ইলশেগুঁড়ি ২৯তম সংখ্যা (শারদীয়া)
ইলশেগুঁড়ি ২৯তম সংখ্যা (শারদীয়া)
বর্ষা বিদায় নিয়েছে, আকাশ ধূসরতা কাটিয়ে হয়ে উঠেছে নীল, বিকাল বেলায় ছাদে বসে আকাশ দেখছি, সাদা সাদা মেঘ দল বেঁধে কোন অজানার পথে ছুটে চলেছে, এমন সময় মেঘেরা সৃষ্টি করল ঠিক যেন বরফে মোড়া কেদারনাথ শৃঙ্গ, বিস্ময়ে চোখ সরছে না, মনটা এই সময় চলে গেলো প্রায় ৩৫ বছর আগে, স্মৃতিপটে ভেসে উঠল পঞ্চকেদার যাত্রার দিনগুলি।
এইরকমই এক সেপ্টেম্বর মাসে আমরা চার বন্ধু পার্থ, রথীন, বরুণ আর আমি পঞ্চকেদার যাত্রার উদ্দেশ্য নিয়ে অমৃতসর মেলে যাত্রা শুরু করেছিলাম। ট্রেন লাকসারে পৌঁছলে আমরা যখন অমৃতসর মেল থেকে নামলাম, তখন প্রায় রাত ১টা। ভোর প্রায় ৪টের সময় লাকসার থেকে আমরা দিল্লি হারিদ্বার প্যাসেঞ্জার ট্রেনে উঠলাম। প্রায় ফাঁকা ট্রেন, বেশ গুছিয়ে বসে ভোরের নরম বাতাস গায়ে লাগিয়ে প্রায় সাড়ে পাঁচটার সময় হরিদ্বারে পৌঁছলাম। এই প্রথম হরিদ্বারে এলাম ষ্টেশনটা দেখেই ভাল লাগছিল। শুনলাম হৃষিকেশ যাবার ট্রেন আনেক বেলায় আসবে, তাই ষ্টেশন থেকে বেরিয়ে একটা বাসে করে চলে এলাম হৃষিকেশে। মাত্র ৪০-৪৫ মিনিটের মধ্যেই বাস আমাদের পৌঁছে দিল হৃষিকেশে।
হৃষিকেশে আমাদের থাকার কথা ছিল শ্রী শ্রী সীতারাম দাস ওঙ্কারনাথ ঠাকুর আশ্রমে। সেজোকাকা ঠাকুরের শিষ্য, উনিই সব ঠিক করে দিয়েছিলেন। কিন্তু খবর নিয়ে জানলাম কেদারের পথে শেষ মোটর পথের গৌরিকুন্ডে যাবার বাস ছাড়ে হৃষিকেশ থেকে ভোর ৫টায়। কাজেই বাসস্ট্যান্ডের কাছে থাকাই শ্রেয়, তাই বাসস্ট্যান্ডের কাছে একটি হোটেল নাম সম্ভবত গিরওয়ারে থাকার ব্যবস্থা করলাম। হৃষিকেশ শহরটাও বেশ সুন্দর, একটু দূরেই পাহাড় দেখা যাচ্ছে, হিমালয়ের একেবারে কোলের কাছে এসেছি ভেবেই মনটা ভালো হয়ে গেলো তাই একটু মুখ হাত ধুয়েই বেরিয়ে পড়লাম এখানকার দর্শনীয় স্থানগুলি যেমন লক্ষণ ঝুলা, গীতাভবন, স্বর্গাশ্রম, শিবানন্দ ঝুলা ইত্যাদি দেখতে। এছাড়া একটি মন্দির যেটা ১৩তলা উঁচু, প্রতিটি তলায় আছে দেব দেবীর মূর্তি। একেবারে ওপর তলা থেকে হৃষিকেশ শহরের বেশ খানিকটা অংশ দেখতে পাওয়া যায়।
বিকালে বাসষ্ট্যান্ড থেকে আগামীকালের ভোর ৫টায় গৌরিকুন্ড যাবার বাসের টিকিট কেটে নিলাম। বাস ভাড়া তখন ছিল প্রতিজনার ৪৯ টাকা। উত্তেজনায় রাতে ঘুম এল না। প্রায় শেষ রাতে হোটেলের ঘর ছেড়ে বাসষ্ট্যান্ডে এলাম। বাস অনেকক্ষন ধরে গর্জন করে অবশেষে সাড়ে ৫টা নাগাদ ছেড়ে বিকাল সাড়ে ৪টের সময় গৌরিকুন্ড পৌঁছল। সকালে আমরা একরকম খালি পেটেই বাস যাত্রা শুরু করেছিলাম, সেটা উচিৎ হয় নি, তাই একটু অস্বস্তি হচ্ছিল। বাস শ্রীনগর থামলে একটু জল খাবার পর শরীরটা ভালো লাগছিল, শ্রীনগর বলতে আমি জানতাম জম্মু কাশ্মীরের রাজধানী শহরের কথা কিন্তু উত্তর প্রদেশেও এক শ্রীনগর আছে তা জানতাম না, (এখন রাজ্যের এই অংশের নাম বদলে হয়েছে উত্তরাখন্ড)। দুপুরের খাওয়ার জন্য গুপ্ত কাশীতে বাস থেমে ছিল। বাস থেকেই তিনটি প্রয়াগ যথা দেবপ্রয়াগ (ভাগীরথি ও অলকানন্দা), রূদ্রপ্রয়াগ (মন্দাকিনি এবং অলকানন্দা) এবং শোন প্রয়াগ (শোন এবং মন্দাকিনি) দর্শন হলো। হিমালয় পথে এই প্রথম এলাম, পথের এক একটি বাঁক যেন নতুন রূপে দেখা দিচ্ছে, বাসটা যখন আরও উপরে উঠছে তখন নীচের আঁকা বাঁকা বাসপথের দিকে তাকিয়ে রোমাঞ্চ অনুভব করছি।
