তা শুরু করেছিলেন। উপর উপর অবশ্য সদ্ভাব রক্ষা, পথেঘাটে দেখা হলে কুশল বিনিময়ে কাষ্ঠহাসি বিলোতে কার্পণ্য করতেন না। নিমতিতা থেকে মালদার দূরত্ব বেশী হলে ষাট কিলোমিটার। মালদায় রেশমের ব্যবসা শুরু করেছিলেন। বহরমপুর মালদা জুড়ে রেশমী বস্ত্রর ব্যবসা। অর্থকৌলীন্য এলেও শিল্প-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে মহেন্দ্রনারায়ণদের ধারে পাশেও পৌঁছাতে পারেন নি। মনের জ্বালা আসলে সেখানেই। নিমতিতা রাজবাড়ির অংশ থাকলেও বড় অট্টালিকা বানিয়ে অন্যত্র বসবাস করতেন। দোল, দুর্গৌৎসব, অন্য সামাজিক অনুষ্ঠানে দুই বংশের লোকেরা একত্রিত হতেন; অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতেন।
নাগাড়ে কথা বলে টেবিলে রাখা গ্লাস তুলে জল খান দুর্গাপ্রসন্ন।
নাতি নাতনীদের উৎসুক মুখগুলি দুর্গাদাদুর মুখের উপর নিবদ্ধ।
পুনরায় শুরু করেন দুর্গপ্রসন্ন। আমার দাদুর বাবা শ্রী দীননাথ সামন্ত নিমতিতা এস্টেটের নায়েব ছিলেন। মহেন্দ্রনাথদের তখন বোলবোলাও অবস্থা, দোর্দন্ড প্রতাপ। সমশেরগঞ্জের নিমতিতা ব্লকের রাজবাড়িতে বহু গুণী মানুষজনের আনাগোনা। দীননাথের শেষের দিকে রাঝবাড়ির অবস্থা পড়ে এসেছিল। মহেন্দ্র নারায়ণের পরবর্তী প্রজন্ম আগের সেই ঠাটঠমক ধরে রাখতে পারেন নি। নব্য শিক্ষিত বংশধরেরা কেউ আর জঙ্গীপুরের এঁদো গ্রামে পড়ে থাকতে চাননি। তাছাড়া গঙ্গার প্রবল ভাঙনে রাজবাড়ির বেশ কিছু অংশ গঙ্গাগর্ভে তলিয়ে গেছিল। আর ছিল বড় ও ছোট তরফের মধ্যে মনোমালিন্য, ঐক্যের অভাব। বড় তরফ গৌরাঙ্গসুন্দরের বংশধররা ব্যবসা বাণিজ্য করে অনেক ধন সম্পত্তির মালিক। অহঙ্কার বাড়ল। ছোট তরফ দ্বারিকানাথের বংশধরদের হেয় ও অবজ্ঞার চোখে দেখতে থাকল। হতশ্রী রাজবাড়ির কৌলীন্য ত্যাগ করে নিজেরা গ্রামের অন্য প্রান্তে বাড়ি বানিয়ে সেখানে চলে গেছিল।
দীননাথ সামন্তের পর তাঁর মেজ ছেলে মানে দুর্গাপ্রসন্নর বাবা হরনাথ ক্ষয়িষ্ণু রাজবাড়ির দেখাশোনার ভার গ্রহণ করলেন। তাঁর চাকরী গ্রহণের কিছু বছর আগে বড় শরিক ও ছোট শরিকের কর্তারা অর্থাৎ মহেন্দ্রনাথরা দেহ রেখেছিলেন।
পরিবার খন্ডিত; ভাইয়ে ভাইয়ে ভিন্নভাগ। একে অপরকে দেখতে পারে না। আড়ালে একে অপরের নামে নিন্দা করে। ছিদ্রাণ্বেষণের প্রয়াস পায়।
