ইলশেগুঁড়ি সাহিত্য পরিবার
সুস্থ সাহিত্য, শিল্প ও সংস্কৃতির প্রসারে লেখক ও পাঠকের মিলিত প্রচেষ্টায় গৌরবের এক দশক
ছোটদের নিজস্ব পত্রিকা ‘‘কুঁড়ি’’
সুস্থ সাহিত্য, শিল্প ও সংস্কৃতির প্রসারে লেখক ও পাঠকের মিলিত প্রচেষ্টায় গৌরবের এক দশক
ছোটদের নিজস্ব পত্রিকা ‘‘কুঁড়ি’’
“ওঃ, পুরো হাঁপিয়ে গেলাম একেবারে। এই জঙ্গলের পথ কি আর কোনদিনও শেষ হবেনা। একটু জল খাওয়া দরকার ছিল। গলাটা শুকিয়ে পুরো কাঠ হয়ে গেছে। কিন্তু কাছাকাছি তো কোনও নদী-নালার দেখাও পাওয়া যাচ্ছেনা। এখানে গাছগুলো এতো সবুজ, মাটিও ভেজা, স্যাতস্যাতে। অথচ কোনো জলের উৎস নেই ভাবতেই তো রীতিমতো অবাক লাগছে।”
“তোমার খুব তেষ্টা পেয়েছে বুঝি, জল খাবে?” একটা হালকা মেয়েলি গলা কানে ভেসে এলো। ঠিক যেন জলতরঙ্গের রিমঝিম মিষ্টি সুরেলা শব্দ। যার প্রতিটি বোলে এক পশলা বৃষ্টির পরে উঁচু গাছের পাতা চুইয়ে নীচের জমে থাকা হালকা জলে খসে পড়া জলের ফোঁটার টিপ টিপ শব্দ।
“এই, কে রে? কে কথা বললো, কাউকেই তো আশেপাশে দেখা যাচ্ছেনা। আমি কি তাহলে ভুল শুনলাম?” একটু ঘাবড়ে গিয়েই শুকনো খসখসে গলায় আশপাশের চারদিকে তাকিয়ে প্রশ্নটা কোনরকমে ছুড়ে দিল রূপ।
এই শুনশান জায়গায় যেখানে এতক্ষণ কেউ ছিলনা সেখানেই হঠাৎ করে একটা এইরকম মেয়েলি গলা! তাহলে কি এটা কথা? কিন্তু কথার গলার স্বর তো কোনদিনই এতটা সুরেলা ছিলনা। সেই কবে থেকে কথাকে দেখছি। গলা চিনতে তো অসুবিধা হওয়ার কথা নয়—নিজের মনেই ভাবতে থাকে রূপ।
“আরে না না ভুল শুনবে কেন? আর তাছাড়া আমি তোমার কথাও নই। উপরে তাকাও, তাহলেই আমাকে স্পষ্ট দেখতে পাবে।’’ সেই মিষ্টি সুরেলা গলা এবার যেন ঠিক মাথার উপরেই। উপরে তাকিয়ে রূপ তো পুরো অবাক। তার মুখের কথাই হারিয়ে গেল কিছুক্ষণের জন্য। এইটা আবার কি রে? একটা সোনালী রঙের মাঝারি আয়তনের সুন্দর নকশা করা ধাতব কলস! ওটার পেটের কাছে আবার উজ্জ্বল দুটো চোখ। চোখের নীচে অবিকল তারই মতো এক জোড়া ঠোঁট। আর ঘাড়ের ঠিক নিচেই পেছনের দিকে দুপাশে বাজ পাখির মতো দুটো মেলে ধরা আকারে ছোট ধাতব ডানা।
“তুমি কে গো, আমার মনের কথা সব ভারি অদ্ভুতভাবে জেনে ফেলছো?”—ভয় কিছুটা কাটিয়ে অবাক বিস্ময়ে রূপ প্রশ্নটা ছুড়ে দেয় সেই অদ্ভুত যন্ত্রটির দিকে।
“আমি কলস পাখি।’’—উত্তর দেয় অদ্ভুত দর্শন সেই জীবন্ত ধাতব কলসটি।
“সে আবার কেমনতর পাখি। কলস আবার কখনও পাখি হয় নাকি? অবশ্য তোমার দুটো ডানা রয়েছে পাখির মতো ঠিকই, কিন্তু সেগুলো তো পালক দিয়ে তৈরি নয়। তাহলে তুমি পাখি হলে কিভাবে?”—নয় বছরের ছোট্ট রূপের বিস্ময়ে ভরা একরাশ প্রশ্ন।