গৌরিকুন্ডে পৌঁছে আমরা ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘের পান্থশালায় আশ্রয় প্রার্থী হলাম। মহারাজ যখন জানলেন আমরা পঞ্চকেদার দর্শনের জন্য এসেছি তখন আশ্রয় শুধু নয়, আমাদের জন্য একজন গাইডেরও ব্যবস্থা করে দিলেন। গাইডের নাম সূরয সিং, উনি শুধু পথ প্রদর্শকই হবেন না আমাদের কিছু কিছু জিনিসের ভারও নিজের কাঁধে তুলে নেবেন।
পরের দিন ভোর ৫টার মধ্যে তৈরি হয়ে বের হলাম কেদার যাত্রার জন্য। প্রচন্ড বৃষ্টি হচ্ছিল তাই তখনই হাঁটা শুরু করলাম না, বৃষ্টি একটু কমতে টিপ টিপ বৃষ্টির মধ্যেই কেদারের পথে হাঁটা শুরু করলাম, ধ্বনি উঠল জয় কেদারনাথ। গৌরিকুন্ড থেকেই অনেকে ঘোড়া ভাড়া করছে পাহাড়ের পথে যাবার জন্য। আমরা নিজেদের পায়ের ভরসায় এগিয়ে চললাম। গৌরিকুন্ড থেকে কেদারনাথ প্রায় ১৪ কি.মি., পথে মাঝে মাঝে একটু বিশ্রাম নেওয়ার জায়গা আছে। এগুলিকে চটি বলে। এ পথের প্রথম চটির নাম জঙ্গল চটি এখানে সামান্য দুধ পাকেড়া ইত্যাদি খেয়ে আবার হাঁটতে শুরু করলাম। পথের একদিকে গভীর খাদ অপর দিকে পাহাড়ের দেওয়াল, কোথাও বা অপূর্ব পাহাড়ী ঝর্না। জীবনে প্রথম এমন পাহাড়ের পথে হাঁটছি, মন মোহিত হয়ে গেল। এই সময় সূরয সিং সাবধান করে দিলেন এই ভাবে দৃশ্যাবলীর দিকে চেয়ে চেয়ে না হাঁটতে, যখন দেখতে চাইবে একটু দাঁড়িয়ে যেও, নাহলে বিপদ হতে পারে।
হিমালয়ের বাতাসের একটা মহৎ গুন, আমি দেখলাম যে পাহাড়ি চড়াই ভাঙ্গতে ভাঙ্গতে যেন দমে টান পড়ে কিন্তু একটু স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলেই পুরো শক্তি যেন ফিরে পাওয়া যায়। এর পরের চটির নাম রামওয়াড়া চটি। এটি গৌরিকুন্ড আর কেদারের মাঝা মাঝি, আমরা ঐ চটিতে বিশ্রাম না নিয়েই এগিয়ে চললাম আরও তিন কিলোমিটার দূরের আরাম চটির পথে। এখানে খানিক বিশ্রাম নিলাম, সঙ্গে আনা শুকনো ফল ইত্যাদি খেলাম। আরাম চটি থেকে ৫ কিলোমিটার পরেই এল গরুড় চটি। শুনলাম এই চটি থেকে আর মাত্র দু কিলোমিটার গেলেই আসবে কেদারনাথ।
উৎসাহে বলে উঠলাম জয় কেদারনাথ। গৌরিকুন্ড থেকে কেদারনাথ এই পুরো পথটাতেই আমাদের সঙ্গ দিয়েছে মন্দাকিনি। নদীর সম্পর্কে বিভিন্ন কবিতায় দেখেছি তির তির করে বয়ে চলা বা কুল কুলু শব্দে বয়ে চলা, আমি তো কবি বা সাহিত্যিক নই আমার কানে তাই মন্দাকিনির বয়ে চলার শব্দের সঙ্গে নূপুরের নিক্কন নয় মাদলের দ্রিম দ্রিম শব্দ মনে হয়েছে।
গরুড় চটির পর শেষ দুকিলোমিটার পথ আরও দুর্গম, আরও চড়াই, কষ্টে প্রাণ ওষ্ঠাগত। একটু পরে সূরয সিং বললেন ‘অব আ গয়া, উ দেখো কেদারজীকা মন্দির।’ মন্দির দেখেই মনে হল কষ্ট অনেকটা কমে গেল, মনের জোরও বেড়ে গেল। আবার সবাই মিলে বললাম জয় কেদারনাথ।
কেদারনাথে সত্যনারায়ণ মন্দির সমিতির আশ্রয়শালায় থাকার ব্যবস্থা করা হল, পোষ্টাপিসের ঠিক কাছেই এই আশ্রয়টি। এখন থেকেই বাড়িতে একটা পোষ্টকার্ডে, পৌছানোর সংবাদ দিলাম। দুপুর বেলায় সামনের একটা ছোট খাবার জায়গা খুঁজে নিরামিষ ভাত খেলাম, পার্থ কোথা থেকে একটু আচার কিনে আনল। এখানেই বুঝলাম খিদে অন্যতম সেরা ব্যাঞ্জন। ভরপেট খেয়ে আশ্রয় কুটিরে শুয়ে পড়লাম, ঘুম ভাঙ্গল বিকালে। শীতপোষাকে নিজেকে মুড়ে নিয়ে একটু পরে গেলাম মন্দির চত্বরে। বিকালে কেদারনাথজীর রাজবেশ দর্শন করলাম। আমরা ঠিক করলাম কাল সকালে চান করে তারপরে পূজো দেবো। কেদারনাথ মন্দিরের কাছেই শঙ্করাচার্য দেবের স্মৃতিমন্দির এবং সমাধিস্থল দেখলাম। যেখানে শঙ্করাচার্যজীর যোগসমাধি হয়েছিল সেখানে ওনার একটি মূর্তি আছে। বরুণ চুপি চুপি একটা ছবি তুলে নিল।