এরপর ১৯৫৮ সালে বিশ্ববন্দিত চিত্র পরিচালক সত্যজিৎ রায় তাঁর স্মরণীয় ছবি ‘জলসাঘর” এর শুটিং করার জন্য এই রাজবাড়িকে নির্বাচন করে ছিলেন।
রাজন্য ভাতা বিলোপের পর রাজা ও জমিদারদের আয়ের শেষ উপায়টুকুও বিলুপ্ত। ক্রমে কৌলীন্য হারিয়ে তাঁরা কালের অতলতলে তলিয়ে গেলেন। ভাঙাচোরা রাজবাড়ি কোনও গতিকে টিকে আছে শেষ প্রহর গোণার অপেক্ষায়।
সে যাক। একবার এক বড়সর ডাকাতির ঘটনা ঘটেছিল গ্রামে। শুনেছিলাম বাবার মুখে। তখন আমি স্কুলেপড়া বালক।
এবার গল্পটা শুরু কর দাদু। কচিকাঁচার দল তাড়া লাগায়।
বলছি শোন। দুর্গাপ্রসন্ন শুরু করেন। তখনকার দিনে গ্রাম্য পরিবেশ এখনকার মত ছিল না। ইলকট্রিসিটি পৌঁছয় নি; বড়লোকদের বাড়িতে বিশেষ কোনও অনুষ্ঠানে হ্যাজাকের ব্যবস্থা করা হত। তা বাদে গ্রাম ঘুরঘুট্টি অন্ধকারে মুখ লুকাত। প্রহরে প্রহরে শিয়ালের হাঁক। ঝিঁঝিঁপোকার নিরবচ্ছিন্ন বাদ্যবৃন্দ। কাঁচা রাস্তায় সাপখোপের ভয়। চোর-ডাকাতের উপদ্রবও কম নয়। কারো বাড়িতে ডাকাত পড়লে প্রাণের ভয়ে পাড়া-প্রতিবেশিরা এগিয়ে আসতে চাইত না। জমিদার বাড়িতে লাইসেন্স করা একটা গাদা বন্দুক অবশ্য ছিল। তবে ব্যবহারের অভাবে পুরানো বন্দুক থেকে কাজের সময় গুলি বেরত কিনা সন্দেহ।
মাঝে মাঝে বনেদী বাড়িতে ডাকাত পড়ত। সেসব ডাকাত ছিল ভয়ঙ্কর। নাম শুনলে সাত গাঁয়ের লোকের বুক কেঁপে উঠত। মুর্শিদাবাদ, মালদা জুড়ে সাহু ডাকাতের রাজত্ব। কারো বাড়ি লুঠ করতে এলে দুচারদিন আগে সে আবার চিঠি লিখে দিনক্ষণ জানিয়ে দিত। গৃহকর্তার মুখ ভয়ে পাংশু। অনেক মাইল দূরে জঙ্গীপুর পুলিশ ফাঁড়ি। থানায় খবর দিলে পুলিশ আসার আগেই লুঠপাট সেরে ডাকাতদল চম্পট। বাড়িতে বাড়িতে টেলিফোন দূর অস্ত, সারা গাঁয়ে একজনের কাছে ছিল কী ছিল না। উপরি যন্ত্রণা, লাইন পাওয়ার সমস্যা।
একবার হল কী, সাহু ডাকাতের চিঠি এল রাজবাড়িতে। চিঠি পড়ে বড়কর্তার মাথায় হাত। কী হবে? কী করবেন তিনি? থানায় নিজে গেলেন। এখন অবস্থা পড়ে এলেও রাজবাড়ির লোকেদের আলাদা একটা খাতির
ও মর্যাদা ছিল। ও সি সাহেব চিঠিখানা শান্ত মনে পড়ে আশ্বস দিলেন পুলিশি নিরাপত্তার।