“ঐ দেখো, পাখি হতে গেলে বুঝি শুধু পালকের ডানাই থাকতে হয়? পাখি মানে যে তার ডানায় ভর দিয়ে আকাশে উড়তে পারে। আর আমিও সেটা পারি। তাই আমিও পাখি।’’ অদ্ভুত সুন্দর যুক্তি দিয়ে রূপের ভুল ধরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে সেই বিরল দর্শন যান্ত্রিক পাখিটি ।
“কি জানি বাপু, এমন অদ্ভুত রোবট পাখি এর আগে তো কখনও দেখিনি। আচ্ছা আপাতত ওসব বাদ দাও। আমার ভীষণ জল তেষ্টা পেয়েছে। তোমার পেটের ভেতরে কি জল আছে? সামান্য জল খাইয়ে আমাকে এই গরমের হাত থেকে বাঁচাও নাগো কলস পাখি। প্রচন্ড তেষ্টায় আমার বুকের ছাতি একেবারেই শুকিয়ে গেছে। এইভাবে চললে কিছুক্ষণ বাদে হয়তো আর কথাই বলতে পারবো না।’’
“পানীয় জল? নিশ্চই আছে। আর সেইজন্যই তো আমি তোমার কাছে নেমে এলাম গো রূপ। তুমি তোমার ঠোঁট দুটো ফাঁক করো, আমি তোমার মুখের উপরে কাত হয়ে জল ঢেলে দিচ্ছি।’’
“আঃ, কি অপূর্ব খেতে গো জলটা। এই জল তুমি কোথায় পেলে গো কলস পাখি? এতো সুস্বাদু কাঁচের মতো চকচকে জল এর আগে তো কখনও পান করিনি।’’
“কি করে পাবে। তোমরা মাটির তলা থেকে তুলে এনে যে জল খাও, এই জল সেই জল নয়। এই জল, এই যে চারপাশে বিশাল বড় বড় অগুনতি উদ্ভিদ দেখছো, তাদের সবুজ পাতার বাষ্পমোচনের জল। তিল তিল করে পরম ধৈর্য ধরে প্রায় চারদিনে যে পরিমাণ জল সংগ্রহ করেছিলাম, মাত্র কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই তার প্রায় অর্ধেক তুমি খেয়ে শেষ করে দিলে। এখন রানীর কাছে আমাকে জবাবদিহি করতে হবে। আমাদের দেশে এই একটাই জঙ্গল। কোনও নদী বা জলাশয় নেই। পুরোটাই পাথরের তৈরি। একটা বিশাল রাজপ্রাসাদই একটা গোটা দেশ। তার কারুকার্য বা শিল্পকলা দেখলে তুমি অবাক হয়ে যাবে। নজর ফেরাতে পারবে না। কোনকিছুর অভাব নেই শুধু এই জীবনদায়ী জল ছাড়া”। একনাগাড়ে কথাগুলো বলে একটু দম নিয়ে আবার বলতে শুরু করে—“এই জঙ্গলে আমারই মতো আরও ঊনিশ জন কলস পাখি আছে। আমাদের কাজই হলো সন্ধ্যার পর থেকে সারারাত ধরে এই জঙ্গল থেকে জল সংগ্রহ করে রাজপ্রাসাদে একদম ভোরবেলা সূর্য ওঠার আগে ফিরে গিয়ে সবাইকে জল খাওয়ানো। আমরা গেলে তবে ওরা দিনের প্রথম জল পাবে। সারাদিনে রাজপ্রাসাদে যারা আছে প্রত্যেকে গুনে গুনে চার ফোঁটা করে জল পাবে। আমাদের এখানে সবাই বিভিন্ন আকারের যন্ত্র। ফলে ঐ চার ফোঁটাতেই যে অক্সিজেন থাকে তাই দিয়েই আমাদের যান্ত্রিক শরীরে কাজ করার শক্তি পাই। আর এখানে আমাদের সবারই পিঠে ছোট ছোট আমারই মতো ডানা আছে। শুধুমাত্র আমাদের রানীই তোমার মতো মানুষ। তার জন্য রোজ সারাদিনে এক কলস করে জল বরাদ্দ”।
“তাহলে তোমাদের রানী রেগে যাবে জেনেও আমাকে এতটা জল খাওয়াতে গেলে কেন? না জানি এর জন্য তোমাকে তোমার রানীর কাছে কতটা শাস্তি পেতে হবে।”