পরের দিন সকালে প্রায় ৬টার সময় উঠে চান টান করে কেদারনাথ মন্দিরে গেলাম পুজো দেব বলে। মন্দিরে গিয়ে বরুণের মনে পড়ল যে বাড়ী থেকে যে বেলপাতাগুলি পুজোর জন্য এনেছিল সেটা আনতে ভুলে গেছে। তাই আমার কাছে যে কয়েকটা বেলপাতা ছিল সেগুলিই সবার পূজোর ডালিতে ভাগ করে নিলাম। ঠান্ডা মন্দিরের চাতালে প্রায় লেফট রাইট প্যারেড করার মতো নাচছিলাম। যদিও পরিবেশ মন ভরিয়ে দিচ্ছিল, একটা অদ্ভুত ভাল লাগার অনুভূতি। যাইহোক সকাল ৭টার মন্দির খোলায় প্রায় সাথে সাথেই আমরা পুজো দিতে লাইনে দাঁড়িয়ে গেলাম। প্রথমে গণেশ পুজো করে, কেদারনাথজীর পূজো দিলাম। কেদারনাথজীর সারা অঙ্গে ঘি মাখিয়ে দিলাম, এত ভালভাবে দর্শন হবে তা ভাবিনি, মন ভরে গেল। জয় কেদারনাথ জী।
পূজো দেবার পর মন্দিরের কাছে পিঠে ঘুরে বেড়ালাম, কেদারনাথ শৃঙ্গ আমাদের একটু দেখা দিয়েই মেঘের আড়ালে চলে গেল। পঞ্চকেদারের প্রথম কেদারটি দর্শন করলাম এরপর আমরা যাব মদমহেশ্বর দর্শন করতে।
এই প্রসঙ্গে পঞ্চকেদারের পৌরানিক গল্পটা একটু বলে নেওয়া যাক। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ শেষ, অনেক আত্মীয় স্বজনকে হারানোর পর পান্ডবরা জয়ী। কিন্তু অনুতাপে দগ্ধ পঞ্চপান্ডব, নিজেদেরকে পাপী বলে সর্বদাই মনে করেন। পাপ খন্ডনের জন্য দেবাদিদেব মহেশ্বরের দর্শন লাভের কথা চিন্তা করে, পান্ডবরা হিমালয়ের স্থানে স্থানে খুঁজে ফিরতে লাগলেন, কিন্তু মহাদেব নিজ মূর্ত্তিতে ধরা দিতে চাইছিলেন না। একজায়গায় মহাদেব মহিষের বেশে মহিষের দলে ভিড়ে ছিলেন, পান্ডবরা তাঁকে চিনতে পারলেন কিন্তু মহাদেবকে ধরা যায় না, তখন মধ্যম পান্ডব দুটি পাহাড়ের মধ্যে দুপা ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন, অন্য পান্ডবরা মহিষদের সেই পথে চালনা করে আনলেন, অন্য মহিষগুলি ভীমের দুপায়ের ফাঁক দিয়ে চলে গেলেও মহাদেব ভীমের পায়ের ফাঁক দিয়ে যেতে পারলেন না, তখন মধ্যম পান্ডব মহাদেবকে পিছন থেকে জাপটে ধরলেন, মহাদেব পাতাল প্রবেশ করতে চাইলে সব পান্ডবেরা মহাদেবের স্তব করতে লাগলেন, তাতে সন্তুষ্ট হয়ে মহাদেব আর পাতাল প্রবেশ করলেন না, ঐ খানেই পাথরে পরিণত হয়ে বিরাজ করতে লাগলেন। এটাই হল কেদারনাথজী। দৈববানী হল হিমালয়ের আরও চারটি জায়গায় মহিষরূপি শিবের দেহাংশ প্রকট আছে, পান্ডবরা যদি ঐ সব স্থানে যান তাহলে শিব দর্শনের পূন্যলাভ করবেন ও তাঁদের যা কিছু মনস্তাপ সব দূর হয়ে যাবে।
কেদারনাথজী যদি প্রথম কেদার হন তাহলে মদমহেশ্বর দ্বিতীয় কেদার, এখানে মহিষরূপী শিরের মধ্যাংশ অর্থাৎ নাভিদেশ দেখতে পাওয়া যায়। তৃতীয় কেদার তুঙ্গনাথ, এখানে বাহু, চতুর্থ কেদার রূদ্রনাথে মুখ এবং পঞ্চম তথা শেষ কেদার কল্পেশ্বরে জটা। কথিত আছে কেউ যদি পঞ্চকেদার দর্শন করেন তাঁর শিব দর্শনের পূন্যলাভ হয়, অবশ্য অন্য একটি মতে এর সঙ্গে পশুপতিনাথ দর্শন করলেই পূর্ণ শিব দর্শন সম্পন্ন হয়।