নির্দিষ্ট দিনে রাজবাড়িতে জনাচারেক পুলিশ প্লেন ড্রেসে মোতায়েন। পুরুষরা দা, বল্লম, সড়কি হাতে প্রস্তুত। গয়নাগাটি, টাকাকড়ি সমেত বাড়ির মেয়েরা ভেতরের গোপন কক্ষে স্থানান্তরিত। সবাই তটস্থ; মুখে চোখে ভয়ের করাল ছাপ। মনে মনে ইষ্টনাম জপ করতে থাকেন। সময় যত ঘনিয়ে আসে, চাপা উদ্বেগ, উৎকন্ঠা ও ভয়ে থরহরি কম্পমান। কী হয়, কী হয়, অস্বস্তিকর দমবন্ধ প্রহর গোণা।
নির্দিষ্ট সময় অতিক্রান্ত। ডাকাতরা হানা দেয় নি। পুলিশি ব্যবস্থার কথা জানতে পেরে সম্ভবত রণে ভঙ্গ দিয়েছে। গৃহকর্তা শশাঙ্কনারায়ণের মুখে স্বস্তির ছাপ—এ যাত্রায় হয়ত বেঁচে গেলেন। কুলদেবী মা কালির উদ্দেশ্যে প্রণাম জানাতে থাকেন বার বার।
কিছু পরে গ্রামের পূবপ্রান্ত থেকে পর পর কয়েকটি বোমা ফাটার বিকট আওয়াজ।
সবাই হতচকিত, ভয়ে বিমূঢ়। কী হল ব্যাপারটা? এ ওর মুখের দিকে চায়। পূবপ্রান্তে নরনারায়ণের বাড়ি। সেখানে কী কিছু হল? দিন চারেক বাদ ও তরফের মেজো মেয়ে সায়ন্তনীর বিয়ে।
হতভম্বভাব কাটিয়ে চারজন সশস্ত্র পূলিশের মধ্যে দুজন ছুট লাগায় শব্দ অনুসরণ করে; বাকি দুজন এবাড়ির পাহারায়।
বেশ কিছু সময় অতিবাহিত। শশাঙ্ক নারায়ণ চুপচাপ থাকতে না পেরে পুলিশ দুজনকে বলেন, আপনারা এখানে থাকুন। আমি গিয়ে দেখি, ব্যাপারটা আদপে কী।
দুজনের একজন বলেন, শান্ত থাকুন। বাইরে গেলে বিপদের সমূহ আশঙ্কা। একটা খবর নিশ্চয় আসবে ওখান থেকে কিছুক্ষণের মধ্যে।
অপেক্ষা করতে হল না বিশেষ। গ্রামের চৌকিদার গজেন হাঁপাতে হাঁপাতে এসে হাজির। মুখচোখে উদ্বেগ ও চরম ভয়ের অভিব্যক্তি। বলে, সব্বোনাশ হয়ে গেছে কত্তা -
কী রকম?
বড় কত্তা লরলারায়ণ মশাইয়ের বাড়িতে ডাকাত পড়েছে।
কী বলছ?
আজ্ঞা হাঁ- নিজ্জস সত্যি কথা বুলছি-
শব্দ কীসের হল?
আজ্ঞা লুঠতরাজ সেরে ডাকাতরা বোমা ফাটাতে ফাটাতে পালিয়ে গেলছে। আমি খপরটা নেবেদন করতে চলে আলছি।
ওখানে পুলিশের লোক দেখতে পেলে?
বুলতে পারব না। তবে মেলা লোক জড়ো হলছে।
শশাঙ্ক বুঝলেন, প্লেন ড্রেসে আছে বলে গজেন পুলিশদের চিনতে পারে নি। বলেন, ঠিক আছে, যাও। আমরা আসছি।
আপাতত বিপদমুক্তি। স্বস্তির শ্বাস ফেলেন শশাঙ্কনারায়ণ। বাকি দুজন পুলিশের সাথে রওনা দেন পূবপাড়ার দিকে।
নরনারায়ণের বাড়ির সামনে লোকে লোকারণ্য। সদর দরজা হাট করে খোলা। শশাঙ্ক ভিতরে ঢোকেন। ঘৃহকর্তা ও তাঁর বড় ছেলে যতীন হাত-পা বাঁধা অবস্থায় চেয়ারে। বাকি নারী-পুরুষ ও বাচ্চারা আতঙ্কে কান্নাকাটি জুড়ে দিয়েছে।
শশাঙ্কনারায়ণ শুধান—পুলিশে খবর দেওয়া হয়েছে?