“কি বলছো, তোমার মতো একটা মিষ্টি ছোট্ট ছেলে তৃষ্ণায় ছটফট করবে আর আমি তাকে জল না দিয়ে তৃষ্ণায় ছটফট করছে, সেটা দেখবো? তুমি হচ্ছো এই মুহূর্তে আমাদের এই রাজ্যের সন্মানীয় অতিথি। তাই সব কথা শুনলে মনে হয়না আমাদের রানী খুব একটা রাগ করবেন।”
“কিন্তু তোমাদের রানী সেই অপরাধে তোমাকে যদি চরম শাস্তি দেন। না না এটা তুমি ঠিক করলে না গো কলস পাখি। আমাকে তুমি চেননা, জানোনা; শুধু শুধু কেন আমাকে বাঁচাতে গেলে? চলো আমিও তোমার সাথে তোমার রানীর কাছে গিয়ে তাকে সব বুঝিয়ে বলবো। তাতে করে তোমার শাস্তিটা যদি কিছুটা কম হয়।“
“তুমি যাবে আমার সাথে আমাদের রাজপ্রাসাদের দেশে! ওঃ সে তো একটা দারুন ব্যাপার হবে। সবাই তোমাকে দেখে একেবারে অবাক হয়ে যাবে, বিশেষ করে আমাদের সকলের প্রিয় রানী। তাহলে আমার পিঠে উঠে শক্ত হয়ে বসো। ভয় পেয়োনা, তোমায় আমি ফেলবো না।’’
“আরে না না, ওসব নিয়ে তুমি ভেবনা। আমি মোটেও পড়ে যাবোনা। কিন্তু তুমি একটা ছোট্ট কলস। তুমি কি আমাকে এতটা পথ নিয়ে যেতে পারবে?”
“না পারলে আর বলছি কেন। তুমি শক্ত করে আমার গলাটা ধরে বসো। আমি তোমাকে অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই রাজপ্রাসাদে নিয়ে গিয়ে আমাদের রানীর সামনে পৌঁছে দেবো।”
রূপ, কলস পাখির পিঠে চড়ে রাজপ্রাসাদের উদ্দেশ্যে আকাশ পথে রওনা দিল। নীচে শুধু ছোট বড় পাথর আর পাথর। দূরে সোনালী বর্ণের রাজপ্রাসাদটা ভোরের সোনালী আলোয় জ্বলজ্বল করছে। “সত্যি এতো সুন্দর একটা দৃশ্য এইরকম একটা উড়ন্ত কলসের পিঠে চড়ে আকাশ পথে যেতে যেতে দেখতে পাবো জীবনে কখনও কল্পনাও করতে পারিনি।” মনে মনে ভাবতে থাকে রূপ।
কলস পাখির সাথে রূপ সোজা রাজপ্রাসাদে এসে উপস্থিত হলো। চতুর্দিকে শুধুই ধাতব বিভিন্ন আকার আকৃতির রোবট ডানা মেলে যে যার মতো উড়ে বেড়াচ্ছে। কলস পাখি ওকে নিয়ে সোজা রাজসভায় নিয়ে এলো যেখানে উপস্থিত সবাই রানীর জন্য অপেক্ষা করছিল। রূপকে দেখে স্বাভাবিকভাবেই চারদিকে একটা মৌমাছির ঝাঁকের মতো মৃদু গুঞ্জন শুরু হলো। আর সেই বিশাল সভাগৃহে প্রবেশদ্বারের বিপরীতে প্রায় একশ হাত দূরে সুবিশাল সিংহাসনের উপরে উপবিষ্ট একরত্তি এক রানী। এতদূর থেকে স্পষ্ট দেখাই যাচ্ছেনা। রূপ হাত জোড় করে সামনে এগিয়ে গেল। মাঝের দূরত্ব ক্রমশ কমে আসছে। পঞ্চাশ হাত, কুড়ি হাত, দশ হাত আর তারপরেই রূপের বিস্ময়ে হতবাক করা চিৎকার ধ্বনি রাজপ্রাসাদের সমগ্র গুঞ্জনকে ছাপিয়ে বলে উঠলো, “কথা! তুই এখানকার রানী? কিন্তু কি করে? আমি তো নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারছিনা। তোকে তোর বাড়ির লোক প্রায় এক মাস ধরে পাগলের মতো চারদিকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। আর তুই নিশ্চিন্তে এই রোবটদের রাজত্বের রানী হয়ে রাজকার্য পরিচালনা করছিস?”