যাইহোক কেদারনাথ দর্শনের ফলে মনটা খুব চাঙ্গা। ফুর ফুরে মেজাজে আমাদের সাময়িক আশ্রয়ে এসে জিনিষপত্র গুছিয়ে একটু জল খাবার খেয়ে আমরা হাঁটতে শুরু করলাম গৌরিকুন্ডের দিকে। চারিদিকের অপূর্ব দৃশ্য, ভাষায় বর্ণনা করা আমার পক্ষে অসম্ভব। কিন্তু একটা দৃশ্য কিছুতেই ভুলতে পারিনি তা হলে দূরে পাহাড়ের মাঝখান থেকে জলধারার কথা, যেন মনে হয় পাহাড়ে কোন পাইপ বসানো আছে। আর সেখান থেকে অবিরাম ধারায় দুধের মতো জল নেমে আসছে, সূরয বলল এটাই কেদার পাহাড়ের বিশেষত্ব। মেঘের আড়াল সরে যাওয়ায় মাঝে মাঝে বরফ মোড়া শৃঙ্গগুলি দেখা যাচ্ছে,এ এক অসাধারণ দৃশ্য। জানিনা অন্যমনস্ক ছিলাম কিনা, কিন্তু একটা হোঁচট খেলাম। পায়ে একটু ব্যাথা ছিল, হোঁচট খাবার পর সেটি চারগুন বেড়ে গিয়ে হাঁটতে পারছিলাম না, তার ওপর পিঠে একটা বোঝা, এই সময় সূরয খুব সাহায্য করে ছিল, আমার স্যাকটাও ওর পিঠে নিয়ে নেওয়াই শুধু নয় আমাকে হাত ধরে ধরে কখনও মনে জোর আনার কথা বলে গৌরিকুন্ড অবধি নিয়ে এসেছিল। আবার ভারত সেবাশ্রমের পান্থনিবাসে ফিরে এলাম। মহারাজ বললেন যাও উষ্ণকুন্ডে স্নান করে এস, শরীরের আরাম পাবে। সত্যি ঐ উষ্ণকুন্ডের জলে কি ওষধী গুন আছে জানিনা তবে বেশ কিছুক্ষন চান করার পরে শরীরটা বেশ ঝর ঝরে হয়ে উঠল। আগামীকাল আমরা বের হব মদমহেশ্বরের পথে। সব জিনিষ গুছিয়ে রাখলাম, কিন্তু চিন্তা হল সুরয না আসায়। একসময় আমারা পঞ্চকেদারের পরিকল্পনা ত্যাগ করে গঙ্গোত্রী গোমুখ এবং যমুনোত্রি যাবার কথা চিন্তাও করছিলাম। বেশ কিছুটা রাতে সুরয এল। আমরা ওকে আমাদের সঙ্গেই থাকতে বললাম। পরের দিন সকাল ৫টার বদ্রীনারায়ণগামী বাসে গৌরিকুন্ড থেকে যাত্রা শুরু করলাম, আমরা নামলাম নানাকোটিতে। এখান থেকে হাঁটাপথে পৌছলাম কালীমঠে। যদিও নানাকোটি থেকে কালীমঠে আসার জন্য মোটর পথ আছে তবুও আমাদের হাঁটতে হল কারণ একমাত্র গাড়ীটি সকালেই চলে গেছে।
কালীমঠে এসে আমরা একটু বিশ্রাম নিতে একটি ধর্মশালায় উঠেছিলাম। এখান স্নানাহার সেরে নিলাম। এখান থেকে আরও একজন পোর্টার নিলাম। নতুন ছেলেটি বেশ ভাল, ওর সঙ্গে কথা বলে জানলাম ওর বাড়ীতে মা আছেন বাবা প্রয়াত, একটি ছোট ভাইও আছে। আমাদের নতুন সঙ্গীর নাম মাহিপাল সিং। কালীমঠ থেকে ৮ কি.মি দূরে লেঙ্ক গ্রামে এসে আমরা একটা চায়ের দোকানে বসে বিশ্রামের সাথে সাথে চায়ের আড্ডা জমিয়ে তুললাম। এখানে আমাদের কিছু বাড়তি জিনিষ সূরষ সিংএর কথায় একটা স্যাকে ভরে রেখে দিলাম। সূরয পথের ধারের একটা টিনের ছাউনির মধ্যে ওগুলি রেখে দিল, শহুরে মন বিশ্বাসই করতে চাইছে না যে ঐ পথের মাঝে বিনা পাহারায় এভাবে জিনিষ পত্র রাখা যয়, সন্দেহ যায় না। আমি পরীক্ষা করার জন্য স্যাকের একটা পকেটে ১০০ টাকা রেখে দিলাম আজ, থেকে ৩৫-৩৬ বছর আগে ১০০ টাকায় অনেক কিছুই পাওয়া যেত। পরে জেনেছি সন্দেহ অমূলক, বেশ কয়েকদিন পরে ফিরে এসে দেখলাম ব্যাগগুলি যে ভাবে রেখেছিলাম সে ভাবেই রয়েছে, হিমালয়ের মানুষদের প্রতি শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে গেছিল। যে রাস্তায় আমরা হাঁটছিলাম সেটি বেশ সুন্দর, চড়াই ভাঙ্গার কষ্ট একটুও নেই, তাই বলে প্রাকৃতিক সৌদর্যেরও অভাব নেই, বেশ বেড়ানোর মত আস্তে আস্তে এসে গেলাম রাঁসী গ্রামে। লেঙ্ক থেকে রাঁসী প্রায় ৬ কিমি। রাঁসীতে রাকেশ্বরীর মাতার মন্দির আছে, এই মন্দিরের পূজারি আমাদের এখানেই