নরনারায়ণের স্ত্রী বলেন, পুলিশের লোক সদরে খবর পাঠিয়েছে।
বাবা-ছেলেকে বাঁধনমুক্ত করা হল। নরনারায়ণ ও যতীন ভয়ে-দুঃখে কেঁদে ওঠেন—টাকাকড়ি গয়নাগাটি সব লুঠ করে পালাল গো। সায়ন্তনীর বিয়ে হবে কী করে?
অন্য সময় কেউ কারো মুখ দেখতে চান না। তবে কিনা এখন চরম সংকটের মুহূর্ত।
নরনারায়ণকে শান্ত করানোর চেষ্টা করেন, শশাঙ্কনারায়ণ, যা হবার হয়ে গেছে। ও সি সাহেব নিজে আসবেন বলেছেন। নিজেকে সামলাও। সায়ন্তনীর বিয়ে ঠিক দিনে ঠিক সময়ে হবে। দানসামগ্রী, গয়নাগাটি জোগাড় করব কীভাবে?
আলাদা থাকলেও আমরা এক বংশের লোক। একই রক্ত বইছে শরীরে। বংশের মর্যাদা রাখব সবাই মিলে। ঠাকমার দেওয়া পঁচিশ ভরি সোনা, পেতল, কাঁসার বাসন-কোসন- যা আমার ভাগে পেয়েছি, সায়ন্তনীর বিয়েতে সেসব দিয়ে দেব। এছাড়া নগদ হাজার পাঁচেক টাকা হাতে রয়েছে, তোমাকে সেসব দিচ্ছি। কাজ চালিয়ে নাও।
কৃতজ্ঞতায় হাউ হাউ করে কেঁদে ওঠেন নরনারায়ণ; জড়িয়ে ধরেন শশাঙ্ককে। অনুতাপে পুড়ে যেতে থাকে মন। এমন সহৃদয় ছোটতরফকে কিনা কত ঈর্ষা করে এসেছেন, অনিষ্ট চেয়েছেন তার। শশাঙ্কর বাড়িতে ডাকাত পড়বে জেনে মজা পেয়েছেন। তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করেছেন সে আনন্দ—সব লুঠে নিয়ে পথের ভিখারি বানিয়ে দিক শশাঙ্ককে। অথচ ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস! ঠিক উল্টোটা ঘটল। মনে মনে ধিক্কার দিতে থাকেন নিজেকে—পরের ক্ষতি চেয়ে কতই না পাপ করে এসেছেন এতদিন। নরনারায়ণের গায়ে পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে থাকেন শশাঙ্ক ভরসা জোগাতে। মনে খটকা, ডাকাতরা তাঁর বাড়ি লুঠ করবে বলে চিঠি দিয়ে নরনারায়ণের বাড়িতে ডাকাতি করতে গেল কেন?