বিপরীতে সিংহাসনে বসে থাকা আট বছরের রানী কথা’র চোখেও অবাক করা বিস্ময়। সে দৌড়ে চলে এসে রূপের বুকের উপরে ঝাঁপ দিয়ে পড়ে তার কান্না ভেজা গলায় বলে ওঠে, “রূপ, আমি অন্ধকারে একটা জঙ্গলের মধ্যে হারিয়ে গিয়েছিলাম। একজন কলম দাসী, যাকে হুবহু কলমের মতো দেখতে, আমাকে এইখানে নিয়ে আসে এবং আমাকেই এখানকার রানী বানিয়ে দেয় এদের বৃদ্ধ রাজা “খাতা রোবট”-এর মৃত্যুর পরে। রাজার শেষ পৃষ্ঠা আমি এখানে আসার পরের দিনই শেষ হয়ে গিয়েছিল”।
ওরা দুজনেই এক মাস আগের কথা স্মরণ করবার চেষ্টা করতে শুরু করে। ঠিক কি ঘটেছিল সেদিন, যার জন্যে দুই প্রাণের বন্ধু রূপ ও কথাকে মাঝের এই প্রায় এক মাসের জন্য পরস্পরের থেকে আলাদা হয়ে যেতে হলো!
এবং ধীরে ধীরে সেদিনের সমস্ত কথাই এক এক করে দুজনেরই মনে পড়তে শুরু করে। স্পষ্ট মনে আছে, দিনটা ছিল শনিবার। অবশ্য দিন বলা ঠিক হবেনা। বরং বলা উচিত শনিবারের রাত। হ্যাঁ, সেই শনিবারের ভয়াবহ রাতেই ঘটেছিল দুজনের জীবনেরই প্রথম সেই ভয়ঙ্করতম অভিজ্ঞতা। সেদিন রূপ’দের বাড়িতে ঠিক ঘড়ি ধরে সন্ধ্যা সাতটায় গৃহশিক্ষক প্রখ্যাত গণিত বিশারদ শ্রী কৃষ্ণচন্দ্র নাগ এসেছিলেন রূপ আর কথা’কে পড়ানোর জন্য। সেদিন ছিল আবার সাপ্তাহিক পরীক্ষা নেওয়ার দিন। তো, শিক্ষক মহাশয় তিরিশ নম্বরের প্রশ্নপত্র বাড়ির থেকে তৈরি করেই এনেছিলেন এবং হাসি হাসি মুখে দুটি প্রশ্ন রূপ এবং কথা’র দিকে এগিয়ে দিয়ে বাজ পড়ার মতো আওয়াজ করে বললেন—“চল্লিশ মিনিট সময়ের মধ্যে পরীক্ষা দিয়ে খাতা জমা দিবি। আজকে যদি গত সপ্তাহের মতো বাজে পরীক্ষা দিয়েছিস তবে দুটোকেই সামনের মুন্সীদের আমবাগানে অন্ধকারে নিয়ে গিয়ে দাঁড় করিয়ে রাখবো। কে তোদের আজ বাঁচায় আমিও দেখবো। অঙ্কের মতো এত সহজ একটা বিষয় তোদের মাথাতেই ঢোকেনা, ভাবলেই অবাক হতে হয়।’’
এরপরে প্রশ্নপত্র হাতে পাওয়ার পর থেকেই রূপের গলা শুকিয়ে কাঠ। বারংবার জল খেতে শুরু করলো। কথাও খাতার উপরে প্রচন্ড মনযোগ সহকারে যেন অনেককিছু লিখে চলেছে, হাবভাবে এরকমই মনে হলো। রূপ তো যত কথাকে দেখছে ততই তার গলা আরও দ্রুত শুকিয়ে যেতে শুরু করলো এই ভেবে যে, আজকে শুধুমাত্র তাকেই একা একা ঐ ভূতুড়ে আমবাগানে রাতের অন্ধকারে গিয়ে, হয়তো বা সারারাত দাড়িয়ে থাকতে হবে। এইভাবে চরম উৎকন্ঠাময় পরিবেশ চলাকালীন ঠিক পঁচিশ মিনিটের মাথায় পেনের কালি ফুরিয়ে গেছে বলে কথা সেই যে ঘর থেকে হাওয়া হলো, আর আসার নাম গন্ধ নেই। স্যার তো রেগে আগুন। কথার অঙ্কের খাতাটা কাছে টেনে নিয়ে দেখে যেন ভূত দেখার মতো আঁতকে উঠলেন।