রাতটুক থাকতে বলছিলেন। কিন্তু আমরা দেখলাম এখনও বেশ দিনের আলো আছে। তাই একটু বিশ্রাম নিয়েই আবার হাঁটতে শুরু করলাম ৭ কিমি দূরে গৌন্ডারের পথে। গৌন্ডার আসার একটু আগে একটা বিশাল ঝর্না দেখলাম। এই যাত্রাপথে আমরা অনেক ঝর্না দেখেছি, কিন্তু এটি সব অর্থেই বিশাল, বেশ কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মন্ত্রমুগ্ধের মত দেখলাম। গৌন্ডারে আমরা ছিলাম এখানকার পঞ্চায়েত ভবনে, পঞ্চায়েত প্রধান নিজে দাঁড়িয়ে থেকে সব ব্যবস্থা করে দিলেন রাতে খাবার সময় নিজে তদারক করে আমাদের খাওয়ানোর বন্দোবস্তও করে দিলেন। একটা কথা বলতে পারি আমার বাড়ীতেও কেউ কোনদিন এত যত্ন করে খাওয়ায় নি।
পরের দিন সকাল ৬টায় আমারা আবার যাত্রা শুরু করলাম। ১কিমি যেতেই এল বানতোলি। শুনেছি এখনে হিমালয়পথিক মাননীয় উমাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের নামে একটি পান্থশালা আছে। গতকাল সূরয সিং আমাদের এখানেই থাকতে অনুরোধ করেছিল। বানতোলি থেকেই শুরু হল কঠিন রাস্তা, প্রায় সবটাই চড়াই। বহুকষ্টে প্রায় দুপুর ১টা নাগাদ আমরা পৌঁছলাম মদমহেশ্বরে, মন্দিরের স্থাপত্য দেখবার মতো, ভাবি আজ থেকে কত বছর আগে এইসব মন্দির তৈরি হয়েছিল। অপূর্ব শৈলি, সেই সব শিল্পীকে জানাই প্রণাম। আমাদের ইচ্ছা ছিল মদমহেশ্বরেই রাত কাটাবার, কিন্তু সূরয আকাশের দিকে তাকিয়ে কি বুঝল জানিনা বলল এখানে না থাকাই ভাল। আমরা ওর কথাকে গুরুত্ব দিয়ে এখন থেকে নেমে চললাম গৌন্ডারের পথে। বৃদ্ধ মদমহেশ্বর দর্শন হল না। ফিরে এলাম গৌন্ডারের সেই পঞ্চায়েত ভবনে, প্রধান মহাশয়ের আতিথ্যের ছত্রছায়ায়। পরের দিন সকাল সকাল একটু চা বিস্কুট খেয়ে আমরা গৌন্ডার থেকে লেঙ্কের পথে যাত্রা শুরু করলাম। পথে সুরয সিংএর একদল বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হল ওরা একজায়গায় বসে আরাম করছিল, ওরা বন্ধুত্বের নিদর্শন হিসাবে একটা শশা দিল। একবড় শশা আমি কোনদিন দেখি নি, প্রায় চালকুমড়োর মতো। ওরা অবশ্য এটিকে কুকড়া বা কাঁকড় বলছিল, যে পথ যেতে আমাদের প্রার ৮ ঘন্টা লেগেছিল, সেই পথটাই আমরা মাত্র চার ঘন্টায় চলে এলাম, আসলে উৎরাই পথে স্বাভাবিকভাবেই হাঁটার গতিবেগ বেড়ে যায়। লেঙ্কে পৌঁছে আমরা বিশ্রাম নিমাম, ঠিক করলাম এখানেই ভাত খেয়ে তারপর আবার হাঁটা শুরু করব। সেইমত দুপুরে বেলায় আবার পথে বের গলাম। আসার সময় আমরা রাঁসীগ্রাম হয়ে এসেছিলাম কিন্তু এখন আমরা চললাম মনসুনার পথে, প্রায় দুঘন্টা হেঁটে পৌঁছলাম মনসুনায়।
মনসুনা একটি ছোট পাহাড়ী শহর, ভাড়ায় গাড়ী পাওয়া যায়। এখন থেকে একটা গাড়ি ভাড়া করে আমরা উখিমঠে এলাম, উখিমঠ থেকে আবার একটা গাড়ি ভাড়া করে ২২ কিমি দূরে চোপতায় এলাম প্রায় রাতের বেলায়। এতটা তাড়াহুড়ো হয়ত করতাম না কিন্তু শুনলাম কোন এক কারনে এখানে আগামী ২ দিন গাড়ি ঘোড়া চলবে না, তাই বাধ্য হয়েই উখিমঠে রাত কাটানো হল না। উখিমঠ এক বিখ্যাত জায়গা এখানে শীতকালে যখন কেদারনাথের সহ অন্য প্রধান মন্দিরগুলি বন্ধ হয়ে যায় তখন কেদারনাথজীর নিত্যপূজা এখানেই হয়। সন্ধ্যে হয়ে যাওয়ায় আমরা প্রাকৃতিক দৃশ্য প্রায় কিছুই দেখতে পাই নি, অথচ চোপতা প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যের এক বিশাল ভান্ডার। কিছুই চিনি না, তাই ঐ ট্যাক্সি চালকটি আমাদের যেখানে থাকার কথা বলল সেখানে কোন দরজা নেই, একদিক পুরো খোলা। এই দেখে রাতেই বরুন আর পার্থ গেল টুরিষ্ট রেষ্ট হাউসে ঘরের সন্ধানে। কেয়ারটেকারকে রাজি করিয়ে কিছু টাকার বিনিময়ে একটা ঘরে আমাদের ঠাঁই হলো। শর্ত ছিল সকাল হতেই ঘর ছেড়ে দিতে হবে।