আসলে এটা ছিল সাহুডাকাতের কৌশলী মাস্টার স্ট্রোক। জানত শশাঙ্কনারায়ণের বাড়ি ডাকাতি করবে বললে অন্য তরফ রিল্যাকসড থাকবে। বড় তরফের বাড়িতে বিয়ে উপলক্ষ্যে অনেক গয়নাগাটি, টাকাকড়ি, বাসনপত্তর মজুদ। লুঠ করতে পারলে মাস ছয়েক হেসেখেলে চলে যাবে। অতর্কিতে নরনারায়ণের বাড়িতে ঢুকে পড়ে দশজন চ্যালাচামুন্ডা সমেত। বাড়ির সবাইকে চাকু, ভোজালি দেখিয়ে আর পুরুষ মানুষ দুজনকে দড়ি দিয়ে বেঁধে ফেলে নিরুপদ্রবে ডাকাতি শেষে বোমা ফাটাতে ফাটাতে অন্ধকারে গা ঢাকা দেয়।
*********
ডাকাত পড়ার মুহূর্তটার কথা মনে পড়লে এখনও ভয়ে কেঁপে ওঠেন নরনারায়ণ।
ঠক্ ঠক্ ঠক্—
জোরে জোরে কড়া নাড়ার শব্দ। এ অসময়ে কে আবার এল?
আবার, আবার কড়া নাড়ার শব্দ। সবে খেতে বসেছেন। বলেন, যতীন দেখত কে?
যতীন গিয়ে দরজা খুলতে হুড়মুড় করে বাড়িতে ঢুকে পড়ে আট দশ জন সশস্ত্র লোক। দশাসই লম্বা পেটাই চেহারা। পড়নে মালকোঁচা মারা হেঁটো ধুতি। চোখগুলো ভাটার মত লাল। মাথায় রুখু বাবড়ি চুল। কপালে লম্বাচওড়া সিঁদুরের টিপ। মুখেচোখে খুনে, নৃশংস অভিব্যক্তি। হাতে ভোজালী, ধারালো চাকু, বল্লম,লাঠি, সড়কি। এদের মধ্যে একজনের মাথায় লালফেট্টি, কোমড়ে কালো কোমড়বন্ধ। সম্ভবতঃ সেই দলের নেতা। বজ্রকন্ঠে নির্দেশ দেয়, বড়দের সবকটাকে বেঁধে ফেল, বাকীদের ঘিরে রাখ। কেউ যেন পালাতে না পারে।
বাকী অনুচররা আদেশ পালন করে। নেতা বলে, আমার নাম সাহুডাকাত। নাম শুনলে দশ গ্রামের লোক ভয়ে কেঁপে ওঠে। কারও কোন অনিষ্ট করব না। শুধু টাকাকড়ি গয়নাগাটি যা আছে, দিয়ে দিন। ভালয় ভালয় চলে যাব।
সবাই চুপ। নরনারায়ণর বুকে ধারালো ছুরিখানা ঠেকিয়ে কুলিশ কন্ঠে বলে—চালিয়ে দেব নাকি!
নরনারায়ণের ছোট নাতি কাতর কন্ঠে বলে ওঠে, ডাকাতদাদু, আমার দাদুকে মেরো না প্লীজ...
না দাদু কিচ্ছু করব না। শুধু তোমার দাদুকে বল সিন্দুকের চাবিটা কোথায় আছে বলে দিতে।
দাদু, চাবিটা দিয়ে দাও না ডাকাতদাদুকে।
এবার নরনারায়ণের স্ত্রী হৈমন্তী বলেন, উনি জানেন না। সিন্দুকের চাবি আমার কাছে। বলে শাড়ির আঁচল থেকে চাবির গোছা খুলে মেঝেতে ফেলে দেন।
সব কিছু নির্বিবাদে লুঠ করে বোমা ফাটাতে ফাটাতে ডাকাতদল পালিয়ে যায়।
এরপর থানা-পুলিশ হল, তদন্ত শুরু।
নির্দিষ্ট দিনে শুভতিথিতে ভালয় ভালয় সায়ন্তনীর বিয়ে সম্পন্ন। দুতরফ মিলেমিশে বিয়ের কাজ সামলালেন। চাপা বিরোধ ও অবিশ্বাসের মূলোচ্ছেদ। সৌভ্রাতৃত্ব আবার ফিরে এসেছিল দুতরফে। গ্রামের লোক ভাবে, ভাগ্যিস্ ডাকাতিটা হয়েছিল!