“একিরে!! কি ভয়ঙ্কর মেয়ে!! মাত্র আট বছর বয়সেই এতটা অধঃপতন!! কিছুই তো লেখে নি। আর খাতায় তো লেখার মতো কোন সাদা পৃষ্ঠাই নেই। তিনি খাতাটা একপ্রকার প্রায় ছুড়ে ফেলে দিয়ে রূপকে পাঠালেন কথাকে খুঁজে ধরে আনার জন্য। কিন্তু কোথায় কথা? বাড়ির ভেতরে কোথাও নেই। গেল কোথায় মেয়েটা, কর্পূরের মতো উবে গেল নাকি? সবটা ভেবে একটা অজানা ভয় যেন রূপের শরীরটাকে আরও দূর্বল করে দিতে শুরু করলো। ডাইনিং টেবিলের উপরে রাখা জলের পেট মোটা অদ্ভুত আকৃতির বোতলটা থেকে আরো দু-ঢোক জল গলায় ঢেলে পুনরায় কথা’কে খুঁজতে শুরু করলো রূপ। এই বেখাপ্পা বোতলটা রূপের বাবা ভুটানে যেবার সপরিবারে বেড়াতে গিয়েছিলেন সেইবার সখ করে কিনে এনেছিলেন। বোতলটার গায়ে আবার চাইনিস একটা ড্রাগনের ছবি আঁকা। হঠাৎ করে একটু কাত করে দেখলে মনে হবে যেন বোতলটা উড়ছে। তো রূপ কথাকে খুঁজতে খুঁজতে ঘরের বাইরে বের হয়ে আসে। তার মনে হলো উঠোনের একপাশে ডাঁই করে রাখা কালো কুঁচো পাথরের ওপাশে ভয় পেয়ে কথা লুকিয়ে নেইতো? এই ভেবে যেই না ধীর পায়ে কয়েক কদম এগিয়েছে, ওমনি সামনের অন্ধকার ভেদ করে দৌড়ে এসে কথা রূপকে জাপটে ধরে বললো, “ধাপ্পা”।
“এই, এখন এটা মজা করার সময় ? ওদিকে স্যার তোর উপরে রেগে আগুন। তোর খাতার পৃষ্ঠা শেষ হয়ে গেছে, অথচ তুই চুপটি করে ঘাপটি মেরে এমনভাবে খাতার পৃষ্ঠার উপরে কলম ঘষছিলি, দেখে মনে হচ্ছিলো যেন দারুণ পরীক্ষা দিচ্ছিস।’’
“তুই থামতো। আমি দেবো ভালো পরীক্ষা, তাও আবার অঙ্ক।’’
“চল, পালিয়ে কোনও লাভ নেই। স্যার তোর উপরে খুব রেগে গেছেন। আজকে তুই নির্ঘাত আচ্ছা করে মার খাবি, আর সেই সঙ্গে আমিও।’’
“তুই দেখছি কিছুই জানিস না। স্যার অনেকক্ষণ আগেই দেখলাম তোকে আর আমাকে, দু-জনকেই না পেয়ে রাগে বিষধর সাপের মতো ফুঁসতে ফুঁসতে বাড়ির থেকে বেড়িয়ে গেলেন।’’
“সত্যি বলছিস?? চল চল, বাড়ির ভেতরে গিয়ে দেখি। তুই আবার ঠিক দেখেছিস তো? দেখিস আবার, ভুল দেখে থাকলে কপালে কিন্তু দ্বিগুন দুর্ভোগ আছে, এই বলে দিচ্ছি।’’
“আচ্ছা কথা, আমরা এইভাবে দিনের পর দিন না পালিয়ে একটু মন দিয়ে লেখাপড়াটাও তো করতে পারি। বিশেষ করে এই অঙ্ক বিষয়টার পেছনে আরেকটু বেশি সময় দিলে দেখবি আমরাও আমাদের পাঠ্য বইয়ের সব অঙ্কগুলোই নিজেরাই ঠিক করতে পারবো কারোর সহায়তা ছাড়াই ।’’
“ঠিক বলেছিস রে। অন্ধকারে ঘন গাছগাছালির জঙ্গলে হারিয়ে যাওয়ার থেকে নিজের ঘরে বসে মনোযোগ সহকারে লেখাপড়া করা অনেক বুদ্ধিমানের কাজ। আমরা পরের দিন থেকে অঙ্ক দেখলেই ভয় পেয়ে আর এরকম পালিয়ে যাবোনা। বল কথা দিচ্ছিস তো রূপ?”
“হ্যাঁ, কথাকে ‘কথা’ দিলাম।’’