পরের দিন ভোর বেলায় চোপতা থেকে তুঙ্গনাথের পথে হাঁটা শুরু করলাম। প্রানান্তকর চড়াই, একটু একটু করে এগোচ্ছি আর গতকাল যে প্রাকৃতিক সৌন্দৰ্য্য থেকে বঞ্চিত হয়েছি সেগুলি একটু করে ধরা দিচ্ছে। ফটো তুলে তুলে ক্যামেরাও বোধহয় ক্লান্ত হয়ে পড়ছে, মাঝে মাঝে বিশ্রাম নিয়ে এগিয়ে চলেছি। এক জায়গায় সবুজ ঘাসেমোড়া একটু ঢালু জায়গা দেখে সবাই শুয়ে পড়লাম শুয়ে শুয়েই দেখতে পাচ্ছি চৌখাম্বা, নন্দাদেবী ইত্যাদি শৃঙ্গরাজি। কিছুটা যেতেই তুঙ্গনাথ মন্দিরের চূড়া দেখতে পেলাম।
আনন্দে মন ভরে উঠল। আমার অনেক দিনের আশা পূর্ণ হবার সময় আসন্ন ভেবেই বলে উঠলাম জয় তুঙ্গনাথ।
পূজারিকে যখন বললাম আমার নামও তুঙ্গনাথ, তখন পূজারি আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন আজ তুঙ্গনাথমে তুঙ্গনাথ আয়া। এই প্রসঙ্গে জানাই আমার পূজনীয় পিতামহ সেই কোন ৫৬-৫৭ সালে হৃষিকেশ থেকে পদব্রজে এসেছিলেন তুঙ্গনাথ দর্শনে। তারপরে সেই স্মৃতির রেশ ধরে রাখতেই আমার নামকরণ হয়।
আগামীকাল সকালে আমরা পূজো দেব ঠিক করলাম। বিকালে ধর্মশালা থেকে বেরিয়ে একটু ঘুরে বেড়ালাম, মন্দিরের চাতালে বসে উপভোগ করলাম প্রাকৃতিক দৃশ্য। যেদিকে তাকাই সেদিকেই বরফে মোড়া হিমালয় দেখতে পেলাম শৃঙ্গগুলির নাম জানতাম না, কিন্তু তাতে আনন্দে একটু খামতি হয় নি। পরের দিন ঘুম থেকে উঠে প্রাত্যহিক কাজগুলি করে পূজো দেব বলে, বের হলাম, তখনও মন্দিরের দরজা খোলে নি। সূর্যের আলোয় চারিদিক ভেসে যাচ্ছে, সেই সময় মন্দিরের পিছন দিকের একটা জায়গায় দাঁড়িয়ে বন্ধুদের বলে একটা ছবি তোলালাম ঠিক করলাম ছবিটার ক্যাপসান দেব ‘তুঙ্গনাথে তুঙ্গনাথ’। পূজারী আসার পর আমরা পূজা দিলাম। অত সকালে ভক্ত বলতে আমরা কজন। পূজারি ঠাকুরকে বললাম দুরের ঐ শৃঙ্গগুলির নাম বলতে, উনি দেখিয়ে দিলেন ঐটা চৌখাম্বা, ঐটা ত্রিশূল ১, তার পিছনে ত্রিশূল ২, আর ৩, তবে ত্রিশূল ২-৩ আমরা দেখতে পাই নি। এছাড়া নন্দাদেবী, কেদারনাথও দৃশ্যমান। উনি আমাদের সব কিছু দেখিয়ে দিলেন। অপূর্ব আনন্দে মন ভরিয়ে আমরা নেমে চললাম চোপতার পথে। এই প্রসঙ্গে বলে রাখি আমার একটা আক্ষেপ রয়ে গেল, এখান থেকে মাত্র ৩ কি.মি দূরের চন্দ্রশিলা দেখা হল না বলে। এরপরে আরও একবার স্ত্রী-পুত্রকে নিয়ে তুঙ্গনাথ এসেছিলাম, কিন্তু সেবারেও চন্দ্রশিলায় সূর্যোদয় দেখা হয়ে ওঠে নি। চোপতা নেমে এসে শুনলাম আজও উত্তরাখান্ড রাজ্যের দাবিতে হরতাল। তাই আমরা হেঁটে ২৬ কি.মি দূরের মন্ডলে যাব ঠিক করলাম। অবশ্য সূর্য সিং পাকদান্ডি পথে মাত্র ১২ কি.মি হাঁটিয়ে মন্ডলে পৌছে দিল। জঙ্গলের মধ্য দিয়ে হাঁটার সময় নিজেদের বেশ অভিযাত্রী অভিযাত্রী মনে হছিল। ভয়ের সঙ্গে আনন্দের এক অদ্ভুত মিশেলে মন ভরিয়ে পৌঁছলাম মন্ডলে। মন্ডলে ভগত আশ্রমে ছিলাম, কিন্তু জায়গাটি বেশ অপরিছন্ন। সামনেই বালখিল্য নদী। ঐ নদীতেই স্নান করলাম। একটা দোকান থেকে খাওয়া দাওয়া করলাম, কোনমতে রাতটুকু ঐ ভগত আশ্রমে কাটিয়ে ভোর হতেই আমরা হাঁটা দিলাম অনসূয়া মন্দিরের দিকে। অনসূয়া রূদ্রনাথ যাবার পথে পড়ে। এখানের দেবীমূর্তিকে পূজো দিলাম। অনসূয়া মন্ডল থেকে মাত্র ৫ কিমি, তবুও এখানেই রাত্রিবাস করতে হল। কারণ অনসূয়া থেকে রূদ্রনাথ মাত্র ১৪ কিমি হলেও পথ অতি দূর্গম আর মাঝে কোথাও কোন আশ্রয়স্থল নেই। এখানে যেখানে আমরা ছিলাম সেখানে কোন চৌকি নেই। মাটিতেই কম্বল পেতে শুতে হল, অবশ্য বেশ কিছু লেপ ছিল কিন্তু তার চেহারা দেখে গায়ে দিতে ইচ্ছা হল না। কিন্তু সকালে উঠে দেখলাম ঠান্ডায় সবাই ঐ গুলিই মুড়ি দিয়েছি। মন্ডল থেকে আসবার সময় আমরা সূরযের পরামর্শে কিছু চাল, আটা, আলু ইত্যাদি কিনে এনেছিলাম, তাই দিয়েই রাতে খাওয়া সারলাম। সূরয কালকের জন্য কিছু রুটি আর আলুর দম তৈরি করে প্যাকেটে করে রেখে দিল। কাল রূদ্রনাথের পথে কাজে দেবে।
পরের দিন সকাল ৬টা নাগদ আমরা অনসূয়া থেকে বের হলাম রূদ্রনাথের পথে, পঞ্চকেদারের মধ্যে রূদ্রনাথের পথ সব থেকে কঠিন। প্রথমে বাধা একটি খরস্রোতা নদী। হাঁটুর নিচে জল, কিন্তু প্রচন্ড স্রোত। হাতের লাঠিটাকে নদীর মধ্যে দিয়ে কোনমতে ভারসাম্য রেখে চলা। এখানে কোন ব্রীজ নেই তাই কনকনে ঠান্ডা জলে প্যান্ট গুটিয়ে চলতে হচ্ছে। একসময় রথীনের হাত থেকে ওর লাঠিটা ছিটকে গেল আর সেই দেখে ভয়ে ও টলমল করতে লাগল। এই সময় সুরয তাড়াতাড়ি গিয়ে ওর হাত ধরে আস্তে আস্তে পার করিয়ে দিল। নদীর ওপার থেকেই জঙ্গলময় রাস্তায় জোঁক আছে, সুরযের পরামর্শে আমরা সবাই পায়ে নুন মাখলাম। কিন্তু তা সত্ত্বেও আমাদের জোঁকের পাল্লায় পড়তে হয়েছিল। কোন ব্যাথা যন্ত্রনা নেই অথচ দেখি হাঁটুর নীচে থেকে রক্ত পড়ে মোজা অবধি ভিজিয়ে দিয়েছে। জঙ্গলের পথে চলতে চলতে একজায়গায় দেখলাম একটি মহিষওলার ঝুপড়ি। ও আমাদের গরম দুধ খেতে দিল, অবশ্যই সামান্য অর্থের বিনিময়ে। আমরা এতদিন দুধ মেশানো জল খেয়েছি, খাঁটি দুধ কখনও পেটে পড়ে নি। তাই এই খাঁটি দুধ পেটে গিয়েই বিদ্রোহ ঘোষনা করে দিল। সারাক্ষন চিন্তা, এই ভাবে পেট ভরা অস্বস্থি, মন ভরা আনন্দ আর পথশ্রমে ক্লান্ত দেহ নিয়ে আমরা এলাম ফুলবাড়ী বলে একটা জায়গায়। এখানে পাহাড়ি ফুলের সমারোহ। সুন্দর দৃশ্য। এখানে কিছুক্ষন বিশ্রাম নিয়ে, সূরয সিংএর হাতে গড়া রুটি ও আলুর দম দিয়ে দুপুরের খাওয়া সারলাম। বাড়ী থেকে হাজার হাজার কিলোমিটার দুরে নীল আকাশের নীচে ঘাসের গালিচায় বসে এমন বনভোজন আর কখনও হয় নি।
বিশ্রাম নিয়ে কিছুদূর যাবার পর সূরয বলল—‘অব রূদ্রনাথ আহি গয়া সমঝো।’ কেননা, এরপর আর চড়াই প্রায় নেই আমরাও আনন্দে বলে উঠলাম হয় রূদ্রনাথকি। পড়ন্ত বিকালবেলায় আমরা রূদ্রনাথ পৌঁছলাম। পূজারি আমাদের থাকার জন্য একটা ছোট ইটখোলার শ্রমিকদের থাকবার জায়গার মতো, তবে ইটের বদলে একটার পর একটা পাথর চাপিয়ে তৈরি করা দেওয়াল, ওপরে ডালপালা ঘাস দিয়ে ছাউনি আর একটা টিনের দরজা দেওয়া ঘরে থাকতে দিলেন। এখানেই সূরজ আমাদের জন্য খাওয়া তৈরি করছিল। ধোঁয়ায় চোখ জ্বালা করছিল। ঘরের বাইরে এসে একটু শান্তি পেলাম।
সন্ধ্যায় রূদ্রনাথজীর আরতি দেখলাম। প্রায়ান্ধকার মন্দিরে প্রদীপের আলোয় এক অপার্থিব পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছিল। এখানে কোন দোকান পাঠ নেই, নেই পুজোর ডালির বন্দোবস্ত, ভক্তি দিয়েই দেবতার পুজা করার ব্যবস্থা। পূজারি আরতির শেষে আমাদের প্রত্যেকের হাতে একটা করে প্রসাদি ব্রহ্মকমল দিলেন। উনিই কয়েকটা কম্বল দিলেন ঐ গুলির সাহায্যেই রাত কাটাতে হবে। এখানে বেশ ঠান্ডা। এই মন্দিরের এবং দেবতার ছবি তোলা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। আমরা যখন ঘরে এলাম তখন খুব বিদ্যুত চমকাচ্ছিল, কাল হয়ত বৃষ্টি মাথায় করেই আমাদের নামতে হবে।
রূদ্রনাথ থেকে ফেরার সময় আমরা অনসূয়া হয়ে আসি নি। ঐ রাস্তাটা আমাদের কাছে আতঙ্কজনক হয়ে গিয়েছিল। সূরযের পরামর্শে আমরা সাগর গ্রাম হয়ে ফিরেছি। সাগর রূদ্রনাথ থেকে প্রায় ১৮ কিমি, এ রাস্তা দুর্গম তবে অনসূয়ার রাস্তার মত নয়। আমরা দুপুর বেলায় সাগরে পৌঁছেছিলাম। এখান থেকে আবার আমাদের মন্ডলে ফিরতে হল কেননা ওখানে আমরা কিছু জিনিষপত্র রেখে এসেছিলাম। না হলে মাত্র চার কিলোমিটার দূরে গোপেশ্বরে যাওয়া যেত, এবং সেটাই সুবিধাজনক হত। মন্ডলে সেই পূর্ব পরিচিত ভগত আশ্রমেই ছিলাম, রাতে খেতে যাবার সময় বাস ষ্টেশনে গিয়ে জানলাম পরের দিন সকাল ৬টায় হেলাং যাবার বাস ছাড়বে। অবশ্য সরাসরি হেলাং যাবে না, চমোলিতে বাস পাল্টাতে হবে।
পরের দিন মন্ডল থেকে প্রায় সকাল ৭টায় সময় বাস ছাড়ল। আমরা চলেছি পঞ্চকেদারের শেষ কেদার কল্পেশ্বর মহাদেব দর্শনের জন্য। চমোলিতে বাস পৌঁছতেই দেখি একটা বাস দাঁড়িয়ে আছে, সেটি হেলাং যাবে। তাড়াতাড়ি বাস পাল্টালাম, চমোলী তখনকার সময়ের সবচেয়ে বড় পাহাড়ি জেলার সদর শহর, এখন অবশ্য ঐ জেলা ভেঙ্গে আরও জেলা হয়েছে। ঘন্টা দুয়েকের মধ্যে বাস আমাদের পৌঁছে দিল হেলাংএ। এখানে একটা হোটেলে খাবারের অর্ডার দিয়ে রাস্তায় ধারে একটা ঝর্নায় চান করলাম পরে খাওয়া দাওয়ার পর একটা দোকানে আমাদের বাড়তি জিনিষপত্র একটা দোকানে জমা দিয়ে কল্পেশ্বরের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম, পাঁচটি কেদারের মধ্যে কল্পেশ্বরের রাস্তাই সবচেয়ে সহজ, যেন মেঠো পথ দিয়ে হেঁটে যাওয়া। ঘন্টা তিনেকের মধ্যেই আমরা পৌঁছলাম উরগম গ্রামে। এখানে পঞ্চধারা আছে। আমরা পঞ্চধারার জল একটু মাথায় দিলাম।
উরগম গ্রামে আমরা নারায়ন সিং রাওয়াতের ঘরে ছিলাম। এখানে রাতের খাওয়ার ব্যবস্থা হলো। বিকালের দিকে রাওয়াতজী ওঁর ক্ষেতের ভুট্টা দিয়ে আপ্যায়ন করলেন। সন্ধ্যাবেলায় আমাদের ঘরে এলেন এক সাধু মহারাজ, একটু সাধুসঙ্গলাভের সৌভাগ্য হলো। উরগম থেকে কল্পেশ্বর মাত্র দেড় কিমি। তাই আমরা সকালে চান করে মন্দির দর্শনে গেলাম, ৭টার মধ্যেই কল্পেশ্বরে পৌঁছলাম। এখানে একটা পাথরকেই শিবের জটা জানে পুজো করা হয়। এখানেও পুজো দেবার কোন বিধিসম্মত ব্যবস্থা নেই। নিজেরাই পুজো দিতে পারেন। আমাদের এক সাধু দর্শন করালেন, সাধুটির প্রণআমীর জন্য হ্যাংলামি একটু দৃষ্টিকটু লেগেছিল।।
একমাত্র কল্পেশ্বরেই আমরা দেবমূর্তির ছবি তুলতে পারলাম। আজ আমরা সফল ভাবে পঞ্চকেদার দর্শন সাঙ্গ করলাম। অনেক জল্পনা কল্পনা আশা নিরাশা ভয় আনন্দ ইত্যাদির সমাপ্তি। উরগম থেকে হেলাং এ এসে আমরা বদ্রীনারায়নের পথে যাব, তাই আমাদের সফর সঙ্গী সূরয এবং মহীপালদের পাওনা মিটিয়ে ওদের নিজ গ্রামে যাবার বাসভাড়া এবং পথখরচ বাবদ কিছু টাকা দিয়ে ওদের সঙ্গে শেষবারের মতো আলিঙ্গন করলাম।
জয় পঞ্চকেদার।